শ্রমজীবী মানুষের মে দিবস কেমন?

মে দিবস আসে, মে দিবস যায়। দেওয়ালজুড়ে কিছু পোস্টার সাঁটানো হয়, শহরে মিছিল হয়, বক্তৃতা হয়। কিন্তু আশপাশের ক্লান্ত শ্রমিকদের জীবন তেমন বদলায় না। তারা হয়তো জানেনই না, আজকের দিনটিকে ‘শ্রমিকের অধিকার দিবস’ বলা হয়। কারণ অধিকার নিয়ে তারা ভাবেন না। তারা শুধু ভাবেন কালকের দিনটি যেন আরও একটি মজুরির দিন হয়। তাদের জীবনের গল্প নিয়েই এ আয়োজন।
ঝুড়ি নয় জীবন বোনেন তারা
বাঁশের চিকন ফালি হাতে দ্রুতগতিতে জোড়া লাগাচ্ছেন এক যুবক। পাশে বসে মাঝবয়সী লোক গ্যালভানাইজড তার দিয়ে সেগুলো বাঁধছেন। এমন দৃশ্য ধরা পড়লো গাবতলীর তুরাগ নদীর তীরঘেঁষা একটি দোকানে। ছোট্ট দোকানে তৈরি করা বাঁশের ঝুড়িগুলো তাদের আয়ের উৎস।
দোকানের ক্রেতা আশপাশের খেটে খাওয়া মানুষ। কেউ ট্রলার থেকে বালু নামান, কেউ পাথর ভাঙেন। ঝুড়ি ভরে নামান মালামাল। কেউ আবার জাহাজ-লঞ্চে মাল তোলেন বা নামান। তৈরি ঝুড়িগুলোর বড় অংশ সেখানেই বিক্রি হয়ে যায়। এই পণ্যের বড় বাজার গড়ে উঠেছে মূলত এসব শ্রমজীবী মানুষের প্রয়োজনেই।
ঝুড়ি তৈরির কাজ সহজ নয়। শুরুটা হয় ভালো মানের বাঁশ বেছে নেওয়ার মাধ্যমে। সেই বাঁশ চিড়ে বানাতে হয় পাতলা ফালি। যা নির্দিষ্ট সময় পানিতে ভিজিয়ে নরম করতে হয়। এরপর শুরু হয় ঝুড়ি বোনার কাজ। নকশা অনুযায়ী চলে বুনন। শাক-সবজির ঝুড়ি, মাছধরার ঝাঁকি, চাল রাখার দোন থেকে শুরু করে রঙিন শো-পিস—সবই বানান তারা। কিছু ঝুড়িতে বাড়ানো হয় সৌন্দর্য। যাতে বাজারে ভালো দাম পাওয়া যায়।
এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত পরিবারগুলো বছরের পর বছর কাজ করে আসছেন। বাবা-মায়ের হাতে শেখা কৌশল আজ জীবিকার অস্ত্র হয়ে উঠেছে। ঝুড়ি বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়েই চলে সংসার। কারিগর সোহেল মিয়া বলেন, ‘আমাদের বানানো ঝুড়ি ছাড়া অনেক কাজই থেমে যাবে। এটি ব্যস্ত এলাকা, ঝুড়ির চাহিদা বেশি। কোরবানিতে চাপ বাড়ে। তেমন কোনো ছুটি নাই, না এলে হাজিরা নাই।’
শহরের কারখানার শ্রমিকদের পাশাপাশি হস্তশিল্পের নীরব শিল্পীদের স্মরণ করা উচিত। যারা দিনের পর দিন হাতেগড়া শিল্পকর্ম দিয়ে জীবনের হাল ধরছেন। তাদের নেই কোনো ছুটি বা উৎসব। তবুও প্রতিদিন রুটিন মাফিক কাজ করে যাচ্ছেন টিকে থাকার লড়াইয়ে।
গোবরে কি পদ্ম ফুল ফোটে
ভ্যানে বোঝাই গোবর। ঘেমে একাকার শরীর। মুখজুড়ে বয়সের রেখা, সাদা চুলে ঝরে পড়া সময়ের ছাপ। তবুও থেমে নেই চাকা, থেমে নেই জীবনসংগ্রাম। নরসিংদীর মনোহরদীর গ্রামীণ পথে দেখা মিললো এই পরিশ্রমী বৃদ্ধের। যিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন শ্রমিক মানেই ইউনিফর্ম বা স্লোগান নয়।
পেছনে গোবরের স্তূপ। সামনে চেনা পথের ধুলো। তার কাছে মে দিবস মানে একটি দিন। প্রয়োজন আর দায়িত্বের কাছে উৎসব নিছক বিলাসিতা। তিনি যাচ্ছেন জমিতে সার প্রয়োগ করতে। যেখানে চলছে ফসলের প্রস্তুতি। এই পরিশ্রমী মানুষেরাই কৃষিকে ধরে রেখেছেন।
গ্রামে এখনো গোবরের কদর অনেক। কেউ ব্যবহার করেন জ্বালানি হিসেবে, কেউ ব্যবহার করেন সার হিসেবে। প্রয়োজন মেটাতেই নিজ ভ্যানে করে তিনি সংগ্রহ করেছেন গোবর। ছুটছেন ফসলি জমির দিকে। আয় বেশি হোক কিংবা কম, জীবনের গতি থেমে নেই। থামেনি শ্রমের চাকা। একাই ছুটছেন।
তুরাগপাড়ের শ্রমিক মা
মাথার ওপর নির্মম রোদ। চারপাশে পাথর আর কাদা মাটি। মাঝখানে একটি দৃশ্য যেন কাঁপিয়ে দেয় হৃদয়। একজন মা, পাথর ভাঙছেন অবিরাম। পাশে দাঁড়িয়ে ছোট্ট ছেলে। ছেলেটির কোলে জড়িয়ে আছে আরেকটি শিশু। কোলের শিশুটি ঘুমিয়ে গেছে। কখনো নড়ে ওঠে। ছেলেটি ভাইকে আঁকড়ে রেখেছে।
তুরাগ নদীর পাড়ে গাবতলীর এই নির্দয় দুপুরে এমন দৃশ্য দেখে চোখ ভিজে আসে। মনে হয়, পৃথিবীর সমস্ত বক্তৃতা, মিছিল, ব্যানার হার মানে মায়ের ঘামেভেজা মুখের সামনে। এই মা জানেন না, মে দিবস কী? তার কাছে মে দিবস মানে পাথর ভাঙা, ঘাম ঝরানো, শিশুর মুখে ভাত তুলে দেওয়ার যুদ্ধ। পাথর ভাঙার শব্দে লুকিয়ে আছে ভালোবাসার, ত্যাগের, টিকে থাকার গান।
শ্রমিক দিবস না জানা মাঝি
নৌকা যেন তার সন্তানের মতো। বুড়িগঙ্গার বুকে নৌকায় ভেসেই কেটে গেছে জীবনের অনেকগুলো বছর। এখন সে বৃদ্ধ, গায়ের জোর কিছুটা কমেছে। তবুও প্রতিদিন সকালে নেমে পড়েন নদীর জলে। কারণ নৌকাই তার আয়ের উৎস। বুড়িগঙ্গার পাড়ে নৌকার পাটাতন মেরামত করছিলেন তিনি। পুরোনো কাঠগুলো নষ্ট হয়ে গেছে, সেখানে যোগ করছেন নতুন কাঠ। হাত কাঁপে, কিন্তু মন স্থির। ‘নৌকা ভাঙলে আমি ভাঙি, এটারে ঠিক না কইরা পারুম কেমনে?’ বলে উঠলেন শক্ত গলায়।
নদীর জলেই তার পথচলা। কেউ নৌকা চালিয়ে মানুষ পার করেন, কেউ মাছ ধরেন, কেউ চুম্বক দিয়ে তোলেন পানির নিচে লুকিয়ে থাকা লোহার জিনিসপত্র। তিনিও তা-ই করতেন একসময়। এখন আর পারেন না। তবুও মাঝনদী অবধি গিয়ে বসে থাকেন। নৌকার পাল তুলে তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে।
কেরানীগঞ্জ আর সদরঘাটের মাঝখানে ভেসে থাকা এই জীবনের গল্পটা কোনো খবরের শিরোনাম নয় কিন্তু শ্রমের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ দেখে না তার নৌকার প্রতিটি কাঠে লেগে আছে কত বছরের ঘাম, কত শীত-গ্রীষ্ম-বৃষ্টির ক্ষতচিহ্ন। তার চোখে স্বপ্ন নেই, আছে টিকে থাকার লড়াই। এখন ছেলেরা নৌকা চালাতে চায় না, বলেন এর মধ্যে ভবিষ্যৎ নেই। কিন্তু তিনি থেমে যান না। কারণ তার ভবিষ্যৎ এখন অতীত হয়ে গেছে। তবুও নৌকার দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘এইডাই আমার জীবন।’
নৌযান চলে যাদের ঘামে
ছেলেটির নাম জহির। বয়স খুব বেশি নয়, বাইশ কি তেইশ। বুড়িগঙ্গার পাড়ে চোখে ঘুম আর হাতে হাতুড়ি নিয়ে হাজির। লঞ্চের মরিচা ধরা লোহার গায়ে জোরে জোরে আঘাত করে যাচ্ছে। সহকর্মী রফিক পেছন থেকে টেনে নিচ্ছেন মোটা শিট, যেটা কেটে পুরোনো জায়গায় বসানো হবে। কেউ গরম আগুনে ঝালাই করছেন, আবার কেউ রঙের বালতিতে তুলি ডুবিয়ে ধাতব গায়ে রঙের প্রলেপ দিচ্ছেন। সবকিছু ছাপিয়ে যা চোখে পড়ে, তা হলো মানুষের ঘাম, ক্লান্তি এবং ঠোঁটে আটকে থাকা নিঃশব্দ সহ্য।
বুড়িগঙ্গা শুধু নদী নয়, ঢাকার ধুকতে থাকা হৃদয়। এর বুকেই দাঁড়িয়ে আছে ছোট-বড় লঞ্চ, কার্গো, বার্জ। নৌযানগুলো যখন চালার অযোগ্য হয়ে পড়ে; তখন তার শুশ্রূষায় নেমে পড়েন এই শ্রমিকরা। কেউ মরিচা পড়া অংশ কেটে বাদ দেন, কেউ নতুন লোহার পাত লাগান, কেউ আবার অগ্নিশিখার মতো আগুনে ঝালাই করেন। প্রতিটি ধাপে থাকে ঝুঁকি, ধুলাবালি, বিষাক্ত গ্যাস এবং দীর্ঘ শ্রমঘণ্টা। তবুও থেমে থাকেন না তারা। যেন জীবন থামলেও, কাজ থামে না।
প্রচণ্ড গরমে মাথা ঢেকে কেউ প্লাস্টিকের টুকরো পরে, কেউ আবার গেঞ্জির হাতা ছিঁড়ে চোখ বাঁচান ধোঁয়ার ঝাপটা থেকে। মুখে মাস্ক নেই, নিরাপত্তা সরঞ্জামের উপস্থিতিও কম। পায়ে ছেঁড়া স্যান্ডেল কিংবা খালি পায়ে আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করছেন। ‘ভাই, এই কাজ ছাড়া আর কিছু পারি না। বাসায় বাচ্চারা তাকায়া আছে আমার মুখের দিকে’। বললেন মাঝবয়সী শ্রমিক জাহাঙ্গীর।
তাদের কাজগুলো অল্প পারিশ্রমিকে করতে হয়। দৈনিক মজুরি ৫০০-৭০০ টাকার মধ্যে। অনেকেই সপ্তাহে সাতদিনই কাজ করেন। কারণ কাজ না করলে পেট চলে না। অথচ স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা বা ছুটির কোনো নিশ্চয়তা নেই। রোগ, দুর্ঘটনা কিংবা বৃদ্ধ বয়স সবই তাদের জন্য নিজের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া।
এই মে দিবসে তাদের জন্য কোনো পুষ্পস্তবক নয়, শুধু দরকার একটি সম্মানজনক জীবনের স্বীকৃতি। দরকার নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ন্যায্য মজুরি আর ভবিষ্যতের এক টুকরো নিশ্চয়তা। যে ঘামে এ শহর ভেজে, সেই ঘাম যেন অপচয় না হয়।