London ০৮:২৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম:
মেডিকেল ক্যাম্প–রক্তদানে ব্যতিক্রমী আয়োজন, পালিত হলো প্রেসক্লাব আলফাডাঙ্গার ২য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী দিনব্যাপী সেবামূলক কার্যক্রমে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ পটুয়াখালী পৌরসভার সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন ভাই আজাদসহ দুই স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা কালিয়াকৈরে সড়ক দুর্ঘটনায় ট্রাকচালক নিহত রাজশাহীতে চলছে ট্রাফিক সপ্তাহ ২০২৫ কালিয়াকৈর ৫ নং ওয়ার্ড পৌর বি এন পির নির্বাচনী প্রস্তুতি সভা ও মতবিনিময় বিক্ষোভ সমাবেশে ক্ষোভের বিস্ফোরণ: শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রহসনমূলক রায়ের প্রতিবাদে লন্ডনে প্রবাসীদের গণজমায়েত রাজশাহীতে চলছে উদ্যোক্তা মেলা গাজীপুর-১ আসন কালিয়াকৈরে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর শীতার্ত মানুষের কষ্ট লাঘবে নানিয়ারচর জোন (১৭ই বেংগল) এর উদ্যোগে বিনামূল্যে শীতবস্ত্র বিতরণ সিরাজগঞ্জ সততা ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির পক্ষ থেকে নবনির্বাচিত পরিচালক হাজী মোঃ আব্দুস সাত্তারকে সংবর্ধনা

হাসিনা আমলের রোহিঙ্গা নীতি পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি

রোহিঙ্গা সংকটের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ‘অংশীজনকে যুক্ত করে বাংলাদেশের একটি নতুন ধারার উদ্যোগী ও সৃজনশীল কূটনীতিতে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন।’

সর্বশেষ পর্যায়ের রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর দীর্ঘ সাত বছর পেরিয়ে গেছে। এরপরও খুব শিগগির প্রত্যাবাসনের কোনো ইঙ্গিত নেই। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। দেশটির বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে আবির্ভাব ঘটেছে নতুন নতুন শক্তির।

রাখাইনে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ নতুন করে রোহিঙ্গা ঢলের মুখোমুখি হচ্ছে। ইউক্রেন আর গাজায় সংঘাতের কারণে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে রোহিঙ্গা সংকট মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছে। আবার বাংলাদেশে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একেবারেই ভিন্ন একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ অনুসৃত রোহিঙ্গা নীতির পরিবর্তন এখন হয়ে উঠেছে সময়ের দাবি।

২০১৬-১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকটের মাত্রায় পরিবর্তনের পর থেকে সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ একটি নীতিগত রূপরেখা গ্রহণ করেছিল। ওই নীতিগত রূপরেখায় টেকসই প্রত্যাবাসন ও মিয়ানমারের প্রতি সাধারণ পদক্ষেপ গ্রহণের মতো উপাদানগুলো ছিল। সামগ্রিকভাবে ওই সময়কালের রূপরেখার তিনটি প্রধান উপাদান ছিল—ক) মানবিক সহায়তা, খ) টেকসই প্রত্যাবর্তন নিশ্চিতের স্বার্থে মিয়ানমারের রাখাইনে সংকটের উৎসের সমাধান এবং গ) অপরাধীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।

রাখাইন ও মিয়ানমারের ব্যাপারে বাংলাদেশকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার মতো খুবই কঠিন কাজ করতে হবে। বাংলাদেশকে সেকেলে নীতিগত রূপরেখা পুনর্বিবেচনা করতে হবে

দ্রুত প্রত্যাবাসনের ওপর বাংলাদেশ মূল মনোযোগ দেওয়ায়, বাংলাদেশ সব সময় রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থান, স্বেচ্ছামূলক কর্মসংস্থান, চলাফেরার স্বাধীনতা, আবাস এবং আত্তিকরণের মতো ১৯৫১ সালের শরণার্থী সনদের বিধানগুলোর বিরোধিতা করে আসছে। বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের বাধ্যবাধকতা রাজনৈতিক, জনসংখ্যাগত ও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় কার্যকর নয়।

