London ১১:৪৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম:
‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ কোন পথে’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত নেত্রকোনা সীমান্তে টংক আন্দোলনের নেত্রী রাশি মণি’র হাজংয়ের ৭৯তম প্রয়াণ দিবস পালিত ফরিদপুরে রিকশা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে চালককে হত্যা বিয়ে করলেন সারজিস আলম টিকটকে আসক্ত মেয়েকে গুলি করে হত্যা উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ প্লে-অফেই রিয়াল-সিটি লড়াই, বাকি ম্যাচে কে কার প্রতিপক্ষ ছাত্রলীগ কোনো প্রোগ্রাম করার চেষ্টা করলে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ কানাডা ও মেক্সিকোর পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ ট্রাম্পের মঞ্চে কোমর ধরে তরুণীকে কাছে টেনে ফ্লার্টিং শাহরুখের! ভিডিও ভাইরাল ১৪ সেকেন্ডের দুষ্টু ভঙ্গির ভিডিওতে ঝড় তুললেন পরীমণি!

আরেকটি নতুন বাদুড় পেল বাংলাদেশ

গুহায় ঝুলে আছে বড় পাতানাক বাদুড়ছবি: লেখক

বান্দরবান শহরে সকালের নাশতা সেরে অটোরিকশা নিয়ে রওনা হই রোয়াংছড়ির উদ্দেশে। গত ডিসেম্বরের ৯ তারিখ।

বান্দরবান শহরটি বেশ ছিমছাম, মানুষজন তুলনামূলকভাবে কম। ফলে রাস্তা বেশ ফাঁকা। শহর পেরিয়ে আমাদের অটোরিকশা ছুটে চলল ভোরের সুনসান রাস্তা ধরে। দুই পাশে উঁচু উঁচু পাহাড়, রাস্তায় বাঁক আছে, ফলে ড্রাইভার বেশ সাবধানেই চালাচ্ছেন। রাস্তায় মানুষের চলাচল কম। পাহাড়ি নারী-পুরুষেরা মাথায় থ্রোন (ঝুড়ি) ঝুলিয়ে জুমে কাজ করতে বেরিয়ে পড়েছেন।

ঘণ্টাখানেক পর আমরা রোয়াংছড়ি বাজারে পৌঁছাই। বেশ বড় বাজার। তবে লোকজনের উপস্থিতি তেমন চোখে পড়ল না। আমাদের গাইড অছাইং ওয়ং মারমা জানান, পাহাড়িরা দূরদূরান্ত থেকে আসে বলে বাজার জমে উঠতে সময় লাগে। বাজারে চা–পানের পর অটোরিকশা নিয়ে আবারও ছুটলাম আমাদের গন্তব্যে। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টায় আমরা পৌঁছাই পাহাড়ের গায়ের ছোট্ট একটি মারমা গ্রামে। গ্রামে ঢোকার রাস্তায় একটি দোকানে গিয়ে বসলাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বাদুড়–গবেষক অংসুই নু মারমা আগেই খবর দিয়ে রেখেছিলেন আমাদের আসার ব্যাপারে। পাড়ার হেডম্যান খুব সমাদর করলেন, চা-বিস্কুট খাওয়ালেন। তারপর তাঁর অল্পবয়সী এক ছেলেকে আমাদের গাইড করতে পাঠালেন।

গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটি ছোট পাহাড়ি ছড়া। পাড়া থেকে নেমে ছড়া পার হয়ে আমরা হাঁটছি। দুই পাশে বাঁশঝাড়, সেগুনের বাগান। ছড়ায় প্রায় হাঁটুসমান পানি। আমাদের এই ছড়ার উৎসমুখে যেতে হবে। তবেই আমরা বাদুড়গুহার কাছে পৌঁছাতে পারব।

আমরা যখন বাদুড়গুহায় পৌঁছাই, তখন দুপুর প্রায় ১২টা। গুহাটির মুখ দেখে মনে হলো, ভেতরে অতটা বড় হবে না। গুহামুখের ডান পাশের পাহাড়ের গায়ে একটি নামফলক আছে। একজন ভান্তে মাঝেমধ্যে ধ্যান করেন এই গুহায়। ফলে পবিত্রতা রক্ষা করে আমরা গুহায় প্রবেশ করি। বেশ অন্ধকার, সরু। উচ্চতা খুব একটা বেশি না। কিছু দূর এগোতেই বাদুড়ের গন্ধ নাকে এল। গাইডকে কিছুটা ভীত বলে মনে হলো। ইশারায় আমার পেছনে আসতে বলে আমি ধীর পায়ে সামনে এগোই। বাদুড় ইতিমধ্যে টের পেয়েছে আমাদের উপস্থিতি, ওড়াউড়ি শুরু করছে। মাথা, কানের দুই পাশ দিয়ে শাঁই শাঁই করে বাদুড় উড়তে শুরু করল। বেশ কিছু পরিচিত বাদুড় গুহার নানা অংশে ঝুলে থাকতে দেখা গেল। টর্চ জ্বালিয়ে ছবি তুললাম, সেই সঙ্গে বাদুড়ের সংখ্যা, নানা বৈশিষ্ট্য টুকে নিলাম। কয়েকটি বাদুড় পেলাম, অন্যদের থেকে একটু আলাদা, বারবার জায়গা পরিবর্তন করছিল। প্রথমে বাদুড়টি দেখে পরিচিত বাদুড়ই মনে হলো। তবে বাদুড়ের গায়ের রং কিছুটা ভিন্ন মনে হওয়ায় একটু সন্দেহ থেকে গেল। তাই একটি নমুনা সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে ডিএনএ বিশ্লেষণের সিদ্ধান্ত নিই। আর এতেই বাদুড়টি নিয়ে আমাদের সন্দেহের উত্তর মেলে।

বাদুড়টির ইংরেজি নাম গ্র্যান্ড লিফনোজ ব্যাট, বাংলায় বড় পাতানাক বাদুড়। এটি বেশ বিরল। এর ঊর্ধ্ববাহুর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৬ মিলিমিটার, মাথা থেকে পায়ু পর্যন্ত ৭৫ মিলিমিটার, লেজ ৩৯ মিলিমিটার, কান ২০ মিলিমিটার লম্বা। মুখের দুই পাশে তিনটি করে লিফলেট থাকে; কিন্তু বাদুড়টি কাছাকাছি অন্য বাদুড় প্রজাতি থেকে শুধু এই বৈশিষ্ট্যগুলো দিয়ে আলাদা করে চেনা সহজ নয়। তাই প্রজাতিটি চিহ্নিত করতে আমরা ডিএনএ বারকোডিং করি। আন্তর্জাতিক জিন ব্যাংক এনসিবিআইতে গত মাসে বাদুড়টির ডিএনএ তথ্য জমা দিলে কর্তৃপক্ষ স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের অ্যাকসেশন নম্বর দেয়।

বাদুড়টি এর আগে বাংলাদেশে কোথাও দেখা যায়নি। এ মাসের ২ তারিখে জার্মানি থেকে প্রকাশিত ম্যামালিয়া নামের বিজ্ঞান সাময়িকীতে এই বাদুড়ের ওপর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

আইইউসিএনের বৈশ্বিক লাল তালিকায় এটি ২০১৬ সালে অন্তর্ভুক্ত করে ‘ডেটা ডেফিশিয়েন্ট’ প্রজাতির তালিকায় রাখা হয়। বিজ্ঞানী অ্যালেন ১৯৩৬ সালে এটি প্রথম মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চল থেকে রিপোর্ট করেন। দীর্ঘ সময় পর চলতি দশকের গোড়ার দিকে এটি ভারতের আসাম ও চীনে পাওয়া যায়। ২০১৯ সালে থাইল্যান্ড, লাওস ও ভিয়েতনামে বিজ্ঞানীরা এটি খুঁজে পান। ২০২৪ সালে এসে বাদুড়ের বৈশ্বিক বিস্তারে বাংলাদেশের নামটি যুক্ত হলো।

অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৪:৪৬:৫৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর ২০২৪
৪৫
Translate »

আরেকটি নতুন বাদুড় পেল বাংলাদেশ

আপডেট : ০৪:৪৬:৫৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর ২০২৪

গুহায় ঝুলে আছে বড় পাতানাক বাদুড়ছবি: লেখক

বান্দরবান শহরে সকালের নাশতা সেরে অটোরিকশা নিয়ে রওনা হই রোয়াংছড়ির উদ্দেশে। গত ডিসেম্বরের ৯ তারিখ।

বান্দরবান শহরটি বেশ ছিমছাম, মানুষজন তুলনামূলকভাবে কম। ফলে রাস্তা বেশ ফাঁকা। শহর পেরিয়ে আমাদের অটোরিকশা ছুটে চলল ভোরের সুনসান রাস্তা ধরে। দুই পাশে উঁচু উঁচু পাহাড়, রাস্তায় বাঁক আছে, ফলে ড্রাইভার বেশ সাবধানেই চালাচ্ছেন। রাস্তায় মানুষের চলাচল কম। পাহাড়ি নারী-পুরুষেরা মাথায় থ্রোন (ঝুড়ি) ঝুলিয়ে জুমে কাজ করতে বেরিয়ে পড়েছেন।

ঘণ্টাখানেক পর আমরা রোয়াংছড়ি বাজারে পৌঁছাই। বেশ বড় বাজার। তবে লোকজনের উপস্থিতি তেমন চোখে পড়ল না। আমাদের গাইড অছাইং ওয়ং মারমা জানান, পাহাড়িরা দূরদূরান্ত থেকে আসে বলে বাজার জমে উঠতে সময় লাগে। বাজারে চা–পানের পর অটোরিকশা নিয়ে আবারও ছুটলাম আমাদের গন্তব্যে। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টায় আমরা পৌঁছাই পাহাড়ের গায়ের ছোট্ট একটি মারমা গ্রামে। গ্রামে ঢোকার রাস্তায় একটি দোকানে গিয়ে বসলাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বাদুড়–গবেষক অংসুই নু মারমা আগেই খবর দিয়ে রেখেছিলেন আমাদের আসার ব্যাপারে। পাড়ার হেডম্যান খুব সমাদর করলেন, চা-বিস্কুট খাওয়ালেন। তারপর তাঁর অল্পবয়সী এক ছেলেকে আমাদের গাইড করতে পাঠালেন।

গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটি ছোট পাহাড়ি ছড়া। পাড়া থেকে নেমে ছড়া পার হয়ে আমরা হাঁটছি। দুই পাশে বাঁশঝাড়, সেগুনের বাগান। ছড়ায় প্রায় হাঁটুসমান পানি। আমাদের এই ছড়ার উৎসমুখে যেতে হবে। তবেই আমরা বাদুড়গুহার কাছে পৌঁছাতে পারব।

আমরা যখন বাদুড়গুহায় পৌঁছাই, তখন দুপুর প্রায় ১২টা। গুহাটির মুখ দেখে মনে হলো, ভেতরে অতটা বড় হবে না। গুহামুখের ডান পাশের পাহাড়ের গায়ে একটি নামফলক আছে। একজন ভান্তে মাঝেমধ্যে ধ্যান করেন এই গুহায়। ফলে পবিত্রতা রক্ষা করে আমরা গুহায় প্রবেশ করি। বেশ অন্ধকার, সরু। উচ্চতা খুব একটা বেশি না। কিছু দূর এগোতেই বাদুড়ের গন্ধ নাকে এল। গাইডকে কিছুটা ভীত বলে মনে হলো। ইশারায় আমার পেছনে আসতে বলে আমি ধীর পায়ে সামনে এগোই। বাদুড় ইতিমধ্যে টের পেয়েছে আমাদের উপস্থিতি, ওড়াউড়ি শুরু করছে। মাথা, কানের দুই পাশ দিয়ে শাঁই শাঁই করে বাদুড় উড়তে শুরু করল। বেশ কিছু পরিচিত বাদুড় গুহার নানা অংশে ঝুলে থাকতে দেখা গেল। টর্চ জ্বালিয়ে ছবি তুললাম, সেই সঙ্গে বাদুড়ের সংখ্যা, নানা বৈশিষ্ট্য টুকে নিলাম। কয়েকটি বাদুড় পেলাম, অন্যদের থেকে একটু আলাদা, বারবার জায়গা পরিবর্তন করছিল। প্রথমে বাদুড়টি দেখে পরিচিত বাদুড়ই মনে হলো। তবে বাদুড়ের গায়ের রং কিছুটা ভিন্ন মনে হওয়ায় একটু সন্দেহ থেকে গেল। তাই একটি নমুনা সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে ডিএনএ বিশ্লেষণের সিদ্ধান্ত নিই। আর এতেই বাদুড়টি নিয়ে আমাদের সন্দেহের উত্তর মেলে।

বাদুড়টির ইংরেজি নাম গ্র্যান্ড লিফনোজ ব্যাট, বাংলায় বড় পাতানাক বাদুড়। এটি বেশ বিরল। এর ঊর্ধ্ববাহুর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৬ মিলিমিটার, মাথা থেকে পায়ু পর্যন্ত ৭৫ মিলিমিটার, লেজ ৩৯ মিলিমিটার, কান ২০ মিলিমিটার লম্বা। মুখের দুই পাশে তিনটি করে লিফলেট থাকে; কিন্তু বাদুড়টি কাছাকাছি অন্য বাদুড় প্রজাতি থেকে শুধু এই বৈশিষ্ট্যগুলো দিয়ে আলাদা করে চেনা সহজ নয়। তাই প্রজাতিটি চিহ্নিত করতে আমরা ডিএনএ বারকোডিং করি। আন্তর্জাতিক জিন ব্যাংক এনসিবিআইতে গত মাসে বাদুড়টির ডিএনএ তথ্য জমা দিলে কর্তৃপক্ষ স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের অ্যাকসেশন নম্বর দেয়।

বাদুড়টি এর আগে বাংলাদেশে কোথাও দেখা যায়নি। এ মাসের ২ তারিখে জার্মানি থেকে প্রকাশিত ম্যামালিয়া নামের বিজ্ঞান সাময়িকীতে এই বাদুড়ের ওপর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

আইইউসিএনের বৈশ্বিক লাল তালিকায় এটি ২০১৬ সালে অন্তর্ভুক্ত করে ‘ডেটা ডেফিশিয়েন্ট’ প্রজাতির তালিকায় রাখা হয়। বিজ্ঞানী অ্যালেন ১৯৩৬ সালে এটি প্রথম মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চল থেকে রিপোর্ট করেন। দীর্ঘ সময় পর চলতি দশকের গোড়ার দিকে এটি ভারতের আসাম ও চীনে পাওয়া যায়। ২০১৯ সালে থাইল্যান্ড, লাওস ও ভিয়েতনামে বিজ্ঞানীরা এটি খুঁজে পান। ২০২৪ সালে এসে বাদুড়ের বৈশ্বিক বিস্তারে বাংলাদেশের নামটি যুক্ত হলো।

অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়