London ১২:০৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মোনালিসার ছবি এত ভুবন বিখ্যাত হওয়ার কারণ কী?

অনলাইন ডেস্ক

জীবনে একবারো মোনালিসার ছবির রেপ্লিকা দেখেননি কিংবা ছবিটির বিষয়ে শোনেননি- এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। রেনেসাঁ যুগের চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা পাঁচ শ’ বছরের পুরনো এই ছবিটিই সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত চিত্রকর্ম।

প্রশ্ন হচ্ছে, যুগে যুগে আরো অনেক শিল্পীই এমন ছবি এঁকেছেন যা শিল্পগুণের দিক থেকে ‘মাস্টারপিস’। কিন্তু সেই সব চিত্রকর্মের চেয়ে মোনালিসার ছবি অনেক বেশি বিখ্যাত এবং পরিচিত। এর কারণ কী?

বিশ্লেষকরা বলছেন, কেবল শিল্পগুণই না, ছবিটির সাথে জড়িয়ে থাকা রহস্য এবং একাধিক ঘটনা এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় চিত্রকর্মগুলোর একটি করার পিছনে ভূমিকা রেখেছে।

যেভাবে সৃষ্টি হয় মোনালিসা
বলা হয়ে থাকে, ১৫০৩ সাল থেকে ১৫১৭ সাল পর্যন্ত এই বিখ্যাত ছবিটি আঁকেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি।

প্রথমে ইতালির ফ্লোরেন্সে এবং পরে রাজা ফ্রান্সিস প্রথমের আমন্ত্রণে ফ্রান্সে যাওয়ার পর সেখানেও ছবিটি নিয়ে কাজ করেন তিনি।

গবেষণাভিত্তিক অলাভজনক সংবাদমাধ্যম দ্য কনভার্সেশনে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে, মোনালিসার ছবিটি আঁকা হয়েছিল একজন সিল্ক ব্যবসায়ীর অনুরোধে।

লিওনার্দোর প্রথম দিককার জীবনীকার ইতালিয়ান স্কলার জর্জিও ভাসারি ১৫৫০ সালে রচিত একটি বইতে এনিয়ে লেখেন।

তিনি লিখেছেন, সিল্ক ব্যবসায়ী ফ্রান্সেসকো ডেল গিওকোন্ডো লিওনার্দোকে তার স্ত্রী লিসা গেরারদিনির প্রোট্রেট আঁকতে অনুরোধ করেন।

ইতালিতে যেকোনো নারীকে ‘মোনা’ বলে সম্বোধন করা হতো। আর ছবিতে থাকা নারীর নাম লিসা। শব্দ দু’টি মিলিয়ে ছবিটির নাম হয় ‘মোনালিসা’।

তবে ছবিটি আসলেই তার ছিল কি না, এনিয়েও আছে বিতর্ক।

ছবিটির সাথে লিওনার্দোর চেহারার অনেক বৈশিষ্ট্যের মিল থাকায় অনেকেই মনে করেন এটি আসলে শিল্পীর নিজেরই ছবি।

আবার অনেকের ধারণা, এটি লিওনার্দোর মা কিংবা তার বান্ধবীর পোট্রেট।

সবশেষ ২০১৫ সালে প্রচলিত সব তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করেন প্যারিসের একজন বিজ্ঞানী পাসকাল কোট।

১০ বছর ধরে গবেষণার পর এই গবেষক দাবি করেন, প্রোট্রেটের রহস্যময়ী এই নারী অন্য কেউ ছিলেন।

তার দাবি, ক্যানভাসের মোনালিসার পেছনে তিনটি আলাদা আলাদা ইমেজ। তৃতীয় যে ইমেজটি তিনি খুঁজে পাচ্ছেন সেটি অন্য এক নারীর মুখ, তার ঠোঁটে কোনো হাসি নেই।

এই বিজ্ঞানী বেশ নিশ্চিত যে ক্যানভাসে খালি চোখে না দেখতে পাওয়া সেই মুখই লিসা গেরারদিনির।

তবে লিওনার্দো নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তাদের অনেকেই নতুন তত্ত্বটিকে তেমন গুরুত্ব দেননি।

