London ০২:১৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম:
রাণীনগরে মৌসুমী সমৃদ্ধির দিনভর নানা উন্নয়নমূলক কর্মসূচি কসবায় হেফাজতের নেতৃবৃন্দের সাথে কসবা-আখাউড়া এমপি পদপ্রার্থী প্রভাষক কাজী মঈনুদ্দিনের সৌজন্য সাক্ষাৎ ও মত বিনিময় সিরাজগঞ্জে পলিথিনে মোড়ানো বস্তুয় অর্ধগলিত নবজাতক শিশুর মরা দেহ উদ্ধার কালিয়াকৈরে দোকানে মালামাল ও নগদ টাকা চুরি কসবায় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এমপি প্রার্থী প্রভাষক কাজী মোঃ মাঈনুদ্দিনের সৌজন্য সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে স্কুল শিক্ষিকা ও চাঁদাবাজদের মাধ্যমে পরিকল্পিত অপপ্রচার রাজশাহীতে হিমাগারের ভাড়া কমালো কালিয়াকৈরে উপজেলা ও পৌর বিএনপির ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত সেই কথিত যুবদল নেতা আবার চাঁদাবাজি করতে গিয়ে জনতার হাতে আটক। নীরব পুলিশ! রাজশাহীতে করোনা সনাক্ত

এক ডোজ এইচপিভি টিকা নিন, জরায়ুমুখ ক্যানসার রুখে দিন

‘জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধ: এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচি-চূড়ান্ত পর্যায়’ উপলক্ষে ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ১৬ অক্টোম্বর ২০২৪, ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে ছবি

প্যানেল আলোচক

অধ্যাপক নাজমুল হোসেন

মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর

মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ

যুগ্ম সচিব, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়

ডা. শাহ আলী আকবর আশরাফি

এমআইএস–এর প্রধান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

মায়া ভানডেনেন্ট

স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

অধ্যাপক খান মইনুদ্দিন সোহেল

পরিচালক (মাধ্যমিক শাখা), মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)

এএসএম শফিউল আলম তালুকদার

প্রকল্প পরিচালক, মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন

ডা. রিয়াদ মাহমুদ

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপক, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

ব্রিগে. জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী

প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন

অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম

সাবেক সভাপতি, ওজিএসবি

ডা. মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন

সহকারী পরিচালক, ইপিআই অ্যান্ড সার্ভিল্যান্স, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

ডা. চিরঞ্জিত দাস

ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার – ইপিআই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ

সাবিনা পারভীন

পরিচালক (পরিকল্পনা),  পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

আলোচনা

অধ্যাপক নাজমুল হোসেন

মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর

বাংলাদেশের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) সাফল্যের ইতিহাস বেশ গৌরবের। এ বিষয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বে রোল মডেল বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে ইপিআইয়ের আওতায় ১০টি রোগের টিকা প্রদান কর্মসূচি চলছে। ২০০১ সাল থেকে এ কার্যক্রমে দ্য গ্লোভাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমুনাইজেশন (গ্যাভি) আমাদের সহযোগিতা করে আসছে। কোভিডকালে তাদের সাহায্য ছিল উল্লেখযোগ্য। আজকের আলোচিত এইচপিভি ভাইরাস প্রতিষেধক ইপিআইয়ের আওতাভুক্ত অন্যান্য টিকা কর্মসূচির তুলনায় একটু ভিন্ন।

পোলিও হলে পঙ্গু হয়ে যায়, টিটেনাস হলে মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু এইচপিভির ক্ষেত্রে ভিন্ন। এ জন্য আমাদের প্রক্রিয়া পদ্ধতি ও ভিন্ন। টিকাদানের ক্ষেত্রে কিশোরদের বয়সসীমা ১০ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশীয় গবেষণায় পশ্চিমা দেশগুলোর তথ্য ও উপাত্ত ব্যবহার এর অন্যতম কারণ। তাই গবেষণায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বয়সসীমা ভিন্নও হতে পারে। দ্য অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) এ বিষয়ে কিছু গবেষণা করেছে। তবে তা শুধু টিকার (ভ্যাকসিন) নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।

ভবিষ্যতে টিকাদানের (ভ্যাকসিনেশন) দারুণ কিছু পরিকল্পনা আছে। লোটা ভাইরাস ও টাইফয়েড কনজুগেট টিকাসহ আরও কিছু রোগের টিকা প্রদানের কথা চিন্তা করছি। বিশ্বের বহু দেশে এখনো এসব টিকার প্রচলন শুরু হয়নি। কিন্তু আমাদের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে (ইপিআই) তা ইতিমধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে কাজ করে যাচ্ছি।

২০২৯ সাল পর্যন্ত গ্যাভি ও সহযোগী সংস্থাগুলো অর্থনৈতিক সহযোগিতা করবে। পরবর্তী সময়ে আমাদের নিজ অর্থায়নে এ কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করতে হবে। এশিয়ার এ অঞ্চলকে ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রতিনিধিত্ব করেন। আমাদের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা তাঁর কাছে ২০৪০ সাল পর্যন্ত সহযোগিতা বর্ধিত করার আবেদন করেছেন। আমরা সর্বনিম্ন ২০৩৫ সাল পর্যন্ত এই সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি। ব্যয় করা অর্থের অপচয় রোধ করা দরকার। আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই। সেখানে তরুণদের সুস্বাস্থ্যের জন্য টিকাদান নিশ্চিত করা অতি জরুরি। সবার সমন্বিত সাহায্য পেলেই এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।

মায়া ভানডেনেন্ট

স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

উদ্দিষ্ট কিশোরীদের এইচপিভি টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে এইচপিভি ক্যাম্পেইন-২০২৪ আয়োজনের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। অবশ্যই এটি একটি অনেক বড় উদ্যোগ। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ এ ধরনের উদ্যোগের সফল বাস্তবায়নে সক্ষম ও উদ্দিষ্ট সব কিশোরীকে এইচপিভি টিকার আওতায় আনা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রুপান্তরে কিশোরী ও নারীরা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। তাই তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এই আলোকে জরায়ুমুখ ক্যানসার থেকে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জরায়ুমুখ ক্যানসারে প্রতিবছর ৫ হাজার নারীর মৃত্যু হয়। সব ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যানসার সংখ্যায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, যা খুবই উদ্বেগজনক। জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্তের দিক থেকে অল্প বয়সী গ্রামীণ ও প্রান্তিক নারীরা বেশি ঝুঁকিতে আছেন এবং এটি প্রতিরোধ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। জরায়ুমুখ ক্যানসার বিষয়ে আলোচনা করতে আমরা প্রায়ই সংকোচ বোধ করি। ফলে আজকের গোলটেবিল আলোচনা করতে পেরে আমরা আনন্দিত। এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সম্মানিত প্রতিনিধির এখানে উপস্থিতির মাধ্যমে এইচপিভি টিকাদান কার্যক্রমে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহায়তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। অত্যন্ত আশার কথা হলো, শুধু একটি টিকার মাধ্যমেই এইচপিভি সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়। এইচপিভি টিকা গ্রহণকে মূলধারায় নিয়ে আসতে বাংলাদেশ অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে।

ঢাকা বিভাগে গত বছর নভেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আংশিকভাবে বন্ধ থাকায় টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল। আশা করছি, এ বছর এই ধরনের চ্যালেঞ্জ  থাকবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকবে এবং আমরা বেশির ভাগ উদ্দিষ্ট কিশোরীদের কাছে পৌঁছাতে পারব। এ ক্ষেত্রে নব-উদ্ভাবিত অনলাইন টিকা নিবন্ধন অ্যাপটি (https://vaxepi.gov.bd/) কিশোরীরা নিজেই বা অন্য কারও সাহায্য নিয়ে ব্যবহার করতে পারবে।

