London ১০:৫৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম:
পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পাশের বাসায় অবস্থান নেয় মোমিন ও সুবা কালিয়াকৈরে ভ্রাম্যমান আদালতে জরিমানা কালিয়াকৈর দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ জাতীয় স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা ক্রীড়া সমিতির উদ্যোগে ৫৩ তম শীতকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ঝাউদিয়া থানা উদ্বোধনের দাবীতে কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে এলাকাবাসীর বিক্ষোভ চুয়াডাঙ্গার সীমান্ত থেকে বাংলাদেশী নাগরিককে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ ফরিদপুরের খাজা আগে যুবলীগ এখন যুবদল পরিচয়ে ত্রাসের রাজত্ব জানুয়ারিতে সড়কে নিহত ৬০৮ যেভাবে খোঁজ মিললো নিখোঁজ কিশোরী সুবার ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি পাচ্ছেন ফুটবলার সুমাইয়া

যৌন নির্যাতন: কিশোরীদের কেউ ছাড়ছে পড়াশোনা, কারও হচ্ছে বাল্যবিবাহ

বছর চারেক আগের ঘটনা। কলেজশিক্ষকের বাসায় পড়তে গিয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন সদ্য এসএসসি পাস মেয়েটি (১৬)। বাড়িতে এসে ঘটনাটি বলার পর উল্টো বকাঝকা শুনতে হয়—এত মেয়ের মধ্যে শিক্ষক কেন তাকেই নির্যাতন করলেন!

কিশোর বয়সী মেয়েটি বলে, ‘ঘটনা প্রকাশ করলে আমাকেই হেনস্তার মধ্যে ফেলবেন বলে শিক্ষক হুমকি দিয়েছিলেন। অন্যদিকে বাসা থেকে সমর্থন পাচ্ছিলাম না। আমি মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিলাম যে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তিন বছর কলেজে যাইনি, কারও সঙ্গে মিশতাম না।’

দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর মেয়েটি পড়াশোনায় ফিরেছিল। তবে পড়াশোনার সেই বিরতি তাকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে ভেবে এখনো মানসিক যাতনায় ভোগে।

আরেকটি ঘটনা। রাজধানীর একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া মেয়েটি অঙ্কে বেশ ভালো ছিল। শিক্ষকেরও মনোযোগী এই ছাত্রীর দিকে ছিল বাড়তি নজর। সেই মেয়েরই একদিন অঙ্কের বিষয়ে বিতৃষ্ণা এসে গেল। সেটি এতটাই যে বই খুললে বমি করে দেয় সে।

এই মেয়ের মা–বাবা প্রথমে ভাবলেন, বড় ক্লাসে উঠে জটিল অঙ্ক দেখে মেয়ে ভয় পেয়ে গেছে। পরে তাঁরা একজন মনঃসামাজিক কাউন্সেলরের কাছে নেন তাকে। জানতে পারেন, ওই শিক্ষক অঙ্ক আরও ভালোভাবে বোঝানোর ছলে মেয়েটিকে একা অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে অযাচিতভাবে স্পর্শ করেছিলেন। যৌন নির্যাতনের সেই ঘটনা কাউকে বলতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়ে মেয়েটি। পরে অঙ্কের বই দেখলে দুঃসহ সেই স্মৃতি সামনে ভেসে আসে।

তিন বছর আগে দীর্ঘ সময় ধরে মেয়েটির কাউন্সেলিং হয় বেসরকারি সংস্থা ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের কাউন্সিলরের কাছে।

শিশুদের নিয়ে কর্মরত ব্যক্তিরা বলছেন, শৈশব, বিশেষ করে কৈশোরে নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পরবর্তী সময়ে ওই শিশুর মনে মানুষের প্রতি অনাস্থা তৈরি হয়। এমন কিশোরীদের অনেকের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। কেউ কেউ পড়াশোনাই ছেড়ে দিচ্ছে, কারও বাল্যবিবাহ হচ্ছে।

শিশু নির্যাতন ও এ বিষয়ে দায়ের হওয়া মামলা নিয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের (গবেষণা–সংশ্লিষ্ট জরিপে অংশ নেওয়া) ৬০ শতাংশ জানিয়েছিল, তারা কোনো না কোনো নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ৭৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ২১ শতাংশ মানসিক নির্যাতন ও ৩ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