‘অমূল্য’ মোনালিসা
ইতিহাস, দর্শন ও শিল্প নিয়ে কাজ করা প্ল্যাটফর্ম দ্য কালেক্টর বলছে, ১৮০৪ সাল থেকে চিত্রকর্মটি ল্যুভর জাদুঘরে আছে।

আইন অনুসারেই, এই ছবিটি ফরাসি নাগরিকদের। ফলে এটি বিক্রি করা অত্যন্ত কঠিন। সবমিলিয়ে এর দাম নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব।

তবে ১৯৬২ সালে যখন একে ইনস্যুরেন্সের অধীনে আনা হয়, তখন এর মূল্য ধরা হয়েছিল ১০ কোটি ডলার, মূল্যস্ফীতির হিসাব ধরেই বর্তমানে যার বাজারমূল্য হতে পারে ৮৩ কোটি ডলারের বেশি।

এদিকে ২০২০ সালে ফরাসি উদ্যোক্তা স্টিফেন ডিস্টিংগুইন বলেছিলেন, মহামারীর বিপর্যয়কর প্রভাব থেকে ফ্রান্সকে পুনরুদ্ধারে মোনালিসাকে বিক্রি করা যেতে পারে।

আর ছবিটি যে পরিমাণ রাজস্ব এনেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এর দাম পাঁচ হাজার কোটি ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে বলেও ওই সময় মন্তব্য করেন তিনি। তবে দাম নিয়ে তার এই মত খারিজ করে দেন শিল্প-সংশ্লিষ্টরা।

মোনালিসার বৈশিষ্ট্য
বলা হয়, মোনালিসা ছিল লিওনার্দোর নিজের আঁকা সবচেয়ে প্রিয় ছবিগুলোর একটি। যদিও মৃত্যুর আগে লিওনার্দো ছবিটির কাজ শেষ করে যেতে পারেননি।

চিত্রকর্মটি নিয়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হলো মোনালিসার হাসি। এতে লিওনার্দো এমনভাবে রঙের ব্যবহার করেছেন যাতে করে ছবির নারীর হাসিতে এক ধরনের রহস্যময়তা ফুটে উঠেছে।

সাধারণভাবে তাকালে যেখানে মনে হয় চিত্রকর্মের নারীটি হাসছেন, আবার হাসির দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকলে সেই হাসি যেন ক্রমেই মিলিয়ে যায়।

রঙের আঁচড়ে দৃষ্টির এই বিভ্রম তৈরি ছাড়াও মোনালিসার ছবি এমনভাবে আঁকা হয়েছে যে চিত্রকর্মটির যেদিকেই দাঁড়ানো হোক না কেন, মনে হয় ছবিটির চোখ সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছে।

এর আগেও এই পদ্ধতিতে একাধিক ছবি আঁকা হলেও মোনালিসার জনপ্রিয়তার সাথে সাথে এই পদ্ধতির নামই হয়ে গেছে ‘মোনালিসা ইফেক্ট’।

এছাড়াও ল্যুভর মিউজিয়ামের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ছবিটিতে লিওনার্দো ব্যবহার করেছেন স্ফুমাটো কৌশল, যার ব্যবহার ওই সময় খুব বেশি প্রচলিত ছিল না।

এর মাধ্যমে ওই সময় সাধারণত শিল্পীদের লাইন টেনে ছবি আঁকার যে কৌশল ব্যবহার করতেন তা থেকে বেরিয়ে আসেন লিওনার্দো।

বরং ছবির কিনারায় স্পষ্ট বিভাজন না করে রঙের মিশ্রণে চোখের কোণ এবং মুখের ওপর ছায়া ফেলেন তিনি। আর এই কৌশলের কারণেই মোনালিসার অভিব্যক্তি আরো বেশি রহস্যময় হয়ে উঠেছে।

কোনো ধরনের লাইন না টেনেই আলো-ছায়ার বিভ্রম তৈরি করতে লিওনার্দো এমনভাবে ছবিটি এঁকেছেন, যার কারণে কাছের বিষয়গুলো স্পষ্ট এবং দূরের বিষয়গুলো ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে গেছে।

