London ০৭:১৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫, ১১ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম:
সিপিবির ‘গণতন্ত্র অভিযাত্রা’য় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার দাবি কালিয়াকৈরে সড়কের পাশ থেকে বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার রাজধানীতে থানায় হামলা, এসিসহ আহত ৫ ১০ম গ্রেড দাবি যমুনা অভিমুখে সহকারী শিক্ষকরা, শাহবাগে থামালো পুলিশ অপহরণচেষ্টার লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন নায়িকা নিঝুম রুবিনা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের প্রক্রিয়ার ওপর গুরুত্বারোপ ড. ইউনূসের বাংলাদেশ সীমান্তে হঠাৎ ‘অপস অ্যালার্ট’ মহড়া শুরু বিএসএফের ব্যবসায়ীর বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি নগদ টাকাসহ স্বর্ণলঙ্কার লুট পিকনিকে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় নারীদের আগাম সন্তান জন্মদানের হিড়িক

বহু-বিবাহ ও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

অনলাইন ডেস্ক

বহু-বিবাহের প্রথাটি ইসলামপূর্ব যুগেও দুনিয়ার প্রায় সকল ধর্ম মতেই বৈধ বলে বিবেচিত হতো। আরব, ভারতীয় উপমহাদেশ, ইরান, মিশর, ব্যাবিলন প্রভৃতি সব দেশেই এই প্রথার প্রচলন ছিল। বহু-বিবাহের প্রয়োজনীয়তার কথা বর্তমান যুগেও স্বীকৃত। বর্তমানকালে ইউরোপের এক শ্রেণীর চিন্তাবিদ বহু-বিবাহ রহিত করার জন্য তাদের অনুসারীদেরকে উদ্বুদ্ধ করে আসছেন বটে, কিন্তু তাতে কোন সুফল হয়নি। বরং তাতে সমস্যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর ফল রক্ষিতার রুপে প্রকাশ পেয়েছে। অবশেষে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক ব্যবস্হারই বিজয় হয়েছে। তাই আজকে ইউরোপের দুরদর্শী চিন্তাশীল ব্যক্তিরা বহু-বিবাহ পুনঃপ্রচলন করার জন্য চিন্তা-ভাবনা করছেন।
ইসলাম পূর্ব যুগে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই বহু-বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন ধর্ম এবং দেশের ইতিহাস থেকে এটা জানা যায় যে, এর প্রতি কোন প্রকার বাঁধা-নিষেধও ছিল না। ইহুদী, খ্রিষ্টান, আর্য, হিন্দু এবং পারসিকদের মধ্যে বহু-বিবাহ প্রচলিত ছিল। ইসলামের প্রাথমিক যুগেও কোন সংখ্যা নির্ধারণ ছাড়াই এই ব্যবস্হা চালু ছিল। তবে তৎকালে সীমা-সংখ্যাহীন বহু-বিবাহের জন্য অনেকের লোভ-লালসার অন্ত ছিল না। অন্য দিকে এথেকে উদ্ভূত দায়িত্বের ব্যাপারেও তারা সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারত না, বরং এসব স্ত্রীকে তারা রাখত দাসী-বাঁদীর মতো এবং তাদের সাথে যথেচ্ছা ব্যবহার করত। তাদের প্রতি কোন প্রকার ইনসাফ করা হত না। চরম বৈষম্য বিরাজ করত পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে।
অনেক সময়, পছন্দসই দু’ একজনের প্রতি লক্ষ্য রেখে অবশিষ্টদের প্রতি চরম অবহেলা প্রদর্শন করা হত।
ইসলামপূর্ব যুগে পৃথিবীর সর্বত্র একাধিক বিবাহের প্রচলন ছিলো ব্যাপকভাবে। কোনো সভ্যতাই একে দোষণীয় জ্ঞান করতো না ; বরং তা ছিলো ব্যক্তির বীরত্বের প্রতীক। ফলে যার ব্যত্যয় ঘটেনি যুগ শ্রেষ্ঠ নবীগণের ক্ষেত্রেও। বাইবেলে বর্ণিত হয়েছে, ‘সোলায়মান আ.-এর সাতশো স্ত্রী ছিলো, যারা ছিলো রাজপরিবারের মেয়ে; এছাড়া তার তিনশো উপস্ত্রী তথা দাসী ছিলো।’ (বাদশাহনামা-১১/৪) দাউদ আ. -এর স্ত্রী ছিলো নিরানব্বইজন, ইবরাহীম আ. -এর তিনজন, ইয়াকুব এবং মূসা আ. এর চারজন করে। (পয়দায়েশ-২৯/৩০)।
