মানুষের হৃদয় যেন এক গভীর সাগর, যেখানে অনুভূতির ঢেউ প্রতিনিয়ত আছড়ে পড়ে। কিন্তু সেই অনুভূতির গভীরতা সবসময় প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। প্রকাশের মতো উপযুক্ত শব্দমালা সল্পতা। যা এখনো আবিস্কার হয়নি। তাই কবি বলেছেন,
"হৃদয়ের ভাষা অব্যক্ত,
তাহা শুধু-ই অশ্রুজল ও আনন্দ।
বাহ্য ভাষা একটি অস্ত্র -
নিজেকে খুন করে জাহির হওয়ার।"
উক্তি আমাদের হৃদয়ের সত্য ও বাহ্যিক প্রকাশের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে গভীর ভাবনার দিগন্ত খুলে দেয়। ভাবুক হৃদয় তা অনুভব করতে পারবে। কারন এই পৃথিবী ও তার বৈচিত্র শধুমাত্র সেই সব ভাববাদীদের জন্যেই নিদর্শন। সৃষ্টিজগৎ নিখুঁত হাতের একটি সাজানো ক্যানভাস একটি শিল্প। শিল্পি জানে এর রহস্য তাই তো সে কাদেঁ আবার হাসে। প্রকাশে বুঝাতে পারে না।
মানুষের হৃদয় যখন অনুভূতিতে ভরে ওঠে, তখন তা শব্দে রূপ নিতে পারে না। এক ফোঁটা অশ্রু বা একটি হাসির ঝলক সেই অনুভূতির গভীরতার বহিঃপ্রকাশ। এই অশ্রু হয়ত দুঃখের, হয়ত আনন্দের। কিন্তু তা সবসময় হৃদয়ের প্রকৃত ভাষাকে বহন করে। অন্যদিকে, ভাষা বা কথা বলার মাধ্যমটি অনেক সময় কৃত্রিম হয়ে ওঠে। লোক দেখানো অভিনয় হয়ে উঠে। সভাতে।বা সমাজে নিজের পান্ডিত্য ধরে রাখার মাধ্যেম হয়ে উঠে। মানুষ নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে বা নিজেকে জাহির করতে যে ভাষার আশ্রয় নেয়, তা অনেক সময় সত্যিকারের অনুভূতিকে দমিয়ে রাখে।
আমাদের সমাজে ভাষা ও কথোপকথনের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। আমরা ভাষার মাধ্যমে নিজেদের পরিচিতি, চিন্তা এবং অবস্থান প্রকাশ করি। কিন্তু এই বাহ্যিক প্রকাশের পেছনে অনেক সময় হৃদয়ের প্রকৃত ভাষা চাপা পড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, কেউ দুঃখে ভেঙে পড়লেও সে হয়ত মুখে হাসি ধরে রাখে, কারণ সে তার কষ্ট অন্যের সামনে প্রকাশ করতে চায় না, কারন নিষ্টুর ও স্বার্থপর মানুষ গুলো আবেগ বুঝে না। যা শুধুই ব্যার্থ চেষ্টা। আবার কেউ আনন্দের সময় এমনভাবে কথা বলে, যেন সেই আনন্দকে অন্যের চোখে বড় করে দেখানোর প্রয়াস করে। এতে হৃদয়ের সত্যিকারের অনুভূতিকে আড়াল করা হয়।
এই প্রক্রিয়ায় আমরা হয়ত সমাজে নিজেদের স্থান করে নিই, কিন্তু ধীরে ধীরে নিজের হৃদয়ের সঙ্গে একটি দূরত্ব তৈরি করে ফেলি। বাহ্যিক ভাষা আমাদের অস্ত্র হয়ে ওঠে, যা আমাদের প্রকৃত সত্তাকে আঘাত করে। আমরা এমন কিছু বলি বা করি যা হয়ত আমাদের হৃদয়ের সঙ্গে খাপ খায় না, কিন্তু পরিস্থিতি সামলাতে তা প্রয়োজনীয় মনে হয়।
তাহলে সমাধান কী? আমাদের শেখা উচিত হৃদয়ের গভীর অনুভূতিগুলিকে সম্মান জানানো এবং সেগুলিকে যথাযথভাবে প্রকাশ করতে দেওয়া। কখনো অশ্রু দিয়ে, কখনো নীরবতা দিয়ে, কখনো বা সরল ভাষায় নিজের মনের কথা বলার চেষ্টা করা উচিত। বাহ্যিক প্রকাশের জন্য কৃত্রিমতার আশ্রয় নেওয়া নয়, বরং হৃদয়ের সত্যিকারের অনুভূতিকে স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ করাই আমাদের মনুষ্যত্বের প্রকৃত সৌন্দর্য।
উক্তি আমাদের শেখায়, সত্যিকারের অনুভূতি প্রকাশ করতে ভাষার প্রয়োজন হয় না। হৃদয়ের গভীরতা কখনো একটি হাসি, কখনো একটি অশ্রু কিংবা কখনো একটি নিঃশ্বাসে প্রকাশ পায়। বাহ্যিক ভাষার অস্ত্র ব্যবহার করার সময় আমাদের সচেতন থাকতে হবে, যেন তা আমাদের হৃদয়ের সত্যিকারের সত্তাকে আহত না করে, অন্য কাউকে আঘাত করে তার হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টি না করে। আর হৃদয়ের সাথে সৎ থাকা এবং তার ভাষাকে মর্যাদা দেওয়া—এই দিকেই আমাদের মনোনিবেশ করা উচিত।
লেখক: শরিফুল ইসলাম
১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ফরিদপুর