শেষ হচ্ছে না কোটা নিয়ে খোঁটা। গত বছর এই কোটা নিয়ে আন্দোলনে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। পতনের আগে হাইকোর্টের রায়ের আলোকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৯৩ শতাংশ মেধা ও সাত শতাংশ কোটা প্রথা চালু করে তারা।
সেই কোটা নিয়ে এখনো বিতর্কের অবসান হয়নি। এ নিয়ে আবারও প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষার্থীরা। বেকায়দায় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার। বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর পড়েছে বিপাকে।
গত রোববার (১৯ জানুয়ারি) ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এতেই সামনে আসে কোটা নিয়ে প্রশ্ন। মেধা থেকে ৭৩ নম্বর পেয়েও ভর্তির জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হতে পারেননি, কিন্তু কোটায় ৪১ নম্বর পেয়েও নির্বাচিত হতে পেরেছেন।
বিষয়টি নিয়ে সেদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম। তিনি বলেছেন, ‘ভর্তি পরীক্ষায় এখনো কিসের কোটা? আজ থেকেই এই শোষণের শেষ হতে হবে। ফুলস্টপ।’
মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় কোটা পদ্ধতি রাখার প্রতিবাদে রোববার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। এসময় তারা কোটাবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেন।
কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে গণআন্দোলনের শুরু। কিন্তু বর্তমান সরকারের ছয় মাস হয়ে গেলেও এখনো কোটা প্রথার বিলুপ্তি দেখতে পাইনি। এখনো কেউ কোটার জোরে ৪১ পেয়ে চান্স পায়, আরেকজন ৭৩ পেয়েও চান্স পায় না।
শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা এক কঠিন গণআন্দোলনের মধ্যদিয়ে স্বৈরাচার পতনের ইতিহাস লিখেছি। মনে রাখতে হবে, এই কোটা আন্দোলনের মাধ্যমেই সেই গণআন্দোলনের শুরু। কিন্তু বর্তমান সরকারের ছয় মাস হয়ে গেলেও এখনো কোটা প্রথার বিলুপ্তি দেখতে পাইনি। এখনো কেউ কোটার জোরে ৪১ পেয়ে চান্স পায়, আরেকজন ৭৩ পেয়েও চান্স পায় না।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যেই বৈষম্য নিরসন করতে গিয়ে আমাদের রাজপথে নামতে হয়েছিল, সেই বৈষম্য দূর করতে যদি আবারও নামতে হয়, তাহলে এই সরকারেরও পরিণতি হাসিনার মতো হবে।
পরদিন সোমবার (২০ জানুয়ারি) সকাল থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। এসময় তারা ‘অবিলম্বে ফলাফল বাতিল করো করতে হবে’, ‘কোটা না মেধা-মেধা মেধা’, ‘মেডিকেলের ফলাফল-পুনঃপ্রকাশ করতে হবে’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) সহযোগী অধ্যাপক ডা. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘আমার একজন ছেলে বা মেয়ে ৭৩ পেয়েও মেডিকেলে চান্স পাচ্ছে না অথচ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩৬ বা ৩৭ পেয়েও চান্স পেয়ে যাচ্ছে। পরিবর্তিত বাংলাদেশে কেনো এই বৈষম্য থাকবে? আমরা এই ফল মানি না।’
আমরা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের ‘মেডিকেল/ডেন্টাল কলেজে এমবিবিএস/বিডিএস কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি নীতিমালা-২০২৫’ অনুসরণ করেছি। হাইকোর্টের রায় ও সরকারের সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনের আলোকেই কোটা রাখা হয়েছে। সরকার এ বিষয়ে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত দিলে আমরা সেটা প্রতিপালন করবো।
শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রয়োজনে আমরা ঢাকা মেডিকেলসহ সারাদেশের সব মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনে নামবো। সুতরাং এই আন্দোলনকে হালকাভাবে নেওয়ার কিছু নেই। আজকের মধ্যেই ফলাফল বাতিল করতে হবে।
সোমবার দিনভর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে তারাও বেশ বেকায়দায় আছেন। দফায় দফায় অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্তাদের বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সমাধান নেই। তাদের হাতে হাইকোর্টের রায় ও সরকারের প্রজ্ঞাপন আছে। সে আলোকে তারা কোটা রেখেছে। এর বাইরে তাদের যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়টিও তাদের বেশ ভাবাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় শিক্ষার্থীদেরই সরকার। তারা চাইলে তো কোটা বাতিল করতে পারতো। সেটি তো করেনি। যেহেতু বাতিল করেনি, সেহেতু আমাকে তো বিদ্যমান প্রজ্ঞাপন ও রায়কেই প্রতিপালন করতে হবে।’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক ডা. রুবীনা ইয়াসমীন বলেন, “আমরা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের ‘মেডিকেল/ডেন্টাল কলেজে এমবিবিএস/বিডিএস কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি নীতিমালা-২০২৫’ অনুসরণ করেছি। সেখানে হাইকোর্টের রায় ও সরকারের সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনের আলোকেই কোটা রাখা হয়েছে। আমরাও তাই করেছি। সরকার এ বিষয়ে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত দিলে আমরা সেটা প্রতিপালন করবো।”
ডা. রুবীনা ইয়াসমীন বলেন, ‘আমরা কোটায় উত্তীর্ণদের প্রমাণাদি যাচাই করবো। আসলেই তারা সংশ্লিষ্ট কোটার উপযোগী কি না। এজন্য আমরা ২৩ ও ২৬ জানুয়ারি পিছিয়ে পড়া পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর কোটায় নির্বাচিত প্রার্থীদের প্রমাণাদিসহ অধিদপ্তরে ডেকেছি। মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত আসনে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের কোটার সপক্ষে সনদ/প্রমাণকসহ ২৭, ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি ডেকেছি। প্রমাণাদি যাচাই করে ঠিক পাওয়া গেলে ভর্তির সুযোগ পাবে, না হলে পাবে না।’