London ০৮:৩৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২৪ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম:
মহাসড়ক বন্ধ করে কৃষকদল নেতা খন্দকার নাসিরের সমাবেশ- যান চলাচল বন্ধ; ভোগান্তি চরমে। পাবিপ্রবিতে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালন ও পিঠা উৎসব অনুষ্ঠিত রাজশাহীতে গাছে গাছে মুকুলের সমারোহ, স্বপ্ন দেখছেন আমচাষীরা সিরিয়া থেকে সব সেনা সরিয়ে নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ভাঙা হলো বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল, বুলডোজার ছাড়াই গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা রাতে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি মুক্ত হবে : হাসনাত আব্দুল্লাহ রূপগঞ্জে কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত ২ ১২২ বস্তা সার পাচারের অভিযোগে বিএনপি-যুবদলের ৫ নেতাকে বহিষ্কার শেখ হাসিনাকে বিচারের আওতায় আনতেই হবে,তারেক রহমান নেত্রকোণার দুর্গাপুরে সুসং সরকারি মহাবিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের নতুন কমিটি গঠিত

ভারত ও কানাডার বিবাদ তেতে উঠল আবারও, এরপর কী

শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যায় ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে গত বছর কানাডা তদন্ত চালানোর ঘোষণা দেওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়ছবি: রয়টার্স।

ভারত ও কানাডার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা কূটনৈতিক বিবাদ আবারও মাথাচারা দিয়ে উঠেছে। সম্প্রতি কানাডা সরকার অভিযোগ করেছে, সে দেশে অবস্থানরত ভারতীয় প্রতিনিধিরা এমন সব কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছেন; যা কানাডার নাগরিকদের নিরাপত্তাহুমকিতে ফেলছে। অভিযোগের জের ধরে দুই দেশই একে অপরের কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছে।

সাম্প্রতিকতম উত্তেজনার শুরু গত সোমবার। ওই দিন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা ‘কূটনৈতিক যোগাযোগে’ ইঙ্গিত পেয়েছে যে উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডায় একটি ঘটনার তদন্তে সেখানকার ভারতীয় কূটনীতিকেরা ‘ফৌজদারি অপরাধে সংশ্লিষ্ট’ থাকতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে।

নয়াদিল্লি–অটোয়া সম্পর্ক নতুন মাত্রায় নিম্নগামী হয় গত বছর। সেই সময় কানাডা সরকার জানায়, দেশটির পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যায় ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না, তা তদন্ত করে দেখছে তারা।

তবে নিজ্জর হত্যায় ভারতীয় কূটনীতিকদের যুক্ত থাকার যেকোনো অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে নয়াদিল্লি। গতকাল তারা বলেছে, ভারত কানাডার ‘অযৌক্তিক দোষারোপ’ জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করছে এবং দেশটি থেকে তার কূটনীতিক ও অন্য কর্মকর্তাদের সরিয়ে নিচ্ছে।

এর কয়েক ঘণ্টা পরই কানাডা সরকার বলেছে, তাদের কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনী প্রমাণ পেয়েছে যে ভারতীয় প্রতিনিধিরা এমন সব কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছেন, যা দেশটির মানুষের নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলছে। সেই সঙ্গে ছয়জন ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হচ্ছে বলে জানায় অটোয়া।

ভারত ও কানাডার মধ্যে কূটনৈতিক বিবাদ চড়ে যাওয়া, এ নিয়ে দুই দেশের অবস্থান ও সামনে কী ঘটতে পারে—সেসব বিষয় খতিয়ে দেখেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা।

কানাডা কী বলছে

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গতকাল বলেছেন, দেশটির ফেডারেল রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ (আরসিএমপি) ‘স্পষ্ট ও জোরালো প্রমাণ’ পেয়েছে যে তাঁর দেশের জনগণকে নিরাপত্তাহুমকিতে ফেলার মতো কর্মকাণ্ডে ভারত সরকারের প্রতিনিধিরা যুক্ত ছিলেন এবং এখনো রয়েছেন।

এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রুডো বলেন, ‘এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে আছে, গোপনে তথ্য সংগ্রহের কৌশল অবলম্বন, দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত কানাডীয়দের প্রতি নিপীড়নমূলক আচরণ, হত্যাসহ এক ডজনের বেশি হুমকি ও সহিংস তৎপরতায় যুক্ত থাকা।’

কানাডা সরকার গতকাল বলেছে, তাদের কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনী প্রমাণ পেয়েছে, ভারতীয় প্রতিনিধিরা এমন সব কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছেন, যা দেশটির মানুষের নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলছে। সেই সঙ্গে ছয়জন ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হচ্ছে বলে জানায় অটোয়া।

