London ১০:১০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে ভাঙছে নদী

‘প্রতি রাতে একটি অসাধু চক্র বালু নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু তুলে বিক্রি করে। সম্প্রতি আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাদের তথ্য চেয়ে পোস্ট করেছিলাম। এ কারণে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান রুবেল ভূঁইয়ার আস্থাভাজন একটি রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা লিটন আমাকে ফোনে হুমকি দেন। এমন কিছু ফেসবুকে পোস্ট করলে আমাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এ বিষয়ে প্রশাসনের নজরদারি নেই বললেই চলে।’ কথাগুলো কলমাকান্দা উপজেলার সিধলী গ্রামের কায়েস আহমেদের।

নেত্রকোনার বিভিন্ন স্থানে নদ-নদী থেকে রাতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে অসাধু চক্র। আদালতের নিষেধাজ্ঞাও মানছে না তারা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফসলি জমি, বসতবাড়িসহ নানান স্থাপনা। প্রাকৃতিক পরিবেশও হুমকিতে রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সামনে এ কার্যক্রম চললেও ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না। প্রশাসন ব্যবস্থা না নেওয়ায় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা। কায়েসের মতো কেউ প্রতিবাদ করলে হুমকি দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জেলার বিভিন্ন নদী থেকে প্রতি রাতে অন্তত অর্ধকোটি টাকার বালু লুট হচ্ছে। মামলা-সংক্রান্ত জটিলতায় বালুমহালের ইজারা হচ্ছে না। এর সুবিধা নিচ্ছে প্রভাবশালীরা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এতদিন নিষ্ক্রিয় থাকা কিছু ব্যক্তি নতুন করে এ কাজে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। সোমেশ্বরী, কংশ, গুমাই, ধলাই, উদ্ধাখালী, ধনুসহ সদর, কলমাকান্দা, খালিয়াজুরী ও দুর্গাপুরের নদ-নদী থেকে এভাবে লুট হচ্ছে বালু। ফলে ভাঙন দেখা দেওয়ায় জমি ও বাড়িঘর হারিয়ে অনেকে নিঃস্ব হচ্ছেন।

স্থানীয় প্রশাসন মাঝেমধ্যে উত্তোলন করা বালু জব্দ করে নিলামে বিক্রি করছে। তবে এতে উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, সদর, কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরে সাতটি বালুমহাল রয়েছে। এগুলো থেকে প্রতি বছর ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা রাজস্ব পেত সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা এবং পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ২০১৫ সালে নদী থেকে বালু উত্তোলন নিয়ে একটি রিট করেছিলেন।

রিটে উল্লেখ করা হয়, পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়ায় বালু উত্তোলন করা হচ্ছে না। পরে রিট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নেত্রকোনার বিভিন্ন বালুমহালের ইজারা প্রক্রিয়া বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। তবে বন্ধ হয়নি বালু উত্তোলন। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলা পাঁচপাই, বাঘরোয়া ও তাতিয়র গ্রামে কংশ নদ থেকে ৩-৪টি নৌকায় প্রতি রাতে বালু উত্তোলন করা হয়। কলমাকান্দার সিধলী এলাকায় ১৫-২০টি নৌকায় তোলা হচ্ছে। দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদীর কয়েকটি স্থানে রাত হলেই সক্রিয় হন উত্তোলনকারীরা। এসব এলাকায় প্রতি রাতে ৪০-৫০টি নৌকা (বাল্কহেড) বোঝাই করা হয়।

প্রতিটিতে ১ থেকে দেড় লাখ টাকার বালু তোলা সম্ভব। এসব রাতে তুলে নদীতীরে স্তূপ করে রাখা হয়। পরে সেখান থেকে বিক্রি করেন প্রভাবশালীরা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে দু-একবার প্রশাসন অভিযান চালালেও হামলার শিকার হয়েছে। সম্প্রতি দুর্গাপুরের সহকারী কমিশনারের (ভূমি) ওপর হামলা হলে তারা ফির যান।