ওই সময় শিল্পীরা আঁকার জন্য ক্যানভাসের ব্যবহার করলেও ৩০/২১ ইঞ্চির এই ছবিটি লিওনার্দো এঁকেছিলেন কাঠের ওপর।

পপলার কাঠের প্যানেলে ছবিটি আঁকার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাওয়ার ফলে এর কিছু অংশে ফাটল ধরেছে।

যে কারণে মোনালিসার ছবি এত বিখ্যাত
মোনালিসার ছবির শিল্পগুণ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে কেবল এর আঁকার উৎকর্ষতার কারণেই মোনালিসার ছবি আকাশচুম্বী খ্যাতি পায়নি। বরং এর জনপ্রিয়তার পিছনে ছবিটির সাথে জড়িয়ে থাকা রহস্য ছাড়াও আছে ফ্রান্সের বিপ্লব, রেনেসাঁ-পরবর্তী যুগে লিওনার্দোর পরিচিতি কিংবা মোনালিসার ছবি চুরি যাওয়ার মতো ঘটনা।

ল্যুভর জাদুঘরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, মোনালিসার রহস্যময় হাসি শতাব্দী ধরে দর্শকদের মুগ্ধ করছে। তাদের মধ্যে প্রথম ছিলেন রাজা ফ্রান্সিস প্রথম।

তিনি ১৫১৮ সালে মোনালিসার ছবিটি কিনে নেন। আর এর মাধ্যমে জগদ্বিখ্যাত ছবিটি ফরাসি রাজকীয় সংগ্রহে আসে এবং ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে ল্যুভরে প্রদর্শন করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা ভিত্তিক মিডিয়া অর্গানাইজেশন টেড-এডের একটি ভিডিওতে বলা হয়েছে, লিওনার্দোসহ ইতালির রেনেসাঁ যুগের একাধিক শিল্পীকে নিয়ে পরবর্তী সময়ে জর্জিও ভাসারির লেখা বই বেশ জনপ্রিয়তা পায় এবং একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়। বইটিতে ‘মোনালিসা’ নিয়ে অত্যুৎসাহী বর্ণনা দেয়া হয়।

পরবর্তী বছরগুলোতে ফ্রান্সের রাজকীয় সংগ্রহের অন্যতম একটি হয়ে দাঁড়ায় মোনালিসা। এটি কিছুদিন নেপোলিয়নের শোবার ঘরের দেয়ালেও ঝুলানো ছিল। পরে জনসাধারণের সামনে প্রদর্শনের জন্য এটি ল্যুভর জাদুঘরে রাখা হয়।

১৮০০ সালের দিকে আলফ্রেড ডুমেন্সিল, থিওফিল গতিয়ার ও ওয়াল্টার পেটারের মতো একাধিক ইউরোপিয়ান স্কলার মোনালিসা চিত্রকর্মটি নিয়ে বেশ আগ্রহ দেখান।

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ‘জিনিয়াস’ বা ‘প্রতিভাধর’ হিসেবে ১৯ শতকে লিওনার্দোকে নিয়ে বেশ সাড়া পড়ে যায়।

বিশেষ করে সময়ের তুলনায় তার এগিয়ে থাকা চিন্তা এবং ১৯ শতকে এসে রেনেসাঁর প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় কেবল একজন চিত্রশিল্পী হিসেবেই নয়, বরং একজন মহান বিজ্ঞানী এবং উদ্ভাবক হিসেবেও তিনি পরিচিতি পান।

তবে পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞান ও স্থাপত্যে তার অবদানের জায়গা সংক্ষিপ্ত হিসাবে দেখা হলেও তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা মিথ একুশ শতকেও সমানভাবে প্রচলিত ছিল, যা মোনালিসার খ্যাতিতেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

ল্যুভর থেকে খোয়া যায় মোনালিসা
ছবিটি ঘিরে লেখকদের আগ্রহের মধ্যেই ১৯১১ সালের আগাস্টে ল্যুভর জাদুঘর থেকে মোনালিসার চুরি যাওয়ায় ঘটনা একে বিশ্বব্যাপী আগ্রহের কেন্দ্রে নিয়ে আসে।

এই ঘটনার পর মানুষের আগ্রহ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে মোনালিসার ছবি ঝুলানোর খালি জায়গা দেখতেও সাধারণ মানুষ সেখানে ভিড় করতো।

এমনকি মোনালিসার ছবি চুরি যাওয়ার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোকেও গ্রেফতার করা হয়।

অবশেষে দু’বছর পর ইতালি থেকে ছবিটি উদ্ধার করা হয়।

ভিনসেঞ্জো পেরুজ্জিয়া নামের একজন ইতালীয় নাগরিক ফ্রান্সের ল্যুভরে কাজ করতেন। মোনালিসাকে নিজ দেশের সম্পদ মনে করতেন তিনি। তাই নিজেদের সম্পদ দেশে ফিরিয়ে নিতে তিনি ছবিটি চুরি করেন বলে জানান।

কিন্তু চুরির দু’বছরেও কোথাও এটি বিক্রি করতে না পারায় ইতালির একজন আর্ট ডিলারের সাথে যোগাযোগ করলে ওই ব্যবসায়ী পুলিশকে এ বিষয়ে জানিয়ে দেন।

পরে ইতালি থেকে ছবিটি ফ্রান্সে ফেরত নেয়া হয়।

পরে সময়ে ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং ১৯৭৪ সালে মোনালিসার জাপান সফর একে ‘সেলিব্রেটি’ তকমা এনে দেয়।

ছবিটি ১৯৬৬ সাল থেকে প্রদর্শনের জন্য ল্যুভর জাদুঘরের আলাদা একটি কক্ষ বরাদ্দ করা হয়।

তবে একাধিকবার অ্যাক্টিভিস্টদের আক্রমণের মুখে পড়ার পর ২০০৫ সাল থেকে ছবিটি বুলেটপ্রুফ কাচের মধ্যে রাখা হচ্ছে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, কোনো একটি নির্দিষ্ট ঘটনা মোনালিসাকে এই খ্যাতি এনে দেয়নি। বরং বিভিন্ন সময়ের ঘটনা পরম্পরা এবং এটি ঘিরে মানুষের বাড়তে থাকা আগ্রহই চিত্রকর্মটির খ্যাতি এমন অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৮:৫৯:২৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫
Translate »

মোনালিসার ছবি এত ভুবন বিখ্যাত হওয়ার কারণ কী?

আপডেট : ০৮:৫৯:২৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫

জীবনে একবারো মোনালিসার ছবির রেপ্লিকা দেখেননি কিংবা ছবিটির বিষয়ে শোনেননি- এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। রেনেসাঁ যুগের চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা পাঁচ শ’ বছরের পুরনো এই ছবিটিই সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত চিত্রকর্ম।

প্রশ্ন হচ্ছে, যুগে যুগে আরো অনেক শিল্পীই এমন ছবি এঁকেছেন যা শিল্পগুণের দিক থেকে ‘মাস্টারপিস’। কিন্তু সেই সব চিত্রকর্মের চেয়ে মোনালিসার ছবি অনেক বেশি বিখ্যাত এবং পরিচিত। এর কারণ কী?

বিশ্লেষকরা বলছেন, কেবল শিল্পগুণই না, ছবিটির সাথে জড়িয়ে থাকা রহস্য এবং একাধিক ঘটনা এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় চিত্রকর্মগুলোর একটি করার পিছনে ভূমিকা রেখেছে।

যেভাবে সৃষ্টি হয় মোনালিসা
বলা হয়ে থাকে, ১৫০৩ সাল থেকে ১৫১৭ সাল পর্যন্ত এই বিখ্যাত ছবিটি আঁকেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি।

প্রথমে ইতালির ফ্লোরেন্সে এবং পরে রাজা ফ্রান্সিস প্রথমের আমন্ত্রণে ফ্রান্সে যাওয়ার পর সেখানেও ছবিটি নিয়ে কাজ করেন তিনি।

গবেষণাভিত্তিক অলাভজনক সংবাদমাধ্যম দ্য কনভার্সেশনে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে, মোনালিসার ছবিটি আঁকা হয়েছিল একজন সিল্ক ব্যবসায়ীর অনুরোধে।

লিওনার্দোর প্রথম দিককার জীবনীকার ইতালিয়ান স্কলার জর্জিও ভাসারি ১৫৫০ সালে রচিত একটি বইতে এনিয়ে লেখেন।

