London ০৫:০১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম:

মায়েদের আত্মত্যাগের শেষ নেই

অনলাইন ডেস্ক:

মায়েদের জন্য আদৌ কোনো দিবসের প্রয়োজন আছে কি? এই প্রশ্নটা প্রায়ই মনে উঠে আসে। কারণ একজন মা কেবল একটি দিনের নয়, তিনি প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ, প্রতি মুহূর্তের। তবুও, মা দিবস একটি উপলক্ষ। ভালোবাসা প্রকাশের, আত্মত্যাগের কৃতজ্ঞতা জানানোর, মায়ের সঙ্গে সময় কাটানোর ছোট্ট একটি সুযোগ।

একজন মা যেন প্রতিদিনই নিজের অস্তিত্বকে ছাড়িয়ে সন্তানদের জন্য বাঁচেন। তাদের এই নিরব, নিঃস্বার্থ জীবনযুদ্ধ আমাদের চোখে পড়ে না, কারণ সেটি এতটাই সাধারণ হয়ে উঠেছে সমাজে। কিন্তু এমন কিছু মায়ের গল্প আমাদের চেতনা জাগায়, ভাবিয়ে তোলে-কেন মায়েরা এতটা ত্যাগ স্বীকার করেন? তাদের কি পাওয়ার কিছুই নেই?

ঢাকার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সামনের ফুটপাতে প্রতিদিন দেখা মেলে ফিরোজা বেগমের। বয়স মাত্র ৩৫। ভ্যানে পিঠা বিক্রি করেন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা চালিয়ে নিতে, সংসারে কিছুটা সহায়তা করতে-এই লড়াই তার।

‘স্বামীর রিকশার আয়ে ঘর চলে না। বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, কিছু একটা করতেই হবে’, বলেন ফিরোজা। কথা বলতে বলতে একটা পিঠা ভাঁজ করতে করতে হালকা হাসেন, ‘এই রোদের মধ্যে কেউ কি নিজের জন্য পিঠা বিক্রি করে? সন্তানের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই সব করি।’

একটু দূরেই বসে ৫০ বছর বয়সী রোজিনা আক্তার। দশ বছর ধরে এখানে চা বিক্রি করছেন। জীবনের এই সন্ধিক্ষণে বিশ্রামের কথা ভাবার কথা থাকলেও তিনি রোজ যুদ্ধ করেন নিজের দুই সন্তানকে মানুষ করার জন্য। রোজিনা আক্তার বলেন ‘বড় ছেলে-মেয়েকে তেমন পড়াতে পারি নাই, কিন্তু ছোট পোলারে আর মেয়েটারে পড়ানোর জন্যই এত কষ্ট করি।’

এই ফিরোজা, রোজিনারা হাজারো মায়ের প্রতিচ্ছবি। কেউ কাজ করেন বাসাবাড়িতে, কেউ সেলাই করেন, কেউ বা চায়ের দোকান চালান। এইসব মায়েরা নিজেরা পেটে ক্ষুধা নিয়েও সন্তানকে খাইয়ে দেন। নিজের নতুন জামা না কিনে সন্তানের স্কুল ড্রেস বানান। সারাদিন খেটে ক্লান্ত শরীরে ফিরেও হাসিমুখে সন্তানের পাশে বসেন।

কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, সেই সন্তানেরাই বড় হয়ে প্রায়শঃ ভুলে যান এই সব ত্যাগের কথা। আজকের এই মা দিবসে কত শত বৃদ্ধা মা রয়েছেন, যারা বৃদ্ধাশ্রমে একটি ফোন কলের জন্য অপেক্ষায় দিন কাটান। এই বুঝি ফোনটা এলো-এই আশায় তারা বারবার ফোনের দিকে তাকান। কেউ কেউ জানেন, ফোনটা আর আসবে না; তবুও অপেক্ষা করেন। তারা সন্তানকে নিজের কাছে চায় না, কেবল জানতে চায় সন্তান ভালো আছে কি না।

যারা এখনো মায়ের সঙ্গে আছেন, তাদের এক বিরাট অংশই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মা দিবস পালন করেন। যেমন-মায়ের সঙ্গে ছবি তোলা, মাকে পোস্ট করা ইত্যাদি। এটি নিঃসন্দেহে ভালো কাজ। কিন্তু আজকের এই দিনটি মায়ের জন্য রাখতে পারেন। ব্যস্ততার কারণে হয়তো অধিকাংশ সময়ই মাকে সময় দিতে পারেন না। মা চুপচাপ থেকে অনেক কথা জমিয়ে রাখেন। ব্যস্ত জীবনে আমরা সে কথাগুলো শুনি না।তাই আজকের এই দিনে মায়ের না বলা কথা গুলো শুনতে পারেন।