এইচপিভি টিকাদান ক্যাম্পেইন কার্যক্রমের এ ধাপে ৭টি বিভাগে ১০ থেকে ১৪ বছরের উদ্দিষ্ট ৬২ লাখ  কিশোরীর সবার কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্য পূরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন টিকাদানকর্মীর শূন্য পদ নিয়ে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। এসব শূন্য পদ পূরণে বাড়তি জোর দেওয়ার এখনই ভালো সময়। রাস্তায় বসবাসকারী শিশুদের জন্যও আমাদের কিছু অংশীদারত্ব রয়েছে। অল্প বয়সে যৌনকর্মী হিসেবে যুক্ত হওয়া কিশোরীরা জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই তাদের টিকাদানও সবচেয়ে জরুরি। এসব কিশোরীর কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় সহায়তা করছি।

টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমুনাইজেশন (গ্যাভি) সহযোগিতা রয়েছে। এ ছাড়া এ কার্যক্রমে ইউএসএআইডি এবং অন্যান্য দাতা প্রতিষ্ঠানকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই। যদিও উদ্দিষ্ট ৬২ লাখ কিশোরীর কাছে পৌঁছানো সহজ বিষয় নয়, তবে সবার সম্মিলিত প্রয়াসে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারব বলে আমি অত্যন্ত আশাবাদী।

মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ

যুগ্ম সচিব, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়

বাংলাদেশে ২০২৩ সালে প্রথম ধাপে ঢাকা বিভাগে এইচপিভি টিকা কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। ২০ লাখের অধিক কিশোরীকে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধী এক ডোজ টিকা সফলভাবে দেওয়া হয়। গত বছর এ টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে অনেকের মধ্যে একটা ভীতি ছিল। এ টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও দ্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস (গ্যাভি) দ্বারা অনুমোধিত। আর গাজীপুরে দীর্ঘদিন ধরে এর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালানো হয়েছিল। গত বছর টিকা দেওয়া ২০ লাখ কিশোরীর মধ্যে এমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকা বিভাগ ব্যতীত ৭টি বিভাগের ৫১টি জেলায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ইপিআই, শিক্ষা বিভাগ, বিভিন্ন সংগঠন, স্থানীয় প্রশাসন, ১৬টি মন্ত্রণালয় ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় একযোগে ১৮ দিনব্যাপী এইচপিভি টিকা প্রদান করা হবে। স্কুল পর্যায়ে ৫ম থেকে ৯ম শ্রেণির কিশোরী ও স্কুলের বাইরে থাকা ১০ থেকে ১৪ বছরের কিশোরীরা এই টিকার আওতাভুক্ত। এ কার্যক্রমের প্রচারণা হিসেবে আজ আমরা এই গোলটেবিল আলোচনায় একত্র হয়েছি।

মাতৃমৃত্যু কমানো আমাদের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) অন্যতম লক্ষ্য। আমাদের দেশে পরিবারপ্রথা ও সমাজব্যবস্থায় মায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মা সুস্থ ও নীরোগ থাকলে পরিবারের অন্য সদস্যরাও ভালো থাকবে।

দেশে প্রতিবছর প্রায় ৫ হাজার নারী এ জরায়ুমুখ ক্যানসারের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। আমাদের মোট মৃত্যুর ৬৫ শতাংশ অসংক্রামক ব্যাধির কারণে ঘটে। এর মধ্যে মরণব্যাধি ঘাতক জরায়ুমুখ ক্যানসার অন্যতম কারণ।

২৪ অক্টোবর এইচপিভি টিকা প্রদান  কার্যক্রমটি শুরু হয়েছে। এটা আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা অত্যন্ত সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পালন করবেন।

আমরা ইপিআই ও অন্যান্য বিভাগের সহযোগিতায় বেশ সফলভাবেই কাজ করছি। ৮৭ শতাংশ মানুষ আমাদের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতাভুক্ত। এর ফলে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সহযোগিতায় মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাবে; মানুষ সুস্থ ও নীরোগ থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

ঢাকা বিভাগের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবার আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারব।

ডা. শাহ আলী আকবর আশরাফি

এমআইএস–এর প্রধান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

সরকারিভাবে কিশোরীদের বয়সসীমা ১০ থেকে ১৪ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ের (ভেরিফিকেশন) জন্য সিটিজেন ওয়েব পোর্টাল তৈরি করা হয়েছে, যেন অভিভাবকেরা তাঁদের কন্যাসন্তানের জন্মসনদ দিয়ে টিকার নিবন্ধন করতে পারেন। টিকা নিবন্ধনের জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ নম্বর থাকা আবশ্যক।

একজন কিশোরী ১৭ সংখ্যার জন্মনিবন্ধন সনদ নম্বর ও জন্মতারিখ দিলে যাচাইকরণের জন্য ৬ সংখ্যার একটি ক্যাপচা কোড পাবে। এ তথ্য বিডিআরএসের তথ্যের সঙ্গে মিললে নিবন্ধনকারীর পূর্ণাঙ্গ তথ্য চলে আসবে। জন্মনিবন্ধন সনদ না থাকা বা নিবন্ধন করতে না পারা কিশোরীদেরও টিকা নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

সরকার মাইক্রো প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে ৫ম থেকে ৯ম শ্রেণির সব কিশোরীর টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে। সে ক্ষেত্রে কারও বয়স ১০ বছরের কম বা ১৪ বছরের বেশি হলে আমরা বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ও বিডিআরএসের তথ্যভান্ডার ব্যবহার করি। সরকারি তথ্য সহায়তার মাধ্যমে মোবাইল ফোনে এইচপিভি টিকা ২০২৪ বিষয়ক বার্তা পাঠিয়ে জনগণের সচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) আমরা অনুরোধ করেছি। এর মাধ্যমে অভিভাবকেরা সচেতন হবেন ও টিকা কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুত থাকবেন। টিকা কার্যক্রম শতভাগ আধুনিকায়নের জন্য ইপিআইকে অনুরোধ করা হয়েছে।

জন্মনিবন্ধন শতভাগ আধুনিক হয়ে ওঠেনি। তাই ম্যানুয়ালি কিছু নিবন্ধনের সুযোগ রাখা হয়েছে। এ আধুনিক অনলাইন প্রক্রিয়ার জন্য আমাদের দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকবল দরকার। এ লোকবলের সাহায্য আমরা ইউনিসেফ থেকে পাচ্ছি।

এ প্রক্রিয়াকে আরও উন্নত করার জন্য ইউনিসেফ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, ব্যানবেইস, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন অধিদপ্তর, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, ব্রিটিশ কাউন্সিলসহ সবার সম্মিলিত সহযোগিতায় কাজ করে যাচ্ছি।

ব্রিগে. জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী

প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন

গতবার এইচপিভি টিকাদানের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল। বাজারে কিছু বাণিজ্যিক টিকা রয়েছে। তাদের ডোজের মাত্রা ভিন্ন হওয়ায় এক ডোজ এইচপিভি টিকা কার্যকরী কি না, তা নিয়ে একটা ভ্রান্ত ধারণা ছিল। বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষকেরা এবং সংবাদমাধ্যমগুলো প্রচারণা চালালে ভুল ধারণাটি দূর করা যাবে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশে এইচপিভি নিয়মিত টিকাদান কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। গত বছর ঢাকা বিভাগের সাফল্য ৭৫ শতাংশ দেখানো হচ্ছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ের কর্মীরা ৯০ শতাংশের বেশি সফলভাবে টিকা গ্রহণ করেছে বলে জানাচ্ছেন।

এখানে তথ্যের এমন বিভ্রান্তি কেন? মাঠপর্যায়ের কর্মীরা স্কুল বা কলেজের দায়িত্বরত প্রধানের কাছে ছাত্রীসংখ্যা জানতে চাইলে তাঁরা তা বাড়িয়ে বলেন। শিক্ষক অনুপাতে শিক্ষার্থী সংখ্যা সব সময় বাড়িয়ে বলা হয়। এখানে হয়তো সরকারি অনুদানের কোনো ব্যাপার আছে। কিন্তু মাইক্রো প্ল্যানের জন্য সঠিক সংখ্যাটা জানা জরুরি। তাই ইপিআই বা মাঠপর্যায়ে দায়িত্বরত ব্যক্তিরা উপস্থিতি খাতা থেকে সঠিক তথ্য আনতে পারলে লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে যাবে।

