London ০১:০৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকের জন্য প্রাধ্যক্ষের বিশেষ ‘শৌচাগার সেবা’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অছাত্র হওয়া সত্ত্বেও অবৈধভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে থাকতেন। হল প্রশাসন এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো তাঁদের সুবিধার্থে দিয়েছে বিশেষ ‘শৌচাগার সেবা’।

হল সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সাড়ে চার শতাধিক শিক্ষার্থীর জন্য শৌচাগার আছে ২৮টি। এর মধ্যে ২৭টি পুরোনো ও জীর্ণশীর্ণ হলেও একটি একেবারে নতুন। প্রায় দুই লাখ টাকা ব্যয়ে টাইলস, বেসিন, কমোডসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে গত বছর শৌচাগারটি আধুনিক করা হয়। এটি ব্যবহার করতেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান (বাবু) ও সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব। দুই নেতাকে তুষ্ট করতে শৌচাগার আধুনিকায়নে উদ্যোগ নিয়েছিলেন হলের সদ্য সাবেক প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শায়খুল ইসলাম মামুন জিয়াদ।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান আগে সৈয়দ আমীর হলে থাকতেন। অছাত্র হওয়ায় হল প্রাধ্যক্ষ ও ছাত্রলীগের গত কমিটির সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার অনুসারীরা তাঁকে হল থেকে বের করে দেন। গত বছরের অক্টোবরে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার আগে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। সভাপতি হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের চার আসনবিশিষ্ট ২৩০ নম্বর কক্ষে একাই থাকতেন। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব নেতা হওয়ার আগে মাদার বখ্শ হলের চার আসনবিশিষ্ট ২১৫ নম্বর কক্ষে থাকতেন। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু হলের ২২৮ নম্বর কক্ষে থাকা শুরু করেন। তাঁরা দুজনে হলের আধুনিকায়ন করা ২৩৪ নম্বর শৌচাগারটি ব্যবহার করতেন।

শৌচাগার আধুনিকায়নে ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী বরাবর একটি আবেদনপত্র পাঠান হলের সাবেক প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শায়খুল ইসলাম মামুন। আবেদনপত্রে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ২৩৪ নম্বর বাথরুমটির মেঝে ও গোসলখানায় পানি জমে থাকায় ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় বাথরুমটি সম্পূর্ণভাবে টাইলসকরণ ও পুরোনো বেসিন দুটি পরিবর্তন করে নতুন দুটি উন্নত মানের বেসিন স্থাপন অতীব জরুরি প্রয়োজন। এমতাবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে বাথরুমটি আধুনিকীকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করছি। উল্লেখ্য, বাথরুমটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ব্যবহার করে থাকেন।’

ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শৌচাগারটি আধুনিকায়নে উদ্যোগ নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর। জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া আমরা ১০ পয়সাও কোথাও খরচ করতে পারি না। প্রশাসনের অনুমতি থাকায় বাথরুমটি আধুনিকীকরণ করা হয়েছিল। সেই কাজে আনুমানিক দুই লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছিল। আমরা স্বপ্রণোদিতভাবে কোনো কাজ করি না।’

কোনো গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করতে প্রশাসনের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া অনিয়ম। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। তিনি বলেন, হলে যাঁরা থাকেন, সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে বৈষম্য করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা উচিত।

হলের কয়েকজন আবাসিক শিক্ষার্থী জানান, হলে ছাত্রলীগের দখলদারি ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের তুলে এনে হলের বিভিন্ন কক্ষে নির্যাতন করা হতো। ছাত্রলীগ নেতাদের সুপারিশ ছাড়া হলে আসন পাওয়া যেত না। এসব ব্যাপারে হল প্রশাসন পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো তাঁদের সাহায্য করেছে।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাইখুল ইসলাম মামুন জিয়াদ পদত্যাগ করেন। এ ব্যাপারে কথা বলতে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও বন্ধ পাওয়া যায়। তবে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ওঁরা (ছাত্রলীগ নেতারা) বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এসেছিলেন। এখানে আমার কিছু করার ছিল না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পদত্যাগ করেছেন। এ বিষয়ে কথা বলতে নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীবের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৪:৫৮:৩২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
৫৬
Translate »

ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকের জন্য প্রাধ্যক্ষের বিশেষ ‘শৌচাগার সেবা’

আপডেট : ০৪:৫৮:৩২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অছাত্র হওয়া সত্ত্বেও অবৈধভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে থাকতেন। হল প্রশাসন এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো তাঁদের সুবিধার্থে দিয়েছে বিশেষ ‘শৌচাগার সেবা’।

হল সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সাড়ে চার শতাধিক শিক্ষার্থীর জন্য শৌচাগার আছে ২৮টি। এর মধ্যে ২৭টি পুরোনো ও জীর্ণশীর্ণ হলেও একটি একেবারে নতুন। প্রায় দুই লাখ টাকা ব্যয়ে টাইলস, বেসিন, কমোডসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে গত বছর শৌচাগারটি আধুনিক করা হয়। এটি ব্যবহার করতেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান (বাবু) ও সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব। দুই নেতাকে তুষ্ট করতে শৌচাগার আধুনিকায়নে উদ্যোগ নিয়েছিলেন হলের সদ্য সাবেক প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শায়খুল ইসলাম মামুন জিয়াদ।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান আগে সৈয়দ আমীর হলে থাকতেন। অছাত্র হওয়ায় হল প্রাধ্যক্ষ ও ছাত্রলীগের গত কমিটির সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার অনুসারীরা তাঁকে হল থেকে বের করে দেন। গত বছরের অক্টোবরে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার আগে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। সভাপতি হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের চার আসনবিশিষ্ট ২৩০ নম্বর কক্ষে একাই থাকতেন। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব নেতা হওয়ার আগে মাদার বখ্শ হলের চার আসনবিশিষ্ট ২১৫ নম্বর কক্ষে থাকতেন। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু হলের ২২৮ নম্বর কক্ষে থাকা শুরু করেন। তাঁরা দুজনে হলের আধুনিকায়ন করা ২৩৪ নম্বর শৌচাগারটি ব্যবহার করতেন।

শৌচাগার আধুনিকায়নে ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী বরাবর একটি আবেদনপত্র পাঠান হলের সাবেক প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শায়খুল ইসলাম মামুন। আবেদনপত্রে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ২৩৪ নম্বর বাথরুমটির মেঝে ও গোসলখানায় পানি জমে থাকায় ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় বাথরুমটি সম্পূর্ণভাবে টাইলসকরণ ও পুরোনো বেসিন দুটি পরিবর্তন করে নতুন দুটি উন্নত মানের বেসিন স্থাপন অতীব জরুরি প্রয়োজন। এমতাবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে বাথরুমটি আধুনিকীকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করছি। উল্লেখ্য, বাথরুমটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ব্যবহার করে থাকেন।’

ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শৌচাগারটি আধুনিকায়নে উদ্যোগ নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর। জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া আমরা ১০ পয়সাও কোথাও খরচ করতে পারি না। প্রশাসনের অনুমতি থাকায় বাথরুমটি আধুনিকীকরণ করা হয়েছিল। সেই কাজে আনুমানিক দুই লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছিল। আমরা স্বপ্রণোদিতভাবে কোনো কাজ করি না।’

কোনো গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করতে প্রশাসনের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া অনিয়ম। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। তিনি বলেন, হলে যাঁরা থাকেন, সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে বৈষম্য করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা উচিত।

হলের কয়েকজন আবাসিক শিক্ষার্থী জানান, হলে ছাত্রলীগের দখলদারি ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের তুলে এনে হলের বিভিন্ন কক্ষে নির্যাতন করা হতো। ছাত্রলীগ নেতাদের সুপারিশ ছাড়া হলে আসন পাওয়া যেত না। এসব ব্যাপারে হল প্রশাসন পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো তাঁদের সাহায্য করেছে।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাইখুল ইসলাম মামুন জিয়াদ পদত্যাগ করেন। এ ব্যাপারে কথা বলতে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও বন্ধ পাওয়া যায়। তবে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ওঁরা (ছাত্রলীগ নেতারা) বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এসেছিলেন। এখানে আমার কিছু করার ছিল না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পদত্যাগ করেছেন। এ বিষয়ে কথা বলতে নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীবের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।