London ০১:২০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যেভাবে নির্মিত হয়েছিল মদিনার প্রথম মসজিদ

অনলাইন ডেস্ক

মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পথে নবিজি হজরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মদিনার নিকটবর্তী এলাকা কুবায় যাত্রাবিরতি করেছিলেন। সেখানে তিনি চার দিন অবস্থান করেন। এ সময় সেখানে তিনি নির্মাণ করেন মুসলমানদের প্রথম মসজিদ। যে মসজিদ নির্মাণের প্রশংসা করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

لَمَسۡجِدٌ اُسِّسَ عَلَی التَّقۡوٰی مِنۡ اَوَّلِ یَوۡمٍ اَحَقُّ اَنۡ تَقُوۡمَ فِیۡهِ

যে মসজিদ প্রথম দিন থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকওয়ার ওপর, তোমার নামাজে দাঁড়ানোর জন্য সেটাই অধিক উপযুক্ত। (সুরা তাওবা: ১০৮)

মসজিদে কুবা কীভাবে নির্মিত হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ইউনুস ইবনে বুকাইর ‘জিয়াদাতুল মাগাজি’ গ্রন্থে আল-মাসউদীর সূত্রে আল-হাকাম ইবনে উতাইবা থেকে বর্ণনা করেন, যখন নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুবায় এলেন, তখন আম্মার ইবনে ইয়াসির বললেন, আল্লাহর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্য এমন একটি স্থান নির্ধারণ করা আবশ্যক, যেখানে তিনি বিশ্রাম নিতে পারবেন এবং নামাজ আদায় করতে পারবেন। এরপর তিনি কিছু পাথর সংগ্রহ করে একটি মসজিদ নির্মাণ করলেন। এভাবে তিনিই প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন।

কিছু ঐতিহাসিকের মত হলো, মসজিদে কুবা নবিজির (সা.) হিজরতের আগেই নির্মিত হয়েছিল। আল্লাহর রাসুলের (সা.) আগে যে সাহাবিরা হিজরত করেছিলেন তারা ও মদিনার আনসরারা এ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। তারা সেখানে নামাজ আদায় করতেন। যখন আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরত করে কুবায় এলেন, তখন তিনি সেখানে তাদের নিয়ে নামাজ আদায় করেন। এটা ছিল প্রথম মসজিদ যেখানে নবিজি (সা.) তার সাহাবিদের নিয়ে প্রকাশ্যে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করেছিলেন।

কিন্তু বেশিরভাগ ঐতিহাসিকের মতে নবিজির (সা.) মদিনায় হিজরতের পথে তার উপস্থিতিতে ও তত্ত্বাবধানেই মসজিদে কুবা নির্মিত হয়। মসজিদে কুবার নির্মাণকাজে নবিজি (সা.) নিজেও অংশ নিয়েছিলেন। তাবরানি জাবের ইবনে সামুরা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, নবিজি (সা.) কুবায় যাত্রাবিরতি করলে কুবার লোকেরা নবিজিকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুরোধ করলেন যেন তিনি তাদের জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করুন। তখন রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আপনারা কেউ এই উটের পিঠে আরোহণ করুন। প্রথমে আবু বকর (রা.) উটের পিঠে আরোহণ করলেন, কিন্তু উটটি নড়লো না। তিনি ফিরে এসে বসে পড়লেন। এরপর ওমর (রা.) উটের পিঠে উঠলেন, কিন্তু উটটি তখনও নড়লো না। তিনিও ব্যর্থ হয়ে ফিরলেন। নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আরও কেউ উঠুক। তখন আলী (রা.) উঠে উটের পিঠে আরোহণ করলে উটটি তাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তখন নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, এর লাগাম ছেড়ে দিন এবং যেখানে এটি থামে, সেখানেই মসজিদ তৈরি করুন, কারণ এটি নির্দেশপ্রাপ্ত।

আরেকটি বর্ণনায় তাবারানি শামুস বিনতে নোমান (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, যখন নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এলেন এবং মসজিদে কুবার ভিত্তি স্থাপন করলেন, তখন তাকে আমি নিজের হাতে পাথর তুলতে দেখেছি। পাথরের ওজনের কারণে তার শরীর কেঁপে উঠছিল। তার পেটে বা নাভিতে ধুলা লেগে গিয়েছিল। এক সাহাবি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা-বাবা আপনার জন্য কোরবান হোক, পাথরটি আমাকে দিন। তিনি বললেন, না, আপনি বরং এ রকম আরেকটি পাথর তুলুন।

মসজিদে কুবা ইসলামে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ মসজিদ। মসজিদে কুবায় নামাজ আদায়ের বিশেষ ফজিলত রয়েছে। নবিজি মাঝে মাঝেই মসজিদে কুবায় নামাজ আদায়ের জন্য যেতেন। সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমে ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে, নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি শনিবার কুবা মসজিদে যেতেন, কখনো হেঁটে, কখনো সওয়ার হয়ে। সহিহ মুসলিমের আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুবা মসজিদে যেতেন, কখনো সওয়ার হয়ে, কখনো হেঁটে, এবং সেখানে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন।

সুনানে তিরমিজিতে উসাইদ ইবনে যুহাইর আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে, নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, মসজিদে কুবায় নামাজ আদায় করা একটি ওমরাহর সমতুল্য। সুনানে নাসাঈতে সাহল ইবনে হুনাইফ (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে, আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি এই মসজিদে (কুবা মসজিদে) আসার উদ্দেশ্যে বের হয় এবং সেখানে গিয়ে নামাজ আদায় করে, সে একটি ওমরাহর সওয়াব লাভ করে।

