London ০৯:২৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম:
সারা দেশে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের মহাসমাবেশ আজ আরও ৫২ ফিলিস্তিনি নিহত গাজায় আক্রমণ আরও জোরদারের নির্দেশ নেতানিয়াহুর ইউক্রেনে সোমবার পর্যন্ত ‘ইস্টার যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণা পুতিনের পেঁয়াজ-সয়াবিন তেলের দামে বাজারে অস্বস্তি সোনার দামে নতুন রেকর্ড নাহিদ ইসলাম এক দলকে সরিয়ে আরেক দলকে ক্ষমতায় বসাতে অভ্যুত্থান হয়নি শ্যামনগরে দুই মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে তিনজন গুরুতর আহত, কিশোরের অবস্থা আশঙ্কাজনক মনগড়া লোডশেডিংয়ে, চরম বিপাকে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা সাংবাদিক আরিফুলের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও হুমকির প্রতিবাদে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন কালকিনিতে মুক্তিযোদ্ধা দলের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

সেই ‘চালবাজির চক্রেই’ চড়া চালের বাজার

নিজস্ব প্রতিবেদক:

• প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে ২-৬ টাকা
• মিল থেকে চাল সরবরাহ করা হচ্ছে না: রাইস এজেন্সি
• ধানের দাম বাড়ায় চালের দাম বাড়াতে হয়েছে: মিলার
• অপপ্রচারে অস্থিতিশীল বাজার: খাদ্যসচিব

বিদেশ থেকে চাল আমদানি উন্মুক্ত। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য স্বাভাবিক। আমনের ভরা মৌসুম। দৃশ্যত কোনো সংকট নেই। তবু বাজারে অযৌক্তিকভাবে বাড়ছে চালের দাম। কৃষক-ফড়িয়াদের মজুতদারি, দেশের অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে ‘দাম আরও বাড়বে’ গুজব, মিলারদের অপতথ্য ছড়ানো থেমে নেই। খুচরা বিক্রেতা থেকে কৃষক পর্যন্ত পুরো চক্রের ‘চালবাজিতে’ লাগামহীন চালের বাজার।

কৃষক থেকে শুরু করে মিলার পর্যায়ে ‘ভবিষ্যতে চালের দাম আরও চড়া হবে’-এমন তথ্য ছড়িয়েছে একটি মহল। ফলে বেড়েছে ধান-চালের মজুতপ্রবণতা। অল্প সরবরাহ রেখে, দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটছে সংশ্লিষ্টরা। এই প্রবণতা দেশে দীর্ঘদিন চলে আসছে। এসব চক্রের কারসাজিতেই চড়া হয় দাম।মাত্র আমন মৌসুমের চাল বাজারে আসছে। যে কারণে প্রকৃতপক্ষে ধান-চালের কোনো সংকট নেই। তারপরেও সরবরাহ কমিয়ে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা ধান-চাল মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে প্রতিদিনই দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।- রাইস এজেন্সির মালিক

কৃষক, মিলার, ফড়িয়া ব্যবসায়ী, পাইকারি-খুচরা বিক্রেতা ও সরকারের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া যায়। সরকারের সর্বোচ্চ মহল জানিয়েছে, ভারতের সঙ্গে চাল আমদানি কার্যক্রম একদম স্বাভাবিক। বরং বাংলাদেশে চালের সরবরাহ আরও বাড়াতে চিঠি দিয়েছেন দেশটির চাল ব্যবসায়ীরা। এছাড়া অন্য দেশ থেকে ক্রমান্বয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি প্রক্রিয়া চলমান। ফলে চালের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

চালের দাম বাড়ছে যেভাবে

ঢাকার বাজার ঘুরে দেখা যায়, আমনের নতুন চাল বাজারে এলেও প্রতি কেজি চালের দাম দুই থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত বেড়েছে গত দুই সপ্তাহে। খুচরায় প্রতি কেজি ৬২ টাকার নিচে কোনো চাল মিলছে না। এ দামে যেসব চাল মিলছে, সেগুলো মোটা স্বর্ণা ও পাইজাম। এ দুই জাতের চাল চলতি আমন মৌসুমে বাজারে এসেছে।মোকামে ধানের সরবরাহ কম। চাষিরাও ধান বিক্রি করতে চাচ্ছে না। যে কারণে দাম বাড়ছে। সেক্ষেত্রে মিলাররা বেকায়দায় পড়েছেন।- দিনাজপুরের আলিমা ট্রেডার্সের হজরত আলী সজিব

চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে মালিবাগে কুমিল্লা রাইস এজেন্সির ফরিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, মিল থেকে চাল সরবরাহ করা হচ্ছে না। তাই সরবরাহ ঘাটতির কারণে চালের দাম বেড়েছে।

তিনি জানান, মানভেদে প্রতি বস্তা চালের দাম দেড়শ থেকে তিনশো টাকা পর্যন্ত বেড়েছে গত ১০-১২ দিনে। মাত্র আমন মৌসুমের চাল বাজারে আসছে। যে কারণে প্রকৃতপক্ষে ধান-চালের কোনো সংকট নেই। তারপরেও সরবরাহ কমিয়ে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা ধান-চাল মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে প্রতিদিনই দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

এদিকে সবশেষ দুদিনে পাইকারিতে চালের দাম আরও বেড়েছে। অর্থাৎ, ঢাকায় চালের দাম আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।এবার গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক প্রচার রয়েছে যে, ভারত ধান-চাল দেবে না, বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্য কৃষক, ফড়িয়া ব্যবসায়ীরাও ধান কিনে মজুত করছেন। আবার দাম বাড়বে এমন গুজব কিছু ব্যবসায়ীও ছড়াচ্ছে, যাতে তারা ভবিষ্যতে ভালো দামে বিক্রি করতে পারেন।- নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোধ বরণ সাহা

যা বলছেন চালকল মালিকরা

স্বাভাবিকভাবে চালকল মালিকদের দাবি, ধানের দাম বাড়ায় তারা চালের দাম বাড়িয়েছেন। নওগাঁ চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ চকদার জাগো নিউজকে বলেন, মোকামে ধান নেই। শুরু থেকে এবার ধানের দাম বেশি। গত এক-দেড় সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি মণে ৭০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ধানের দাম বাড়ার কারণে স্বাভাবিক কারণেই চালের দাম বাড়াতে হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে চালের বড় মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগর, নওগাঁ ও দিনাজপুরে প্রতি মণ স্বর্ণা ধান এক হাজার ৪২০ থেকে এক হাজার ৪৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এসব এলাকায় প্রতি মণে ধানের দাম গত সপ্তাহের চেয়ে ৫০ টাকা বেড়েছে। যেখানে প্রতি বস্তা চালের দাম একই সময়ে বেড়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। ওইসব এলাকায় প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকায়।

 

দিনাজপুরের আলিমা ট্রেডার্সের হজরত আলী সজিব বলেন, মোকামে ধানের সরবরাহ কম। চাষিরাও ধান বিক্রি করতে চাচ্ছে না। যে কারণে দাম বাড়ছে। সেক্ষেত্রে মিলাররা বেকায়দায় পড়েছেন।সংকটের আতঙ্ক তৈরি করে বাজার বাড়ানোর প্রবণতা নতুন নয়। তবে এটি অনৈতিক। কেন এটা করা হচ্ছে সেটা আমার জানা নেই। তবে ভারতের সঙ্গে চাল আমদানি বিষয়ে কোনো টানাপোড়েন নেই। যারা এ বিষয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাদের বাজার অস্থিতিশীল করার মতো সুনির্দিষ্ট কারণ আছে।- খাদ্যসচিব মাসুদুল হাসান

আসলেই কি ধান বিক্রি কম হচ্ছে?