আপনি কি জানেন, আপনার মায়ের সবচেয়ে প্রিয় খাবার কোনটি? তার ছোটবেলার কোনো প্রিয় গল্প? কোনো অপূর্ণ স্বপ্ন? হয়তো জানেন না। কারণ জানার চেষ্টাই করা হয়নি। কিন্তু এইসব ছোট ছোট খেয়াল রাখাটাই তো ভালোবাসা।

আজকের এই দিনটিতে আপনি চাইলে মাকে রান্না করে খাওয়াতে পারেন, একটি শাড়ি কিনে উপহার দিতে পারেন, কিংবা মাকে নিয়ে বিকালে একটু হাঁটতে যেতে পারেন। এটা শুধু একটা দিনের জন্য না, বরং আমাদের মনে করিয়ে দেয়-মায়ের যত্ন প্রতিদিনই দরকার।

একজন মা কোনো বিনিময়ের আশায় সন্তানদের লালন করেন না। তিনি শুধু চান সন্তানের মুখে হাসি ফুটুক। আর সেই হাসির জন্য তিনি নিজের কষ্টগুলো হেসে হেসে সয়ে যান। তাই তার প্রতি দায়িত্ববোধটাও আমাদের প্রতিদিনের হওয়া উচিত। মা’কে শুধু একদিনের নয়, প্রতিদিনই ভালোবাসার দিন।

মায়ের আত্মত্যাগের মূল্য কোনো শব্দে বা উপহারেই মেটানো সম্ভব নয়। তবে আমরা যদি অন্তত তার পাশে থাকি, তার সুখ-দুঃখ ভাগ করি, তাতেই মা খুশি। আজকের এই মা দিবসে প্রতিজ্ঞা হোক মায়ের ভালোবাসাকে কেবল একদিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রতিদিন তার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও যত্ন প্রকাশ করার।

আপনার একটি ফোনকল, একটু সময়, এক কাপ চা একসঙ্গে খাওয়া এই ছোট ছোট ভালোবাসাগুলোই একজন মায়ের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উপহার। তাই আসুন, মা দিবসকে শুধুই ছবি পোস্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, ভালোবাসার বাস্তব ছোঁয়া দিয়ে তা পূর্ণ করি।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০২:১৫:৩৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১২ মে ২০২৫
Translate »

মায়েদের আত্মত্যাগের শেষ নেই

আপডেট : ০২:১৫:৩৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১২ মে ২০২৫

মায়েদের জন্য আদৌ কোনো দিবসের প্রয়োজন আছে কি? এই প্রশ্নটা প্রায়ই মনে উঠে আসে। কারণ একজন মা কেবল একটি দিনের নয়, তিনি প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ, প্রতি মুহূর্তের। তবুও, মা দিবস একটি উপলক্ষ। ভালোবাসা প্রকাশের, আত্মত্যাগের কৃতজ্ঞতা জানানোর, মায়ের সঙ্গে সময় কাটানোর ছোট্ট একটি সুযোগ।

একজন মা যেন প্রতিদিনই নিজের অস্তিত্বকে ছাড়িয়ে সন্তানদের জন্য বাঁচেন। তাদের এই নিরব, নিঃস্বার্থ জীবনযুদ্ধ আমাদের চোখে পড়ে না, কারণ সেটি এতটাই সাধারণ হয়ে উঠেছে সমাজে। কিন্তু এমন কিছু মায়ের গল্প আমাদের চেতনা জাগায়, ভাবিয়ে তোলে-কেন মায়েরা এতটা ত্যাগ স্বীকার করেন? তাদের কি পাওয়ার কিছুই নেই?

ঢাকার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সামনের ফুটপাতে প্রতিদিন দেখা মেলে ফিরোজা বেগমের। বয়স মাত্র ৩৫। ভ্যানে পিঠা বিক্রি করেন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা চালিয়ে নিতে, সংসারে কিছুটা সহায়তা করতে-এই লড়াই তার।

‘স্বামীর রিকশার আয়ে ঘর চলে না। বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, কিছু একটা করতেই হবে’, বলেন ফিরোজা। কথা বলতে বলতে একটা পিঠা ভাঁজ করতে করতে হালকা হাসেন, ‘এই রোদের মধ্যে কেউ কি নিজের জন্য পিঠা বিক্রি করে? সন্তানের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই সব করি।’

