London ০৫:৪১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২১ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম:
সহায়-সম্বলহীন শুক্কুরী বেগমকে ঘর উপহার দিলেন তারেক রহমান পটুয়াখালীতে মার্কিন নাগরিককে গণধর্ষণ মামলার ০৩ আসামি গ্রেফতার র‌্যাব-১২ এর অভিযানে বিপুল গাঁজা উদ্ধার, গ্রেফতার ১ কালিয়াকৈরে প্রথম বাণিজ্য মেলার উদ্বোধন, দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় সংগ্রামী জীবনের প্রতিচ্ছবি: উল্লাপাড়ায় আলোচনায় ডিআইজি (অব.) খান সাঈদ হাসান রাজশাহীতে ৯ টা মামলার চার্জশিট দাখিল গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের বিশেষ আলোচনা: ‘আর্থিক স্বাধীনতা ছাড়া গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্ভব নয়’ — কামাল আহমদ তরুণদের ক্ষমতায়নে ১৩.৭ মিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ করেছে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল: সমাপ্ত হলো সামার ফেয়ার ৯ দিন ধরে নিখোঁজ সামিরা,এলাকার বাসির মানব বন্ধনে প্রশাসনের গাফলতির অভিযোগ পটুয়াখালীতে নদী থেকে দুই যুবকের মরদেহ উদ্ধার

সিরাজগঞ্জে প্রসূতির মৃত্যুকে ঘিরে তোলপাড়-জীবনের মূল্য ৬৫ হাজার টাকা?

ওয়াসিম সেখ, সিরাজগঞ্জ

সিরাজগঞ্জে শহরের সেবা জেনারেল হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশনের পর ফাতেমা খাতুন (২৫) নামে এক প্রসূতির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তীব্র উত্তেজনা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা, আর্থিক লেনদেন এবং বিশেষজ্ঞ না হয়েও ইউরোলজিস্ট দিয়ে সিজারিয়ান অপারেশনের মতো অভিযোগ তুলেছে ভুক্তভোগীর পরিবার। সদ্যোজাত কন্যা সন্তানের মুখ দেখলেও পৃথিবীর আলো বেশিক্ষণ দেখা হলো না মায়ের। জীবনের মূল্যে হাসপাতালের সাথে ৬৫ হাজার টাকায় দফারফা হওয়ার এক চাঞ্চল্যকর তথ্যও সামনে এসেছে।

ঘটনার শিকার ফাতেমা খাতুন সদর উপজেলার কালিয়া হরিপুর ইউনিয়নের ছাইতানতলী গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী এনামুল সরকারের স্ত্রী এবং একই গ্রামের কেরামত আলী ও মমতা খাতুনের কন্যা।

গত ১০ জুলাই, সকাল সাড়ে ১১টার দিকে প্রসব বেদনা নিয়ে ফাতেমা খাতুনকে শহরের জগাই মোড় সংলগ্ন সেবা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নিহতের পরিবারের অভিযোগ, হাসপাতালের দায়িত্বরত গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. ইসমত আরা প্রথমে সিজার করতে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু হাসপাতালের কর্মচারী মোহাম্মদ আলী ও মালিক শ্রী চিত্তরঞ্জন সরকারের ক্রমাগত চাপের মুখে রোগীর শ্বশুর অপারেশনে সম্মতি দেন।

অবশেষে, রাত ৮টার দিকে ইউরোলজিস্ট (মূত্ররোগ বিশেষজ্ঞ) ডা. মোজাহারুল ইসলাম ফাতেমার সিজারিয়ান অপারেশন সম্পন্ন করেন এবং একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে পরদিন ভোরে। ১১ জুলাই ভোর ২টার পর থেকে ফাতেমার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভোর ৪টার দিকে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

ফাতেমার মৃত্যুতে পরিবার ও এলাকাবাসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিহতের মা মমতা খাতুন বলেন, আমার মেয়ে হাসপাতালের অবহেলায় মারা গেছে। আমি আমার মেয়ের হত্যার বিচার চাই। ন্যায়বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। পরে আইন ও মানবাধিকার সুরক্ষা ফাউন্ডেশনে অভিযোগ করলে তারা আমাকে সাদা কাগজ ও স্ট্যাম্পে সই নিয়ে ৭০ হাজার টাকা দেয়, যার মধ্যে ৫ হাজার টাকা তারা রেখে দিয়েছে। আমি টাকায় আমার মেয়ের জীবন ফেরত পাবো না, আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।

এলাকাবাসী ও পরিবারের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি হলো, ডা. মোজাহারুল ইসলাম গাইনি সার্জন না হয়েও কীভাবে সিজারিয়ান অপারেশনের মতো একটি জটিল অস্ত্রোপচার করলেন। এ বিষয়ে ডা. মোজাহারুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দম্ভের সাথে বলেন, হ্যাঁ, আমি গাইনি সার্জারি করতে পারি।

হাসপাতালের কর্মচারী মোহাম্মদ আলীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমি কোনো সার্জারি করিনি, শুধু রোগীকে ভর্তি করিয়েছিলাম।

অন্যদিকে, হাসপাতালের মালিক শ্রী চিত্তরঞ্জন সরকার বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে বলেন, বিষয়টি আমি জানি। এজন্য ভুক্তভোগীদের সঙ্গে সমাধান করে নিয়েছি। তার এই বক্তব্যে ৬৫ হাজার টাকায় জীবনের মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোখলেছুর রহমান জানান, এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

