London ১১:১২ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২১ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আনিসুল, সালমান ও জিয়াকে অব্যাহতির চেষ্টা, তদন্ত কর্মকর্তাকে সাময়িক বহিষ্কার

জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যার দুটি মামলায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন পুলিশের একজন তদন্ত কর্মকর্তা। অব্যাহতি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানকেও। তবে আদালতে ওঠার আগেই বিষয়টি ধরা পড়ে যায়। আবার তদন্ত করা হচ্ছে।

নথিপত্র ও পুলিশ সূত্র বলছে, তদন্ত কর্মকর্তা তাঁর ডিবির পরিচয় গোপন করে থানা–পুলিশের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি আদালতে জমার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি এ ক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নেননি। বিষয়টি জানাজানির পর তিনি অসুস্থতার কথা বলে ছুটিতে চলে গেছেন।

সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক
ও উপদেষ্টা সালমান গ্রেপ্তার

তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

আনিসুল হক ও সালমানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল সবুজ মিয়া ও মো. শাহ-জাহান মিয়া হত্যা মামলায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ১৬ জুলাই ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় সবুজকে মারধর করে ও শাহ-জাহানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনার পরের দিন নিউমার্কেট থানায় মামলা হয়। সবুজের চাচাতো ভাই মো. নুরনবী ও শাহ-জাহানের মা আয়শা বেগম মামলার বাদী হন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১৩ আগস্ট আনিসুল ও সালমানকে আটক করে এই দুই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ১৬ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পাওয়া মেজর জেনারেল জিয়াকে।

মামলা দুটির তদন্ত করছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) রমনার পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর আরিফ। তিনি গত ২৩ অক্টোবর দুই মামলায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার চেষ্টা করেন। নথিতে দেখা যায়, চূড়ান্ত প্রতিবেদনে নিজেকে তিনি নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক পরিচয় দিয়েছেন। যদিও তিনি কর্মরত ডিবিতে।

আনিসুল, সালমান ও জিয়াউল আবার রিমান্ডে

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মামলা দুটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার চেষ্টার আগে তদন্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আরিফ সাক্ষ্য–স্মারকলিপিতে (মেমো অব এভিডেন্স বা এমই) ডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সই নেননি। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেছেন, ডিবি থেকে কোনো মামলায় অভিযোগপত্র বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য–স্মারকলিপিতে তদন্ত–তদারক কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার, অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রশাসন), উপকমিশনার এবং গুরুত্বপূর্ণ মামলার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কমিশনার ও ক্ষেত্রবিশেষ কমিশনারের সই লাগে। জাহাঙ্গীর আরিফ কর্মকর্তাদের সই নেওয়া এড়াতে নিজেকে নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক বলে উল্লেখ করেছেন।

দুটি হত্যা মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া এবং আনিসুল ও সালমানকে অব্যাহতির বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর থেকে অসুস্থতা দেখিয়ে ছুটিতে রয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আরিফ। বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য জানতে তাঁকে একাধিকবার ফোন করা হয়েছিল। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি। ডিবি সূত্র বলছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জাহাঙ্গীর আরিফ দাবি করেছেন, তিনি অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) সানজিদা আফরিনের (এখন এপিবিএনে কর্মরত) নির্দেশে কাজটি করেছেন।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে এডিসি সানজিদা গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রথম আলো কে বলেন, তিনি এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। এ রকম আলোচিত মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সিদ্ধান্তের এখতিয়ার তাঁর নেই।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বারডেম হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে শাহবাগ থানায় আটকে ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধঘোষিত) দুই কেন্দ্রীয় নেতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নেতাকে ব্যাপক মারধরের ঘটনায় আলোচনায় এসেছিলেন এডিসি সানজিদা। ডিএমপি ও ডিবি সূত্র জানায়, মামলা থেকে আনিসুল ও সালমানকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া চেষ্টার ঘটনায় ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাদ আলী এডিসি সানজিদার কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। সানজিদা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সেই ব্যাখ্যা ডিএমপির কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি।

আনিসুল ও সালমানকে অব্যাহতির চেষ্টার ঘটনাটি জানার পরই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করেছেন ডিবির দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক। তিনি গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আরিফকে রোববার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

অন্যদিকে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ডিবির রমনা অঞ্চলের পরিদর্শক মো. মনিরুল ইসলামকে। যদিও সম্প্রতি বিষয়টি জানাজানি হয়। মনিরুল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি তদন্ত করছেন এবং জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছেন।

আমি আয়নাঘরে কখনো চাকরি করিনি,
দাবি জিয়াউল আহসানের

চূড়ান্ত প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছিল

১৬ জুলাই সবুজ ও শাহ-জাহানকে হত্যার ঘটনায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিউমার্কেট থানা করা মামলায় দায়ী করা হয়েছিল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী এবং বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের। গোপনে যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছিল তাতে বলা হয়, ঘটনার জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। বাদী ভুল করে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের দায়ী করেছিলেন।