গবেষণা কী বলছে

এ বছর ‘শিশু যৌন নির্যাতন: ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে দায়েরকৃত মামলার ওপর একটি গবেষণা’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্যাতনের শিকার শিশুরা অরুচি, নিদ্রাহীনতা, পরিবারের অসম্মানজনিত আত্মগ্লানি, স্বাধীনভাবে চলাচল করতে না পারা, হতাশা, হীনম্মন্যতা, দুশ্চিন্তা, লজ্জা ও ভয়ের মতো মানসিক সমস্যায় ভোগে।

ওই গবেষণায় ঢাকা শহরের তিনটি বিদ্যালয় ও কলেজের ১৮ বছরের কম বয়সী ১৫০ জন ছেলে ও মেয়েশিশুর ওপর জরিপ করা হয় এবং ২৫টি মামলা পর্যবেক্ষণ করা হয়। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এ–সংক্রান্ত জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের ৬০ শতাংশ জানিয়েছিল, তারা কোনো না কোনো নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ৭৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ২১ শতাংশ মানসিক নির্যাতন ও ৩ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

আবার যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুদের মধ্যে প্রায় ৭৪ শতাংশ অবাঞ্ছিত স্পর্শ, প্রায় ৩৪ শতাংশ জোরপূর্বক অশ্লীল কিছু দেখানো, ২৮ শতাংশ যৌনাঙ্গ স্পর্শ এবং প্রায় ২৪ শতাংশ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। প্রধানত, সচেতনতার অভাব ও পুলিশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার কারণে এসব ক্ষেত্রে ৬৬ শতাংশ অভিভাবক পুলিশের সহায়তা চাননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

ডিএমপির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুদের বেশির ভাগ বা ৩৯ শতাংশ অপরিচিত ব্যক্তি, প্রায় ১২ শতাংশ চাচা-মামা, প্রায় ৬ শতাংশ চাচাতো-মামাতো ভাই, প্রায় ৯ শতাংশ দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় এবং ৪ শতাংশের বেশি বন্ধুর মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষকসহ অন্যদের মাধ্যমেও নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনা রয়েছে।

শিশুরা যখন নির্যাতনের কোনো ঘটনা বলে, তখন সেটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে মা–বাবাকে। শিশু যেন মনখুলে সবকিছু বলতে পারে—এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে হবে মা–বাবার সঙ্গে। শিশু অবস্থায় পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শেখাতে হবে ভালো স্পর্শ ও মন্দ স্পর্শ কোনটি। আর শিশু নির্যাতন কমাতে আইনের কার্যকর প্রয়োগও প্রয়োজন।

রোকসানা সুলতানা, ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক

বাড়িছাড়া, বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া

গাইবান্ধায় কাটাবাড়ি সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ইয়ুথ অর্গানাইজেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী যুব সংগঠন রয়েছে। এলাকায় যৌন নিপীড়ন, নির্যাতন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধসহ সামাজিক কাজে যুক্ত থাকেন সংগঠনের সদস্যরা। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবেদা সুলতানা আঁখি এ জেলায় যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া কিশোরীদের কিছু ঘটনা তুলে ধরেন।

গত বছর এক কিশোরী (১২) মাদ্রাসাশিক্ষকের কাছে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কিশোরীর মা–বাবা এ ঘটনায় স্থানীয় সালিসে প্রতিকার চেয়ে ব্যর্থ হন। পরে মেয়েটিকে মাদ্রাসায় পাঠানো বন্ধ করে দেন। ছয় মাস পর মেয়েটির বাল্যবিবাহ হয়।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে আরেক কিশোরী সৎবাবার যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে এখন বাড়িছাড়া। আবেদা সুলতানা জানান, ১১ বছর বয়সে মেয়েটির বাবা মারা যাওয়ার পর মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। মায়ের দ্বিতীয় সংসারে এখন একটি সন্তানও আছে। মেয়েটি সৎবাবার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করলেও মা আমলে নিতেন না। কিছুদিন আগে মেয়েটিকে বাবা নিপীড়ন করলে সে চিৎকার দেয় এবং আশপাশের লোকজন জড়ো হন।