বাংলাদেশ তাই রোহিঙ্গাদের বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক (এফডিএমএন) হিসেবে অভিহিত করেছে, শরণার্থী নয়। শিবিরে চলাফেরা ও সুযোগ সীমিত থাকার ফলে সেখানে রোহিঙ্গাদের মাঝে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে চলেছে। রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) অনিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ড শিবিরগুলোয় নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে দিয়েছে।

মিয়ানমার ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গাদের এমন একটি জাতিসত্তা হিসেবে দেখছে, যাদের সঙ্গে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের গভীর জাতিগত, ভাষাগত ও ধর্মীয় সম্পর্ক রয়েছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সব সময় ভিনদেশি হিসেবে বিবেচনা করেছে। রোহিঙ্গাদের সব সময় নিরাপত্তাহীনতার লেন্স দিয়ে দেখেছে মিয়ানমার। মিয়ানমার সরকারের নীতি ও কর্মকাণ্ডগুলো উত্তর রাখাইনে জনসংখ্যার ভারসাম্য নিশ্চিত করার আকাঙ্ক্ষা এবং ‌‘পশ্চিম দুয়ারকে সুরক্ষার’ জাতীয় অগ্রাধিকার দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। মিয়ানমারের নিরাপত্তাহীনতার ধারণা তার পশ্চিমের প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকেও আসে।

২০২৪ সালের জুলাইয়ে রাখাইনে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ঐতিহ্যবাহী বসতি হিসেবে পরিচিত মায়ু-কালাদান-লেমরো অঞ্চলে অঘোষিত কর্তৃপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফলে অঘোষিত কর্তৃপক্ষ হিসেবে আরাকান আর্মি রাখাইনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে এবং প্রত্যাবাসনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে তাদের কাছ থেকে। এরপরও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি সুরাহার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে রয়ে গেছে।

আরাকান আর্মির নেতৃত্ব বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার বার্তা পাঠিয়েছিল, যা বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে উপেক্ষা করেছে। মিয়ানমারের ৭০০ যোদ্ধাকে তাদের কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলাদেশের হস্তান্তরের বিষয়টি আরাকান আর্মি যে পছন্দ করেনি, সেটা বলাই বাহুল্য। কক্সবাজারের শিবির এলাকাগুলোয় মিয়ানমার সেনাদের জন্য আরসা ও আরএসও রোহিঙ্গাদের নিয়োগের খবরটি আরাকান আর্মিকে রোহিঙ্গাবিরোধী অবস্থান নিতে উসকে দিয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, রাখাইন রাজ্যের ওপর আঞ্চলিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আরাকান আর্মি ও ইউনাইটেড লীগ অব আরাকানের (ইউএলএ) জন্য আরাকান নিয়ে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের একটি ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই মুহূর্তে কিন্তু এটা স্পষ্ট নয় যে তারা মিয়ানমারের মধ্যে সত্যিকার অর্থেই ফেডারেল কাঠামোর মধ্যে সমাধান চাইবে নাকি একটি আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্যে তা চাইবে। তারা যখন প্রশাসন পরিচালনা করতে চায়, জরুরি ভিত্তিতে তাদের রাখাইনে মানবিক সহায়তা সরবরাহের ব্যবস্থা করা, রাজ্যকে অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল করা এবং কৃষিকে পুনরুজ্জীবিত করা উচিত।