অধুনাও একাধিক বিবাহের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করতে পারেনি কেউ। ইউরোপ আমেরিকার প্রসিদ্ধ খ্রিস্টান গবেষকগণও একাধিক বিবাহকে উত্তম ও যথাযোগ্য বিধান বলে অভিহিত করেছেন। খ্রিস্টান গবেষক মিস্টার ডিউন পোর্ট একাধিক বিবাহের পক্ষে ইনজিলের বিভিন্ন আয়াত উল্লেখ করে বলেন, ‘এসব আয়াতের আলোকে এ কথা সুস্পষ্ট প্রতিভাত হয়, একাধিক বিবাহ শুধু এক উত্তম আমল নয়; বরং তাতে বিধাতার বিশেষ এক রহমত আছে।’ অনুরূপ কথা পাদ্রী ফক্স, নেক্সন, জান মিলটন এবং এ্যাইজাক টেলরও বলেছেন।
এখানে একটি কথা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, ইসলামপূর্ব যুগে একাধিক বিবাহের কোনো সীমারেখা ছিলো না ফলে এক পুরুষের বিবাহে শতাধিক নারীও ছিলো এমনকি কোনো কোনো খ্রিস্টান পাদ্রী হাজারের অধিক নারীকে বিবাহ করেছেন, বিশেষত জার্মানিতে ষোল শতাব্দীর পূর্বে এর ব্যাপক প্রচলন ছিলো। তখনও কোনো ধর্ম এর বিরোধিতা করেনি, ফলে সে যুগে নারীরা তাদের যথার্থ মর্যাদা থেকে বঞ্চিত ছিলো। তারা ছিলো শুধু পুরুষের ইন্দ্রিয় বাসনা চরিতার্থ করার বৈধ পাত্র। সমাজে ছিলো না তাদের কোনো মূল্যায়ন! এরপর পৃথিবীর আকাশে যখন ইসলামের সূর্য উদিত হয়, তখন মানব প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রেখে মহামহিম আল্লাহ তায়ালা একাধিক বিবাহের অনুমতি দেন। নারীজাতিকে মর্যাদার আসনে সমাসীন রাখতে এর সংখ্যাও তিনি নির্ধারণ করে দেন।
ইসলামের বিধান : মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনুল কারীমে মানবজাতির উদ্দেশ্যে ইরশাদ করেন, ‘আর যদি তোমরা ভয় কর যে, এতীম মেয়েদের হক যথাযথভাবে পূরণ করতে পারবে না, তবে সেসব মেয়েদের মধ্য থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরুপ আশঙ্কা কর যে, তাদের মধ্যে ন্যায়-সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে একটিই; অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে; এতেই পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা।’ (সূরা নিসা : ৩)।
আল-কুরআন এই সামাজিক অনাচার এবং জুলুমের প্রতিরোধ করেছে। বহু-বিবাহের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় বিধি-নিষেধও জারি করেছে। ইসলাম একই সময় চার এর অধিক স্ত্রী রাখাকে হারাম ঘোষণা করেছে। ইসলাম এ ক্ষেত্রে ইনসাফ কায়েমের জন্য বিশেষ তাগিদ দিয়েছে এবং ইনসাফের পরিবর্তে জুলুম করা হলে তার জন্য শাস্তির কথা ঘোষণা করেছে। আলোচ্য আয়াতে একাধিক অর্থাৎ, চারজন স্ত্রী গ্রহণ করার সুযোগ অবশ্য দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে এই চার পর্যন্ত কথাটি আরোপ করে তার উর্ধ্ব সংখ্যক কোন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারবে না বরং তা হবে সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ তাও ব্যক্ত করে দেয়া হয়েছে।
মহানবী সা. -এর বহু বিবাহের মাঝে সুপ্ত ছিলো বহু প্রজ্ঞা। ও আল্লাহর নির্দেশ : মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. ছিলেন সত্য পথের দিশারী, গাঢ় অমানিশা বিদূরকারী। তার চরিত্রে ছিলো না কদর্য, ছিলো না কোনো পঙ্কিলতা। তার মর্যাদা সুউচ্চ সপ্ত আকাশের চেয়েও বহু ঊর্ধ্বে। বিন্দু পরিমাণ ত্রুটি নেই তার আদর্শ জীবনীতে। তিনি ছিলেন এক মহামানব, যার তুলনা কখনো মিলবে না নীল আকাশের নীচে! তার আলোকিত জীবন বিশ্ব-মানবতার আদর্শ, ধ্বংসের অতল গহ্বর থেকে মুক্তি ও উত্তরণের পথ। মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ সা. -এর জীবনীতে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সূরা আহযাব : ২১)।