সদর উপজেলার মেদনী ইউনিয়নের বড়ওয়ারী, ঠাকুরাকোনা ইউনিয়নের বাঘরুয়া, পাঁচপাই, বারহাট্টার দশধার ও কলমাকান্দার সিধলী এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, নদীতীরে বালু স্তূপাকারে রাখা হয়েছে। কয়েকটি স্থানে রাস্তার পাশে বালু রাখায় যানবাহন ও পথচারীদের চলাচলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সদরের বাঘরোয়া গ্রামের আরিফ তালুকদার ও তুহিন তালুকদারের ভাষ্য, স্থানীয় কিছু ব্যক্তির সহযোগিতায় প্রতিরাতে প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে বালু তুলে নৌকায় নিয়ে যান। এতে নদীভাঙন বেড়েছে।

আগে স্থানীয় কিছু লোক নদী থেকে বালু তুলে বিক্রি করতো জানিয়ে একই এলাকার বিএনপি নেতা বাহার উদ্দিন সেলিম বলেন, এখনও মাঝেমধ্যে উত্তোলন হয় বলে শুনেছেন। কিন্তু কারা এতে জড়িত, তা জানেন না।

এ বিষয়ে কলমাকান্দা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও কৈলাটি ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান রুবেল ভূঁইয়ার বক্তব্য জানা যায়নি। তবে তাঁর সমর্থক ১ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি লিটন ভূঁইয়া বলেন, আগে আওয়ামী লীগের লোকজন বালু তুলে বিক্রি করত। এখন বিএনপির নেতাকর্মীরা রাতে পাহারা দেন। যুবককে হুমকি দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, ফেসবুক পোস্ট নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছিল। পরে মীমাংসা করা হয়েছে।

দলের যুগ্ম আহ্বায়ক রুবেল ভূঁইয়ার বালু উত্তোলন করে বিক্রির বিষয়ে শুনেছেন জানিয়ে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এম এ খায়ের বলেন, এলাকার লোকজন তাঁর পক্ষে রয়েছে। তাঁর ভাই ইউনিয়ন বিএনপির যুববিষয়ক সম্পাদক জুয়েল ভূঁইয়াকে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে বহিষ্কার করা হয়েছে।

আদালতের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও কিছু মানুষের নদী থেকে বালু তোলা দুঃখজনক উল্লেখ করে বারসিকের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী অহিদুর রহমান বলেন, এতে প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নদীতে ভাঙন দেখা দিচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। 

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৪:০৮:৪৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
৬০
Translate »

অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে ভাঙছে নদী

আপডেট : ০৪:০৮:৪৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

‘প্রতি রাতে একটি অসাধু চক্র বালু নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু তুলে বিক্রি করে। সম্প্রতি আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাদের তথ্য চেয়ে পোস্ট করেছিলাম। এ কারণে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান রুবেল ভূঁইয়ার আস্থাভাজন একটি রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা লিটন আমাকে ফোনে হুমকি দেন। এমন কিছু ফেসবুকে পোস্ট করলে আমাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এ বিষয়ে প্রশাসনের নজরদারি নেই বললেই চলে।’ কথাগুলো কলমাকান্দা উপজেলার সিধলী গ্রামের কায়েস আহমেদের।

নেত্রকোনার বিভিন্ন স্থানে নদ-নদী থেকে রাতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে অসাধু চক্র। আদালতের নিষেধাজ্ঞাও মানছে না তারা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফসলি জমি, বসতবাড়িসহ নানান স্থাপনা। প্রাকৃতিক পরিবেশও হুমকিতে রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সামনে এ কার্যক্রম চললেও ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না। প্রশাসন ব্যবস্থা না নেওয়ায় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা। কায়েসের মতো কেউ প্রতিবাদ করলে হুমকি দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জেলার বিভিন্ন নদী থেকে প্রতি রাতে অন্তত অর্ধকোটি টাকার বালু লুট হচ্ছে। মামলা-সংক্রান্ত জটিলতায় বালুমহালের ইজারা হচ্ছে না। এর সুবিধা নিচ্ছে প্রভাবশালীরা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এতদিন নিষ্ক্রিয় থাকা কিছু ব্যক্তি নতুন করে এ কাজে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। সোমেশ্বরী, কংশ, গুমাই, ধলাই, উদ্ধাখালী, ধনুসহ সদর, কলমাকান্দা, খালিয়াজুরী ও দুর্গাপুরের নদ-নদী থেকে এভাবে লুট হচ্ছে বালু। ফলে ভাঙন দেখা দেওয়ায় জমি ও বাড়িঘর হারিয়ে অনেকে নিঃস্ব হচ্ছেন।