এর পাশাপাশি রাখাইন ও চিন রাজ্যের প্রায় সব সম্প্রদায়ের মাঝে সামরিকীকরণ প্রতিবেশী মিজোরাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, এমনকি চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় অস্থিতিশীলতাকে উসকে দিচ্ছে। সম্প্রতি মণিপুর ও নাগাল্যান্ডে জাতিগত সংঘাতের পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে সীমান্তবর্তী এলাকায় এবং কালাদান বহুমাত্রিক প্রকল্পে ভারতের দুর্বলতার বিষয়টি উন্মোচিত হয়েছে। চকফিউ বন্দর ও ইউনানে তেল ও গ্যাস পাইপলাইনে চীনের সরাসরি অংশীদারত্ব রয়েছে।

এদিকে মিয়ানমারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার গভীর আগ্রহের ইঙ্গিত দিয়েছে। বৈচিত্র্যময় নানা পক্ষ এবং তাদের ভিন্ন ভিন্ন ভূকৌশলগত স্বার্থ বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারত ও চীনের সীমান্তবর্তী এলাকায় পুরোপুরি অনুমানযোগ্য এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এমন আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ অনিচ্ছা সত্ত্বেও সামরিক সংঘাতের ঘূর্ণিপাকে আটকে যাবে—এমনটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনী বাংলাদেশকে একটি সশস্ত্র সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে অনেক কিছুই করেছিল।

রাখাইন ও মিয়ানমারের ব্যাপারে বাংলাদেশকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার মতো খুবই কঠিন কাজ করতে হবে। বাংলাদেশকে সেকেলে নীতিগত রূপরেখা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। জরুরি পর্যালোচনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের উচিত:

১. রোহিঙ্গা ও মিয়ানমারবিষয়ক নীতিগত রূপরেখা প্রণয়নে দেশের সব অংশীজনকে যুক্ত করা; ২. বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বোঝাতে শ্রেণীকরণের পরিবর্তন করে বা না করেই মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের কর্মসংস্থান এবং শিক্ষার পাশাপাশি চলাফেরার স্বাধীনতাসহ বাড়তি কী কী সেবা যুক্ত করা যায়, সেটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া; ৩. রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে শিবির এবং এর আশপাশের এলাকাগুলোয় ব্যাপকতর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; ৪. রোহিঙ্গাদের মৌলিক সেবা, চলাফেরার স্বাধীনতা ও নাগরিকত্বের বিষয়ে আলোচনার স্বার্থে আরাকান আর্মি/ইউনাইটেড লীগ অব আরাকানের সঙ্গে যথাযথ কিছু পন্থায় আলোচনার (পরোক্ষভাবে) বিষয়টি এবং রোহিঙ্গা নাগরিকদের সুনির্দিষ্ট পথরেখা নিশ্চিত করতে এনইউজির সঙ্গে যুক্ততা বিবেচনা করা; ৫. মানবিক সহায়তার স্বার্থে বাংলাদেশ হয়ে রাখাইনে প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত রাখার বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখা এবং রাখাইন রাজ্যের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেনের পাশাপাশি রাখাইনের উৎপাদিত পণ্যগুলোর বাজার নিশ্চিত করতে একটি বিকল্প সরবরাহ ব্যবস্থা চালুর বিষয়টি বাংলাদেশ বিবেচনায় নিতে পারে।

পরিবর্তিত বাস্তবতা ও শরণার্থীদের নতুন চাপের পরিপ্রেক্ষিতে, রোহিঙ্গাদের পুনরায় আসার ধারা বন্ধ করতে এবং উন্নত মানবিক সহায়তার বিকল্প পথগুলো বিবেচনায় নিতে রাখাইনে নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোকে যুক্ত করতে পারে।

আন্তর্জাতিক এসব অংশীজনকে রাখাইনে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং রোহিঙ্গারা আদি নিবাসে ফিরে গেলে তাদের জীবিকার সহায়তার জন্য অবদান রাখার অনুরোধ জানাতে পারে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতকে (আইসিজে) প্রতিশোধমূলক বিচারের ঊর্ধ্বে উঠে মুসলিম রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধ রাখাইনদের মধ্যে মানসিক ক্ষত নিরাময় ও পুনর্মিলনে কাজ শুরু করা উচিত।