একটু দূরেই বসে ৫০ বছর বয়সী রোজিনা আক্তার। দশ বছর ধরে এখানে চা বিক্রি করছেন। জীবনের এই সন্ধিক্ষণে বিশ্রামের কথা ভাবার কথা থাকলেও তিনি রোজ যুদ্ধ করেন নিজের দুই সন্তানকে মানুষ করার জন্য। রোজিনা আক্তার বলেন ‘বড় ছেলে-মেয়েকে তেমন পড়াতে পারি নাই, কিন্তু ছোট পোলারে আর মেয়েটারে পড়ানোর জন্যই এত কষ্ট করি।’

এই ফিরোজা, রোজিনারা হাজারো মায়ের প্রতিচ্ছবি। কেউ কাজ করেন বাসাবাড়িতে, কেউ সেলাই করেন, কেউ বা চায়ের দোকান চালান। এইসব মায়েরা নিজেরা পেটে ক্ষুধা নিয়েও সন্তানকে খাইয়ে দেন। নিজের নতুন জামা না কিনে সন্তানের স্কুল ড্রেস বানান। সারাদিন খেটে ক্লান্ত শরীরে ফিরেও হাসিমুখে সন্তানের পাশে বসেন।

কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, সেই সন্তানেরাই বড় হয়ে প্রায়শঃ ভুলে যান এই সব ত্যাগের কথা। আজকের এই মা দিবসে কত শত বৃদ্ধা মা রয়েছেন, যারা বৃদ্ধাশ্রমে একটি ফোন কলের জন্য অপেক্ষায় দিন কাটান। এই বুঝি ফোনটা এলো-এই আশায় তারা বারবার ফোনের দিকে তাকান। কেউ কেউ জানেন, ফোনটা আর আসবে না; তবুও অপেক্ষা করেন। তারা সন্তানকে নিজের কাছে চায় না, কেবল জানতে চায় সন্তান ভালো আছে কি না।

যারা এখনো মায়ের সঙ্গে আছেন, তাদের এক বিরাট অংশই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মা দিবস পালন করেন। যেমন-মায়ের সঙ্গে ছবি তোলা, মাকে পোস্ট করা ইত্যাদি। এটি নিঃসন্দেহে ভালো কাজ। কিন্তু আজকের এই দিনটি মায়ের জন্য রাখতে পারেন। ব্যস্ততার কারণে হয়তো অধিকাংশ সময়ই মাকে সময় দিতে পারেন না। মা চুপচাপ থেকে অনেক কথা জমিয়ে রাখেন। ব্যস্ত জীবনে আমরা সে কথাগুলো শুনি না।তাই আজকের এই দিনে মায়ের না বলা কথা গুলো শুনতে পারেন।

আপনি কি জানেন, আপনার মায়ের সবচেয়ে প্রিয় খাবার কোনটি? তার ছোটবেলার কোনো প্রিয় গল্প? কোনো অপূর্ণ স্বপ্ন? হয়তো জানেন না। কারণ জানার চেষ্টাই করা হয়নি। কিন্তু এইসব ছোট ছোট খেয়াল রাখাটাই তো ভালোবাসা।

আজকের এই দিনটিতে আপনি চাইলে মাকে রান্না করে খাওয়াতে পারেন, একটি শাড়ি কিনে উপহার দিতে পারেন, কিংবা মাকে নিয়ে বিকালে একটু হাঁটতে যেতে পারেন। এটা শুধু একটা দিনের জন্য না, বরং আমাদের মনে করিয়ে দেয়-মায়ের যত্ন প্রতিদিনই দরকার।

একজন মা কোনো বিনিময়ের আশায় সন্তানদের লালন করেন না। তিনি শুধু চান সন্তানের মুখে হাসি ফুটুক। আর সেই হাসির জন্য তিনি নিজের কষ্টগুলো হেসে হেসে সয়ে যান। তাই তার প্রতি দায়িত্ববোধটাও আমাদের প্রতিদিনের হওয়া উচিত। মা’কে শুধু একদিনের নয়, প্রতিদিনই ভালোবাসার দিন।

মায়ের আত্মত্যাগের মূল্য কোনো শব্দে বা উপহারেই মেটানো সম্ভব নয়। তবে আমরা যদি অন্তত তার পাশে থাকি, তার সুখ-দুঃখ ভাগ করি, তাতেই মা খুশি। আজকের এই মা দিবসে প্রতিজ্ঞা হোক মায়ের ভালোবাসাকে কেবল একদিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রতিদিন তার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও যত্ন প্রকাশ করার।

আপনার একটি ফোনকল, একটু সময়, এক কাপ চা একসঙ্গে খাওয়া এই ছোট ছোট ভালোবাসাগুলোই একজন মায়ের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উপহার। তাই আসুন, মা দিবসকে শুধুই ছবি পোস্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, ভালোবাসার বাস্তব ছোঁয়া দিয়ে তা পূর্ণ করি।