তিনি লিখেছেন, সিল্ক ব্যবসায়ী ফ্রান্সেসকো ডেল গিওকোন্ডো লিওনার্দোকে তার স্ত্রী লিসা গেরারদিনির প্রোট্রেট আঁকতে অনুরোধ করেন।

ইতালিতে যেকোনো নারীকে ‘মোনা’ বলে সম্বোধন করা হতো। আর ছবিতে থাকা নারীর নাম লিসা। শব্দ দু’টি মিলিয়ে ছবিটির নাম হয় ‘মোনালিসা’।

তবে ছবিটি আসলেই তার ছিল কি না, এনিয়েও আছে বিতর্ক।

ছবিটির সাথে লিওনার্দোর চেহারার অনেক বৈশিষ্ট্যের মিল থাকায় অনেকেই মনে করেন এটি আসলে শিল্পীর নিজেরই ছবি।

আবার অনেকের ধারণা, এটি লিওনার্দোর মা কিংবা তার বান্ধবীর পোট্রেট।

সবশেষ ২০১৫ সালে প্রচলিত সব তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করেন প্যারিসের একজন বিজ্ঞানী পাসকাল কোট।

১০ বছর ধরে গবেষণার পর এই গবেষক দাবি করেন, প্রোট্রেটের রহস্যময়ী এই নারী অন্য কেউ ছিলেন।

তার দাবি, ক্যানভাসের মোনালিসার পেছনে তিনটি আলাদা আলাদা ইমেজ। তৃতীয় যে ইমেজটি তিনি খুঁজে পাচ্ছেন সেটি অন্য এক নারীর মুখ, তার ঠোঁটে কোনো হাসি নেই।

এই বিজ্ঞানী বেশ নিশ্চিত যে ক্যানভাসে খালি চোখে না দেখতে পাওয়া সেই মুখই লিসা গেরারদিনির।

তবে লিওনার্দো নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তাদের অনেকেই নতুন তত্ত্বটিকে তেমন গুরুত্ব দেননি।

‘অমূল্য’ মোনালিসা
ইতিহাস, দর্শন ও শিল্প নিয়ে কাজ করা প্ল্যাটফর্ম দ্য কালেক্টর বলছে, ১৮০৪ সাল থেকে চিত্রকর্মটি ল্যুভর জাদুঘরে আছে।

আইন অনুসারেই, এই ছবিটি ফরাসি নাগরিকদের। ফলে এটি বিক্রি করা অত্যন্ত কঠিন। সবমিলিয়ে এর দাম নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব।

তবে ১৯৬২ সালে যখন একে ইনস্যুরেন্সের অধীনে আনা হয়, তখন এর মূল্য ধরা হয়েছিল ১০ কোটি ডলার, মূল্যস্ফীতির হিসাব ধরেই বর্তমানে যার বাজারমূল্য হতে পারে ৮৩ কোটি ডলারের বেশি।

এদিকে ২০২০ সালে ফরাসি উদ্যোক্তা স্টিফেন ডিস্টিংগুইন বলেছিলেন, মহামারীর বিপর্যয়কর প্রভাব থেকে ফ্রান্সকে পুনরুদ্ধারে মোনালিসাকে বিক্রি করা যেতে পারে।

আর ছবিটি যে পরিমাণ রাজস্ব এনেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এর দাম পাঁচ হাজার কোটি ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে বলেও ওই সময় মন্তব্য করেন তিনি। তবে দাম নিয়ে তার এই মত খারিজ করে দেন শিল্প-সংশ্লিষ্টরা।

মোনালিসার বৈশিষ্ট্য
বলা হয়, মোনালিসা ছিল লিওনার্দোর নিজের আঁকা সবচেয়ে প্রিয় ছবিগুলোর একটি। যদিও মৃত্যুর আগে লিওনার্দো ছবিটির কাজ শেষ করে যেতে পারেননি।

চিত্রকর্মটি নিয়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হলো মোনালিসার হাসি। এতে লিওনার্দো এমনভাবে রঙের ব্যবহার করেছেন যাতে করে ছবির নারীর হাসিতে এক ধরনের রহস্যময়তা ফুটে উঠেছে।