সংক্ষেপে বলা যায়, রোহিঙ্গা সংকটের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন অংশীজনকে যুক্ত করে বাংলাদেশের একটি নতুন ধারার উদ্যোগী ও সৃজনশীল কূটনীতিতে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। এটি সংকটের অপেক্ষাকৃত ভালো সমাধান এবং মিয়ানমারের সঙ্গে পারস্পরিক কল্যাণমূলক ও বহুস্তরের সম্পর্কের স্বার্থে হওয়া জরুরি।

  • মোহাম্মদ সুফিউর রহমান মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও জ্যেষ্ঠ ফেলো, এসআইপিজি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি
Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ১২:৩৩:২৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
১৪৮
Translate »

হাসিনা আমলের রোহিঙ্গা নীতি পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি

আপডেট : ১২:৩৩:২৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রোহিঙ্গা সংকটের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ‘অংশীজনকে যুক্ত করে বাংলাদেশের একটি নতুন ধারার উদ্যোগী ও সৃজনশীল কূটনীতিতে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন।’

সর্বশেষ পর্যায়ের রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর দীর্ঘ সাত বছর পেরিয়ে গেছে। এরপরও খুব শিগগির প্রত্যাবাসনের কোনো ইঙ্গিত নেই। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। দেশটির বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে আবির্ভাব ঘটেছে নতুন নতুন শক্তির।

রাখাইনে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ নতুন করে রোহিঙ্গা ঢলের মুখোমুখি হচ্ছে। ইউক্রেন আর গাজায় সংঘাতের কারণে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে রোহিঙ্গা সংকট মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছে। আবার বাংলাদেশে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একেবারেই ভিন্ন একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ অনুসৃত রোহিঙ্গা নীতির পরিবর্তন এখন হয়ে উঠেছে সময়ের দাবি।

২০১৬-১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকটের মাত্রায় পরিবর্তনের পর থেকে সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ একটি নীতিগত রূপরেখা গ্রহণ করেছিল। ওই নীতিগত রূপরেখায় টেকসই প্রত্যাবাসন ও মিয়ানমারের প্রতি সাধারণ পদক্ষেপ গ্রহণের মতো উপাদানগুলো ছিল। সামগ্রিকভাবে ওই সময়কালের রূপরেখার তিনটি প্রধান উপাদান ছিল—ক) মানবিক সহায়তা, খ) টেকসই প্রত্যাবর্তন নিশ্চিতের স্বার্থে মিয়ানমারের রাখাইনে সংকটের উৎসের সমাধান এবং গ) অপরাধীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।

রাখাইন ও মিয়ানমারের ব্যাপারে বাংলাদেশকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার মতো খুবই কঠিন কাজ করতে হবে। বাংলাদেশকে সেকেলে নীতিগত রূপরেখা পুনর্বিবেচনা করতে হবে

দ্রুত প্রত্যাবাসনের ওপর বাংলাদেশ মূল মনোযোগ দেওয়ায়, বাংলাদেশ সব সময় রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থান, স্বেচ্ছামূলক কর্মসংস্থান, চলাফেরার স্বাধীনতা, আবাস এবং আত্তিকরণের মতো ১৯৫১ সালের শরণার্থী সনদের বিধানগুলোর বিরোধিতা করে আসছে। বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের বাধ্যবাধকতা রাজনৈতিক, জনসংখ্যাগত ও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় কার্যকর নয়।

বাংলাদেশ তাই রোহিঙ্গাদের বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক (এফডিএমএন) হিসেবে অভিহিত করেছে, শরণার্থী নয়। শিবিরে চলাফেরা ও সুযোগ সীমিত থাকার ফলে সেখানে রোহিঙ্গাদের মাঝে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে চলেছে। রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) অনিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ড শিবিরগুলোয় নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে দিয়েছে।