নওগাঁর অন্যতম বড় ধানের মোকাম পত্নীতলা উপজেলার মধইল বাজার। ওই বাজারে সপ্তাহের প্রতিদিন ধান কেনাবেচা হয়। ৫০০ মণের ৬০ থেকে ৭০টি ট্রাকে প্রতিদিন আসে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মণ ধান। সেখানে এখন আমদানি হচ্ছে ৭ হাজার ৫০০ থেকে ১০ হাজার মণ বলে দাবি কয়েকজন ব্যবসায়ীর। তারা বলছেন, আমদানি প্রায় এক তৃতীয়াংশ কমেছে।

বেশ কয়েকজন ধানের আড়তদার জানান, চালকলের মালিকেরা ধান কেনার জন্য এসে ফিরে যাচ্ছে, কারণ ধানের সরবরাহ কম। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় ধানের দাম বেড়ে গেছে।

মধইল বাজারসহ নঁওগার চৌবাড়ীয়া হাটেও সরবরাহ কম বলে জানা যায়। এছাড়া এসব হাটের আশপাশের এলাকায় কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবিষ্যতে বাজারে চালের দাম বাড়বে বলে মনে করেন তারা। যে কারণে তারা ধান বিক্রি কমিয়েছেন।

বিদারুল ইসলাম নামে একজন কৃষক বলেন, অন্য জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, গত একবছর ধানের দাম সেভাবে বাড়েনি। ফলে দাম বাড়ার কারণ রয়েছে। এছাড়া ভারত থেকে চাল না এলে দেশে ধানের দাম স্বাভাবিকভাবে বাড়বে।

মজুতপ্রবণতা ও সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা তৎপর

খাদ্যপণ্যের পুরোনো ব্যবসায়ী নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোধ বরণ সাহা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, কৃষক পর্যায়ে ধান আটকে রয়েছে। বাকিটা মিলে মিলে মজুত হচ্ছে। দেশের অনিশ্চয়তা ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা এবার ধানের দামে প্রভাব ফেলেছে।

তিনিও বলেন, এবার গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক প্রচার রয়েছে যে, ভারত ধান-চাল দেবে না, বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্য কৃষক, ফড়িয়া ব্যবসায়ীরাও ধান কিনে মজুত করছেন। আবার দাম বাড়বে এমন গুজব কিছু ব্যবসায়ীও ছড়াচ্ছে, যাতে তারা ভবিষ্যতে ভালো দামে বিক্রি করতে পারেন।

বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কাওসার আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, সরকার সেভাবে চাল আমদানি করতে পারছে না। বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি উন্মুক্ত থাকলেও বিশ্ববাজারে দাম বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা চাল আনছেন না। এর মধ্যে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, সে তুলনায় এতদিন চালের দাম কম ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবে চালের দাম বাড়বে এটা বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ধরে রেখেছেন।

এছাড়া মিল মালিকদের মধ্যে অনেক পতিত সরকারের মদতপুষ্ট রয়েছেন, তারাও বাজার বাড়াতে চেষ্টা করছেন বলেও জানিয়েছেন কিছু ব্যবসায়ী।

যা বলছে সরকার

এসব বিষয়ে জাগো নিউজকে খাদ্যসচিব মাসুদুল হাসান বলেন, সংকটের আতঙ্ক তৈরি করে বাজার বাড়ানোর প্রবণতা নতুন নয়। তবে এটি অনৈতিক। কেন এটা করা হচ্ছে সেটা আমার জানা নেই। তবে ভারতের সঙ্গে চাল আমদানি বিষয়ে কোনো টানাপোড়েন নেই। যারা এ বিষয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাদের বাজার অস্থিতিশীল করার মতো সুনির্দিষ্ট কারণ আছে।

তিনি বলেন, ভারত থেকে বেসরকারি পর্যায়ে ৭৩ হাজার টন চাল এসেছে। এছাড়া সরকার এই মুহূর্তে ২৪ হাজার ৮০০ টন চালের জাহাজ খালাস করছে। এরপর যে জাহাজ আসছে তাতে ২২ হাজার টন আসবে। এভাবে ক্রমান্বয়ে চাল আসবে।

মাসুদুল হাসান বলেন, বরং ভারতের যে চাল রপ্তানিকারকদের সংগঠন ইন্ডিয়ান রাইস ফেডারেশন, তারা আমাদের চিঠি দিয়েছে, প্রতিযোগিতামূলক দামে আরও চাল কেনার জন্য।

