গাছে গাছে এখন মুকুল বের হয়েছে। এরপর আসবে গুটি গুটি আম। গাছে মুকুলের সমারোহ দেখে আমকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছেন আমচাষী ও ব্যবসায়ীরা। রাজশাহীর আমের খ্যাতি দেশজুড়ে। আমের মৌসুম এলেই ব্যবসা হয় জমজমাট।
এই খাতে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা জমে। অনলাইন ও অফলাইনে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও যায় রাজশাহীর আম। আমের মৌসুমে গড়ে উঠে তরুণ উদ্যোক্তা। তারা আশায় রয়েছেন এবারও জমে উঠবে আমের বাজার। স্বপ্নপূণের লক্ষ্যমাত্র নিয়ে এখন গাছ পরির্ষায় ব্যস্ত সময় পার করছেন বাগান মালিকরা। তবে গতবছর তুলনায় এবার আম গাছে ভালো মুকুল হয়েছে।
ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গের আম উৎপাদনকারী চার জেলা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোরের গাছে গাছে মুকুল ফুটতে শুরু করেছে। ম-ম গন্ধে ভরে উঠেছে বাগান। বাগানের কোনো কোনো গাছে নাকফুলের মতো আমের ক্ষুদ্র গুটি এসেছে। দু’একটি গাছে গুটি হয়েছে মটরদানার মতোও।
তবে এবার আবহাওয়াকে ‘ম্যাঙ্গো ফ্রেন্ডলি’ বলে মনে করছেন রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের চাষীরা। তবে শঙ্কার কথা বলছেন নওগাঁর চাষি। যদিও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা ও ফল গবেষকেরা বলছেন, এবার আমের উৎপাদন গতবছরের চেয়ে বেশি হবে বলে তারা ধারণা করছেন। এ অবস্থায় চাষিদের আমবাগান পরিচর্যায় মনোযোগ দিতে বলা হচ্ছে। চার জেলায় এ পর্যন্ত গড়ে ২৫ শতাংশ গাছে মুকুল এসেছে। ১৫ থেকে ২০ দিন আগে প্রথম মুকুল আসে ব্যানানা জাতের আমে। এরপর ধীরে ধীরে অন্য গাছগুলোতে মুকুল ফোঁটা শুরু হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চার জেলায় গত মৌসুমে ৯৩ হাজার ২২৪ হেক্টর জমিতে আমবাগান ছিল। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বাগান ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জে। তারপর নওগাঁ, রাজশাহী ও নাটোরের অবস্থান। এ চার জেলায় উৎপাদন হয়েছিল ১০ লাখ ২৮ হাজার ৮৪৫ মেট্রিক টন আম। এবার কোনো লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়নি। গতবছর আমের ‘অফ ইয়ার’ থাকায় এবার ‘অন ইয়ার’ ধরে নেওয়া হচ্ছে। সে অনুযায়ী আমের উৎপাদন গতবছরের চেয়ে বেশি হবে বলে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করছেন।
রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় মুকুল আসার আগে থেকেই আমগাছের পরিচর্যা করছেন বাগান মালিকরা। মুকুল আসার পরে চাষিদের ব্যস্ততা আরও বেড়ে গেছে। গাছে গাছে চলছে ছত্রাকনাশক স্প্রে করার কাজ চলছে। পাশাপাশি আম গাছের গোড়া চক্রাকারে খুড়ে সেচও দেওয়া হচ্ছে গাছের গুটি টেকাতে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলা সদরে ২০ বিঘা জমিতে আমবাগান করেছেন ইসমাঈল খান শামিম। তিনি বলেন, ‘এবার শীত কম, কুয়াশাও কম। আবহাওয়া ম্যাঙ্গো ফ্রেন্ডলি। গাছে গাছে আমের মুকুলও খুব ভাল আসছে। গতবছর গাছে ফলন কম ছিল। এবার সব গাছেই মুকুল আসছে। শেষ পর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ না এলে আমের ভাল ফলন হবে।’
মৌসুমের শুরু থেকেই সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামের বড় আমচাষি সাদিয়া ইসলাম। তিনিও বলছেন, আবহাওয়া খুব ভাল আছে। গাছে গাছে ব্যাপক মুকুল এসেছে। কতটুকু টিকবে, ফলন কেমন হবে তা এখনই বলতে পারছি না।’
তিনি আরও জানান, সবার আগে মুকুল এসেছে ব্যানানা জাতের গাছে। এরপর আম্রপালি, হিমসাগর, ল্যাংড়া, বারী-৪, গৌড়মতি, লক্ষণভোগ, আশ্বিনা, দুধসর ও অন্যান্য গুটি জাতের আমের মুকুল এসেছে। বাগান ভরেছে কাটিমনের মুকুলেও। কাটিমনের গাছে বছরে তিনবার মুকুল আসে। তাই এবারের মুকুল তারা ভেঙে দেবেন। এরপর অফ সিজনে কাটিমনের যে মুকুল আসবে, সেটা রাখবেন। ওই সময় আমের দাম পাওয়া যাবে ভাল।
রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে আবহাওয়া নিয়ে চাষিদের আপত্তি না থাকলেও শঙ্কার কথা জানান নওগাঁর পত্মীতলা উপজেলার চাষি দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী। নওগাঁর বিভিন্ন এলাকায় তার ২০০ বিঘা জমিতে বাগান আছে। দেলোয়ার বলেন, ‘নওগাঁয় এবার কিছুদিন আগে তাপমাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। তারপর আবার টানা শীত ও কুয়াশা চলছে। ফলে আমের মুকুল আসার ক্ষেত্রে কোনো শৃঙ্খলা নেই। একই গাছে দুই-তিনবার মুকুল ফুটছে।’
তিনি জানান, মুকুল বেশি বের হয় তাপমাত্রা বেশি থাকলে। শুরুর দিকে যে মুকুলগুলো বের হয়েছিল সেগুলো এখন নাকফুল কিংবা মটরদানার মতো গুটি বেঁধেছে। এখন আবার শীত ও কুয়াশার কারণে গুটি কালো হয়ে যাচ্ছে। এই গুটি টেকাতে এক গাছে কয়েকবার স্প্রে করতে হচ্ছে। আবার দফায় দফায় মুকুল বের হওয়ার কারণে দফায় দফায় স্প্রে করতে হচ্ছে। ১৫-২০ দিন আগে তার বাগানে প্রথম ব্যানানা জাতের গাছে মুকুল আসে। এরপর বারি-৪, ল্যাংড়ায় মুকুল এসেছে। গোপালভোগের সবার আগে মুকুল আসার কথা থাকলেও এবার ব্যতিক্রম। এখনও গোপালভোগের মুকুল দেখা যায়নি। আম্রপালিতেও মুকুল আসেনি।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম জানান, ‘গত মৌসুমে যে বাগানের আম দেরিতে নামানো হয়েছে, সে বাগানে মুকুলও দেরিতে আসবে। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। ধীরে ধীরে সব গাছেই মুকুল চলে আসবে। গতবছর আমের ফলন কম ছিল।
এবার কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকলে ফলন ভালো হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিচালক ড. মোতালেব হোসেন জানান, ‘আমরা বিভিন্ন স্থান থেকে তথ্য সংগ্রহ করছি। এ পর্যন্ত ২৫ শতাংশ গাছে মুকুল এসেছে। জাত, ভৌগলিক অবস্থান, আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে মুকুল আগে-পিছে আসতে পারে। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই এবার ফলন ভাল হবে বলে আশা করেন তিনি।