কওমি মাদ্রাসা ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আমরা একধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। এ টিকা শুধু নারীদের জন্য, তাহলে পুরুষের জন্য কী ব্যবস্থা? আমরা এ ধরনের কথা অনেক শুনেছি। তাদের মধ্যে এখনো হয়তো সে সচেতনতার বার্তা পৌঁছায়নি।

অনেক ছাত্রীর ১৭ সংখ্যার জন্মনিবন্ধন সনদ নেই। আবার অনেক শিশুর জন্মনিবন্ধন সনদ হাতে লেখা। ঢাকায় এ সমস্যা বেশি দেখা গেছে। তাই জন্মনিবন্ধন না থাকা বা জন্মনিবন্ধন ১৭ সংখ্যার নয়, এমন কিশোরীদেরও যেন টিকা দেওয়া যায়, সে সিদ্ধান্ত আগে থেকেই নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে যথাযথ পদ্ধতিও ঠিক করতে হবে। মানুষকে আরও সচেতন ও টিকাদানে অনুপ্রাণিত করার বিষয়েও ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্য প্রচারমাধ্যমগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।

ডা. মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন

সহকারী পরিচালক, ইপিআই অ্যান্ড সার্ভিল্যান্স, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের (এইচপিভি) এক শর বেশি সেরোটাইপ রয়েছে। জরায়ুমুখ ক্যানসার তৈরিতে ১৬ ও ১৮ নম্বর সেরোটাইপ ৭০ শতাংশ ভূমিকা রাখে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ রোগ পুরুষেরা বহন করেন আর নারীরা ভুক্তভোগী হন। বিশ্বব্যাপী নারীদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার দিকে থেকে জরায়ুমুখ ক্যানসার চতুর্থ।

বাংলাদেশে ক্যানসার–জাতীয় রোগগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্যানসারের কারণ জরায়ুমুখ ক্যানসার। দেশে প্রতি লাখ নারীর মধ্যে ১১ জন এ ক্যানসারে আক্রান্ত হয় এবং প্রতিবছর প্রায় ৫ হাজারের মতো নারী জরায়ুমুখ ক্যানসারে মারা যায়। পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি এবং ১০ থেকে ১৪ বছরের কিশোরীদের এক ডোজ এইচপিভি টিকা দিয়ে নারী জরায়ুমুখ ক্যানসারে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এইচপিভি টিকাদানের মাধ্যমে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারি। ক্যাম্পেইনে পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি ও ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীদের ৯৫ শতাংশ টিকার আওতায় নিয়ে আসা হবে।

অনলাইনে ভ্যাক্সইপিআই অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করে তাদের টিকা দেওয়া হবে। এই অ্যাপে কিশোরীরাই নিবন্ধন করতে পারবে। ২০১৬-১৭ সালে গাজীপুরে একটি পরীক্ষামূলক টিকা কার্যক্রম করেছিলাম। সেখানে ৯৫ শতাংশ টিকা দেওয়া হয়েছিল। তাদের কারও কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি। ফলে এ টিকা সুরক্ষিত ও কার্যকর। গত বছর ঢাকা বিভাগে ১৫ অক্টোবর থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত টিকা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য ছিল ২০ লাখ ১৮ হাজার ৪৩ জনকে টিকা দেওয়া। এর মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

এ বছর ২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকা বাদে বাকি ৭টি বিভাগে এ কার্যক্রম চলবে। এবার শতভাগ নিবন্ধনের মাধ্যমে টিকা নিশ্চিতকরণের চেষ্টা থাকবে। কওমি মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোকে ঠিকমতো টিকার আওতায় নিয়ে আসতে পারিনি। অটিস্টিক কন্যাশিশুদেরও টিকার আওতায় আনার চেষ্টা করছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানবহির্ভূত কিশোরীদের বিদ্যমান টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে টিকা দেওয়া হবে। এ কার্যক্রম সফল করার জন্য আমরা মাঠপর্যায়ে কর্মী ও সুপারভাইজারদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে যুক্ত করা হয়েছে।

অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসী বেগম

সাবেক সভাপতি, ওজিএসবি

আমরা যারা গাইনোকোলজিস্ট, একবারে কাছ থেকে এ রোগে আক্রান্ত নারীদের ভোগান্তি দেখেছি।

জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে এইচপিভি টিকার যথেষ্ট চাহিদা তৈরি হয়েছে। আশপাশের মানুষজন এ টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার বিষয়ে আলোচনা করছে। এ টিকা নেওয়া দরকার, এ প্রত্যাশা মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে।

আমরা দেশেই গবেষণা করে দেখিয়েছি যে এইচপিভি টিকা নিরাপদ। টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়া যথাযথ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গ্যাভি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবাই যথাযথভাবে ভূমিকা পালন করবেন বলে আশা রাখছি। গতবার ৭৫ শতাংশ টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এবার আশা করছি শতভাগ টিকার আওতাভুক্ত হবে। গতবার থেকে শিক্ষা নিয়ে অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগানো অত্যন্ত প্রয়োজন।

টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে এখনো কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছে। বিবাহিতরা টিকা নিতে পারবেন কি না, প্রায়ই এ প্রশ্ন আসে। অনেকেই মনে করেন এ টিকা বিবাহিতরা নিতে পারবেন না।এ জন্য স্কুলের বাইরে প্রচারণা আরও জোরদার করতে হবে। এরপরও টিকা নিয়ে অনেক খুঁটিনাটি প্রশ্ন থাকে। টিকা সম্পর্কিত সব প্রশ্নের উত্তর আমাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। ওজিএসবি থেকে বিশেষ দল এসব উত্তর দিয়েছে। এরপরও কোনো প্রশ্ন থাকলে আমাদের জানাবেন। আমরা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে উত্তর দেওয়ার ব্যবস্থা করব।

আমরা ১৬৫তম দেশ হিসেবে টিকা কার্যক্রমে যোগ দিয়েছি। এ ক্ষেত্রে আমরা শতভাগ সাফল্য অর্জন করে প্রথম হতে চাই। নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষার যেকোনো বিষয়ে কাজে বেসরকারি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সহযোগিতার জন্য ওজিএসবি সব সময় সজাগ আছে।

অধ্যাপক খান মইনুদ্দিন সোহেল

পরিচালক (মাধ্যমিক শাখা), মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)

এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচনা হচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পক্ষ থেকে বলতে পারি, আমাদের কাজ শুধু সহযোগিতা করা। বাকি সব কাজ আপনাদের।

শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ এ কাজে যুক্ত রয়েছে। এ কর্মসূচি যাদের কেন্দ্র করে, মূলত তারা বেশির ভাগই আমাদের আওতায়। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ এ কর্মসূচিকে সফল করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। আমাদের দেশের কন্যাশিশুদের নিয়ে আপনাদের কর্মসূচি সফল করতে নির্দেশনা, পরিপত্র, চিঠিসহ আরও যা যা প্রয়োজন সব সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। আপনাদের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা পেলে শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যা প্রয়োজন, সে নির্দেশনা এবং সহযোগিতা করা হবে।

গত বছর শুধু ঢাকা বিভাগে এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এবার ২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকা বিভাগ ছাড়া দেশের অন্যান্য ৭টি বিভাগে এই কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। আমি আশা করি, এবার এই কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়িত হবে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।

এএসএম শফিউল আলম তালুকদার

প্রকল্প পরিচালক, মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন

এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচিতে সচেতনতা বাড়াতে আমরা একটা সহায়ক ভূমিকা পালন করছি। মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমে মূলত কোরআন শিক্ষা এবং নীতিনৈতিকতার শিক্ষা দিয়ে থাকে। আমাদের ৪৪ হাজার ২০০ সেন্টার আছে, যেখানে শিশুদের কোরআন ও নৈতিক শিক্ষা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