তিনি বলেন, আমন মৌসুমে সরকারকে কৃষকরা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চাল দিয়েছে। আমাদের দেড় লাখ টন চাল কেনার পরিকল্পনা ছিল, সেখানে দুই লাখ ৬৫ হাজার টন পেরিয়ে গেছে। তাহলে কৃষকরা চাল বিক্রি করছে না, এ কথাও ঠিক নয়।

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৪:১২:০৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪
৩৬
Translate »

সেই ‘চালবাজির চক্রেই’ চড়া চালের বাজার

আপডেট : ০৪:১২:০৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪

• প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে ২-৬ টাকা
• মিল থেকে চাল সরবরাহ করা হচ্ছে না: রাইস এজেন্সি
• ধানের দাম বাড়ায় চালের দাম বাড়াতে হয়েছে: মিলার
• অপপ্রচারে অস্থিতিশীল বাজার: খাদ্যসচিব

বিদেশ থেকে চাল আমদানি উন্মুক্ত। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য স্বাভাবিক। আমনের ভরা মৌসুম। দৃশ্যত কোনো সংকট নেই। তবু বাজারে অযৌক্তিকভাবে বাড়ছে চালের দাম। কৃষক-ফড়িয়াদের মজুতদারি, দেশের অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে ‘দাম আরও বাড়বে’ গুজব, মিলারদের অপতথ্য ছড়ানো থেমে নেই। খুচরা বিক্রেতা থেকে কৃষক পর্যন্ত পুরো চক্রের ‘চালবাজিতে’ লাগামহীন চালের বাজার।

কৃষক থেকে শুরু করে মিলার পর্যায়ে ‘ভবিষ্যতে চালের দাম আরও চড়া হবে’-এমন তথ্য ছড়িয়েছে একটি মহল। ফলে বেড়েছে ধান-চালের মজুতপ্রবণতা। অল্প সরবরাহ রেখে, দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটছে সংশ্লিষ্টরা। এই প্রবণতা দেশে দীর্ঘদিন চলে আসছে। এসব চক্রের কারসাজিতেই চড়া হয় দাম।মাত্র আমন মৌসুমের চাল বাজারে আসছে। যে কারণে প্রকৃতপক্ষে ধান-চালের কোনো সংকট নেই। তারপরেও সরবরাহ কমিয়ে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা ধান-চাল মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে প্রতিদিনই দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।- রাইস এজেন্সির মালিক

কৃষক, মিলার, ফড়িয়া ব্যবসায়ী, পাইকারি-খুচরা বিক্রেতা ও সরকারের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া যায়। সরকারের সর্বোচ্চ মহল জানিয়েছে, ভারতের সঙ্গে চাল আমদানি কার্যক্রম একদম স্বাভাবিক। বরং বাংলাদেশে চালের সরবরাহ আরও বাড়াতে চিঠি দিয়েছেন দেশটির চাল ব্যবসায়ীরা। এছাড়া অন্য দেশ থেকে ক্রমান্বয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি প্রক্রিয়া চলমান। ফলে চালের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

চালের দাম বাড়ছে যেভাবে

ঢাকার বাজার ঘুরে দেখা যায়, আমনের নতুন চাল বাজারে এলেও প্রতি কেজি চালের দাম দুই থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত বেড়েছে গত দুই সপ্তাহে। খুচরায় প্রতি কেজি ৬২ টাকার নিচে কোনো চাল মিলছে না। এ দামে যেসব চাল মিলছে, সেগুলো মোটা স্বর্ণা ও পাইজাম। এ দুই জাতের চাল চলতি আমন মৌসুমে বাজারে এসেছে।মোকামে ধানের সরবরাহ কম। চাষিরাও ধান বিক্রি করতে চাচ্ছে না। যে কারণে দাম বাড়ছে। সেক্ষেত্রে মিলাররা বেকায়দায় পড়েছেন।- দিনাজপুরের আলিমা ট্রেডার্সের হজরত আলী সজিব

চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে মালিবাগে কুমিল্লা রাইস এজেন্সির ফরিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, মিল থেকে চাল সরবরাহ করা হচ্ছে না। তাই সরবরাহ ঘাটতির কারণে চালের দাম বেড়েছে।

তিনি জানান, মানভেদে প্রতি বস্তা চালের দাম দেড়শ থেকে তিনশো টাকা পর্যন্ত বেড়েছে গত ১০-১২ দিনে। মাত্র আমন মৌসুমের চাল বাজারে আসছে। যে কারণে প্রকৃতপক্ষে ধান-চালের কোনো সংকট নেই। তারপরেও সরবরাহ কমিয়ে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা ধান-চাল মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে প্রতিদিনই দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

এদিকে সবশেষ দুদিনে পাইকারিতে চালের দাম আরও বেড়েছে। অর্থাৎ, ঢাকায় চালের দাম আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।এবার গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক প্রচার রয়েছে যে, ভারত ধান-চাল দেবে না, বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্য কৃষক, ফড়িয়া ব্যবসায়ীরাও ধান কিনে মজুত করছেন। আবার দাম বাড়বে এমন গুজব কিছু ব্যবসায়ীও ছড়াচ্ছে, যাতে তারা ভবিষ্যতে ভালো দামে বিক্রি করতে পারেন।- নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোধ বরণ সাহা

যা বলছেন চালকল মালিকরা

স্বাভাবিকভাবে চালকল মালিকদের দাবি, ধানের দাম বাড়ায় তারা চালের দাম বাড়িয়েছেন। নওগাঁ চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ চকদার জাগো নিউজকে বলেন, মোকামে ধান নেই। শুরু থেকে এবার ধানের দাম বেশি। গত এক-দেড় সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি মণে ৭০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ধানের দাম বাড়ার কারণে স্বাভাবিক কারণেই চালের দাম বাড়াতে হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে চালের বড় মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগর, নওগাঁ ও দিনাজপুরে প্রতি মণ স্বর্ণা ধান এক হাজার ৪২০ থেকে এক হাজার ৪৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এসব এলাকায় প্রতি মণে ধানের দাম গত সপ্তাহের চেয়ে ৫০ টাকা বেড়েছে। যেখানে প্রতি বস্তা চালের দাম একই সময়ে বেড়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। ওইসব এলাকায় প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকায়।

 

দিনাজপুরের আলিমা ট্রেডার্সের হজরত আলী সজিব বলেন, মোকামে ধানের সরবরাহ কম। চাষিরাও ধান বিক্রি করতে চাচ্ছে না। যে কারণে দাম বাড়ছে। সেক্ষেত্রে মিলাররা বেকায়দায় পড়েছেন।সংকটের আতঙ্ক তৈরি করে বাজার বাড়ানোর প্রবণতা নতুন নয়। তবে এটি অনৈতিক। কেন এটা করা হচ্ছে সেটা আমার জানা নেই। তবে ভারতের সঙ্গে চাল আমদানি বিষয়ে কোনো টানাপোড়েন নেই। যারা এ বিষয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাদের বাজার অস্থিতিশীল করার মতো সুনির্দিষ্ট কারণ আছে।- খাদ্যসচিব মাসুদুল হাসান

আসলেই কি ধান বিক্রি কম হচ্ছে?

নওগাঁর অন্যতম বড় ধানের মোকাম পত্নীতলা উপজেলার মধইল বাজার। ওই বাজারে সপ্তাহের প্রতিদিন ধান কেনাবেচা হয়। ৫০০ মণের ৬০ থেকে ৭০টি ট্রাকে প্রতিদিন আসে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মণ ধান। সেখানে এখন আমদানি হচ্ছে ৭ হাজার ৫০০ থেকে ১০ হাজার মণ বলে দাবি কয়েকজন ব্যবসায়ীর। তারা বলছেন, আমদানি প্রায় এক তৃতীয়াংশ কমেছে।

বেশ কয়েকজন ধানের আড়তদার জানান, চালকলের মালিকেরা ধান কেনার জন্য এসে ফিরে যাচ্ছে, কারণ ধানের সরবরাহ কম। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় ধানের দাম বেড়ে গেছে।