মিয়ানমার ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গাদের এমন একটি জাতিসত্তা হিসেবে দেখছে, যাদের সঙ্গে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের গভীর জাতিগত, ভাষাগত ও ধর্মীয় সম্পর্ক রয়েছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সব সময় ভিনদেশি হিসেবে বিবেচনা করেছে। রোহিঙ্গাদের সব সময় নিরাপত্তাহীনতার লেন্স দিয়ে দেখেছে মিয়ানমার। মিয়ানমার সরকারের নীতি ও কর্মকাণ্ডগুলো উত্তর রাখাইনে জনসংখ্যার ভারসাম্য নিশ্চিত করার আকাঙ্ক্ষা এবং ‌‘পশ্চিম দুয়ারকে সুরক্ষার’ জাতীয় অগ্রাধিকার দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। মিয়ানমারের নিরাপত্তাহীনতার ধারণা তার পশ্চিমের প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকেও আসে।

২০২৪ সালের জুলাইয়ে রাখাইনে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ঐতিহ্যবাহী বসতি হিসেবে পরিচিত মায়ু-কালাদান-লেমরো অঞ্চলে অঘোষিত কর্তৃপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফলে অঘোষিত কর্তৃপক্ষ হিসেবে আরাকান আর্মি রাখাইনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে এবং প্রত্যাবাসনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে তাদের কাছ থেকে। এরপরও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি সুরাহার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে রয়ে গেছে।

আরাকান আর্মির নেতৃত্ব বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার বার্তা পাঠিয়েছিল, যা বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে উপেক্ষা করেছে। মিয়ানমারের ৭০০ যোদ্ধাকে তাদের কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলাদেশের হস্তান্তরের বিষয়টি আরাকান আর্মি যে পছন্দ করেনি, সেটা বলাই বাহুল্য। কক্সবাজারের শিবির এলাকাগুলোয় মিয়ানমার সেনাদের জন্য আরসা ও আরএসও রোহিঙ্গাদের নিয়োগের খবরটি আরাকান আর্মিকে রোহিঙ্গাবিরোধী অবস্থান নিতে উসকে দিয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, রাখাইন রাজ্যের ওপর আঞ্চলিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আরাকান আর্মি ও ইউনাইটেড লীগ অব আরাকানের (ইউএলএ) জন্য আরাকান নিয়ে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের একটি ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই মুহূর্তে কিন্তু এটা স্পষ্ট নয় যে তারা মিয়ানমারের মধ্যে সত্যিকার অর্থেই ফেডারেল কাঠামোর মধ্যে সমাধান চাইবে নাকি একটি আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্যে তা চাইবে। তারা যখন প্রশাসন পরিচালনা করতে চায়, জরুরি ভিত্তিতে তাদের রাখাইনে মানবিক সহায়তা সরবরাহের ব্যবস্থা করা, রাজ্যকে অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল করা এবং কৃষিকে পুনরুজ্জীবিত করা উচিত।

এর পাশাপাশি রাখাইন ও চিন রাজ্যের প্রায় সব সম্প্রদায়ের মাঝে সামরিকীকরণ প্রতিবেশী মিজোরাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, এমনকি চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় অস্থিতিশীলতাকে উসকে দিচ্ছে। সম্প্রতি মণিপুর ও নাগাল্যান্ডে জাতিগত সংঘাতের পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে সীমান্তবর্তী এলাকায় এবং কালাদান বহুমাত্রিক প্রকল্পে ভারতের দুর্বলতার বিষয়টি উন্মোচিত হয়েছে। চকফিউ বন্দর ও ইউনানে তেল ও গ্যাস পাইপলাইনে চীনের সরাসরি অংশীদারত্ব রয়েছে।