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৩:৪৮:২৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫
Translate »

যেভাবে নির্মিত হয়েছিল মদিনার প্রথম মসজিদ

আপডেট : ০৩:৪৮:২৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫

মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পথে নবিজি হজরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মদিনার নিকটবর্তী এলাকা কুবায় যাত্রাবিরতি করেছিলেন। সেখানে তিনি চার দিন অবস্থান করেন। এ সময় সেখানে তিনি নির্মাণ করেন মুসলমানদের প্রথম মসজিদ। যে মসজিদ নির্মাণের প্রশংসা করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

لَمَسۡجِدٌ اُسِّسَ عَلَی التَّقۡوٰی مِنۡ اَوَّلِ یَوۡمٍ اَحَقُّ اَنۡ تَقُوۡمَ فِیۡهِ

যে মসজিদ প্রথম দিন থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকওয়ার ওপর, তোমার নামাজে দাঁড়ানোর জন্য সেটাই অধিক উপযুক্ত। (সুরা তাওবা: ১০৮)

মসজিদে কুবা কীভাবে নির্মিত হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ইউনুস ইবনে বুকাইর ‘জিয়াদাতুল মাগাজি’ গ্রন্থে আল-মাসউদীর সূত্রে আল-হাকাম ইবনে উতাইবা থেকে বর্ণনা করেন, যখন নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুবায় এলেন, তখন আম্মার ইবনে ইয়াসির বললেন, আল্লাহর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্য এমন একটি স্থান নির্ধারণ করা আবশ্যক, যেখানে তিনি বিশ্রাম নিতে পারবেন এবং নামাজ আদায় করতে পারবেন। এরপর তিনি কিছু পাথর সংগ্রহ করে একটি মসজিদ নির্মাণ করলেন। এভাবে তিনিই প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন।

কিছু ঐতিহাসিকের মত হলো, মসজিদে কুবা নবিজির (সা.) হিজরতের আগেই নির্মিত হয়েছিল। আল্লাহর রাসুলের (সা.) আগে যে সাহাবিরা হিজরত করেছিলেন তারা ও মদিনার আনসরারা এ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। তারা সেখানে নামাজ আদায় করতেন। যখন আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরত করে কুবায় এলেন, তখন তিনি সেখানে তাদের নিয়ে নামাজ আদায় করেন। এটা ছিল প্রথম মসজিদ যেখানে নবিজি (সা.) তার সাহাবিদের নিয়ে প্রকাশ্যে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করেছিলেন।

কিন্তু বেশিরভাগ ঐতিহাসিকের মতে নবিজির (সা.) মদিনায় হিজরতের পথে তার উপস্থিতিতে ও তত্ত্বাবধানেই মসজিদে কুবা নির্মিত হয়। মসজিদে কুবার নির্মাণকাজে নবিজি (সা.) নিজেও অংশ নিয়েছিলেন। তাবরানি জাবের ইবনে সামুরা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, নবিজি (সা.) কুবায় যাত্রাবিরতি করলে কুবার লোকেরা নবিজিকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুরোধ করলেন যেন তিনি তাদের জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করুন। তখন রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আপনারা কেউ এই উটের পিঠে আরোহণ করুন। প্রথমে আবু বকর (রা.) উটের পিঠে আরোহণ করলেন, কিন্তু উটটি নড়লো না। তিনি ফিরে এসে বসে পড়লেন। এরপর ওমর (রা.) উটের পিঠে উঠলেন, কিন্তু উটটি তখনও নড়লো না। তিনিও ব্যর্থ হয়ে ফিরলেন। নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আরও কেউ উঠুক। তখন আলী (রা.) উঠে উটের পিঠে আরোহণ করলে উটটি তাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তখন নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, এর লাগাম ছেড়ে দিন এবং যেখানে এটি থামে, সেখানেই মসজিদ তৈরি করুন, কারণ এটি নির্দেশপ্রাপ্ত।

আরেকটি বর্ণনায় তাবারানি শামুস বিনতে নোমান (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, যখন নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এলেন এবং মসজিদে কুবার ভিত্তি স্থাপন করলেন, তখন তাকে আমি নিজের হাতে পাথর তুলতে দেখেছি। পাথরের ওজনের কারণে তার শরীর কেঁপে উঠছিল। তার পেটে বা নাভিতে ধুলা লেগে গিয়েছিল। এক সাহাবি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা-বাবা আপনার জন্য কোরবান হোক, পাথরটি আমাকে দিন। তিনি বললেন, না, আপনি বরং এ রকম আরেকটি পাথর তুলুন।

মসজিদে কুবা ইসলামে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ মসজিদ। মসজিদে কুবায় নামাজ আদায়ের বিশেষ ফজিলত রয়েছে। নবিজি মাঝে মাঝেই মসজিদে কুবায় নামাজ আদায়ের জন্য যেতেন। সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমে ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে, নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি শনিবার কুবা মসজিদে যেতেন, কখনো হেঁটে, কখনো সওয়ার হয়ে। সহিহ মুসলিমের আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুবা মসজিদে যেতেন, কখনো সওয়ার হয়ে, কখনো হেঁটে, এবং সেখানে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন।

সুনানে তিরমিজিতে উসাইদ ইবনে যুহাইর আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে, নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, মসজিদে কুবায় নামাজ আদায় করা একটি ওমরাহর সমতুল্য। সুনানে নাসাঈতে সাহল ইবনে হুনাইফ (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে, আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি এই মসজিদে (কুবা মসজিদে) আসার উদ্দেশ্যে বের হয় এবং সেখানে গিয়ে নামাজ আদায় করে, সে একটি ওমরাহর সওয়াব লাভ করে।