আগের দিন গত রোববার আরসিএমপি বলে, কানাডায় ‘হত্যা ও সহিংসতা’ এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করাসহ ‘গুরুতর ফৌজদারি কার্যকলাপে’ ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে তারা।

আরসিএমপি এক বিবৃতিতে আরও বলেছে, ‘এসব প্রমাণ ভারতের সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে সরাসরি পেশ করা হয়েছে। তাঁদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, তাঁরা যেন সহিংসতা থামাতে সহযোগিতা করেন এবং এসব বিষয়ে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে একত্রে কাজ করেন।’

এই বিবৃতির পর ছয় ভারতীয় কূটনীতিক ও কনস্যুলার কর্মকর্তাকে সে দেশ থেকে বহিষ্কারের কথা ঘোষণা করে কানাডার পররাষ্ট্র দপ্তর ‘গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা’। দেশ ছাড়ার নির্দেশ পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন কানাডায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারও।

বিবৃতিতে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলি শিখ নেতা নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সরাসরি অভিযুক্ত করেন।

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। অটোয়া, কানাডা, ১৪ অক্টোবর ২০২৪

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। অটোয়া, কানাডা, ১৪ অক্টোবর ২০২৪ছবি: রয়টার্স

কী বলছে ভারত

কানাডার অভিযোগ জোরালো ভাষায় নাকচ করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল এক বিবৃতিতে বলছে, ‘তদন্তের দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে এটি ভারতকে কলঙ্কিত করার একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চেষ্টা।’

মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, ‘বারবার অনুরোধ জানানোর পরও’ অভিযোগের পক্ষে ‘কোনো প্রমাণ তাদের সঙ্গে শেয়ার’ করেনি কানাডা সরকার।

পরে মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘কানাডায় ভারতের হাইকমিশনার এবং অন্যান্য কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের নিশানা করে ভিত্তিহীন যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে, সেসব একেবারে অগ্রহণযোগ্য’—সেটি অবগত করতে দেশটির (কানাডা) চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে তলব করেছে তারা।

পুলিশ ‘স্পষ্ট ও জোরালো প্রমাণ’ পেয়েছে, কানাডার জনগণকে নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলার মতো কর্মকাণ্ডে ভারত সরকারের প্রতিনিধিরা যুক্ত ছিলেন ও এখনো রয়েছেন।

—জাস্টিন ট্রুডো, কানাডার প্রধানমন্ত্রী

এ ঘটনায় ‘নয়াদিল্লি আরও ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার রাখে’ উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ভারতীয় হাইকমিশনার এবং অন্যান্য কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের নিরাপত্তায় বর্তমান কানাডা সরকারের প্রতিশ্রুতির প্রতি আমাদের কোনো আস্থা নেই। তাই তাঁদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার।

এরপর পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ হিসেবে ভারত থেকে ছয় কানাডীয় কূটনীতিককে বহিষ্কারের কথা ঘোষণা করে মন্ত্রণালয়। এই কূটনীতিকদের মধ্যে কানাডার ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারও রয়েছেন। ভারত ছাড়তে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে তাঁদের।

দুই দেশের উত্তেজনা এমন পর্যায়ে এল কীভাবে

ভারত–কানাডা সম্পর্কে উত্তেজনা হঠাৎ বেড়ে যায় গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জাস্টিন ট্রুডোর এক ঘোষণায়। ওই সময় তিনি বলেন, কানাডীয় নাগরিক নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের সম্ভাব্য সংশ্লিষ্টতার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ তদন্ত করছে কানাডার কর্তৃপক্ষ।

ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সারের একটি শিখ মন্দিরের বাইরে ২০২৩ সালের ১৮ জুন গুলিতে নিহত হন নিজ্জর। ওই মন্দিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। খালিস্তান আন্দোলনের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিও ছিলেন তিনি। ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা এ আন্দোলনের লক্ষ্য।

তদন্তের দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে ভারতকে কলঙ্কিত করার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চেষ্টা এটি।

—ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, গতকাল এক বিবৃতিতে

অন্যদিকে ভারত সরকার শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এ আন্দোলনকে ভারতের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। সেই সঙ্গে প্রবাসে থাকা খালিস্তান আন্দোলনের নেতাদের দমনে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে সরকার।

ভারতের অভিযোগ, নিজ্জর ‘সন্ত্রাসবাদে’ জড়িত। তবে তাঁর সমর্থকেরা এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন।

কানাডার অভিযোগ প্রথম প্রকাশ্যে আসার পর দুই দেশ তাঁদের কূটনীতিকদের প্রত্যাহার করে নেয়। এ ছাড়া কানাডীয়দের জন্য কূটনৈতিক পরিষেবাও স্থগিত করে ভারত।