পরে পুলিশ এলেও মেয়েটির মা ওই ঘটনায় কোনো মামলা করতে চাননি। মেয়েটি পরিবারে থাকলে সৎবাবা তাকে বের করে দেবেন জেনে নিজেই মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। এখন মেয়েটি যুব সংগঠনটির হেফাজতে রয়েছে।

আবেদা সুলতানা বলেন, স্কুলে আসা–যাওয়ার পথে বখাটের মাধ্যমেও যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এমন এক ঘটনায় একটি মেয়ে প্রতিবাদ করলে একজন বখাটে ইট ছুড়ে তাঁকে আহত করেন। গ্রাম্য সালিসে মেয়েটিকে উল্টো অভিযুক্ত করে মাতব্বরেরা বলতে থাকেন, ‘কী দেখে মেয়েটির মনে হলো যে ছেলেটি তাকে যৌন নিপীড়ন করেছে?’ পরে যুব সংগঠন ওই ঘটনায় মেয়েটির পরিবারকে মামলা করতে বললেও সামাজিক হেনস্তার শিকার হওয়ার ভয়ে তারা রাজি হয়নি।

ঘটছে ধর্ষণের ঘটনাও

যৌন নির্যাতনের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনাও রয়েছে। গত ১১ সেপ্টেম্বরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) গিয়ে এক কিশোরীর (১২) সঙ্গে দেখা হয়। সাভারের শ্রমজীবী পরিবারের মেয়েটিকে এক প্রতিবেশী ধর্ষণ করে হাতে ১০০ টাকা গুঁজে দিয়েছিল।

রাজধানীর কালাচাঁদপুরে প্রতিবেশীর ধর্ষণের শিকার হয়ে গত ৩১ আগস্ট ওসিসিতে ভর্তি হয় আরেক শিশু। তাকে চকলেট দেওয়ার কথা বলে এক প্রতিবেশী ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের তথ্য সংকলন করে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬৩১টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ২৩৯টি শিশু। সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৪৫টি শিশু। এ ছাড়া শিক্ষকের মাধ্যমে ৭৮ এবং বখাটের মাধ্যমে ২৪টি যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। মামলা হয়েছে মাত্র ১৪টি ঘটনায়।

এদিকে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ করতে গিয়ে খুন হয়েছে তিনটি শিশু এবং একটি শিশু আত্মহত্যা করেছে। মোট নির্যাতনের ৪৮ শতাংশ ঘটনায় মামলা হয়েছে।

শিশুর কথা শুনতে হবে

রাজধানীর এক নারী স্বামীর মৃত্যুর পর ৮ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়িতে উঠেছিলেন। ১৫ বছর বয়সে কিশোরীর তীব্র কোমরব্যথা শুরু হলে মা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। পরীক্ষা–নিরীক্ষায় দেখা যায়, সমস্যা শারীরিক নয়, মানসিক। চিকিৎসক কিশোরীকে ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স সংগঠনের মনঃসামাজিক কাউন্সিলরের কাছে পাঠিয়ে দেন।

বেশ কয়েকটা অধিবেশন শেষে কাউন্সেলর জানতে পারেন, মেয়েটি নিয়মিত মামার যৌন নির্যাতনের শিকার হতো। শিশু অবস্থায় সে বুঝতে পারত না এটি নির্যাতন। কিশোরী হওয়ার পর সেই অভিজ্ঞতা তার মানসিক ব্যধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা বলেন, শিশু অবস্থায় যৌন নির্যাতনের কোনো কোনো ঘটনা দীর্ঘমেয়াদি ছাপ ফেলে। বিশেষ করে যেসব শিশু সংবেদনশীল, তাদের যৌন নির্যাতনের স্মৃতি তাড়া করে ফেরে। শৈশবের এমন ঘটনার শিকার এক নারী পরবর্তী সময়ে স্বামীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে পারেননি এবং বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন—এমন ঘটনাও ঘটেছে। তাই শিশুদের সুরক্ষায় পরিবার থেকে সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