একজন ইউরোলজিস্ট দিয়ে সিজারিয়ান অপারেশনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচার করানো এবং প্রসূতির মৃত্যুর পর টাকার বিনিময়ে বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা স্বাস্থ্যখাতের চরম অব্যবস্থাপনা ও নৈতিক অবক্ষয়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। স্বাস্থ্যসেবার নামে কসাইখানায় পরিণত হওয়া এ ধরনের ক্লিনিক ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং চিকিৎসকদের অবহেলার কারণে আর কোনো মায়ের যেন এমন মর্মান্তিক পরিণতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করছেন এলাকাবাসী। ফাতেমার সদ্যোজাত কন্যার ভবিষ্যৎ এবং তার পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি এখন অনিশ্চয়তার মুখে।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৬:০৫:৩০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৫
২৬
Translate »

সিরাজগঞ্জে প্রসূতির মৃত্যুকে ঘিরে তোলপাড়-জীবনের মূল্য ৬৫ হাজার টাকা?

আপডেট : ০৬:০৫:৩০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৫

সিরাজগঞ্জে শহরের সেবা জেনারেল হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশনের পর ফাতেমা খাতুন (২৫) নামে এক প্রসূতির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তীব্র উত্তেজনা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা, আর্থিক লেনদেন এবং বিশেষজ্ঞ না হয়েও ইউরোলজিস্ট দিয়ে সিজারিয়ান অপারেশনের মতো অভিযোগ তুলেছে ভুক্তভোগীর পরিবার। সদ্যোজাত কন্যা সন্তানের মুখ দেখলেও পৃথিবীর আলো বেশিক্ষণ দেখা হলো না মায়ের। জীবনের মূল্যে হাসপাতালের সাথে ৬৫ হাজার টাকায় দফারফা হওয়ার এক চাঞ্চল্যকর তথ্যও সামনে এসেছে।

ঘটনার শিকার ফাতেমা খাতুন সদর উপজেলার কালিয়া হরিপুর ইউনিয়নের ছাইতানতলী গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী এনামুল সরকারের স্ত্রী এবং একই গ্রামের কেরামত আলী ও মমতা খাতুনের কন্যা।

গত ১০ জুলাই, সকাল সাড়ে ১১টার দিকে প্রসব বেদনা নিয়ে ফাতেমা খাতুনকে শহরের জগাই মোড় সংলগ্ন সেবা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নিহতের পরিবারের অভিযোগ, হাসপাতালের দায়িত্বরত গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. ইসমত আরা প্রথমে সিজার করতে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু হাসপাতালের কর্মচারী মোহাম্মদ আলী ও মালিক শ্রী চিত্তরঞ্জন সরকারের ক্রমাগত চাপের মুখে রোগীর শ্বশুর অপারেশনে সম্মতি দেন।

অবশেষে, রাত ৮টার দিকে ইউরোলজিস্ট (মূত্ররোগ বিশেষজ্ঞ) ডা. মোজাহারুল ইসলাম ফাতেমার সিজারিয়ান অপারেশন সম্পন্ন করেন এবং একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে পরদিন ভোরে। ১১ জুলাই ভোর ২টার পর থেকে ফাতেমার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভোর ৪টার দিকে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

ফাতেমার মৃত্যুতে পরিবার ও এলাকাবাসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিহতের মা মমতা খাতুন বলেন, আমার মেয়ে হাসপাতালের অবহেলায় মারা গেছে। আমি আমার মেয়ের হত্যার বিচার চাই। ন্যায়বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। পরে আইন ও মানবাধিকার সুরক্ষা ফাউন্ডেশনে অভিযোগ করলে তারা আমাকে সাদা কাগজ ও স্ট্যাম্পে সই নিয়ে ৭০ হাজার টাকা দেয়, যার মধ্যে ৫ হাজার টাকা তারা রেখে দিয়েছে। আমি টাকায় আমার মেয়ের জীবন ফেরত পাবো না, আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।

এলাকাবাসী ও পরিবারের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি হলো, ডা. মোজাহারুল ইসলাম গাইনি সার্জন না হয়েও কীভাবে সিজারিয়ান অপারেশনের মতো একটি জটিল অস্ত্রোপচার করলেন। এ বিষয়ে ডা. মোজাহারুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দম্ভের সাথে বলেন, হ্যাঁ, আমি গাইনি সার্জারি করতে পারি।

হাসপাতালের কর্মচারী মোহাম্মদ আলীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমি কোনো সার্জারি করিনি, শুধু রোগীকে ভর্তি করিয়েছিলাম।

অন্যদিকে, হাসপাতালের মালিক শ্রী চিত্তরঞ্জন সরকার বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে বলেন, বিষয়টি আমি জানি। এজন্য ভুক্তভোগীদের সঙ্গে সমাধান করে নিয়েছি। তার এই বক্তব্যে ৬৫ হাজার টাকায় জীবনের মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোখলেছুর রহমান জানান, এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

একজন ইউরোলজিস্ট দিয়ে সিজারিয়ান অপারেশনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচার করানো এবং প্রসূতির মৃত্যুর পর টাকার বিনিময়ে বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা স্বাস্থ্যখাতের চরম অব্যবস্থাপনা ও নৈতিক অবক্ষয়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। স্বাস্থ্যসেবার নামে কসাইখানায় পরিণত হওয়া এ ধরনের ক্লিনিক ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং চিকিৎসকদের অবহেলার কারণে আর কোনো মায়ের যেন এমন মর্মান্তিক পরিণতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করছেন এলাকাবাসী। ফাতেমার সদ্যোজাত কন্যার ভবিষ্যৎ এবং তার পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি এখন অনিশ্চয়তার মুখে।