আমাদের স্কুল ও সেন্টারে যে শিশুরা আছে, তাদের বয়সসীমা ৫ থেকে ৬ বছর। আরেকটি আছে ৮ বছর ১৪ বছরের যারা কোরআন শিক্ষায় আছে। এর মধ্যে আমাদের ২৫ শতাংশ নারী শিক্ষক রয়েছেন, যাঁদের আমরা এখানে যুক্ত করতে পারি। এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচিতে ধর্মীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সচেতনমূলক বার্তা প্রচার করা যায়।

টিকাদানের ক্ষেত্রে যে বয়সসীমা বেছে নেওয়া হয়েছে, সেখানে আমাদের প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশকে গ্যাভি যে বয়সসীমার পরামর্শ দিয়েছে, আমাদের নির্দিষ্ট একটা টিকা নির্ধারণ করে দিয়েছে, যা দিয়ে আমরা এই টিকাদান কর্মসূচিটা পরিচালনা করছি। আমাদের চ্যালেঞ্জটা হলো, নির্ধারিত বয়সসীমা যদি বাড়ানো যায়, তাহলে ভালো হয়। কারণ, বড় একটা অংশ টিকার আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ জন্য আমাদের কাভারেজ শতভাগ হচ্ছে না।

ডা. চিরঞ্জিত দাস

ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার–ইপিআই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ

জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধের মূল হাতিয়ারই ভ্যাকসিন। আর বাংলাদেশ সরকার ১০ থেকে ১৪ বছরের যে বয়সসীমা নির্ধারণ করেছে, তা সবচেয়ে আদর্শ সময়। সুতরাং এটাই আমাদের ফলো করতে হবে, এখানে দ্বিধা করার কোনো সুযোগ নেই। দ্বিতীয় যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, এক ডোজ না একাধিক ডোজ। বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞদের মতে এবং বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞদের সম্মিলিত মতে বলা হয়েছে, এইচপিভির জন্য এক ডোজ টিকাই চলবে। এইচপিভি টিকা এক ডোজই যথেষ্ট, এটি ফার্মাসিস্ট কোম্পানিগুলোও মেনে নিয়েছে। তাই এখানে সংশয় প্রকাশ করার কোনো সুযোগ নেই।

গত বছর ঢাকা বিভাগের অর্জন ৭৫ শতাংশ, তবু এখানে কিছু ঘাটতি ছিল। প্রতিবছর ১ লাখ নারীর মধ্যে ১১ জন নারী জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন। জাতীয়ভাবে ইপিআই কার্যক্রমে ১৫ লাখ টিকা দিয়েছি, সে হিসাবে গড়ে আমরা ১৫০ জন নারীকে সুরক্ষিত করতে পেরেছি। আমরা যে ২৫ শতাংশ অকার্যকর হয়েছি, সেখানে গড়ে ৫০ জন নারী এখনো ঝুঁকিতে। তাই এখানেই এখন ভূমিকা রাখতে হবে। আমাদের কোনো সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না এবং উচ্চ ঝুঁকিতে যে শিশুটি আছে, তাকে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে সরকারকে আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। যদিও আমরা বলছি ৯০ শতাংশ আমাদের লক্ষ্য, কিন্তু প্রতিটি কন্যাশিশুর কাছে আমরা পৌঁছাতে চাই।

সাবিনা পারভীন

পরিচালক (পরিকল্পনা), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর

সব সময় একজন সহযোদ্ধা হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাশে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ছিল। মাঠপর্যায়ে সম্মুখসারিতে আমাদের কর্মীরাও এই কার্যক্রম চলমান রাখতে সহযোগিতা করে চলেছেন।

যে পদ্ধতিতে জরায়ুমুখ ক্যানসারের টেস্টগুলো করেছি, কিছু রিপোর্ট আমাদের কাছে আছে। আমাদের এমসিডব্লিউসির মাধ্যমে যে টেস্ট করেছি, সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিবছরই প্রায় ২৫ হাজারের মতো স্ক্রিনিং হয়। এর মধ্যে দু-তিন হাজার পজিটিভ কেস থাকে, তখন তা সঙ্গে সঙ্গেই বিভাগীয় হাসপাতালগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম পর্যায়েই ১০ থেকে ১৪ বছরের কন্যাশিশুদের যদি এইচপিভি টিকা দেওয়া যায়, তাহলে প্রথমেই জরায়ুমুখ ক্যানসার রুখে দেওয়া সম্ভব।

ঢাকা বিভাগের যে অভিজ্ঞতা, সেখানে পরিবার পরিকল্পনার লোকবলও ছিল। তাঁদের ট্রেনিং করানো হয়েছিল। আমাদের টার্গেট গ্রুপ ৭৫ লাখের মতো। আমরা গত বছর ১৫ লাখের মতো টিকা দিয়েছি। এই টার্গেট গ্রুপের মোট সংখ্যাটা কত? যেহেতু এটা আনুমানিক একটা সংখ্যা এবং ভুল তথ্যের কারণে টার্গেট বেশি থাকায় সাফল্য কম; তাই লক্ষ্যের তথ্য সঠিক হলে সাফল্য বাড়বে।

স্কুল ঝরে পড়া শিশুদের জন্য আমাদের কিছু কার্যক্রম আছে। এ ক্ষেত্রে আমরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সহযোগিতাও নিয়ে থাকি। যেহেতু এই পুরো প্রক্রিয়া মেয়েদের, তাই এই ক্যাম্পিংয়ে নারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে করালে সহজ হবে। বিষয়টিতে সবার মনোযোগ দেওয়ার অনুরোধ রইল।

ডা. রিয়াদ মাহমুদ

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপক, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

স্কুলগুলো খুললে ক্যাম্পেইন আরও জোরদার করতে হবে; যাতে রেজিস্ট্রেশন সবাই নিশ্চিত করে ফেলে। কারণ, রেজিস্ট্রেশন না হলে শিক্ষার্থীরা টিকা পাবে না। ক্যাম্পেইন শেষ হলে আগামী বছর থেকে শুধু ৫ম শ্রেণি পড়ুয়া অথবা স্কুলবহির্ভূত ১০ বছরের শিশুরা টিকা পাবে। সুতরাং ২০২৪ ক্যাম্পেইনে কোনো কিশোরীকে বাদ দেওয়া যাবে না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান–বহির্ভূত কিশোরীরাও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারাই কিন্তু বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই সংখ্যা কিন্তু বেশি না, মাত্র ৩%। আমাদের টার্গেটের ৬২ লাখের মধ্যে ১ লাখ ৮৬ হাজার মেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান–বহির্ভূত। সংখ্যায় অল্প হলেও এখানে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের যত কৌশল আছে, যাঁরা মাঠে আছেন, তাঁরা সব শক্তি দিয়ে জানাবেন টিকাটা নিতেই হবে।

যত রকম তরুণ সংগঠন ও যুব দল আছে বিশেষ করে শিক্ষার্থী ভাইবোনদের ব্যবহার করতে হবে।

পার্বত্য অঞ্চল, চা–বাগান—এসব অঞ্চলেও আমরা কাজ করছি স্কুলগুলো নিয়ে। এদের সংখ্যাটা কম, কিন্তু এরাই রয়েছে বেশি ঝুঁকিতে।

আরেকটি কথা বলতে চাই, টিকাদান শিশুদের জন্য বিনিয়োগ, এটি খরচ নয়। ইউনিসেফ এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটা জরিপ করেছে, তাতে দেখেছি ১ ডলার বিনিয়োগ করলে পরিবর্তে রিটার্ন আসছে ২৫.২ ডলার। টিকাদানের কারণে প্রতিবছর ৯৪ হাজার শিশুর জীবন বাঁচে। টিকার কারণে ৫০ লাখের রোগ হয় না। তাই টিকাদান একটি বিনিয়োগ, এ জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানাই।

নির্দেশনা

  • জরায়ুমুখ ক্যানসার রোধে কিশোরীদের বিনা মূল্যে এক ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে।
  • ভ্যাক্সইপিআই অ্যাপের (vaxepi.gov.bd) মাধ্যমে কিশোরীরা নিজেরাই টিকার জন্য নিবন্ধন করে টিকা নিতে পারবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিকা দিতে ব্যর্থ হলে নিকটবর্তী ইপিআই সেন্টারে টিকা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
  • ঢাকা বিভাগের বাইরে অন্য সাত বিভাগে ২৪ অক্টোবর থেকে এইচপিভি টিকা কার্যক্রম চলবে।
  • জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে বিশ্বের ১৪০টি দেশে ২০০৬ সাল থেকে এই টিকা দেওয়া হচ্ছে।
  • এইচপিভি টিকা নিরাপদ ও এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৩:৪১:৫৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৪
৫২
Translate »

এক ডোজ এইচপিভি টিকা নিন, জরায়ুমুখ ক্যানসার রুখে দিন

আপডেট : ০৩:৪১:৫৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৪

‘জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধ: এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচি-চূড়ান্ত পর্যায়’ উপলক্ষে ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ১৬ অক্টোম্বর ২০২৪, ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে ছবি

প্যানেল আলোচক

অধ্যাপক নাজমুল হোসেন

মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর

মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ

যুগ্ম সচিব, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়

ডা. শাহ আলী আকবর আশরাফি

এমআইএস–এর প্রধান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

মায়া ভানডেনেন্ট

স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

অধ্যাপক খান মইনুদ্দিন সোহেল

পরিচালক (মাধ্যমিক শাখা), মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)

এএসএম শফিউল আলম তালুকদার

প্রকল্প পরিচালক, মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন

ডা. রিয়াদ মাহমুদ

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপক, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

ব্রিগে. জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী

প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন

অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম

সাবেক সভাপতি, ওজিএসবি

ডা. মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন

সহকারী পরিচালক, ইপিআই অ্যান্ড সার্ভিল্যান্স, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

ডা. চিরঞ্জিত দাস

ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার – ইপিআই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ

সাবিনা পারভীন

পরিচালক (পরিকল্পনা),  পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

আলোচনা

অধ্যাপক নাজমুল হোসেন

মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর

বাংলাদেশের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) সাফল্যের ইতিহাস বেশ গৌরবের। এ বিষয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বে রোল মডেল বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে ইপিআইয়ের আওতায় ১০টি রোগের টিকা প্রদান কর্মসূচি চলছে। ২০০১ সাল থেকে এ কার্যক্রমে দ্য গ্লোভাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমুনাইজেশন (গ্যাভি) আমাদের সহযোগিতা করে আসছে। কোভিডকালে তাদের সাহায্য ছিল উল্লেখযোগ্য। আজকের আলোচিত এইচপিভি ভাইরাস প্রতিষেধক ইপিআইয়ের আওতাভুক্ত অন্যান্য টিকা কর্মসূচির তুলনায় একটু ভিন্ন।

পোলিও হলে পঙ্গু হয়ে যায়, টিটেনাস হলে মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু এইচপিভির ক্ষেত্রে ভিন্ন। এ জন্য আমাদের প্রক্রিয়া পদ্ধতি ও ভিন্ন। টিকাদানের ক্ষেত্রে কিশোরদের বয়সসীমা ১০ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশীয় গবেষণায় পশ্চিমা দেশগুলোর তথ্য ও উপাত্ত ব্যবহার এর অন্যতম কারণ। তাই গবেষণায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বয়সসীমা ভিন্নও হতে পারে। দ্য অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) এ বিষয়ে কিছু গবেষণা করেছে। তবে তা শুধু টিকার (ভ্যাকসিন) নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।

ভবিষ্যতে টিকাদানের (ভ্যাকসিনেশন) দারুণ কিছু পরিকল্পনা আছে। লোটা ভাইরাস ও টাইফয়েড কনজুগেট টিকাসহ আরও কিছু রোগের টিকা প্রদানের কথা চিন্তা করছি। বিশ্বের বহু দেশে এখনো এসব টিকার প্রচলন শুরু হয়নি। কিন্তু আমাদের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে (ইপিআই) তা ইতিমধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে কাজ করে যাচ্ছি।

২০২৯ সাল পর্যন্ত গ্যাভি ও সহযোগী সংস্থাগুলো অর্থনৈতিক সহযোগিতা করবে। পরবর্তী সময়ে আমাদের নিজ অর্থায়নে এ কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করতে হবে। এশিয়ার এ অঞ্চলকে ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রতিনিধিত্ব করেন। আমাদের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা তাঁর কাছে ২০৪০ সাল পর্যন্ত সহযোগিতা বর্ধিত করার আবেদন করেছেন। আমরা সর্বনিম্ন ২০৩৫ সাল পর্যন্ত এই সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি। ব্যয় করা অর্থের অপচয় রোধ করা দরকার। আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই। সেখানে তরুণদের সুস্বাস্থ্যের জন্য টিকাদান নিশ্চিত করা অতি জরুরি। সবার সমন্বিত সাহায্য পেলেই এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।

মায়া ভানডেনেন্ট

স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

উদ্দিষ্ট কিশোরীদের এইচপিভি টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে এইচপিভি ক্যাম্পেইন-২০২৪ আয়োজনের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। অবশ্যই এটি একটি অনেক বড় উদ্যোগ। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ এ ধরনের উদ্যোগের সফল বাস্তবায়নে সক্ষম ও উদ্দিষ্ট সব কিশোরীকে এইচপিভি টিকার আওতায় আনা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রুপান্তরে কিশোরী ও নারীরা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। তাই তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এই আলোকে জরায়ুমুখ ক্যানসার থেকে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জরায়ুমুখ ক্যানসারে প্রতিবছর ৫ হাজার নারীর মৃত্যু হয়। সব ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যানসার সংখ্যায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, যা খুবই উদ্বেগজনক। জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্তের দিক থেকে অল্প বয়সী গ্রামীণ ও প্রান্তিক নারীরা বেশি ঝুঁকিতে আছেন এবং এটি প্রতিরোধ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। জরায়ুমুখ ক্যানসার বিষয়ে আলোচনা করতে আমরা প্রায়ই সংকোচ বোধ করি। ফলে আজকের গোলটেবিল আলোচনা করতে পেরে আমরা আনন্দিত। এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সম্মানিত প্রতিনিধির এখানে উপস্থিতির মাধ্যমে এইচপিভি টিকাদান কার্যক্রমে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহায়তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। অত্যন্ত আশার কথা হলো, শুধু একটি টিকার মাধ্যমেই এইচপিভি সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়। এইচপিভি টিকা গ্রহণকে মূলধারায় নিয়ে আসতে বাংলাদেশ অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে।

ঢাকা বিভাগে গত বছর নভেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আংশিকভাবে বন্ধ থাকায় টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল। আশা করছি, এ বছর এই ধরনের চ্যালেঞ্জ  থাকবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকবে এবং আমরা বেশির ভাগ উদ্দিষ্ট কিশোরীদের কাছে পৌঁছাতে পারব। এ ক্ষেত্রে নব-উদ্ভাবিত অনলাইন টিকা নিবন্ধন অ্যাপটি (https://vaxepi.gov.bd/) কিশোরীরা নিজেই বা অন্য কারও সাহায্য নিয়ে ব্যবহার করতে পারবে।

এইচপিভি টিকাদান ক্যাম্পেইন কার্যক্রমের এ ধাপে ৭টি বিভাগে ১০ থেকে ১৪ বছরের উদ্দিষ্ট ৬২ লাখ  কিশোরীর সবার কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্য পূরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন টিকাদানকর্মীর শূন্য পদ নিয়ে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। এসব শূন্য পদ পূরণে বাড়তি জোর দেওয়ার এখনই ভালো সময়। রাস্তায় বসবাসকারী শিশুদের জন্যও আমাদের কিছু অংশীদারত্ব রয়েছে। অল্প বয়সে যৌনকর্মী হিসেবে যুক্ত হওয়া কিশোরীরা জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই তাদের টিকাদানও সবচেয়ে জরুরি। এসব কিশোরীর কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় সহায়তা করছি।

টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমুনাইজেশন (গ্যাভি) সহযোগিতা রয়েছে। এ ছাড়া এ কার্যক্রমে ইউএসএআইডি এবং অন্যান্য দাতা প্রতিষ্ঠানকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই। যদিও উদ্দিষ্ট ৬২ লাখ কিশোরীর কাছে পৌঁছানো সহজ বিষয় নয়, তবে সবার সম্মিলিত প্রয়াসে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারব বলে আমি অত্যন্ত আশাবাদী।

মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ

যুগ্ম সচিব, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়

বাংলাদেশে ২০২৩ সালে প্রথম ধাপে ঢাকা বিভাগে এইচপিভি টিকা কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। ২০ লাখের অধিক কিশোরীকে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধী এক ডোজ টিকা সফলভাবে দেওয়া হয়। গত বছর এ টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে অনেকের মধ্যে একটা ভীতি ছিল। এ টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও দ্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস (গ্যাভি) দ্বারা অনুমোধিত। আর গাজীপুরে দীর্ঘদিন ধরে এর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালানো হয়েছিল। গত বছর টিকা দেওয়া ২০ লাখ কিশোরীর মধ্যে এমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকা বিভাগ ব্যতীত ৭টি বিভাগের ৫১টি জেলায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ইপিআই, শিক্ষা বিভাগ, বিভিন্ন সংগঠন, স্থানীয় প্রশাসন, ১৬টি মন্ত্রণালয় ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় একযোগে ১৮ দিনব্যাপী এইচপিভি টিকা প্রদান করা হবে। স্কুল পর্যায়ে ৫ম থেকে ৯ম শ্রেণির কিশোরী ও স্কুলের বাইরে থাকা ১০ থেকে ১৪ বছরের কিশোরীরা এই টিকার আওতাভুক্ত। এ কার্যক্রমের প্রচারণা হিসেবে আজ আমরা এই গোলটেবিল আলোচনায় একত্র হয়েছি।

মাতৃমৃত্যু কমানো আমাদের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) অন্যতম লক্ষ্য। আমাদের দেশে পরিবারপ্রথা ও সমাজব্যবস্থায় মায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মা সুস্থ ও নীরোগ থাকলে পরিবারের অন্য সদস্যরাও ভালো থাকবে।

দেশে প্রতিবছর প্রায় ৫ হাজার নারী এ জরায়ুমুখ ক্যানসারের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। আমাদের মোট মৃত্যুর ৬৫ শতাংশ অসংক্রামক ব্যাধির কারণে ঘটে। এর মধ্যে মরণব্যাধি ঘাতক জরায়ুমুখ ক্যানসার অন্যতম কারণ।

২৪ অক্টোবর এইচপিভি টিকা প্রদান  কার্যক্রমটি শুরু হয়েছে। এটা আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা অত্যন্ত সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পালন করবেন।

আমরা ইপিআই ও অন্যান্য বিভাগের সহযোগিতায় বেশ সফলভাবেই কাজ করছি। ৮৭ শতাংশ মানুষ আমাদের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতাভুক্ত। এর ফলে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সহযোগিতায় মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাবে; মানুষ সুস্থ ও নীরোগ থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

ঢাকা বিভাগের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবার আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারব।

ডা. শাহ আলী আকবর আশরাফি

এমআইএস–এর প্রধান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

সরকারিভাবে কিশোরীদের বয়সসীমা ১০ থেকে ১৪ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ের (ভেরিফিকেশন) জন্য সিটিজেন ওয়েব পোর্টাল তৈরি করা হয়েছে, যেন অভিভাবকেরা তাঁদের কন্যাসন্তানের জন্মসনদ দিয়ে টিকার নিবন্ধন করতে পারেন। টিকা নিবন্ধনের জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ নম্বর থাকা আবশ্যক।

একজন কিশোরী ১৭ সংখ্যার জন্মনিবন্ধন সনদ নম্বর ও জন্মতারিখ দিলে যাচাইকরণের জন্য ৬ সংখ্যার একটি ক্যাপচা কোড পাবে। এ তথ্য বিডিআরএসের তথ্যের সঙ্গে মিললে নিবন্ধনকারীর পূর্ণাঙ্গ তথ্য চলে আসবে। জন্মনিবন্ধন সনদ না থাকা বা নিবন্ধন করতে না পারা কিশোরীদেরও টিকা নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

সরকার মাইক্রো প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে ৫ম থেকে ৯ম শ্রেণির সব কিশোরীর টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে। সে ক্ষেত্রে কারও বয়স ১০ বছরের কম বা ১৪ বছরের বেশি হলে আমরা বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ও বিডিআরএসের তথ্যভান্ডার ব্যবহার করি। সরকারি তথ্য সহায়তার মাধ্যমে মোবাইল ফোনে এইচপিভি টিকা ২০২৪ বিষয়ক বার্তা পাঠিয়ে জনগণের সচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) আমরা অনুরোধ করেছি। এর মাধ্যমে অভিভাবকেরা সচেতন হবেন ও টিকা কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুত থাকবেন। টিকা কার্যক্রম শতভাগ আধুনিকায়নের জন্য ইপিআইকে অনুরোধ করা হয়েছে।

জন্মনিবন্ধন শতভাগ আধুনিক হয়ে ওঠেনি। তাই ম্যানুয়ালি কিছু নিবন্ধনের সুযোগ রাখা হয়েছে। এ আধুনিক অনলাইন প্রক্রিয়ার জন্য আমাদের দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকবল দরকার। এ লোকবলের সাহায্য আমরা ইউনিসেফ থেকে পাচ্ছি।

এ প্রক্রিয়াকে আরও উন্নত করার জন্য ইউনিসেফ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, ব্যানবেইস, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন অধিদপ্তর, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, ব্রিটিশ কাউন্সিলসহ সবার সম্মিলিত সহযোগিতায় কাজ করে যাচ্ছি।

ব্রিগে. জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী

প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন

গতবার এইচপিভি টিকাদানের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল। বাজারে কিছু বাণিজ্যিক টিকা রয়েছে। তাদের ডোজের মাত্রা ভিন্ন হওয়ায় এক ডোজ এইচপিভি টিকা কার্যকরী কি না, তা নিয়ে একটা ভ্রান্ত ধারণা ছিল। বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষকেরা এবং সংবাদমাধ্যমগুলো প্রচারণা চালালে ভুল ধারণাটি দূর করা যাবে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশে এইচপিভি নিয়মিত টিকাদান কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। গত বছর ঢাকা বিভাগের সাফল্য ৭৫ শতাংশ দেখানো হচ্ছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ের কর্মীরা ৯০ শতাংশের বেশি সফলভাবে টিকা গ্রহণ করেছে বলে জানাচ্ছেন।

এখানে তথ্যের এমন বিভ্রান্তি কেন? মাঠপর্যায়ের কর্মীরা স্কুল বা কলেজের দায়িত্বরত প্রধানের কাছে ছাত্রীসংখ্যা জানতে চাইলে তাঁরা তা বাড়িয়ে বলেন। শিক্ষক অনুপাতে শিক্ষার্থী সংখ্যা সব সময় বাড়িয়ে বলা হয়। এখানে হয়তো সরকারি অনুদানের কোনো ব্যাপার আছে। কিন্তু মাইক্রো প্ল্যানের জন্য সঠিক সংখ্যাটা জানা জরুরি। তাই ইপিআই বা মাঠপর্যায়ে দায়িত্বরত ব্যক্তিরা উপস্থিতি খাতা থেকে সঠিক তথ্য আনতে পারলে লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে যাবে।

কওমি মাদ্রাসা ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আমরা একধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। এ টিকা শুধু নারীদের জন্য, তাহলে পুরুষের জন্য কী ব্যবস্থা? আমরা এ ধরনের কথা অনেক শুনেছি। তাদের মধ্যে এখনো হয়তো সে সচেতনতার বার্তা পৌঁছায়নি।