এদিকে মিয়ানমারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার গভীর আগ্রহের ইঙ্গিত দিয়েছে। বৈচিত্র্যময় নানা পক্ষ এবং তাদের ভিন্ন ভিন্ন ভূকৌশলগত স্বার্থ বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারত ও চীনের সীমান্তবর্তী এলাকায় পুরোপুরি অনুমানযোগ্য এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এমন আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ অনিচ্ছা সত্ত্বেও সামরিক সংঘাতের ঘূর্ণিপাকে আটকে যাবে—এমনটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনী বাংলাদেশকে একটি সশস্ত্র সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে অনেক কিছুই করেছিল।

রাখাইন ও মিয়ানমারের ব্যাপারে বাংলাদেশকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার মতো খুবই কঠিন কাজ করতে হবে। বাংলাদেশকে সেকেলে নীতিগত রূপরেখা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। জরুরি পর্যালোচনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের উচিত:

১. রোহিঙ্গা ও মিয়ানমারবিষয়ক নীতিগত রূপরেখা প্রণয়নে দেশের সব অংশীজনকে যুক্ত করা; ২. বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বোঝাতে শ্রেণীকরণের পরিবর্তন করে বা না করেই মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের কর্মসংস্থান এবং শিক্ষার পাশাপাশি চলাফেরার স্বাধীনতাসহ বাড়তি কী কী সেবা যুক্ত করা যায়, সেটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া; ৩. রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে শিবির এবং এর আশপাশের এলাকাগুলোয় ব্যাপকতর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; ৪. রোহিঙ্গাদের মৌলিক সেবা, চলাফেরার স্বাধীনতা ও নাগরিকত্বের বিষয়ে আলোচনার স্বার্থে আরাকান আর্মি/ইউনাইটেড লীগ অব আরাকানের সঙ্গে যথাযথ কিছু পন্থায় আলোচনার (পরোক্ষভাবে) বিষয়টি এবং রোহিঙ্গা নাগরিকদের সুনির্দিষ্ট পথরেখা নিশ্চিত করতে এনইউজির সঙ্গে যুক্ততা বিবেচনা করা; ৫. মানবিক সহায়তার স্বার্থে বাংলাদেশ হয়ে রাখাইনে প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত রাখার বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখা এবং রাখাইন রাজ্যের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেনের পাশাপাশি রাখাইনের উৎপাদিত পণ্যগুলোর বাজার নিশ্চিত করতে একটি বিকল্প সরবরাহ ব্যবস্থা চালুর বিষয়টি বাংলাদেশ বিবেচনায় নিতে পারে।

পরিবর্তিত বাস্তবতা ও শরণার্থীদের নতুন চাপের পরিপ্রেক্ষিতে, রোহিঙ্গাদের পুনরায় আসার ধারা বন্ধ করতে এবং উন্নত মানবিক সহায়তার বিকল্প পথগুলো বিবেচনায় নিতে রাখাইনে নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোকে যুক্ত করতে পারে।

আন্তর্জাতিক এসব অংশীজনকে রাখাইনে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং রোহিঙ্গারা আদি নিবাসে ফিরে গেলে তাদের জীবিকার সহায়তার জন্য অবদান রাখার অনুরোধ জানাতে পারে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতকে (আইসিজে) প্রতিশোধমূলক বিচারের ঊর্ধ্বে উঠে মুসলিম রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধ রাখাইনদের মধ্যে মানসিক ক্ষত নিরাময় ও পুনর্মিলনে কাজ শুরু করা উচিত।

সংক্ষেপে বলা যায়, রোহিঙ্গা সংকটের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন অংশীজনকে যুক্ত করে বাংলাদেশের একটি নতুন ধারার উদ্যোগী ও সৃজনশীল কূটনীতিতে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। এটি সংকটের অপেক্ষাকৃত ভালো সমাধান এবং মিয়ানমারের সঙ্গে পারস্পরিক কল্যাণমূলক ও বহুস্তরের সম্পর্কের স্বার্থে হওয়া জরুরি।

  • মোহাম্মদ সুফিউর রহমান মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও জ্যেষ্ঠ ফেলো, এসআইপিজি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি