জনকল্যাণ ও জবাবদিহিতার সাংবাদিকতা

সাংবাদিকতা কেন দরকার? সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও বা নিউজ পোর্টাল সমাজের জন্য কেন প্রয়োজন? সাংবাদিকরা রাষ্ট্র কাঠামোয় ঠিক কি অবদান রাখেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নানাভাবে দেওয়া যেতে পারে। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে একটি ভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করার প্রয়োজন বোধ করছি।
আপনি কি জানেন, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর হামলায় কত সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন? আল জাজিরার তথ্য বলছে, এক বছরের বেশি সময়ের এই সংঘাতে ২১৭ জন সংবাদকর্মী নিহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে ছিলেন প্রতিবেদক, চিত্র সাংবাদিক, ভিডিও সাংবাদিক এবং অনেক সহায়ক কর্মী।
এত সাংবাদিককে কেন প্রাণ দিতে হলো? যাতে সত্য তথ্য প্রচার না হয়। এইসব সাংবাদিকরা জানেন, তা জেনেই তারা কাজ করেন। এটাই আসলে সাংবাদিকতা পেশার মাহাত্ম্য। যার মাধ্যমে ক্ষমতা কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। জাগ্রত করা যায় বিশ্ববিবেক। গঠন করা যায় নিপীড়নবিরোধী জনমত। সর্বশেষ, নিশ্চিত করা যায় জবাবদিহিতা। যেখানে প্রাণ সংশয়ও তুচ্ছ।
ভারতবর্ষের সাংবাদিকতার জনক আইরিশ নাগরিক জেমস অগাস্টাস হিকি। যার হাত ধরেই যাত্রা শুরু ভারতবর্ষের প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র হিকি’জ বেঙ্গল গেজেট বা অরিজিনাল ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভারটাইজার-এর। ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি কলকাতার ৬৭ নম্বর রাধাবাজার ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক এই সংবাদপত্রের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসসহ অন্যান্য শীর্ষ কর্তাদের লাগামহীন অপকর্মের তথ্য তুলে ধরা। হ্যাঁ, হিকির গেজেটে নিশ্চিতভাবেই কুৎসা ছিল, ইয়োলো আধেয় ছিল, অপপ্রচার ছিল।
সাপ্তাহিক এই সংবাদপত্রে অনেক সংবাদ প্রকাশিত হতো নিতান্তই ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বন্দ্বে। কিন্তু তারপরও সংবাদপত্রের সূচনা যাত্রায় ক্ষমতা কাঠামোকে প্রশ্ন করার যে দৃষ্টান্ত হিকি স্থাপন করেছিলেন তা আজও স্মরণে রাখার মতো। সে সময় হিকি ছিলেন লুটেরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে এক সোচ্চার কণ্ঠস্বর।
এবার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। যমুনা টিভিতে উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত ছিলেন বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক, বাংলাদেশের যুদ্ধদিনের বন্ধু সায়মন ড্রিং। একদিন সায়মন ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ দ্য টেলিগ্রাফে প্রকাশিত TANKS CRUSH REVOLT IN PAKISTAN শিরোনামের প্রতিবেদন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছিলেন। উল্লেখ করা যেতে পারে এই রিপোর্টটি ছিল বিশ্বগণমাধ্যমে বাংলাদেশের জেনেসাইড নিয়ে প্রকাশিত প্রথম কোনো সংবাদ প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদনের জন্য সায়মনকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হয়েছিল।
…একমাত্র সাংবাদিকরাই বহু ধরনের মানুষের সাথে কথা বলতে পারেন, মিশতে পারেন, প্রশ্ন করতে পারেন, তাদের অবস্থান বা সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা চাইতে পারেন।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি এবং এপির ফটোসাংবাদিক মিশেল লরেন্ট গোপনে ঢাকায় থেকে গিয়েছিলেন। তারপর প্রথম কোনো প্রতিবেদক হিসেবে ঘুরে দেখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পুরাতন ঢাকা, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরসহ বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ। সে সময় অবরুদ্ধ ঢাকায় অন্য কোনো বিদেশি সংবাদকর্মীর প্রবেশাধিকার ছিল না। তাই বর্বর গণহত্যার শিকার বাঙালি জাতির কথা বলার কেউ ছিলেন না। এ সময় সায়মন ড্রিং বাঙালির কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনিই ছিলেন বিশ্ব দরবারে বাঙালির কণ্ঠস্বর।
সায়মন বলেছিলেন, একজন সংবাদ প্রতিবেদকের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো বিভিন্ন ধরনের মানুষ ও ঘটনায় তার প্রবেশ করার সুবিধা থাকে। সায়মন জানান, তিনি একজন সাংবাদিক হিসেবে কম্বোডিয়ায় কমিউনিস্ট গেরিলা নেতার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, আফ্রিকার জঙ্গলে কথা বলেছেন বর্বর বিদ্রোহী নেতার সাথে, ইরানে ইসলামী বিপ্লবী নেতা খোমিনির সাথেও সরাসরি কথা বলেছেন।