রাসূলুল্লাহ সা. -এর বহু বিবাহের মাঝে সুপ্ত ছিলো বহু প্রজ্ঞা। মহামহিম আল্লাহর নির্দেশেই তিনি এ মহৎ কাজ সম্পাদন করেছেন। আবূ সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ততক্ষণ আমি কোনো নারীকে বিবাহ করিনি এবং আমার মেয়েদেরকে অন্য কারো কাছে বিবাহ দেইনি যতক্ষণ না আমার প্রভুর পক্ষ থেকে জিবরাঈল আ. বিবাহের আদেশ সম্বলিত বার্তা না এনেছেন। (উয়ুনুল আছার-২/৩০০, শরহে মাওয়াহিব-৩/২১৯)। নবী-রাসূলগণ আল্লাহর কিতাব ও মুজিযাপ্রাপ্ত হন। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তাঁরা কোনো কাজ করেন না। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আর তিনি (রাসূল) প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না, বরং যা কিছু বলেন তা সবই (আল্লাহর কাছ থেকে) প্রত্যাদেশ হয়। (সূরা আন-নাজম : ৩-৪)।
মহানবী সা.-এর বহু-বিবাহের অনেক কারণ রয়েছে। তা হলো, দ্বীন প্রচার-প্রসারের মাধ্যম। মহানবী সা. ছিলেন বিশ্বনবী ও রাষ্ট্রনায়ক। চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে ইসলাম ধর্মকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি আদিষ্ট হয়েছেন। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতিকে শামাল দিতে অনেক জটিল সমস্যার সম্মুখীন হন। ফলে মহানবী সা:-এর পক্ষে দ্বীন প্রচার করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাঁর বহু-বিবাহ ধর্মীয় বিধান প্রচার ও প্রসারে বিরাট ভূমিকা রাখে। বহু বিয়ের ফলে বিভিন্ন গোত্রের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। যা রাজনৈতিক জটিলতাকে দূর করে দ্বীন প্রাচারের সুযোগ করে।
যদি সমতা রক্ষা করা সম্ভব না হয় : চারটি পর্যন্ত বিয়ের অনুমতি দেয়ার পর বলা হয়েছে : অর্থাৎ, যদি আশঙ্কা কর যে, স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা করতে পারবে না, তবে এক স্ত্রীতেই তৃপ্ত থাক। পবিত্র কুরআনুল কারীমে চারজন স্ত্রীর কথা বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং সাথে সাথে এও বলে দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমরা তাদের মধ্যে সমতা বিধান তথা ন্যায়বিচার করতে না পার, তাহলে এক স্ত্রীর উপরেই নির্ভর কর। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, একাধিক বিয়ে ঠিক তখনই বৈধ হতে পারে, যখন শরীয়ত মোতাবেক সবার সাথে সমান আচরণ করা হবে; তাদের সবার অধিকার সমভাবে সংরক্ষণ করা হবে। এ ব্যাপারে অপারগ হলে এক স্ত্রীর ওপরই নির্ভর করতে হবে এবং এটাই ইসলামের নির্দেশ।
রাসূলুল্লাহ সা. একাধিক স্ত্রীর বেলায় সবার সাথে পরিপূর্ণ সমতার ব্যবহার করার ব্যাপারে বিশেষভাবে তাগিদ করেছেন এবং যারা এর খেলাফ (ব্যতিক্রম) করবে, তাদের জন্য কঠিন শাস্তির খবর দিয়েছেন। নিজের ব্যবহারিক জীবনেও তিনি এ ব্যাপারে সর্বোত্তম আদর্শ স্হাপন করে দেখিয়েছেন। এমনকি তিনি এমন বিষয়েও সমতাপূর্ণ ব্যবহারের আদর্শ স্হাপন করেছেন যে ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন ছিল না। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তির দুই স্ত্রী রয়েছে, সে যদি এদের মধ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে পূর্ণ সমতা ও ইনসাফ করতে না পারে, তবে কিয়ামতের ময়দানে সে এমনভাবে উঠবে যে, তার শরীরের এক পার্শ্ব অবশ হয়ে থাকবে। (মিশকাত শরীফ, ২৭৮ পৃ.)।
আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ, যদি ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার বজায় রাখতে পারবে না বলে ভয় কর, তবে এক স্ত্রীতেই তৃপ্ত থাক, বলে সে সমস্ত ব্যাপারেই ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেগুলো মানুষের সাধ্যায়ত্ব। এসব ব্যাপারে বেইনসাফী মহাপাপ। আর যাদের এরুপ পাপে জড়িত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাদের পক্ষে একাধিক বিয়ে না করাই কর্তব্য।

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৪:৫৯:২২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫
Translate »

বহু-বিবাহ ও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

আপডেট : ০৪:৫৯:২২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫

বহু-বিবাহের প্রথাটি ইসলামপূর্ব যুগেও দুনিয়ার প্রায় সকল ধর্ম মতেই বৈধ বলে বিবেচিত হতো। আরব, ভারতীয় উপমহাদেশ, ইরান, মিশর, ব্যাবিলন প্রভৃতি সব দেশেই এই প্রথার প্রচলন ছিল। বহু-বিবাহের প্রয়োজনীয়তার কথা বর্তমান যুগেও স্বীকৃত। বর্তমানকালে ইউরোপের এক শ্রেণীর চিন্তাবিদ বহু-বিবাহ রহিত করার জন্য তাদের অনুসারীদেরকে উদ্বুদ্ধ করে আসছেন বটে, কিন্তু তাতে কোন সুফল হয়নি। বরং তাতে সমস্যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর ফল রক্ষিতার রুপে প্রকাশ পেয়েছে। অবশেষে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক ব্যবস্হারই বিজয় হয়েছে। তাই আজকে ইউরোপের দুরদর্শী চিন্তাশীল ব্যক্তিরা বহু-বিবাহ পুনঃপ্রচলন করার জন্য চিন্তা-ভাবনা করছেন।
ইসলাম পূর্ব যুগে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই বহু-বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন ধর্ম এবং দেশের ইতিহাস থেকে এটা জানা যায় যে, এর প্রতি কোন প্রকার বাঁধা-নিষেধও ছিল না। ইহুদী, খ্রিষ্টান, আর্য, হিন্দু এবং পারসিকদের মধ্যে বহু-বিবাহ প্রচলিত ছিল। ইসলামের প্রাথমিক যুগেও কোন সংখ্যা নির্ধারণ ছাড়াই এই ব্যবস্হা চালু ছিল। তবে তৎকালে সীমা-সংখ্যাহীন বহু-বিবাহের জন্য অনেকের লোভ-লালসার অন্ত ছিল না। অন্য দিকে এথেকে উদ্ভূত দায়িত্বের ব্যাপারেও তারা সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারত না, বরং এসব স্ত্রীকে তারা রাখত দাসী-বাঁদীর মতো এবং তাদের সাথে যথেচ্ছা ব্যবহার করত। তাদের প্রতি কোন প্রকার ইনসাফ করা হত না। চরম বৈষম্য বিরাজ করত পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে।
অনেক সময়, পছন্দসই দু’ একজনের প্রতি লক্ষ্য রেখে অবশিষ্টদের প্রতি চরম অবহেলা প্রদর্শন করা হত।
ইসলামপূর্ব যুগে পৃথিবীর সর্বত্র একাধিক বিবাহের প্রচলন ছিলো ব্যাপকভাবে। কোনো সভ্যতাই একে দোষণীয় জ্ঞান করতো না ; বরং তা ছিলো ব্যক্তির বীরত্বের প্রতীক। ফলে যার ব্যত্যয় ঘটেনি যুগ শ্রেষ্ঠ নবীগণের ক্ষেত্রেও। বাইবেলে বর্ণিত হয়েছে, ‘সোলায়মান আ.-এর সাতশো স্ত্রী ছিলো, যারা ছিলো রাজপরিবারের মেয়ে; এছাড়া তার তিনশো উপস্ত্রী তথা দাসী ছিলো।’ (বাদশাহনামা-১১/৪) দাউদ আ. -এর স্ত্রী ছিলো নিরানব্বইজন, ইবরাহীম আ. -এর তিনজন, ইয়াকুব এবং মূসা আ. এর চারজন করে। (পয়দায়েশ-২৯/৩০)।
অধুনাও একাধিক বিবাহের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করতে পারেনি কেউ। ইউরোপ আমেরিকার প্রসিদ্ধ খ্রিস্টান গবেষকগণও একাধিক বিবাহকে উত্তম ও যথাযোগ্য বিধান বলে অভিহিত করেছেন। খ্রিস্টান গবেষক মিস্টার ডিউন পোর্ট একাধিক বিবাহের পক্ষে ইনজিলের বিভিন্ন আয়াত উল্লেখ করে বলেন, ‘এসব আয়াতের আলোকে এ কথা সুস্পষ্ট প্রতিভাত হয়, একাধিক বিবাহ শুধু এক উত্তম আমল নয়; বরং তাতে বিধাতার বিশেষ এক রহমত আছে।’ অনুরূপ কথা পাদ্রী ফক্স, নেক্সন, জান মিলটন এবং এ্যাইজাক টেলরও বলেছেন।