সাধারণভাবে তাকালে যেখানে মনে হয় চিত্রকর্মের নারীটি হাসছেন, আবার হাসির দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকলে সেই হাসি যেন ক্রমেই মিলিয়ে যায়।

রঙের আঁচড়ে দৃষ্টির এই বিভ্রম তৈরি ছাড়াও মোনালিসার ছবি এমনভাবে আঁকা হয়েছে যে চিত্রকর্মটির যেদিকেই দাঁড়ানো হোক না কেন, মনে হয় ছবিটির চোখ সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছে।

এর আগেও এই পদ্ধতিতে একাধিক ছবি আঁকা হলেও মোনালিসার জনপ্রিয়তার সাথে সাথে এই পদ্ধতির নামই হয়ে গেছে ‘মোনালিসা ইফেক্ট’।

এছাড়াও ল্যুভর মিউজিয়ামের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ছবিটিতে লিওনার্দো ব্যবহার করেছেন স্ফুমাটো কৌশল, যার ব্যবহার ওই সময় খুব বেশি প্রচলিত ছিল না।

এর মাধ্যমে ওই সময় সাধারণত শিল্পীদের লাইন টেনে ছবি আঁকার যে কৌশল ব্যবহার করতেন তা থেকে বেরিয়ে আসেন লিওনার্দো।

বরং ছবির কিনারায় স্পষ্ট বিভাজন না করে রঙের মিশ্রণে চোখের কোণ এবং মুখের ওপর ছায়া ফেলেন তিনি। আর এই কৌশলের কারণেই মোনালিসার অভিব্যক্তি আরো বেশি রহস্যময় হয়ে উঠেছে।

কোনো ধরনের লাইন না টেনেই আলো-ছায়ার বিভ্রম তৈরি করতে লিওনার্দো এমনভাবে ছবিটি এঁকেছেন, যার কারণে কাছের বিষয়গুলো স্পষ্ট এবং দূরের বিষয়গুলো ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে গেছে।

ওই সময় শিল্পীরা আঁকার জন্য ক্যানভাসের ব্যবহার করলেও ৩০/২১ ইঞ্চির এই ছবিটি লিওনার্দো এঁকেছিলেন কাঠের ওপর।

পপলার কাঠের প্যানেলে ছবিটি আঁকার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাওয়ার ফলে এর কিছু অংশে ফাটল ধরেছে।

যে কারণে মোনালিসার ছবি এত বিখ্যাত
মোনালিসার ছবির শিল্পগুণ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে কেবল এর আঁকার উৎকর্ষতার কারণেই মোনালিসার ছবি আকাশচুম্বী খ্যাতি পায়নি। বরং এর জনপ্রিয়তার পিছনে ছবিটির সাথে জড়িয়ে থাকা রহস্য ছাড়াও আছে ফ্রান্সের বিপ্লব, রেনেসাঁ-পরবর্তী যুগে লিওনার্দোর পরিচিতি কিংবা মোনালিসার ছবি চুরি যাওয়ার মতো ঘটনা।

ল্যুভর জাদুঘরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, মোনালিসার রহস্যময় হাসি শতাব্দী ধরে দর্শকদের মুগ্ধ করছে। তাদের মধ্যে প্রথম ছিলেন রাজা ফ্রান্সিস প্রথম।

তিনি ১৫১৮ সালে মোনালিসার ছবিটি কিনে নেন। আর এর মাধ্যমে জগদ্বিখ্যাত ছবিটি ফরাসি রাজকীয় সংগ্রহে আসে এবং ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে ল্যুভরে প্রদর্শন করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা ভিত্তিক মিডিয়া অর্গানাইজেশন টেড-এডের একটি ভিডিওতে বলা হয়েছে, লিওনার্দোসহ ইতালির রেনেসাঁ যুগের একাধিক শিল্পীকে নিয়ে পরবর্তী সময়ে জর্জিও ভাসারির লেখা বই বেশ জনপ্রিয়তা পায় এবং একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়। বইটিতে ‘মোনালিসা’ নিয়ে অত্যুৎসাহী বর্ণনা দেয়া হয়।