তদন্ত কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আরও লেখেন, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান ও জিয়াউল আহসান হত্যার ঘটনা দুটিতে জড়িত বলে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই তাঁদের অব্যাহতি দেওয়ার জন্য বিজ্ঞ আদালতের কাছে আবেদন করা হলো এবং মামলার দুই বাদীকে বিষয়টি জানানো হলো।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) মো. ইসরাইল হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুলিশ বাদী হয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। এ ধরনের মামলা যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে নিউমার্কেট থানার ওই দুটি হত্যা মামলায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের না জানিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা অপরাধ করেছেন।

নিহতের ঘটনায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কিছু মামলা হয়। সেসব মামলায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের দায়ী করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আরও মামলা হয়। এসব মামলায় শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী এবং দল ও দলের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গণ-অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য ঘটনায় সারা দেশে ২ হাজার ৪০০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় প্রায় দেড় লাখ মানুষকে আসামি করা হয়েছে। রোববার পর্যন্ত ১ হাজার ২০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম ৫ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে উদ্ভূত ঘটনায় অনেক মামলা হয়েছে, আসামির সংখ্যাও অনেক। মামলা নিয়ে অনেকে বাণিজ্য করছেন। যথাযথ তদন্তে সক্ষম পুলিশ সদস্যদের দিয়ে মামলার তদন্ত করা হবে। সারা দেশে বিভাগ অনুযায়ী ‘মেনটরিং অ্যান্ড মনিটরিং কমিটি’ গঠন করা হয়েছে।

বিচার চান শাহ-জাহানের মা

পুলিশ ও আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আনিসুল হকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ মোট মামলা হয়েছে ৫৫টি। সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৮টি। তাঁরা এখন কারাগারে।

নিহত শাহ-জাহানের মা ও মামলার বাদী আয়শা বেগম রোববার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর পুলিশ নিজেদের খেয়ালখুশিমতো মামলা করেছিল। কাদের আসামি করা হয়েছে, সেটাও জানানো হয়নি। এখন চূড়ান্ত প্রতিবেদনের কথাও তিনি জানেন না। তিনি ছেলে হত্যার বিচার চান।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৬:১৪:৫২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
১৩
Translate »

আনিসুল, সালমান ও জিয়াকে অব্যাহতির চেষ্টা, তদন্ত কর্মকর্তাকে সাময়িক বহিষ্কার

আপডেট : ০৬:১৪:৫২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪

জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যার দুটি মামলায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন পুলিশের একজন তদন্ত কর্মকর্তা। অব্যাহতি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানকেও। তবে আদালতে ওঠার আগেই বিষয়টি ধরা পড়ে যায়। আবার তদন্ত করা হচ্ছে।

নথিপত্র ও পুলিশ সূত্র বলছে, তদন্ত কর্মকর্তা তাঁর ডিবির পরিচয় গোপন করে থানা–পুলিশের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি আদালতে জমার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি এ ক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নেননি। বিষয়টি জানাজানির পর তিনি অসুস্থতার কথা বলে ছুটিতে চলে গেছেন।

সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক
ও উপদেষ্টা সালমান গ্রেপ্তার

তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

আনিসুল হক ও সালমানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল সবুজ মিয়া ও মো. শাহ-জাহান মিয়া হত্যা মামলায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ১৬ জুলাই ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় সবুজকে মারধর করে ও শাহ-জাহানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনার পরের দিন নিউমার্কেট থানায় মামলা হয়। সবুজের চাচাতো ভাই মো. নুরনবী ও শাহ-জাহানের মা আয়শা বেগম মামলার বাদী হন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১৩ আগস্ট আনিসুল ও সালমানকে আটক করে এই দুই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ১৬ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পাওয়া মেজর জেনারেল জিয়াকে।

মামলা দুটির তদন্ত করছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) রমনার পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর আরিফ। তিনি গত ২৩ অক্টোবর দুই মামলায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার চেষ্টা করেন। নথিতে দেখা যায়, চূড়ান্ত প্রতিবেদনে নিজেকে তিনি নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক পরিচয় দিয়েছেন। যদিও তিনি কর্মরত ডিবিতে।

আনিসুল, সালমান ও জিয়াউল আবার রিমান্ডে

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মামলা দুটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার চেষ্টার আগে তদন্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আরিফ সাক্ষ্য–স্মারকলিপিতে (মেমো অব এভিডেন্স বা এমই) ডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সই নেননি। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেছেন, ডিবি থেকে কোনো মামলায় অভিযোগপত্র বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য–স্মারকলিপিতে তদন্ত–তদারক কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার, অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রশাসন), উপকমিশনার এবং গুরুত্বপূর্ণ মামলার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কমিশনার ও ক্ষেত্রবিশেষ কমিশনারের সই লাগে। জাহাঙ্গীর আরিফ কর্মকর্তাদের সই নেওয়া এড়াতে নিজেকে নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক বলে উল্লেখ করেছেন।