রোকসানা সুলতানা বলেন, শিশুরা যখন নির্যাতনের কোনো ঘটনা বলে, তখন সেটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে মা–বাবাকে। শিশু যেন মনখুলে সব কিছু বলতে পারে—এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে হবে মা–বাবার সঙ্গে। শিশু অবস্থায় পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শেখাতে হবে ভালো স্পর্শ ও মন্দ স্পর্শ কোনটি। আর শিশু নির্যাতন কমাতে আইনের কার্যকর প্রয়োগও প্রয়োজন।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৬:৪৫:০১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪
২২
Translate »

যৌন নির্যাতন: কিশোরীদের কেউ ছাড়ছে পড়াশোনা, কারও হচ্ছে বাল্যবিবাহ

আপডেট : ০৬:৪৫:০১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪

বছর চারেক আগের ঘটনা। কলেজশিক্ষকের বাসায় পড়তে গিয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন সদ্য এসএসসি পাস মেয়েটি (১৬)। বাড়িতে এসে ঘটনাটি বলার পর উল্টো বকাঝকা শুনতে হয়—এত মেয়ের মধ্যে শিক্ষক কেন তাকেই নির্যাতন করলেন!

কিশোর বয়সী মেয়েটি বলে, ‘ঘটনা প্রকাশ করলে আমাকেই হেনস্তার মধ্যে ফেলবেন বলে শিক্ষক হুমকি দিয়েছিলেন। অন্যদিকে বাসা থেকে সমর্থন পাচ্ছিলাম না। আমি মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিলাম যে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তিন বছর কলেজে যাইনি, কারও সঙ্গে মিশতাম না।’

দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর মেয়েটি পড়াশোনায় ফিরেছিল। তবে পড়াশোনার সেই বিরতি তাকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে ভেবে এখনো মানসিক যাতনায় ভোগে।

আরেকটি ঘটনা। রাজধানীর একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া মেয়েটি অঙ্কে বেশ ভালো ছিল। শিক্ষকেরও মনোযোগী এই ছাত্রীর দিকে ছিল বাড়তি নজর। সেই মেয়েরই একদিন অঙ্কের বিষয়ে বিতৃষ্ণা এসে গেল। সেটি এতটাই যে বই খুললে বমি করে দেয় সে।

এই মেয়ের মা–বাবা প্রথমে ভাবলেন, বড় ক্লাসে উঠে জটিল অঙ্ক দেখে মেয়ে ভয় পেয়ে গেছে। পরে তাঁরা একজন মনঃসামাজিক কাউন্সেলরের কাছে নেন তাকে। জানতে পারেন, ওই শিক্ষক অঙ্ক আরও ভালোভাবে বোঝানোর ছলে মেয়েটিকে একা অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে অযাচিতভাবে স্পর্শ করেছিলেন। যৌন নির্যাতনের সেই ঘটনা কাউকে বলতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়ে মেয়েটি। পরে অঙ্কের বই দেখলে দুঃসহ সেই স্মৃতি সামনে ভেসে আসে।

তিন বছর আগে দীর্ঘ সময় ধরে মেয়েটির কাউন্সেলিং হয় বেসরকারি সংস্থা ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের কাউন্সিলরের কাছে।

শিশুদের নিয়ে কর্মরত ব্যক্তিরা বলছেন, শৈশব, বিশেষ করে কৈশোরে নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পরবর্তী সময়ে ওই শিশুর মনে মানুষের প্রতি অনাস্থা তৈরি হয়। এমন কিশোরীদের অনেকের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। কেউ কেউ পড়াশোনাই ছেড়ে দিচ্ছে, কারও বাল্যবিবাহ হচ্ছে।

শিশু নির্যাতন ও এ বিষয়ে দায়ের হওয়া মামলা নিয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের (গবেষণা–সংশ্লিষ্ট জরিপে অংশ নেওয়া) ৬০ শতাংশ জানিয়েছিল, তারা কোনো না কোনো নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ৭৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ২১ শতাংশ মানসিক নির্যাতন ও ৩ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

গবেষণা কী বলছে

এ বছর ‘শিশু যৌন নির্যাতন: ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে দায়েরকৃত মামলার ওপর একটি গবেষণা’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্যাতনের শিকার শিশুরা অরুচি, নিদ্রাহীনতা, পরিবারের অসম্মানজনিত আত্মগ্লানি, স্বাধীনভাবে চলাচল করতে না পারা, হতাশা, হীনম্মন্যতা, দুশ্চিন্তা, লজ্জা ও ভয়ের মতো মানসিক সমস্যায় ভোগে।