পরবর্তী বছরগুলোতে ফ্রান্সের রাজকীয় সংগ্রহের অন্যতম একটি হয়ে দাঁড়ায় মোনালিসা। এটি কিছুদিন নেপোলিয়নের শোবার ঘরের দেয়ালেও ঝুলানো ছিল। পরে জনসাধারণের সামনে প্রদর্শনের জন্য এটি ল্যুভর জাদুঘরে রাখা হয়।

১৮০০ সালের দিকে আলফ্রেড ডুমেন্সিল, থিওফিল গতিয়ার ও ওয়াল্টার পেটারের মতো একাধিক ইউরোপিয়ান স্কলার মোনালিসা চিত্রকর্মটি নিয়ে বেশ আগ্রহ দেখান।

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ‘জিনিয়াস’ বা ‘প্রতিভাধর’ হিসেবে ১৯ শতকে লিওনার্দোকে নিয়ে বেশ সাড়া পড়ে যায়।

বিশেষ করে সময়ের তুলনায় তার এগিয়ে থাকা চিন্তা এবং ১৯ শতকে এসে রেনেসাঁর প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় কেবল একজন চিত্রশিল্পী হিসেবেই নয়, বরং একজন মহান বিজ্ঞানী এবং উদ্ভাবক হিসেবেও তিনি পরিচিতি পান।

তবে পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞান ও স্থাপত্যে তার অবদানের জায়গা সংক্ষিপ্ত হিসাবে দেখা হলেও তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা মিথ একুশ শতকেও সমানভাবে প্রচলিত ছিল, যা মোনালিসার খ্যাতিতেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

ল্যুভর থেকে খোয়া যায় মোনালিসা
ছবিটি ঘিরে লেখকদের আগ্রহের মধ্যেই ১৯১১ সালের আগাস্টে ল্যুভর জাদুঘর থেকে মোনালিসার চুরি যাওয়ায় ঘটনা একে বিশ্বব্যাপী আগ্রহের কেন্দ্রে নিয়ে আসে।

এই ঘটনার পর মানুষের আগ্রহ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে মোনালিসার ছবি ঝুলানোর খালি জায়গা দেখতেও সাধারণ মানুষ সেখানে ভিড় করতো।

এমনকি মোনালিসার ছবি চুরি যাওয়ার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোকেও গ্রেফতার করা হয়।

অবশেষে দু’বছর পর ইতালি থেকে ছবিটি উদ্ধার করা হয়।

ভিনসেঞ্জো পেরুজ্জিয়া নামের একজন ইতালীয় নাগরিক ফ্রান্সের ল্যুভরে কাজ করতেন। মোনালিসাকে নিজ দেশের সম্পদ মনে করতেন তিনি। তাই নিজেদের সম্পদ দেশে ফিরিয়ে নিতে তিনি ছবিটি চুরি করেন বলে জানান।

কিন্তু চুরির দু’বছরেও কোথাও এটি বিক্রি করতে না পারায় ইতালির একজন আর্ট ডিলারের সাথে যোগাযোগ করলে ওই ব্যবসায়ী পুলিশকে এ বিষয়ে জানিয়ে দেন।

পরে ইতালি থেকে ছবিটি ফ্রান্সে ফেরত নেয়া হয়।

পরে সময়ে ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং ১৯৭৪ সালে মোনালিসার জাপান সফর একে ‘সেলিব্রেটি’ তকমা এনে দেয়।

ছবিটি ১৯৬৬ সাল থেকে প্রদর্শনের জন্য ল্যুভর জাদুঘরের আলাদা একটি কক্ষ বরাদ্দ করা হয়।

তবে একাধিকবার অ্যাক্টিভিস্টদের আক্রমণের মুখে পড়ার পর ২০০৫ সাল থেকে ছবিটি বুলেটপ্রুফ কাচের মধ্যে রাখা হচ্ছে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, কোনো একটি নির্দিষ্ট ঘটনা মোনালিসাকে এই খ্যাতি এনে দেয়নি। বরং বিভিন্ন সময়ের ঘটনা পরম্পরা এবং এটি ঘিরে মানুষের বাড়তে থাকা আগ্রহই চিত্রকর্মটির খ্যাতি এমন অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।