এখানে একটি কথা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, ইসলামপূর্ব যুগে একাধিক বিবাহের কোনো সীমারেখা ছিলো না ফলে এক পুরুষের বিবাহে শতাধিক নারীও ছিলো এমনকি কোনো কোনো খ্রিস্টান পাদ্রী হাজারের অধিক নারীকে বিবাহ করেছেন, বিশেষত জার্মানিতে ষোল শতাব্দীর পূর্বে এর ব্যাপক প্রচলন ছিলো। তখনও কোনো ধর্ম এর বিরোধিতা করেনি, ফলে সে যুগে নারীরা তাদের যথার্থ মর্যাদা থেকে বঞ্চিত ছিলো। তারা ছিলো শুধু পুরুষের ইন্দ্রিয় বাসনা চরিতার্থ করার বৈধ পাত্র। সমাজে ছিলো না তাদের কোনো মূল্যায়ন! এরপর পৃথিবীর আকাশে যখন ইসলামের সূর্য উদিত হয়, তখন মানব প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রেখে মহামহিম আল্লাহ তায়ালা একাধিক বিবাহের অনুমতি দেন। নারীজাতিকে মর্যাদার আসনে সমাসীন রাখতে এর সংখ্যাও তিনি নির্ধারণ করে দেন।
ইসলামের বিধান : মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনুল কারীমে মানবজাতির উদ্দেশ্যে ইরশাদ করেন, ‘আর যদি তোমরা ভয় কর যে, এতীম মেয়েদের হক যথাযথভাবে পূরণ করতে পারবে না, তবে সেসব মেয়েদের মধ্য থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরুপ আশঙ্কা কর যে, তাদের মধ্যে ন্যায়-সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে একটিই; অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে; এতেই পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা।’ (সূরা নিসা : ৩)।
আল-কুরআন এই সামাজিক অনাচার এবং জুলুমের প্রতিরোধ করেছে। বহু-বিবাহের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় বিধি-নিষেধও জারি করেছে। ইসলাম একই সময় চার এর অধিক স্ত্রী রাখাকে হারাম ঘোষণা করেছে। ইসলাম এ ক্ষেত্রে ইনসাফ কায়েমের জন্য বিশেষ তাগিদ দিয়েছে এবং ইনসাফের পরিবর্তে জুলুম করা হলে তার জন্য শাস্তির কথা ঘোষণা করেছে। আলোচ্য আয়াতে একাধিক অর্থাৎ, চারজন স্ত্রী গ্রহণ করার সুযোগ অবশ্য দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে এই চার পর্যন্ত কথাটি আরোপ করে তার উর্ধ্ব সংখ্যক কোন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারবে না বরং তা হবে সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ তাও ব্যক্ত করে দেয়া হয়েছে।
মহানবী সা. -এর বহু বিবাহের মাঝে সুপ্ত ছিলো বহু প্রজ্ঞা। ও আল্লাহর নির্দেশ : মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. ছিলেন সত্য পথের দিশারী, গাঢ় অমানিশা বিদূরকারী। তার চরিত্রে ছিলো না কদর্য, ছিলো না কোনো পঙ্কিলতা। তার মর্যাদা সুউচ্চ সপ্ত আকাশের চেয়েও বহু ঊর্ধ্বে। বিন্দু পরিমাণ ত্রুটি নেই তার আদর্শ জীবনীতে। তিনি ছিলেন এক মহামানব, যার তুলনা কখনো মিলবে না নীল আকাশের নীচে! তার আলোকিত জীবন বিশ্ব-মানবতার আদর্শ, ধ্বংসের অতল গহ্বর থেকে মুক্তি ও উত্তরণের পথ। মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ সা. -এর জীবনীতে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সূরা আহযাব : ২১)।