দুটি হত্যা মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া এবং আনিসুল ও সালমানকে অব্যাহতির বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর থেকে অসুস্থতা দেখিয়ে ছুটিতে রয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আরিফ। বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য জানতে তাঁকে একাধিকবার ফোন করা হয়েছিল। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি। ডিবি সূত্র বলছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জাহাঙ্গীর আরিফ দাবি করেছেন, তিনি অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) সানজিদা আফরিনের (এখন এপিবিএনে কর্মরত) নির্দেশে কাজটি করেছেন।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে এডিসি সানজিদা গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রথম আলো কে বলেন, তিনি এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। এ রকম আলোচিত মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সিদ্ধান্তের এখতিয়ার তাঁর নেই।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বারডেম হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে শাহবাগ থানায় আটকে ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধঘোষিত) দুই কেন্দ্রীয় নেতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নেতাকে ব্যাপক মারধরের ঘটনায় আলোচনায় এসেছিলেন এডিসি সানজিদা। ডিএমপি ও ডিবি সূত্র জানায়, মামলা থেকে আনিসুল ও সালমানকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া চেষ্টার ঘটনায় ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাদ আলী এডিসি সানজিদার কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। সানজিদা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সেই ব্যাখ্যা ডিএমপির কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি।

আনিসুল ও সালমানকে অব্যাহতির চেষ্টার ঘটনাটি জানার পরই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করেছেন ডিবির দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক। তিনি গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আরিফকে রোববার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

অন্যদিকে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ডিবির রমনা অঞ্চলের পরিদর্শক মো. মনিরুল ইসলামকে। যদিও সম্প্রতি বিষয়টি জানাজানি হয়। মনিরুল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি তদন্ত করছেন এবং জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছেন।

আমি আয়নাঘরে কখনো চাকরি করিনি,
দাবি জিয়াউল আহসানের

চূড়ান্ত প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছিল

১৬ জুলাই সবুজ ও শাহ-জাহানকে হত্যার ঘটনায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিউমার্কেট থানা করা মামলায় দায়ী করা হয়েছিল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী এবং বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের। গোপনে যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছিল তাতে বলা হয়, ঘটনার জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। বাদী ভুল করে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের দায়ী করেছিলেন।

তদন্ত কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আরও লেখেন, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান ও জিয়াউল আহসান হত্যার ঘটনা দুটিতে জড়িত বলে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই তাঁদের অব্যাহতি দেওয়ার জন্য বিজ্ঞ আদালতের কাছে আবেদন করা হলো এবং মামলার দুই বাদীকে বিষয়টি জানানো হলো।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) মো. ইসরাইল হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুলিশ বাদী হয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। এ ধরনের মামলা যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে নিউমার্কেট থানার ওই দুটি হত্যা মামলায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের না জানিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা অপরাধ করেছেন।

নিহতের ঘটনায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কিছু মামলা হয়। সেসব মামলায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের দায়ী করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আরও মামলা হয়। এসব মামলায় শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী এবং দল ও দলের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গণ-অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য ঘটনায় সারা দেশে ২ হাজার ৪০০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় প্রায় দেড় লাখ মানুষকে আসামি করা হয়েছে। রোববার পর্যন্ত ১ হাজার ২০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম ৫ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে উদ্ভূত ঘটনায় অনেক মামলা হয়েছে, আসামির সংখ্যাও অনেক। মামলা নিয়ে অনেকে বাণিজ্য করছেন। যথাযথ তদন্তে সক্ষম পুলিশ সদস্যদের দিয়ে মামলার তদন্ত করা হবে। সারা দেশে বিভাগ অনুযায়ী ‘মেনটরিং অ্যান্ড মনিটরিং কমিটি’ গঠন করা হয়েছে।

বিচার চান শাহ-জাহানের মা

পুলিশ ও আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আনিসুল হকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ মোট মামলা হয়েছে ৫৫টি। সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৮টি। তাঁরা এখন কারাগারে।

নিহত শাহ-জাহানের মা ও মামলার বাদী আয়শা বেগম রোববার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর পুলিশ নিজেদের খেয়ালখুশিমতো মামলা করেছিল। কাদের আসামি করা হয়েছে, সেটাও জানানো হয়নি। এখন চূড়ান্ত প্রতিবেদনের কথাও তিনি জানেন না। তিনি ছেলে হত্যার বিচার চান।