অনেক ছাত্রীর ১৭ সংখ্যার জন্মনিবন্ধন সনদ নেই। আবার অনেক শিশুর জন্মনিবন্ধন সনদ হাতে লেখা। ঢাকায় এ সমস্যা বেশি দেখা গেছে। তাই জন্মনিবন্ধন না থাকা বা জন্মনিবন্ধন ১৭ সংখ্যার নয়, এমন কিশোরীদেরও যেন টিকা দেওয়া যায়, সে সিদ্ধান্ত আগে থেকেই নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে যথাযথ পদ্ধতিও ঠিক করতে হবে। মানুষকে আরও সচেতন ও টিকাদানে অনুপ্রাণিত করার বিষয়েও ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্য প্রচারমাধ্যমগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।

ডা. মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন

সহকারী পরিচালক, ইপিআই অ্যান্ড সার্ভিল্যান্স, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের (এইচপিভি) এক শর বেশি সেরোটাইপ রয়েছে। জরায়ুমুখ ক্যানসার তৈরিতে ১৬ ও ১৮ নম্বর সেরোটাইপ ৭০ শতাংশ ভূমিকা রাখে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ রোগ পুরুষেরা বহন করেন আর নারীরা ভুক্তভোগী হন। বিশ্বব্যাপী নারীদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার দিকে থেকে জরায়ুমুখ ক্যানসার চতুর্থ।

বাংলাদেশে ক্যানসার–জাতীয় রোগগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্যানসারের কারণ জরায়ুমুখ ক্যানসার। দেশে প্রতি লাখ নারীর মধ্যে ১১ জন এ ক্যানসারে আক্রান্ত হয় এবং প্রতিবছর প্রায় ৫ হাজারের মতো নারী জরায়ুমুখ ক্যানসারে মারা যায়। পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি এবং ১০ থেকে ১৪ বছরের কিশোরীদের এক ডোজ এইচপিভি টিকা দিয়ে নারী জরায়ুমুখ ক্যানসারে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এইচপিভি টিকাদানের মাধ্যমে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারি। ক্যাম্পেইনে পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি ও ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীদের ৯৫ শতাংশ টিকার আওতায় নিয়ে আসা হবে।

অনলাইনে ভ্যাক্সইপিআই অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করে তাদের টিকা দেওয়া হবে। এই অ্যাপে কিশোরীরাই নিবন্ধন করতে পারবে। ২০১৬-১৭ সালে গাজীপুরে একটি পরীক্ষামূলক টিকা কার্যক্রম করেছিলাম। সেখানে ৯৫ শতাংশ টিকা দেওয়া হয়েছিল। তাদের কারও কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি। ফলে এ টিকা সুরক্ষিত ও কার্যকর। গত বছর ঢাকা বিভাগে ১৫ অক্টোবর থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত টিকা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য ছিল ২০ লাখ ১৮ হাজার ৪৩ জনকে টিকা দেওয়া। এর মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

এ বছর ২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকা বাদে বাকি ৭টি বিভাগে এ কার্যক্রম চলবে। এবার শতভাগ নিবন্ধনের মাধ্যমে টিকা নিশ্চিতকরণের চেষ্টা থাকবে। কওমি মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোকে ঠিকমতো টিকার আওতায় নিয়ে আসতে পারিনি। অটিস্টিক কন্যাশিশুদেরও টিকার আওতায় আনার চেষ্টা করছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানবহির্ভূত কিশোরীদের বিদ্যমান টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে টিকা দেওয়া হবে। এ কার্যক্রম সফল করার জন্য আমরা মাঠপর্যায়ে কর্মী ও সুপারভাইজারদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে যুক্ত করা হয়েছে।

অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসী বেগম

সাবেক সভাপতি, ওজিএসবি

আমরা যারা গাইনোকোলজিস্ট, একবারে কাছ থেকে এ রোগে আক্রান্ত নারীদের ভোগান্তি দেখেছি।

জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে এইচপিভি টিকার যথেষ্ট চাহিদা তৈরি হয়েছে। আশপাশের মানুষজন এ টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার বিষয়ে আলোচনা করছে। এ টিকা নেওয়া দরকার, এ প্রত্যাশা মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে।

আমরা দেশেই গবেষণা করে দেখিয়েছি যে এইচপিভি টিকা নিরাপদ। টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়া যথাযথ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গ্যাভি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবাই যথাযথভাবে ভূমিকা পালন করবেন বলে আশা রাখছি। গতবার ৭৫ শতাংশ টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এবার আশা করছি শতভাগ টিকার আওতাভুক্ত হবে। গতবার থেকে শিক্ষা নিয়ে অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগানো অত্যন্ত প্রয়োজন।

টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে এখনো কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছে। বিবাহিতরা টিকা নিতে পারবেন কি না, প্রায়ই এ প্রশ্ন আসে। অনেকেই মনে করেন এ টিকা বিবাহিতরা নিতে পারবেন না।এ জন্য স্কুলের বাইরে প্রচারণা আরও জোরদার করতে হবে। এরপরও টিকা নিয়ে অনেক খুঁটিনাটি প্রশ্ন থাকে। টিকা সম্পর্কিত সব প্রশ্নের উত্তর আমাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। ওজিএসবি থেকে বিশেষ দল এসব উত্তর দিয়েছে। এরপরও কোনো প্রশ্ন থাকলে আমাদের জানাবেন। আমরা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে উত্তর দেওয়ার ব্যবস্থা করব।

আমরা ১৬৫তম দেশ হিসেবে টিকা কার্যক্রমে যোগ দিয়েছি। এ ক্ষেত্রে আমরা শতভাগ সাফল্য অর্জন করে প্রথম হতে চাই। নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষার যেকোনো বিষয়ে কাজে বেসরকারি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সহযোগিতার জন্য ওজিএসবি সব সময় সজাগ আছে।

অধ্যাপক খান মইনুদ্দিন সোহেল

পরিচালক (মাধ্যমিক শাখা), মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)

এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচনা হচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পক্ষ থেকে বলতে পারি, আমাদের কাজ শুধু সহযোগিতা করা। বাকি সব কাজ আপনাদের।

শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ এ কাজে যুক্ত রয়েছে। এ কর্মসূচি যাদের কেন্দ্র করে, মূলত তারা বেশির ভাগই আমাদের আওতায়। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ এ কর্মসূচিকে সফল করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। আমাদের দেশের কন্যাশিশুদের নিয়ে আপনাদের কর্মসূচি সফল করতে নির্দেশনা, পরিপত্র, চিঠিসহ আরও যা যা প্রয়োজন সব সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। আপনাদের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা পেলে শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যা প্রয়োজন, সে নির্দেশনা এবং সহযোগিতা করা হবে।

গত বছর শুধু ঢাকা বিভাগে এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এবার ২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকা বিভাগ ছাড়া দেশের অন্যান্য ৭টি বিভাগে এই কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। আমি আশা করি, এবার এই কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়িত হবে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।

এএসএম শফিউল আলম তালুকদার

প্রকল্প পরিচালক, মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন

এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচিতে সচেতনতা বাড়াতে আমরা একটা সহায়ক ভূমিকা পালন করছি। মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমে মূলত কোরআন শিক্ষা এবং নীতিনৈতিকতার শিক্ষা দিয়ে থাকে। আমাদের ৪৪ হাজার ২০০ সেন্টার আছে, যেখানে শিশুদের কোরআন ও নৈতিক শিক্ষা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

আমাদের স্কুল ও সেন্টারে যে শিশুরা আছে, তাদের বয়সসীমা ৫ থেকে ৬ বছর। আরেকটি আছে ৮ বছর ১৪ বছরের যারা কোরআন শিক্ষায় আছে। এর মধ্যে আমাদের ২৫ শতাংশ নারী শিক্ষক রয়েছেন, যাঁদের আমরা এখানে যুক্ত করতে পারি। এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচিতে ধর্মীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সচেতনমূলক বার্তা প্রচার করা যায়।

