London ০৪:১০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শীতে বেড়েছে ঠান্ডাজনিত রোগের প্রকোপ, বেশি ভুগছে শিশুরা

অনলাইন ডেস্ক

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের নিউমোনিয়া ওয়ার্ডে বিছানায় শুয়ে আছে তিন বছর বয়সী আনিশা। নরসিংদীর বেলাবো উপজেলা থেকে এসেছে সে। নাকে অক্সিজেনের নল, হাতে লাগানো রয়েছে ক্যানুলা। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার।

পাশে বসে আনিশার যত্ন নিচ্ছিলেন মা শাহিনুর আক্তার। আনিশা ২৬ নভেম্বর থেকে এই ওয়ার্ডে ভর্তি বলে জানান তিনি। জাগো নিউজকে শাহিনুর আক্তার বলেন, ‘যখন এক বছর বয়স, সেসময় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয় আনিশা। এবার নিউমোনিয়া ও হাঁপানির সমস্যায় তিন দিন আইসিইউতে ছিল। অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। এখন শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হয়নি।’

শীতের আগমনের পর থেকে বেড়েছে নিউমোনিয়াসহ শীতকালীন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ৬৮১ শয্যার হাসপাতালে নিউমোনিয়া রোগীদের জন্য আছে ১৯ শয্যা। সবগুলোতেই রোগী ভর্তি আছে। এছাড়া বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছে এক হাজার ২০০ শিশু।

শাহিনুর আক্তার বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার মেয়ের শ্বাসকষ্ট ছিল। প্রতি বছর শীত মৌসুমে তার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এবার যখন অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠলো, তখন আমরা তাকে শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসি।’

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শিশু হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে শিশুদের নিয়ে অপেক্ষা করছেন অভিভাবকরা। হাসপাতালের নিউমোনিয়া ওয়ার্ডের সব শয্যাই রোগীতে পূর্ণ। অনেকে শয্যা না পেয়ে ভর্তি হতে পারেনি।

শীতে বেড়েছে ঠান্ডাজনিত রোগের প্রকোপ, বেশি ভুগছে শিশুরা

শিশু হাসপাতালের তথ্যে জানা যায়, নিউমোনিয়াসহ শীতকালীন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। ৬৮১ শয্যার হাসপাতালে নিউমোনিয়া রোগীদের জন্য আছে ১৯ শয্যা। সবগুলোতেই রোগী ভর্তি। এছাড়া বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছে এক হাজার ২০০ শিশু। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৪ হাজার ১১৮ জন। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৫১১ জন।

চলতি মাসের প্রথম ১১ দিনে (১ থেকে ১১ ডিসেম্বর) নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৭৪ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, যা পুরো নভেম্বরে ছিল ২২৭ জন। এছাড়া অক্টোবরে ২৯২ ও সেপ্টেম্বরে ৩৭৮ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে এই হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেয় ৩০২ জন এবং সেপ্টেম্বরে ৩৪৫ জন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহবুবুল হক বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিন বাড়ছে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা এই সময়ে (শীতকালে) বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। দূষিত বাতাসের সঙ্গে মিলিত ঠান্ডা আবহাওয়াও অ্যালার্জিজনিত সমস্যা বাড়িয়ে দেয়।

ডা. মাহবুবুল হক বলেন, শিশুরা এ সময়ে ঠান্ডাজনিত রোগে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় শিশু হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়েছে।

পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী অন্যতম প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। এই রোগে শিশুদের ফুসফুস সংকুচিত হয়। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইসিডিডিআর) তথ্যমতে, সারাবিশ্বে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুতে প্রধান পাঁচ কারণের একটি নিউমোনিয়া।

এই রোগের ফলে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় সাত লাখ শিশু মারা যায়, যা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর ১৪ শতাংশ। বাংলাদেশেও নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যুর হার বেশি।

পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতি ঘণ্টায় দুই থেকে তিনটি শিশু মারা যায় নিউমোনিয়ায়, যাদের বয়স পাঁচ বছরের কম। বছরে নতুন করে এ রোগে আক্রান্ত হয় ৪০ লাখ শিশু। আক্রান্তদের মধ্যে মাত্র ছয় লাখ ৭৭ হাজার শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়। এদের মধ্যে মারা যায় প্রায় ২৪ হাজার শিশু, যা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর ২৪ শতাংশ।

শীতে বেড়েছে ঠান্ডাজনিত রোগের প্রকোপ, বেশি ভুগছে শিশুরা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৫ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ঠান্ডাজনিত রোগে মারা গেছে ১৯ জন। এছাড়া ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ৮৫ হাজার ৪৬৯ জন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হয় বায়ু দূষণের কারণে। চিকিৎসকদের মতে, বায়ু দূষণ ঠান্ডাজনিত রোগের একটি প্রধান কারণ, বিশেষ করে নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. নাবিলা আকন্দ বলেন, অসুস্থ শিশুদের মধ্যে বেশিরভাগই বাতাস থেকে আসা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। শিশুদের শ্বাসতন্ত্র অপরিণত হওয়ায় বায়ু দূষণের কারণে তারা বেশি ভুক্তভোগী হয়। বায়ু দূষণ হাঁপানি এবং নিউমোনিয়াসহ শ্বাসকষ্টজনিত অনেক জটিলতার জন্য দায়ী। দূষণ কমাতে পারলে এ ধরনের জটিলতায় ভোগা শিশুদের সংখ্যা কমবে।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ১১:১৯:৪০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪
১৭
Translate »

শীতে বেড়েছে ঠান্ডাজনিত রোগের প্রকোপ, বেশি ভুগছে শিশুরা

আপডেট : ১১:১৯:৪০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের নিউমোনিয়া ওয়ার্ডে বিছানায় শুয়ে আছে তিন বছর বয়সী আনিশা। নরসিংদীর বেলাবো উপজেলা থেকে এসেছে সে। নাকে অক্সিজেনের নল, হাতে লাগানো রয়েছে ক্যানুলা। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার।

পাশে বসে আনিশার যত্ন নিচ্ছিলেন মা শাহিনুর আক্তার। আনিশা ২৬ নভেম্বর থেকে এই ওয়ার্ডে ভর্তি বলে জানান তিনি। জাগো নিউজকে শাহিনুর আক্তার বলেন, ‘যখন এক বছর বয়স, সেসময় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয় আনিশা। এবার নিউমোনিয়া ও হাঁপানির সমস্যায় তিন দিন আইসিইউতে ছিল। অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। এখন শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হয়নি।’

শীতের আগমনের পর থেকে বেড়েছে নিউমোনিয়াসহ শীতকালীন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ৬৮১ শয্যার হাসপাতালে নিউমোনিয়া রোগীদের জন্য আছে ১৯ শয্যা। সবগুলোতেই রোগী ভর্তি আছে। এছাড়া বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছে এক হাজার ২০০ শিশু।

শাহিনুর আক্তার বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার মেয়ের শ্বাসকষ্ট ছিল। প্রতি বছর শীত মৌসুমে তার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এবার যখন অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠলো, তখন আমরা তাকে শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসি।’

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শিশু হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে শিশুদের নিয়ে অপেক্ষা করছেন অভিভাবকরা। হাসপাতালের নিউমোনিয়া ওয়ার্ডের সব শয্যাই রোগীতে পূর্ণ। অনেকে শয্যা না পেয়ে ভর্তি হতে পারেনি।

শীতে বেড়েছে ঠান্ডাজনিত রোগের প্রকোপ, বেশি ভুগছে শিশুরা

শিশু হাসপাতালের তথ্যে জানা যায়, নিউমোনিয়াসহ শীতকালীন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। ৬৮১ শয্যার হাসপাতালে নিউমোনিয়া রোগীদের জন্য আছে ১৯ শয্যা। সবগুলোতেই রোগী ভর্তি। এছাড়া বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছে এক হাজার ২০০ শিশু। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৪ হাজার ১১৮ জন। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৫১১ জন।

চলতি মাসের প্রথম ১১ দিনে (১ থেকে ১১ ডিসেম্বর) নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৭৪ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, যা পুরো নভেম্বরে ছিল ২২৭ জন। এছাড়া অক্টোবরে ২৯২ ও সেপ্টেম্বরে ৩৭৮ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে এই হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেয় ৩০২ জন এবং সেপ্টেম্বরে ৩৪৫ জন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহবুবুল হক বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিন বাড়ছে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা এই সময়ে (শীতকালে) বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। দূষিত বাতাসের সঙ্গে মিলিত ঠান্ডা আবহাওয়াও অ্যালার্জিজনিত সমস্যা বাড়িয়ে দেয়।

ডা. মাহবুবুল হক বলেন, শিশুরা এ সময়ে ঠান্ডাজনিত রোগে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় শিশু হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়েছে।

পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী অন্যতম প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। এই রোগে শিশুদের ফুসফুস সংকুচিত হয়। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইসিডিডিআর) তথ্যমতে, সারাবিশ্বে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুতে প্রধান পাঁচ কারণের একটি নিউমোনিয়া।

এই রোগের ফলে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় সাত লাখ শিশু মারা যায়, যা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর ১৪ শতাংশ। বাংলাদেশেও নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যুর হার বেশি।

পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতি ঘণ্টায় দুই থেকে তিনটি শিশু মারা যায় নিউমোনিয়ায়, যাদের বয়স পাঁচ বছরের কম। বছরে নতুন করে এ রোগে আক্রান্ত হয় ৪০ লাখ শিশু। আক্রান্তদের মধ্যে মাত্র ছয় লাখ ৭৭ হাজার শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়। এদের মধ্যে মারা যায় প্রায় ২৪ হাজার শিশু, যা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর ২৪ শতাংশ।

শীতে বেড়েছে ঠান্ডাজনিত রোগের প্রকোপ, বেশি ভুগছে শিশুরা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৫ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ঠান্ডাজনিত রোগে মারা গেছে ১৯ জন। এছাড়া ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ৮৫ হাজার ৪৬৯ জন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হয় বায়ু দূষণের কারণে। চিকিৎসকদের মতে, বায়ু দূষণ ঠান্ডাজনিত রোগের একটি প্রধান কারণ, বিশেষ করে নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. নাবিলা আকন্দ বলেন, অসুস্থ শিশুদের মধ্যে বেশিরভাগই বাতাস থেকে আসা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। শিশুদের শ্বাসতন্ত্র অপরিণত হওয়ায় বায়ু দূষণের কারণে তারা বেশি ভুক্তভোগী হয়। বায়ু দূষণ হাঁপানি এবং নিউমোনিয়াসহ শ্বাসকষ্টজনিত অনেক জটিলতার জন্য দায়ী। দূষণ কমাতে পারলে এ ধরনের জটিলতায় ভোগা শিশুদের সংখ্যা কমবে।