স্থানীয় প্রশাসন মাঝেমধ্যে উত্তোলন করা বালু জব্দ করে নিলামে বিক্রি করছে। তবে এতে উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, সদর, কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরে সাতটি বালুমহাল রয়েছে। এগুলো থেকে প্রতি বছর ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা রাজস্ব পেত সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা এবং পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ২০১৫ সালে নদী থেকে বালু উত্তোলন নিয়ে একটি রিট করেছিলেন।

রিটে উল্লেখ করা হয়, পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়ায় বালু উত্তোলন করা হচ্ছে না। পরে রিট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নেত্রকোনার বিভিন্ন বালুমহালের ইজারা প্রক্রিয়া বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। তবে বন্ধ হয়নি বালু উত্তোলন। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলা পাঁচপাই, বাঘরোয়া ও তাতিয়র গ্রামে কংশ নদ থেকে ৩-৪টি নৌকায় প্রতি রাতে বালু উত্তোলন করা হয়। কলমাকান্দার সিধলী এলাকায় ১৫-২০টি নৌকায় তোলা হচ্ছে। দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদীর কয়েকটি স্থানে রাত হলেই সক্রিয় হন উত্তোলনকারীরা। এসব এলাকায় প্রতি রাতে ৪০-৫০টি নৌকা (বাল্কহেড) বোঝাই করা হয়।

প্রতিটিতে ১ থেকে দেড় লাখ টাকার বালু তোলা সম্ভব। এসব রাতে তুলে নদীতীরে স্তূপ করে রাখা হয়। পরে সেখান থেকে বিক্রি করেন প্রভাবশালীরা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে দু-একবার প্রশাসন অভিযান চালালেও হামলার শিকার হয়েছে। সম্প্রতি দুর্গাপুরের সহকারী কমিশনারের (ভূমি) ওপর হামলা হলে তারা ফির যান।

সদর উপজেলার মেদনী ইউনিয়নের বড়ওয়ারী, ঠাকুরাকোনা ইউনিয়নের বাঘরুয়া, পাঁচপাই, বারহাট্টার দশধার ও কলমাকান্দার সিধলী এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, নদীতীরে বালু স্তূপাকারে রাখা হয়েছে। কয়েকটি স্থানে রাস্তার পাশে বালু রাখায় যানবাহন ও পথচারীদের চলাচলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সদরের বাঘরোয়া গ্রামের আরিফ তালুকদার ও তুহিন তালুকদারের ভাষ্য, স্থানীয় কিছু ব্যক্তির সহযোগিতায় প্রতিরাতে প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে বালু তুলে নৌকায় নিয়ে যান। এতে নদীভাঙন বেড়েছে।

আগে স্থানীয় কিছু লোক নদী থেকে বালু তুলে বিক্রি করতো জানিয়ে একই এলাকার বিএনপি নেতা বাহার উদ্দিন সেলিম বলেন, এখনও মাঝেমধ্যে উত্তোলন হয় বলে শুনেছেন। কিন্তু কারা এতে জড়িত, তা জানেন না।

এ বিষয়ে কলমাকান্দা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও কৈলাটি ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান রুবেল ভূঁইয়ার বক্তব্য জানা যায়নি। তবে তাঁর সমর্থক ১ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি লিটন ভূঁইয়া বলেন, আগে আওয়ামী লীগের লোকজন বালু তুলে বিক্রি করত। এখন বিএনপির নেতাকর্মীরা রাতে পাহারা দেন। যুবককে হুমকি দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, ফেসবুক পোস্ট নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছিল। পরে মীমাংসা করা হয়েছে।

দলের যুগ্ম আহ্বায়ক রুবেল ভূঁইয়ার বালু উত্তোলন করে বিক্রির বিষয়ে শুনেছেন জানিয়ে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এম এ খায়ের বলেন, এলাকার লোকজন তাঁর পক্ষে রয়েছে। তাঁর ভাই ইউনিয়ন বিএনপির যুববিষয়ক সম্পাদক জুয়েল ভূঁইয়াকে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে বহিষ্কার করা হয়েছে।

আদালতের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও কিছু মানুষের নদী থেকে বালু তোলা দুঃখজনক উল্লেখ করে বারসিকের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী অহিদুর রহমান বলেন, এতে প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নদীতে ভাঙন দেখা দিচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে।