ছাত্র-জনতার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টা দায়িত্ব গ্রহণের পরই নতুন শিক্ষাক্রম বাদ দিয়ে পুরোনো শিক্ষাক্রমে ফেরত যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এখন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী, বিশেষ করে বর্তমানে যারা নবম শ্রেণিতে পড়ছে, তারা কীভাবে এর সমন্বয় করবে? যদিও সরকার আশ্বস্ত করেছে, কিন্তু কীভাবে সমাধান হবে সেটাই দেখার বিষয়। তবে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে ফেরতই কি সমাধান? কারণ তার পুরোটাই মুখস্থ ও পরীক্ষানির্ভর।
বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি দীর্ঘদিনের। অথচ পরিহাসের বিষয়, শিক্ষা বাজেট দিন দিন কমছে। ২০০৯-১০ সালেও জিডিপি অনুপাতে ২.২ শতাংশ বরাদ্দ ছিল শিক্ষাক্ষেত্রে, যা কমতে কমতে চলতি বছর দাঁড়ায় ১.৬৯ শতাংশে। এই যৎসামান্য শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থও পুরোপুরি ব্যয় করা হয় না। এর ভেতরে আবার শিক্ষা বাজেটের টাকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং ক্যাডেট শিক্ষার নাম করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চলে যায়। যেটুকু অর্থ থাকে, তাও খরচ করা হয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং শিক্ষকদের বেতন-ভাতায়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নের বিষয়টি একেবারে অবহেলিত ছিল। কিন্তু ২০২১ সাল থেকে দেখছি বরাদ্দকৃত অর্থের একটি বড় অংশই ব্যয় করা হচ্ছিল শিক্ষকদের মানোন্নয়নের জন্য ট্রেনিংয়ে। এর আগে যত শিক্ষাক্রম ছিল, কোনোটাতেই শিক্ষায় বরাদ্দের স্বল্পতা এভাবে প্রকট করে তুলতে পারেনি। অতীতের শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থী পরিবারের ব্যক্তিগত ব্যয় শুধু বৃদ্ধিই পাচ্ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রকে শিক্ষার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য মুখস্থ বুলি আওড়ানো ছাড়া যৌক্তিকভাবে বাধ্য করা যাচ্ছিল না।
নতুন শিক্ষাক্রমের সবচেয়ে সমালোচনা মূল্যায়ন এবং শিক্ষার্থীদের ডিভাইসমুখী করে তোলার বিষয়ে। তবে অনেক শিক্ষার্থী সামাজিক হওয়ার পাঠ নিচ্ছিল এই শিখন প্রক্রিয়ায়। এক পাঠ্যবই-ই যে সব জ্ঞানের উৎস নয়; সেই সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার অদম্য তাগিদ ছিল এ শিক্ষাক্রমের। শিক্ষার্থীদের বিশ্বজুড়ে পাঠশালার ছাত্র করার একটা উদ্যোগ ছিল।
নতুন শিক্ষাক্রম ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির পাঠ্যবই শিক্ষক সহায়িকা (শিক্ষক গাইড)-সহ পড়লে প্রতিবারই বিস্মিত হতে হয়। এ শিক্ষাক্রম যে কোনো লুটেরা স্বৈরাচারী শাসকেরই অনুমোদন দেওয়ার কথা না। কারণ এর প্রতিটি বিষয়ের দৃষ্টিভঙ্গি, শিখন এবং মূল্যায়ন পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক ও গণতান্ত্রিক। দলীয় এবং জোড়ায় কাজ করার ভেতর দিয়ে শিক্ষার্থীরা গঠনমূলক সমালোচনা করা ও গ্রহণ করার প্রক্রিয়ার ভেতর প্রবেশ করছিল। নতুন শিক্ষাক্রমে আওয়ামী লীগ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে ন্যারেটিভ তা হলো, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এবং একটি মাত্র দলই স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, তাদের তৈরি এই বয়ান নতুন কারিকুলামের মূল্যায়নের সঙ্গেই সাংঘর্ষিক ছিল। কারণ প্রতিটি শ্রেণিতেই ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিবেদন তৈরি করতে হতো তাদের নিকটস্থ মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের গল্প শুনে শুনে এবং স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে বিদ্যালয়ে সরাসরি মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে বিজয়গাথা শোনার ব্যবস্থা ছিল শিক্ষাক্রমে। এতে এক ব্যক্তি মানে বঙ্গবন্ধু এবং একক দল আওয়ামী লীগ যে স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই ন্যারেটিভ প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া শুরু হচ্ছিল শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তাদের ভেতরে স্বাধীনতা যুদ্ধকে জনযুদ্ধ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ইতোমধ্যে বহু স্বর ও মতকে স্বীকার করার চর্চার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। পাঠ্যবইয়ের কোনো ছকই ছাত্রদের চিন্তাহীন বা অনুসন্ধান না করে পূরণ করার সুযোগ ছিল না। শিক্ষার্থীরা একেকজন দল-মতের কাছে মস্তক বন্ধক না রেখেই স্বাধীন, মুক্ত, উদার হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করছিল। আমি নতুন কারিকুলাম দেখতাম আর ভাবতাম, ‘তোমারে বধিবে যে নতুন শিক্ষাক্রমে বাড়িছে সে।’
আমি বিশ্বাস করি, সরকার একেবারে পুরোনো মুখস্থ ধারায় ফিরে না গিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম থেকেও কিছু শিখন গ্রহণ করবে। নতুন শিক্ষাক্রমের ভালো দিকগুলো গ্রহণ করা যায়। তবে শিক্ষার একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত করা দরকার। এমনভাবে স্থায়ী কমিশন গঠন করতে হবে, যাতে বারবার পাল্টানো না লাগে। সে জন্য ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করেই শিক্ষাক্রম গ্রহণ ও তার মূল্যায়নের দিকটি সামনে রাখতে হবে। তা ছাড়া শিক্ষা বাজেট অবশ্যই বাড়াতে হবে। বাজেট না বাড়ালে শিক্ষার উন্নয়ন কঠিন হবে।