ওই গবেষণায় ঢাকা শহরের তিনটি বিদ্যালয় ও কলেজের ১৮ বছরের কম বয়সী ১৫০ জন ছেলে ও মেয়েশিশুর ওপর জরিপ করা হয় এবং ২৫টি মামলা পর্যবেক্ষণ করা হয়। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এ–সংক্রান্ত জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের ৬০ শতাংশ জানিয়েছিল, তারা কোনো না কোনো নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ৭৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ২১ শতাংশ মানসিক নির্যাতন ও ৩ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

আবার যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুদের মধ্যে প্রায় ৭৪ শতাংশ অবাঞ্ছিত স্পর্শ, প্রায় ৩৪ শতাংশ জোরপূর্বক অশ্লীল কিছু দেখানো, ২৮ শতাংশ যৌনাঙ্গ স্পর্শ এবং প্রায় ২৪ শতাংশ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। প্রধানত, সচেতনতার অভাব ও পুলিশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার কারণে এসব ক্ষেত্রে ৬৬ শতাংশ অভিভাবক পুলিশের সহায়তা চাননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

ডিএমপির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুদের বেশির ভাগ বা ৩৯ শতাংশ অপরিচিত ব্যক্তি, প্রায় ১২ শতাংশ চাচা-মামা, প্রায় ৬ শতাংশ চাচাতো-মামাতো ভাই, প্রায় ৯ শতাংশ দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় এবং ৪ শতাংশের বেশি বন্ধুর মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষকসহ অন্যদের মাধ্যমেও নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনা রয়েছে।

শিশুরা যখন নির্যাতনের কোনো ঘটনা বলে, তখন সেটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে মা–বাবাকে। শিশু যেন মনখুলে সবকিছু বলতে পারে—এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে হবে মা–বাবার সঙ্গে। শিশু অবস্থায় পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শেখাতে হবে ভালো স্পর্শ ও মন্দ স্পর্শ কোনটি। আর শিশু নির্যাতন কমাতে আইনের কার্যকর প্রয়োগও প্রয়োজন।

রোকসানা সুলতানা, ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক

বাড়িছাড়া, বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া

গাইবান্ধায় কাটাবাড়ি সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ইয়ুথ অর্গানাইজেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী যুব সংগঠন রয়েছে। এলাকায় যৌন নিপীড়ন, নির্যাতন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধসহ সামাজিক কাজে যুক্ত থাকেন সংগঠনের সদস্যরা। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবেদা সুলতানা আঁখি এ জেলায় যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া কিশোরীদের কিছু ঘটনা তুলে ধরেন।

গত বছর এক কিশোরী (১২) মাদ্রাসাশিক্ষকের কাছে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কিশোরীর মা–বাবা এ ঘটনায় স্থানীয় সালিসে প্রতিকার চেয়ে ব্যর্থ হন। পরে মেয়েটিকে মাদ্রাসায় পাঠানো বন্ধ করে দেন। ছয় মাস পর মেয়েটির বাল্যবিবাহ হয়।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে আরেক কিশোরী সৎবাবার যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে এখন বাড়িছাড়া। আবেদা সুলতানা জানান, ১১ বছর বয়সে মেয়েটির বাবা মারা যাওয়ার পর মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। মায়ের দ্বিতীয় সংসারে এখন একটি সন্তানও আছে। মেয়েটি সৎবাবার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করলেও মা আমলে নিতেন না। কিছুদিন আগে মেয়েটিকে বাবা নিপীড়ন করলে সে চিৎকার দেয় এবং আশপাশের লোকজন জড়ো হন।

পরে পুলিশ এলেও মেয়েটির মা ওই ঘটনায় কোনো মামলা করতে চাননি। মেয়েটি পরিবারে থাকলে সৎবাবা তাকে বের করে দেবেন জেনে নিজেই মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। এখন মেয়েটি যুব সংগঠনটির হেফাজতে রয়েছে।