মধইল বাজারসহ নঁওগার চৌবাড়ীয়া হাটেও সরবরাহ কম বলে জানা যায়। এছাড়া এসব হাটের আশপাশের এলাকায় কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবিষ্যতে বাজারে চালের দাম বাড়বে বলে মনে করেন তারা। যে কারণে তারা ধান বিক্রি কমিয়েছেন।

বিদারুল ইসলাম নামে একজন কৃষক বলেন, অন্য জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, গত একবছর ধানের দাম সেভাবে বাড়েনি। ফলে দাম বাড়ার কারণ রয়েছে। এছাড়া ভারত থেকে চাল না এলে দেশে ধানের দাম স্বাভাবিকভাবে বাড়বে।

মজুতপ্রবণতা ও সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা তৎপর

খাদ্যপণ্যের পুরোনো ব্যবসায়ী নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোধ বরণ সাহা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, কৃষক পর্যায়ে ধান আটকে রয়েছে। বাকিটা মিলে মিলে মজুত হচ্ছে। দেশের অনিশ্চয়তা ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা এবার ধানের দামে প্রভাব ফেলেছে।

তিনিও বলেন, এবার গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক প্রচার রয়েছে যে, ভারত ধান-চাল দেবে না, বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্য কৃষক, ফড়িয়া ব্যবসায়ীরাও ধান কিনে মজুত করছেন। আবার দাম বাড়বে এমন গুজব কিছু ব্যবসায়ীও ছড়াচ্ছে, যাতে তারা ভবিষ্যতে ভালো দামে বিক্রি করতে পারেন।

বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কাওসার আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, সরকার সেভাবে চাল আমদানি করতে পারছে না। বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি উন্মুক্ত থাকলেও বিশ্ববাজারে দাম বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা চাল আনছেন না। এর মধ্যে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, সে তুলনায় এতদিন চালের দাম কম ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবে চালের দাম বাড়বে এটা বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ধরে রেখেছেন।

এছাড়া মিল মালিকদের মধ্যে অনেক পতিত সরকারের মদতপুষ্ট রয়েছেন, তারাও বাজার বাড়াতে চেষ্টা করছেন বলেও জানিয়েছেন কিছু ব্যবসায়ী।

যা বলছে সরকার

এসব বিষয়ে জাগো নিউজকে খাদ্যসচিব মাসুদুল হাসান বলেন, সংকটের আতঙ্ক তৈরি করে বাজার বাড়ানোর প্রবণতা নতুন নয়। তবে এটি অনৈতিক। কেন এটা করা হচ্ছে সেটা আমার জানা নেই। তবে ভারতের সঙ্গে চাল আমদানি বিষয়ে কোনো টানাপোড়েন নেই। যারা এ বিষয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাদের বাজার অস্থিতিশীল করার মতো সুনির্দিষ্ট কারণ আছে।

তিনি বলেন, ভারত থেকে বেসরকারি পর্যায়ে ৭৩ হাজার টন চাল এসেছে। এছাড়া সরকার এই মুহূর্তে ২৪ হাজার ৮০০ টন চালের জাহাজ খালাস করছে। এরপর যে জাহাজ আসছে তাতে ২২ হাজার টন আসবে। এভাবে ক্রমান্বয়ে চাল আসবে।

মাসুদুল হাসান বলেন, বরং ভারতের যে চাল রপ্তানিকারকদের সংগঠন ইন্ডিয়ান রাইস ফেডারেশন, তারা আমাদের চিঠি দিয়েছে, প্রতিযোগিতামূলক দামে আরও চাল কেনার জন্য।

তিনি বলেন, আমন মৌসুমে সরকারকে কৃষকরা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চাল দিয়েছে। আমাদের দেড় লাখ টন চাল কেনার পরিকল্পনা ছিল, সেখানে দুই লাখ ৬৫ হাজার টন পেরিয়ে গেছে। তাহলে কৃষকরা চাল বিক্রি করছে না, এ কথাও ঠিক নয়।