আবার আধুনিক ইউরোপের বিভিন্ন প্রতাপশালী সরকার প্রধানও তাকে সময় দিয়েছেন। এর অর্থ হলো, একমাত্র সাংবাদিকরাই বহু ধরনের মানুষের সাথে কথা বলতে পারেন, মিশতে পারেন, প্রশ্ন করতে পারেন, তাদের অবস্থান বা সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। আর এই বিশেষ সুবিধার একটি দার্শনিক ভিত্তি আছে, তা হলো সাংবাদিকদের সাধারণ মানুষ জনগণের কণ্ঠস্বর মনে করে। মানুষ মনে করে, একজন সাংবাদিক তাদের প্রয়োজন, সমস্যা, শঙ্কা, সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে ক্ষমতাসীন, ক্ষমতাহীনসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে প্রশ্ন করে থাকেন।
শুধু রাজনীতি বা যুদ্ধ-সংঘাত নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্বিপাকেও সাংবাদিকরা থাকেন মানুষের পাশে। ২০০৯ সালের ২৫ মে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হেনেছিল আইলা নামের একটি ঘূর্ণিঝড়। তখন আমি প্রতিবেদক। সেই সময় ঝড়ের প্রভাব ও ক্ষয়ক্ষতি দেখতে পাঠানো হয়েছিল ভোলার ঢালচর। এটি দ্বীপ জেলা ভোলা থেকেও কয়েকশ কিলোমিটার দূরে মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত। এটি দেশের সর্ব দক্ষিণের ইউনিয়ন।
আইলার আঘাতে এই দ্বীপ ইউনিয়নটি একেবারে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। স্থানীয় হাট-হাজার, বসতঘর সবই বিধ্বস্ত। ২৭ মে গিয়ে দেখলাম সেখানে তীব্র সুপেয় পানির সংকট। কিছু এনজিও কর্মী প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তখন তা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদন প্রকাশের পর সচিবালয় বিট-এর প্রতিবেদক সাইফুল হাসান এই বিষয়টি নিয়ে উপদেষ্টাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, ত্রাণ সহায়তা ও সুপেয় পানি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় দ্রুত পদক্ষেপ। এটাই সাংবাদিকের জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা। ঢালচরের সেই পীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বোচ্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে তুলে ধরা। এভাবেই সাংবাদিক হয়ে ওঠেন মানুষের কণ্ঠস্বর।
বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ, আদর্শ সংবাদপত্র ও একজন পেশাদার কতটা প্রভাবশালী হতে পারে তা প্রথম প্রমাণিত হয় গত শতকের ৭০-এর দশকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খলনায়ক রিচার্ড নিক্সন ক্ষমতায় টিকে থাকতে ওয়াগেট কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছিলেন। যা মার্কিন জনগণের সামনে তুলে ধরেন দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্রের সাংবাদিক কার্ল বার্নস্টাইন ও বব উডওয়ার্থ।
তথ্য অনুযায়ী চীন, ইসরায়েল, রাশিয়া, মিয়ানমারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংবাদ প্রকাশের দায়ে কারারুদ্ধ আছেন ৩৬১ জন সাংবাদিক।
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি প্রকাশ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন এই দুই সাংবাদিক। সাংবাদিকদের এই লড়াই এখনো জারি আছে। দেশে দেশে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো প্রকাশ করে এখনো নিপীড়িত মানুষের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন সাংবাদিকরা।
ছোট্ট একটা তথ্য জানিয়ে রাখি, সাংবাদিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট নামের একটি সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী চীন, ইসরায়েল, রাশিয়া, মিয়ানমারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংবাদ প্রকাশের দায়ে কারারুদ্ধ আছেন ৩৬১ জন সাংবাদিক।
এদের মধ্যে চীনে বন্দি আছেন ৫০ জন আর ইসরায়েল ও তাদের অধিকৃত ভূমিতে আটক আছেন ৪৩ জন সংবাদকর্মী। যারা প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছেন কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন ব্যবস্থার ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের। যদিও আশার কথা হলো এরপরও সংবাদকর্মীদের দমিয়ে রাখা যায়নি। বরং নতুন উদ্যমে, নতুন সংকল্পে সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুক্ত মানুষকে তথ্য পৌঁছে দেওয়ার বিপদজ্জনক কাজে।
এর বিপরীত চিত্রও আছে। অনেক দেশে অনেক সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব ভুলে ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছেন বিভিন্ন কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর পক্ষে। যা তুলনা করা যেতে পারে চাঁদের কলঙ্কের সাথে।
হ্যাঁ, সাংবাদিকতা পেশাতেও কলঙ্ক আছে। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে তা চাঁদের কলঙ্কের মতোই। যেখানে উদ্ভাসিত জ্যোৎস্নায় ম্লান কলঙ্কিত অংশটি।
সারা পৃথিবীতে সাংবাদিকতার জয় হোক। ভয়মুক্ত হোক সাংবাদিকতার পরিবেশ।
রাহাত মিনহাজ ।। সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
minhaz_uddin_du@yahoo.com