রাসূলুল্লাহ সা. -এর বহু বিবাহের মাঝে সুপ্ত ছিলো বহু প্রজ্ঞা। মহামহিম আল্লাহর নির্দেশেই তিনি এ মহৎ কাজ সম্পাদন করেছেন। আবূ সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ততক্ষণ আমি কোনো নারীকে বিবাহ করিনি এবং আমার মেয়েদেরকে অন্য কারো কাছে বিবাহ দেইনি যতক্ষণ না আমার প্রভুর পক্ষ থেকে জিবরাঈল আ. বিবাহের আদেশ সম্বলিত বার্তা না এনেছেন। (উয়ুনুল আছার-২/৩০০, শরহে মাওয়াহিব-৩/২১৯)। নবী-রাসূলগণ আল্লাহর কিতাব ও মুজিযাপ্রাপ্ত হন। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তাঁরা কোনো কাজ করেন না। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আর তিনি (রাসূল) প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না, বরং যা কিছু বলেন তা সবই (আল্লাহর কাছ থেকে) প্রত্যাদেশ হয়। (সূরা আন-নাজম : ৩-৪)।
মহানবী সা.-এর বহু-বিবাহের অনেক কারণ রয়েছে। তা হলো, দ্বীন প্রচার-প্রসারের মাধ্যম। মহানবী সা. ছিলেন বিশ্বনবী ও রাষ্ট্রনায়ক। চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে ইসলাম ধর্মকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি আদিষ্ট হয়েছেন। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতিকে শামাল দিতে অনেক জটিল সমস্যার সম্মুখীন হন। ফলে মহানবী সা:-এর পক্ষে দ্বীন প্রচার করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাঁর বহু-বিবাহ ধর্মীয় বিধান প্রচার ও প্রসারে বিরাট ভূমিকা রাখে। বহু বিয়ের ফলে বিভিন্ন গোত্রের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। যা রাজনৈতিক জটিলতাকে দূর করে দ্বীন প্রাচারের সুযোগ করে।
যদি সমতা রক্ষা করা সম্ভব না হয় : চারটি পর্যন্ত বিয়ের অনুমতি দেয়ার পর বলা হয়েছে : অর্থাৎ, যদি আশঙ্কা কর যে, স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা করতে পারবে না, তবে এক স্ত্রীতেই তৃপ্ত থাক। পবিত্র কুরআনুল কারীমে চারজন স্ত্রীর কথা বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং সাথে সাথে এও বলে দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমরা তাদের মধ্যে সমতা বিধান তথা ন্যায়বিচার করতে না পার, তাহলে এক স্ত্রীর উপরেই নির্ভর কর। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, একাধিক বিয়ে ঠিক তখনই বৈধ হতে পারে, যখন শরীয়ত মোতাবেক সবার সাথে সমান আচরণ করা হবে; তাদের সবার অধিকার সমভাবে সংরক্ষণ করা হবে। এ ব্যাপারে অপারগ হলে এক স্ত্রীর ওপরই নির্ভর করতে হবে এবং এটাই ইসলামের নির্দেশ।
রাসূলুল্লাহ সা. একাধিক স্ত্রীর বেলায় সবার সাথে পরিপূর্ণ সমতার ব্যবহার করার ব্যাপারে বিশেষভাবে তাগিদ করেছেন এবং যারা এর খেলাফ (ব্যতিক্রম) করবে, তাদের জন্য কঠিন শাস্তির খবর দিয়েছেন। নিজের ব্যবহারিক জীবনেও তিনি এ ব্যাপারে সর্বোত্তম আদর্শ স্হাপন করে দেখিয়েছেন। এমনকি তিনি এমন বিষয়েও সমতাপূর্ণ ব্যবহারের আদর্শ স্হাপন করেছেন যে ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন ছিল না। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তির দুই স্ত্রী রয়েছে, সে যদি এদের মধ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে পূর্ণ সমতা ও ইনসাফ করতে না পারে, তবে কিয়ামতের ময়দানে সে এমনভাবে উঠবে যে, তার শরীরের এক পার্শ্ব অবশ হয়ে থাকবে। (মিশকাত শরীফ, ২৭৮ পৃ.)।
আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ, যদি ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার বজায় রাখতে পারবে না বলে ভয় কর, তবে এক স্ত্রীতেই তৃপ্ত থাক, বলে সে সমস্ত ব্যাপারেই ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেগুলো মানুষের সাধ্যায়ত্ব। এসব ব্যাপারে বেইনসাফী মহাপাপ। আর যাদের এরুপ পাপে জড়িত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাদের পক্ষে একাধিক বিয়ে না করাই কর্তব্য।