টিকাদানের ক্ষেত্রে যে বয়সসীমা বেছে নেওয়া হয়েছে, সেখানে আমাদের প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশকে গ্যাভি যে বয়সসীমার পরামর্শ দিয়েছে, আমাদের নির্দিষ্ট একটা টিকা নির্ধারণ করে দিয়েছে, যা দিয়ে আমরা এই টিকাদান কর্মসূচিটা পরিচালনা করছি। আমাদের চ্যালেঞ্জটা হলো, নির্ধারিত বয়সসীমা যদি বাড়ানো যায়, তাহলে ভালো হয়। কারণ, বড় একটা অংশ টিকার আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ জন্য আমাদের কাভারেজ শতভাগ হচ্ছে না।

ডা. চিরঞ্জিত দাস

ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার–ইপিআই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ

জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধের মূল হাতিয়ারই ভ্যাকসিন। আর বাংলাদেশ সরকার ১০ থেকে ১৪ বছরের যে বয়সসীমা নির্ধারণ করেছে, তা সবচেয়ে আদর্শ সময়। সুতরাং এটাই আমাদের ফলো করতে হবে, এখানে দ্বিধা করার কোনো সুযোগ নেই। দ্বিতীয় যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, এক ডোজ না একাধিক ডোজ। বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞদের মতে এবং বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞদের সম্মিলিত মতে বলা হয়েছে, এইচপিভির জন্য এক ডোজ টিকাই চলবে। এইচপিভি টিকা এক ডোজই যথেষ্ট, এটি ফার্মাসিস্ট কোম্পানিগুলোও মেনে নিয়েছে। তাই এখানে সংশয় প্রকাশ করার কোনো সুযোগ নেই।

গত বছর ঢাকা বিভাগের অর্জন ৭৫ শতাংশ, তবু এখানে কিছু ঘাটতি ছিল। প্রতিবছর ১ লাখ নারীর মধ্যে ১১ জন নারী জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন। জাতীয়ভাবে ইপিআই কার্যক্রমে ১৫ লাখ টিকা দিয়েছি, সে হিসাবে গড়ে আমরা ১৫০ জন নারীকে সুরক্ষিত করতে পেরেছি। আমরা যে ২৫ শতাংশ অকার্যকর হয়েছি, সেখানে গড়ে ৫০ জন নারী এখনো ঝুঁকিতে। তাই এখানেই এখন ভূমিকা রাখতে হবে। আমাদের কোনো সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না এবং উচ্চ ঝুঁকিতে যে শিশুটি আছে, তাকে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে সরকারকে আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। যদিও আমরা বলছি ৯০ শতাংশ আমাদের লক্ষ্য, কিন্তু প্রতিটি কন্যাশিশুর কাছে আমরা পৌঁছাতে চাই।

সাবিনা পারভীন

পরিচালক (পরিকল্পনা), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর

সব সময় একজন সহযোদ্ধা হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাশে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ছিল। মাঠপর্যায়ে সম্মুখসারিতে আমাদের কর্মীরাও এই কার্যক্রম চলমান রাখতে সহযোগিতা করে চলেছেন।

যে পদ্ধতিতে জরায়ুমুখ ক্যানসারের টেস্টগুলো করেছি, কিছু রিপোর্ট আমাদের কাছে আছে। আমাদের এমসিডব্লিউসির মাধ্যমে যে টেস্ট করেছি, সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিবছরই প্রায় ২৫ হাজারের মতো স্ক্রিনিং হয়। এর মধ্যে দু-তিন হাজার পজিটিভ কেস থাকে, তখন তা সঙ্গে সঙ্গেই বিভাগীয় হাসপাতালগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম পর্যায়েই ১০ থেকে ১৪ বছরের কন্যাশিশুদের যদি এইচপিভি টিকা দেওয়া যায়, তাহলে প্রথমেই জরায়ুমুখ ক্যানসার রুখে দেওয়া সম্ভব।

ঢাকা বিভাগের যে অভিজ্ঞতা, সেখানে পরিবার পরিকল্পনার লোকবলও ছিল। তাঁদের ট্রেনিং করানো হয়েছিল। আমাদের টার্গেট গ্রুপ ৭৫ লাখের মতো। আমরা গত বছর ১৫ লাখের মতো টিকা দিয়েছি। এই টার্গেট গ্রুপের মোট সংখ্যাটা কত? যেহেতু এটা আনুমানিক একটা সংখ্যা এবং ভুল তথ্যের কারণে টার্গেট বেশি থাকায় সাফল্য কম; তাই লক্ষ্যের তথ্য সঠিক হলে সাফল্য বাড়বে।

স্কুল ঝরে পড়া শিশুদের জন্য আমাদের কিছু কার্যক্রম আছে। এ ক্ষেত্রে আমরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সহযোগিতাও নিয়ে থাকি। যেহেতু এই পুরো প্রক্রিয়া মেয়েদের, তাই এই ক্যাম্পিংয়ে নারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে করালে সহজ হবে। বিষয়টিতে সবার মনোযোগ দেওয়ার অনুরোধ রইল।

ডা. রিয়াদ মাহমুদ

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপক, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

স্কুলগুলো খুললে ক্যাম্পেইন আরও জোরদার করতে হবে; যাতে রেজিস্ট্রেশন সবাই নিশ্চিত করে ফেলে। কারণ, রেজিস্ট্রেশন না হলে শিক্ষার্থীরা টিকা পাবে না। ক্যাম্পেইন শেষ হলে আগামী বছর থেকে শুধু ৫ম শ্রেণি পড়ুয়া অথবা স্কুলবহির্ভূত ১০ বছরের শিশুরা টিকা পাবে। সুতরাং ২০২৪ ক্যাম্পেইনে কোনো কিশোরীকে বাদ দেওয়া যাবে না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান–বহির্ভূত কিশোরীরাও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারাই কিন্তু বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই সংখ্যা কিন্তু বেশি না, মাত্র ৩%। আমাদের টার্গেটের ৬২ লাখের মধ্যে ১ লাখ ৮৬ হাজার মেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান–বহির্ভূত। সংখ্যায় অল্প হলেও এখানে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের যত কৌশল আছে, যাঁরা মাঠে আছেন, তাঁরা সব শক্তি দিয়ে জানাবেন টিকাটা নিতেই হবে।

যত রকম তরুণ সংগঠন ও যুব দল আছে বিশেষ করে শিক্ষার্থী ভাইবোনদের ব্যবহার করতে হবে।

পার্বত্য অঞ্চল, চা–বাগান—এসব অঞ্চলেও আমরা কাজ করছি স্কুলগুলো নিয়ে। এদের সংখ্যাটা কম, কিন্তু এরাই রয়েছে বেশি ঝুঁকিতে।

আরেকটি কথা বলতে চাই, টিকাদান শিশুদের জন্য বিনিয়োগ, এটি খরচ নয়। ইউনিসেফ এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটা জরিপ করেছে, তাতে দেখেছি ১ ডলার বিনিয়োগ করলে পরিবর্তে রিটার্ন আসছে ২৫.২ ডলার। টিকাদানের কারণে প্রতিবছর ৯৪ হাজার শিশুর জীবন বাঁচে। টিকার কারণে ৫০ লাখের রোগ হয় না। তাই টিকাদান একটি বিনিয়োগ, এ জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানাই।

নির্দেশনা

  • জরায়ুমুখ ক্যানসার রোধে কিশোরীদের বিনা মূল্যে এক ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে।
  • ভ্যাক্সইপিআই অ্যাপের (vaxepi.gov.bd) মাধ্যমে কিশোরীরা নিজেরাই টিকার জন্য নিবন্ধন করে টিকা নিতে পারবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিকা দিতে ব্যর্থ হলে নিকটবর্তী ইপিআই সেন্টারে টিকা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
  • ঢাকা বিভাগের বাইরে অন্য সাত বিভাগে ২৪ অক্টোবর থেকে এইচপিভি টিকা কার্যক্রম চলবে।
  • জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে বিশ্বের ১৪০টি দেশে ২০০৬ সাল থেকে এই টিকা দেওয়া হচ্ছে।
  • এইচপিভি টিকা নিরাপদ ও এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা