London ০৬:৩৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

এনসিপিতে পদ পেতে ‘চাকরি ছাড়তেও প্রস্তুত’ প্রাথমিক শিক্ষকরা

অনলাইন ডেস্ক:

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর চরনুনখাওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হাফিজুর রহমান জুয়েল। শিক্ষকতার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে তিনি স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িত। ছিলেন যুবদলের জেলা কমিটির নেতা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুবদল ছেড়ে যোগ দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টিতে (এনসিপি)। পরিচয় দেন নাগেশ্বরী উপজেলা কমিটির আহ্বায়ক। শিগগির জেলা কমিটি হবে। সেখানে ভালো পদ পাবেন বলেও আশাবাদী।

তার ভাষ্য, ‘খুব তাড়াতাড়ি এনসিপির কুড়িগ্রাম জেলা কমিটি হবে। আশা করছি, সেখানে খুব ভালো পদ পাবো। আপনারা দোয়া করবেন যেন এগিয়ে যেতে পারি।’

শুধু হাফিজুর রহমান নন, দেশের বিভিন্ন জেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ‘শিক্ষকতা’ ছেড়ে এখন রাজনীতির দিকে ঝুঁকছেন। তাদের অধিকাংশই বেছে নিচ্ছেন এনসিপি। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে এ প্রবণতা বেশি। অথচ সরকারি চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী— সরকারি কর্মচারীরা কোনো রাজনৈতিক দল বা অঙ্গসংগঠনে সম্পৃক্তই হতে পারবেন না।

তাহলে কীভাবে তাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূরণ হবে? এমন প্রশ্নে রাজনীতিতে জড়ানো শিক্ষকদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের সোজাসাপ্টা উত্তর ‘পদ পেলেই চাকরি ছেড়ে দেবো। রিজাইন লেটারও রেডি (পদত্যাগপত্র প্রস্তুত)।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুড়িগ্রামের দুটি উপজেলার আহ্বায়ক বা সভাপতি হতে জোর তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন দুজন প্রাথমিক শিক্ষক। তারা হলেন— নাগেশ্বরীর চরনুনখাওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হাফিজুর রহমান জুয়েল এবং রাজারহাটের আবুল কাশেম বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মুনিবুল হক বসুনিয়া।

মুনিবুল হক জাতীয় নাগরিক কমিটির রাজারহাট উপজেলার আহ্বায়ক। এখন এনসিপির আহ্বায়ক পরিচয় দেন। আর হাফিজুর রহমান পরিচয় দেন নাগেশ্বরী উপজেলার আহ্বায়ক। সম্প্রতি উপজেলা ও জেলাপর্যায়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন তারা। এনসিপির কমিটি গঠন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় এ দুই শিক্ষক। কুড়িগ্রামের আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষককেও এনসিপির কর্মসূচিতে দেখা যাচ্ছে।

হাফিজুর রহমান জুয়েল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন রাজনীতি করি। যুবদলে ছিলাম…এ কারণে ফ্যাসিস্ট আসলাম এমপি আমাকে ফাঁসিয়েছিলেন। হাসিনার আমলে আমার বিরুদ্ধে ১২টা মামলা হয়েছিল। সে কারণে আমাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। আমার মামলাগুলো শেষের দিকে…১২টার মধ্যে ১০টি মামলা খারিজ হয়ে গেছে। দুটি মামলা আছে। মামলা দুটি শেষ হলে আমি প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে গিয়ে রিজাইন করবো। আমি রাজনীতিতে পুরোপুরি সক্রিয় থাকতে চাইছি।’

যুবদল ছেড়ে এনসিপিতে কেন— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘১৫-১৬ বছর টানা ক্ষমতায় থেকেও আওয়ামী লীগ এখন ধূলিস্যাৎ। বিএনপিরও আমি ভবিষ্যৎ দেখছি না। সেজন্য চব্বিশের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এনসিপিতে কাজ করছি। এ দলের হয়ে আমার এলাকার মানুষের জন্য কাজ করতে চাই।’

আরেক শিক্ষক মুনিবুল হক বসুনিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি এনসিপিতে আছি। কেন্দ্র থেকে কোনো লিখিত কমিটি এখানে এখনো হয়নি। নাগরিক কমিটিতে ছিলাম। সেখান থেকে এখন এনসিপিও চালাচ্ছি।’

সরকারি চাকরিতে থেকে রাজনীতিতে জড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এনসিপি এখনো নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়নি। নিবন্ধন পেলে তখন আমি আমার অবস্থান জানাবো যে আমি শিক্ষকতা করবো নাকি এনসিপিতে যাবো।’

বগুড়া-ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড়েও এনসিপিতে শিক্ষকরা

কুড়িগ্রামের দুই শিক্ষকের এনসিপির নেতা হওয়ার দৌড়ঝাঁপের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে সামনে এসেছে আরও কয়েকটি জেলার শিক্ষকদের রাজনীতিতে জড়ানোর তথ্য। খোদ জেলা ও উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছেও রয়েছে তালিকা।

নাম প্রকাশ না করে উত্তরবঙ্গের একটি জেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, স্থানীয়ভাবে বিএনপি ও জামায়াতের অনেকেই জড়িত। আগেও আওয়ামী লীগে ছিল অনেকে। তারা পদ-পদবি নিতো না। এখন যারা এনসিপিতে যাচ্ছেন, তারা সরাসরি পদে বসতে চাচ্ছেন। এ কারণে বিষয়গুলো সামনে আসছে।

তার দেওয়া তথ্যমতে, উত্তরাঞ্চলের তিন জেলা বগুড়া, ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড়ে অন্তত ১০ জন প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক এবং ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এনসিপিতে যোগ দিতে মরিয়া। পদ পেলেই তারা চাকরি ছাড়বেন। আগামীতে স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন পরিচালক নাম-পরিচয় প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায়ই এ নিয়ে তালিকা আসছে। রাজনীতিতে জড়িয়ে চাকরিবিধি ভাঙলেও উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা এ নিয়ে কোনো শোকজ করতে সাহস পাচ্ছেন না। কারণ তারা সবাই নতুন দল এনসিপিতে সক্রিয়।’

কতজনের তালিকা এসেছে—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলার ১৭ জনের তালিকা পেয়েছি। আলাদা আলাদাভাবে এসেছে সেগুলো। আসার পর আমরাও কোনো পদক্ষেপ নেইনি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মতামত ছাড়া এ নিয়ে চিঠি ইস্যু করা ঠিক হবে না বলে সবাই মনে করছেন। এজন্য বিষয়টি চাপা পড়ে আছে।’

‘ভালো পদ পেলে স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়বো’

গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্রদের নেতৃত্বে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করা হয়। জাতীয় নাগরিক কমিটি সারাদেশে সেসময় কমিটি দিয়েছিল। এটি যেহেতু রাজনৈতিক সংগঠন নয়, সেজন্য কমিটিতে নাম লেখান শিক্ষকসহ বহু পেশাজীবী। অনেক জেলা ও উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তখন জেলা কিংবা উপজেলা কমিটির আহ্বায়ক হন। এর মধ্যদিয়ে তাদের রাজনৈতিক স্পৃহা তৈরি হয়।

রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপি যাত্রা শুরুর পর থেকে পুরোদমে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার বাসনা পেয়ে বসে শিক্ষকদের। এখন চাকরি ছেড়ে হলেও রাজনীতিতে থাকতে চান তারা। বগুড়ার কাহালু উপজেলার একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রোগ্রামে নিয়মিত যাচ্ছি। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে আমরা মাঠে থেকে বিদায় করেছি। এ স্মৃতি ধরে রাখতে রাজনীতিতে থাকতে চাচ্ছি। পরিবারও সায় দিয়েছে। ভালো পদ পেলে এনসিপিতে রাজনীতি করবো। তখন শিক্ষক পদ থেকে পদত্যাগ করবো।’

‘কিছুই জানেন না’ দাবি শিক্ষা কর্মকর্তাদের

উপজেলা ও জেলার শিক্ষকরা সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন, নিয়মিত মিটিং-মিছিল ও সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন; তারপরও বিষয়টি নিয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন স্ব স্ব জেলা ও উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তারা।

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. লুৎফর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কারও রাজনীতিতে জড়ানোর বিষয়ে আমি অবগত নই। যদি এ বিষয়ে কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

একই কথা বলেন রাজারহাট উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শরীফ আহমেদও।

জানতে চাইলে কুড়িগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা স্বপন কুমার রায় চৌধুরী বলেন, ‘উপজেলা পর্যায় থেকে কোনো চিঠি বা অভিযোগ এলে আমরা সেটা নিয়ে ব্যবস্থা নিই। তারা যদি আমাদের না জানান, তাহলে আমরা কীভাবে জানবো?’

চাকরি বিধিমালা লঙ্ঘন করলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ার করেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) আবু নূর মো. শামসুজ্জামান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘কেউ যদি চাকরি ছেড়ে দিতে চান, সেটা তো ঠেকানোর উপায় নেই। তবে কেউ চাকরিতে থাকা অবস্থায় রাজনীতিতে জড়ালে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে বাড়তি সুবিধা দেওয়া হবে না।’

নিয়ম মেনে এলে স্বাগত জানাবে এনসিপি

শুধু শিক্ষক নন, যে কোনো পেশাজীবী এনসিপিতে রাজনীতি করতে চাইলে তাদের স্বাগত জানাবে নতুন এ দলটি। সেক্ষেত্রে নিয়ম-কানুন মেনে দলে আসতে হবে। সরকারি চাকরিরত কেউ বিধি ভেঙে দলে আসুক, তা চান না কেন্দ্রীয় নেতারা।

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এখনো কোনো জেলা বা উপজেলায় কমিটি দেইনি। কমিটি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। সেখানে হয়তো জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যারা ছিলেন, তাদের বিবেচনায় রাখা হয়েছে। কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ থাকতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিগত ১৫ বছর ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে মসজিদের ইমাম, স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক থেকে শুরু করে এমন কোনো পেশাজীবী নেই, যাদের জোর করে আওয়ামী লীগ করতে বাধ্য করা হয়নি। আমরা সেই পথে হাঁটবো না। রাজনীতি করতে চাওয়াটা কারও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। যদি কেউ এনসিপিতে আসতে চান, আমরা স্বাগত জানাবো। সেক্ষেত্রে অবশ্যই নিয়ম মেনে আসতে হবে।’

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০২:১৬:২৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ মে ২০২৫
Translate »

এনসিপিতে পদ পেতে ‘চাকরি ছাড়তেও প্রস্তুত’ প্রাথমিক শিক্ষকরা

আপডেট : ০২:১৬:২৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ মে ২০২৫

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর চরনুনখাওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হাফিজুর রহমান জুয়েল। শিক্ষকতার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে তিনি স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িত। ছিলেন যুবদলের জেলা কমিটির নেতা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুবদল ছেড়ে যোগ দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টিতে (এনসিপি)। পরিচয় দেন নাগেশ্বরী উপজেলা কমিটির আহ্বায়ক। শিগগির জেলা কমিটি হবে। সেখানে ভালো পদ পাবেন বলেও আশাবাদী।

তার ভাষ্য, ‘খুব তাড়াতাড়ি এনসিপির কুড়িগ্রাম জেলা কমিটি হবে। আশা করছি, সেখানে খুব ভালো পদ পাবো। আপনারা দোয়া করবেন যেন এগিয়ে যেতে পারি।’

শুধু হাফিজুর রহমান নন, দেশের বিভিন্ন জেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ‘শিক্ষকতা’ ছেড়ে এখন রাজনীতির দিকে ঝুঁকছেন। তাদের অধিকাংশই বেছে নিচ্ছেন এনসিপি। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে এ প্রবণতা বেশি। অথচ সরকারি চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী— সরকারি কর্মচারীরা কোনো রাজনৈতিক দল বা অঙ্গসংগঠনে সম্পৃক্তই হতে পারবেন না।

তাহলে কীভাবে তাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূরণ হবে? এমন প্রশ্নে রাজনীতিতে জড়ানো শিক্ষকদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের সোজাসাপ্টা উত্তর ‘পদ পেলেই চাকরি ছেড়ে দেবো। রিজাইন লেটারও রেডি (পদত্যাগপত্র প্রস্তুত)।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুড়িগ্রামের দুটি উপজেলার আহ্বায়ক বা সভাপতি হতে জোর তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন দুজন প্রাথমিক শিক্ষক। তারা হলেন— নাগেশ্বরীর চরনুনখাওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হাফিজুর রহমান জুয়েল এবং রাজারহাটের আবুল কাশেম বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মুনিবুল হক বসুনিয়া।

মুনিবুল হক জাতীয় নাগরিক কমিটির রাজারহাট উপজেলার আহ্বায়ক। এখন এনসিপির আহ্বায়ক পরিচয় দেন। আর হাফিজুর রহমান পরিচয় দেন নাগেশ্বরী উপজেলার আহ্বায়ক। সম্প্রতি উপজেলা ও জেলাপর্যায়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন তারা। এনসিপির কমিটি গঠন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় এ দুই শিক্ষক। কুড়িগ্রামের আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষককেও এনসিপির কর্মসূচিতে দেখা যাচ্ছে।

হাফিজুর রহমান জুয়েল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন রাজনীতি করি। যুবদলে ছিলাম…এ কারণে ফ্যাসিস্ট আসলাম এমপি আমাকে ফাঁসিয়েছিলেন। হাসিনার আমলে আমার বিরুদ্ধে ১২টা মামলা হয়েছিল। সে কারণে আমাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। আমার মামলাগুলো শেষের দিকে…১২টার মধ্যে ১০টি মামলা খারিজ হয়ে গেছে। দুটি মামলা আছে। মামলা দুটি শেষ হলে আমি প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে গিয়ে রিজাইন করবো। আমি রাজনীতিতে পুরোপুরি সক্রিয় থাকতে চাইছি।’

যুবদল ছেড়ে এনসিপিতে কেন— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘১৫-১৬ বছর টানা ক্ষমতায় থেকেও আওয়ামী লীগ এখন ধূলিস্যাৎ। বিএনপিরও আমি ভবিষ্যৎ দেখছি না। সেজন্য চব্বিশের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এনসিপিতে কাজ করছি। এ দলের হয়ে আমার এলাকার মানুষের জন্য কাজ করতে চাই।’

আরেক শিক্ষক মুনিবুল হক বসুনিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি এনসিপিতে আছি। কেন্দ্র থেকে কোনো লিখিত কমিটি এখানে এখনো হয়নি। নাগরিক কমিটিতে ছিলাম। সেখান থেকে এখন এনসিপিও চালাচ্ছি।’

সরকারি চাকরিতে থেকে রাজনীতিতে জড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এনসিপি এখনো নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়নি। নিবন্ধন পেলে তখন আমি আমার অবস্থান জানাবো যে আমি শিক্ষকতা করবো নাকি এনসিপিতে যাবো।’

বগুড়া-ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড়েও এনসিপিতে শিক্ষকরা

কুড়িগ্রামের দুই শিক্ষকের এনসিপির নেতা হওয়ার দৌড়ঝাঁপের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে সামনে এসেছে আরও কয়েকটি জেলার শিক্ষকদের রাজনীতিতে জড়ানোর তথ্য। খোদ জেলা ও উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছেও রয়েছে তালিকা।

নাম প্রকাশ না করে উত্তরবঙ্গের একটি জেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, স্থানীয়ভাবে বিএনপি ও জামায়াতের অনেকেই জড়িত। আগেও আওয়ামী লীগে ছিল অনেকে। তারা পদ-পদবি নিতো না। এখন যারা এনসিপিতে যাচ্ছেন, তারা সরাসরি পদে বসতে চাচ্ছেন। এ কারণে বিষয়গুলো সামনে আসছে।

তার দেওয়া তথ্যমতে, উত্তরাঞ্চলের তিন জেলা বগুড়া, ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড়ে অন্তত ১০ জন প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক এবং ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এনসিপিতে যোগ দিতে মরিয়া। পদ পেলেই তারা চাকরি ছাড়বেন। আগামীতে স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন পরিচালক নাম-পরিচয় প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায়ই এ নিয়ে তালিকা আসছে। রাজনীতিতে জড়িয়ে চাকরিবিধি ভাঙলেও উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা এ নিয়ে কোনো শোকজ করতে সাহস পাচ্ছেন না। কারণ তারা সবাই নতুন দল এনসিপিতে সক্রিয়।’

কতজনের তালিকা এসেছে—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলার ১৭ জনের তালিকা পেয়েছি। আলাদা আলাদাভাবে এসেছে সেগুলো। আসার পর আমরাও কোনো পদক্ষেপ নেইনি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মতামত ছাড়া এ নিয়ে চিঠি ইস্যু করা ঠিক হবে না বলে সবাই মনে করছেন। এজন্য বিষয়টি চাপা পড়ে আছে।’

‘ভালো পদ পেলে স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়বো’

গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্রদের নেতৃত্বে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করা হয়। জাতীয় নাগরিক কমিটি সারাদেশে সেসময় কমিটি দিয়েছিল। এটি যেহেতু রাজনৈতিক সংগঠন নয়, সেজন্য কমিটিতে নাম লেখান শিক্ষকসহ বহু পেশাজীবী। অনেক জেলা ও উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তখন জেলা কিংবা উপজেলা কমিটির আহ্বায়ক হন। এর মধ্যদিয়ে তাদের রাজনৈতিক স্পৃহা তৈরি হয়।

রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপি যাত্রা শুরুর পর থেকে পুরোদমে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার বাসনা পেয়ে বসে শিক্ষকদের। এখন চাকরি ছেড়ে হলেও রাজনীতিতে থাকতে চান তারা। বগুড়ার কাহালু উপজেলার একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রোগ্রামে নিয়মিত যাচ্ছি। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে আমরা মাঠে থেকে বিদায় করেছি। এ স্মৃতি ধরে রাখতে রাজনীতিতে থাকতে চাচ্ছি। পরিবারও সায় দিয়েছে। ভালো পদ পেলে এনসিপিতে রাজনীতি করবো। তখন শিক্ষক পদ থেকে পদত্যাগ করবো।’

‘কিছুই জানেন না’ দাবি শিক্ষা কর্মকর্তাদের

উপজেলা ও জেলার শিক্ষকরা সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন, নিয়মিত মিটিং-মিছিল ও সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন; তারপরও বিষয়টি নিয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন স্ব স্ব জেলা ও উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তারা।

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. লুৎফর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কারও রাজনীতিতে জড়ানোর বিষয়ে আমি অবগত নই। যদি এ বিষয়ে কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

একই কথা বলেন রাজারহাট উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শরীফ আহমেদও।

জানতে চাইলে কুড়িগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা স্বপন কুমার রায় চৌধুরী বলেন, ‘উপজেলা পর্যায় থেকে কোনো চিঠি বা অভিযোগ এলে আমরা সেটা নিয়ে ব্যবস্থা নিই। তারা যদি আমাদের না জানান, তাহলে আমরা কীভাবে জানবো?’

চাকরি বিধিমালা লঙ্ঘন করলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ার করেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) আবু নূর মো. শামসুজ্জামান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘কেউ যদি চাকরি ছেড়ে দিতে চান, সেটা তো ঠেকানোর উপায় নেই। তবে কেউ চাকরিতে থাকা অবস্থায় রাজনীতিতে জড়ালে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে বাড়তি সুবিধা দেওয়া হবে না।’

নিয়ম মেনে এলে স্বাগত জানাবে এনসিপি

শুধু শিক্ষক নন, যে কোনো পেশাজীবী এনসিপিতে রাজনীতি করতে চাইলে তাদের স্বাগত জানাবে নতুন এ দলটি। সেক্ষেত্রে নিয়ম-কানুন মেনে দলে আসতে হবে। সরকারি চাকরিরত কেউ বিধি ভেঙে দলে আসুক, তা চান না কেন্দ্রীয় নেতারা।

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এখনো কোনো জেলা বা উপজেলায় কমিটি দেইনি। কমিটি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। সেখানে হয়তো জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যারা ছিলেন, তাদের বিবেচনায় রাখা হয়েছে। কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ থাকতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিগত ১৫ বছর ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে মসজিদের ইমাম, স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক থেকে শুরু করে এমন কোনো পেশাজীবী নেই, যাদের জোর করে আওয়ামী লীগ করতে বাধ্য করা হয়নি। আমরা সেই পথে হাঁটবো না। রাজনীতি করতে চাওয়াটা কারও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। যদি কেউ এনসিপিতে আসতে চান, আমরা স্বাগত জানাবো। সেক্ষেত্রে অবশ্যই নিয়ম মেনে আসতে হবে।’