আবেদা সুলতানা বলেন, স্কুলে আসা–যাওয়ার পথে বখাটের মাধ্যমেও যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এমন এক ঘটনায় একটি মেয়ে প্রতিবাদ করলে একজন বখাটে ইট ছুড়ে তাঁকে আহত করেন। গ্রাম্য সালিসে মেয়েটিকে উল্টো অভিযুক্ত করে মাতব্বরেরা বলতে থাকেন, ‘কী দেখে মেয়েটির মনে হলো যে ছেলেটি তাকে যৌন নিপীড়ন করেছে?’ পরে যুব সংগঠন ওই ঘটনায় মেয়েটির পরিবারকে মামলা করতে বললেও সামাজিক হেনস্তার শিকার হওয়ার ভয়ে তারা রাজি হয়নি।

ঘটছে ধর্ষণের ঘটনাও

যৌন নির্যাতনের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনাও রয়েছে। গত ১১ সেপ্টেম্বরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) গিয়ে এক কিশোরীর (১২) সঙ্গে দেখা হয়। সাভারের শ্রমজীবী পরিবারের মেয়েটিকে এক প্রতিবেশী ধর্ষণ করে হাতে ১০০ টাকা গুঁজে দিয়েছিল।

রাজধানীর কালাচাঁদপুরে প্রতিবেশীর ধর্ষণের শিকার হয়ে গত ৩১ আগস্ট ওসিসিতে ভর্তি হয় আরেক শিশু। তাকে চকলেট দেওয়ার কথা বলে এক প্রতিবেশী ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের তথ্য সংকলন করে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬৩১টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ২৩৯টি শিশু। সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৪৫টি শিশু। এ ছাড়া শিক্ষকের মাধ্যমে ৭৮ এবং বখাটের মাধ্যমে ২৪টি যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। মামলা হয়েছে মাত্র ১৪টি ঘটনায়।

এদিকে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ করতে গিয়ে খুন হয়েছে তিনটি শিশু এবং একটি শিশু আত্মহত্যা করেছে। মোট নির্যাতনের ৪৮ শতাংশ ঘটনায় মামলা হয়েছে।

শিশুর কথা শুনতে হবে

রাজধানীর এক নারী স্বামীর মৃত্যুর পর ৮ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়িতে উঠেছিলেন। ১৫ বছর বয়সে কিশোরীর তীব্র কোমরব্যথা শুরু হলে মা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। পরীক্ষা–নিরীক্ষায় দেখা যায়, সমস্যা শারীরিক নয়, মানসিক। চিকিৎসক কিশোরীকে ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স সংগঠনের মনঃসামাজিক কাউন্সিলরের কাছে পাঠিয়ে দেন।

বেশ কয়েকটা অধিবেশন শেষে কাউন্সেলর জানতে পারেন, মেয়েটি নিয়মিত মামার যৌন নির্যাতনের শিকার হতো। শিশু অবস্থায় সে বুঝতে পারত না এটি নির্যাতন। কিশোরী হওয়ার পর সেই অভিজ্ঞতা তার মানসিক ব্যধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা বলেন, শিশু অবস্থায় যৌন নির্যাতনের কোনো কোনো ঘটনা দীর্ঘমেয়াদি ছাপ ফেলে। বিশেষ করে যেসব শিশু সংবেদনশীল, তাদের যৌন নির্যাতনের স্মৃতি তাড়া করে ফেরে। শৈশবের এমন ঘটনার শিকার এক নারী পরবর্তী সময়ে স্বামীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে পারেননি এবং বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন—এমন ঘটনাও ঘটেছে। তাই শিশুদের সুরক্ষায় পরিবার থেকে সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

রোকসানা সুলতানা বলেন, শিশুরা যখন নির্যাতনের কোনো ঘটনা বলে, তখন সেটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে মা–বাবাকে। শিশু যেন মনখুলে সব কিছু বলতে পারে—এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে হবে মা–বাবার সঙ্গে। শিশু অবস্থায় পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শেখাতে হবে ভালো স্পর্শ ও মন্দ স্পর্শ কোনটি। আর শিশু নির্যাতন কমাতে আইনের কার্যকর প্রয়োগও প্রয়োজন।