চলতি বছরের মে মাসে কানাডা–ভারত উত্তেজনা আবার বেড়ে যায়, যখন কানাডীয় পুলিশ ঘোষণা করে যে নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে তারা। গ্রেপ্তারকৃত তিনজনই ভারতীয়। একই সঙ্গে পুলিশ জানায়, ওই ঘটনায় ভারত সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একই ঘটনায় পরে আরেক ভারতীয়কে গ্রেপ্তার করে কানাডা পুলিশ।

কানাডার সর্বশেষ পদক্ষেপ নাকচ করে দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। তিনি বলেছেন, কানাডা ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ ভারতকে দোষ দিচ্ছে।

নয়াদিল্লিতে গত বছর অনুষ্ঠিত জি–২০ শীর্ষ সম্মেলন শুরুর আগে হাত মেলান কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

নয়াদিল্লিতে গত বছর অনুষ্ঠিত জি–২০ শীর্ষ সম্মেলন শুরুর আগে হাত মেলান কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিছবি: এএফপি

এরপর কী

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল ‘আরও পদক্ষেপ’ নেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছে, দেশটি সে অনুযায়ী কী ব্যবস্থা নেয়, তার ওপরই নির্ভর করছে ওই ঘটনার ফলাফল কত দূর গড়ায় সেই বিষয়টি।

অটোয়ায় কার্লটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক স্টেফানি কারভিন বলেন, কানাডার সর্বশেষ অভিযোগগুলো ‘খুবই গুরুতর’। এতে ভারতের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক আরও ক্ষতির মুখে পড়ার ঝুঁকিতে পড়বে। কানাডাকে এক জটিল পরিস্থিতিতে ফেলেছে এটি।

কারভিন আরও বলেন, কানাডায় দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের বসবাস। দেশটিতে বড় সংখ্যক ভারতীয় শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনা করেন। এই ভারতীয়দের কনস্যুলার সেবা প্রয়োজন। তাই তাঁদের জন্য দেশটিতে কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্বও থাকা দরকার।

এদিকে আল–জাজিরাকে শিখ বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিকেরা বলেন, কানাডায় প্রায় ৭ লাখ ৭০ হাজার শিখ নাগরিকের বসবাস। ভারতের বাইরে বিদেশে তাঁদের সংখ্যা এটিই সর্বোচ্চ। এই কানাডীয়দের ভাষ্য, ভারত সরকারের হস্তক্ষেপ নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন।

অলাভজনক সংগঠন ‘ওয়ার্ল্ড শিখ অর্গানাইজেশন অব কানাডা’ বলেছে, তারা কানাডা সরকারের গতকালের ঘোষণাকে স্বাগত জানায়। পাশাপাশি নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় কূটনীতিকসহ সব অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার চায় তারা।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০১:১৪:২৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪
২৭
Translate »

ভারত ও কানাডার বিবাদ তেতে উঠল আবারও, এরপর কী

আপডেট : ০১:১৪:২৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যায় ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে গত বছর কানাডা তদন্ত চালানোর ঘোষণা দেওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়ছবি: রয়টার্স।

ভারত ও কানাডার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা কূটনৈতিক বিবাদ আবারও মাথাচারা দিয়ে উঠেছে। সম্প্রতি কানাডা সরকার অভিযোগ করেছে, সে দেশে অবস্থানরত ভারতীয় প্রতিনিধিরা এমন সব কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছেন; যা কানাডার নাগরিকদের নিরাপত্তাহুমকিতে ফেলছে। অভিযোগের জের ধরে দুই দেশই একে অপরের কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছে।

সাম্প্রতিকতম উত্তেজনার শুরু গত সোমবার। ওই দিন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা ‘কূটনৈতিক যোগাযোগে’ ইঙ্গিত পেয়েছে যে উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডায় একটি ঘটনার তদন্তে সেখানকার ভারতীয় কূটনীতিকেরা ‘ফৌজদারি অপরাধে সংশ্লিষ্ট’ থাকতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে।

নয়াদিল্লি–অটোয়া সম্পর্ক নতুন মাত্রায় নিম্নগামী হয় গত বছর। সেই সময় কানাডা সরকার জানায়, দেশটির পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যায় ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না, তা তদন্ত করে দেখছে তারা।

তবে নিজ্জর হত্যায় ভারতীয় কূটনীতিকদের যুক্ত থাকার যেকোনো অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে নয়াদিল্লি। গতকাল তারা বলেছে, ভারত কানাডার ‘অযৌক্তিক দোষারোপ’ জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করছে এবং দেশটি থেকে তার কূটনীতিক ও অন্য কর্মকর্তাদের সরিয়ে নিচ্ছে।

এর কয়েক ঘণ্টা পরই কানাডা সরকার বলেছে, তাদের কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনী প্রমাণ পেয়েছে যে ভারতীয় প্রতিনিধিরা এমন সব কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছেন, যা দেশটির মানুষের নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলছে। সেই সঙ্গে ছয়জন ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হচ্ছে বলে জানায় অটোয়া।

ভারত ও কানাডার মধ্যে কূটনৈতিক বিবাদ চড়ে যাওয়া, এ নিয়ে দুই দেশের অবস্থান ও সামনে কী ঘটতে পারে—সেসব বিষয় খতিয়ে দেখেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা।

কানাডা কী বলছে

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গতকাল বলেছেন, দেশটির ফেডারেল রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ (আরসিএমপি) ‘স্পষ্ট ও জোরালো প্রমাণ’ পেয়েছে যে তাঁর দেশের জনগণকে নিরাপত্তাহুমকিতে ফেলার মতো কর্মকাণ্ডে ভারত সরকারের প্রতিনিধিরা যুক্ত ছিলেন এবং এখনো রয়েছেন।

এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রুডো বলেন, ‘এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে আছে, গোপনে তথ্য সংগ্রহের কৌশল অবলম্বন, দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত কানাডীয়দের প্রতি নিপীড়নমূলক আচরণ, হত্যাসহ এক ডজনের বেশি হুমকি ও সহিংস তৎপরতায় যুক্ত থাকা।’

কানাডা সরকার গতকাল বলেছে, তাদের কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনী প্রমাণ পেয়েছে, ভারতীয় প্রতিনিধিরা এমন সব কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছেন, যা দেশটির মানুষের নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলছে। সেই সঙ্গে ছয়জন ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হচ্ছে বলে জানায় অটোয়া।

আগের দিন গত রোববার আরসিএমপি বলে, কানাডায় ‘হত্যা ও সহিংসতা’ এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করাসহ ‘গুরুতর ফৌজদারি কার্যকলাপে’ ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে তারা।

আরসিএমপি এক বিবৃতিতে আরও বলেছে, ‘এসব প্রমাণ ভারতের সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে সরাসরি পেশ করা হয়েছে। তাঁদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, তাঁরা যেন সহিংসতা থামাতে সহযোগিতা করেন এবং এসব বিষয়ে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে একত্রে কাজ করেন।’

এই বিবৃতির পর ছয় ভারতীয় কূটনীতিক ও কনস্যুলার কর্মকর্তাকে সে দেশ থেকে বহিষ্কারের কথা ঘোষণা করে কানাডার পররাষ্ট্র দপ্তর ‘গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা’। দেশ ছাড়ার নির্দেশ পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন কানাডায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারও।

বিবৃতিতে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলি শিখ নেতা নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সরাসরি অভিযুক্ত করেন।

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। অটোয়া, কানাডা, ১৪ অক্টোবর ২০২৪

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। অটোয়া, কানাডা, ১৪ অক্টোবর ২০২৪ছবি: রয়টার্স

কী বলছে ভারত

কানাডার অভিযোগ জোরালো ভাষায় নাকচ করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল এক বিবৃতিতে বলছে, ‘তদন্তের দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে এটি ভারতকে কলঙ্কিত করার একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চেষ্টা।’

মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, ‘বারবার অনুরোধ জানানোর পরও’ অভিযোগের পক্ষে ‘কোনো প্রমাণ তাদের সঙ্গে শেয়ার’ করেনি কানাডা সরকার।

পরে মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘কানাডায় ভারতের হাইকমিশনার এবং অন্যান্য কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের নিশানা করে ভিত্তিহীন যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে, সেসব একেবারে অগ্রহণযোগ্য’—সেটি অবগত করতে দেশটির (কানাডা) চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে তলব করেছে তারা।

পুলিশ ‘স্পষ্ট ও জোরালো প্রমাণ’ পেয়েছে, কানাডার জনগণকে নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলার মতো কর্মকাণ্ডে ভারত সরকারের প্রতিনিধিরা যুক্ত ছিলেন ও এখনো রয়েছেন।

—জাস্টিন ট্রুডো, কানাডার প্রধানমন্ত্রী

এ ঘটনায় ‘নয়াদিল্লি আরও ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার রাখে’ উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ভারতীয় হাইকমিশনার এবং অন্যান্য কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের নিরাপত্তায় বর্তমান কানাডা সরকারের প্রতিশ্রুতির প্রতি আমাদের কোনো আস্থা নেই। তাই তাঁদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার।

এরপর পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ হিসেবে ভারত থেকে ছয় কানাডীয় কূটনীতিককে বহিষ্কারের কথা ঘোষণা করে মন্ত্রণালয়। এই কূটনীতিকদের মধ্যে কানাডার ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারও রয়েছেন। ভারত ছাড়তে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে তাঁদের।

দুই দেশের উত্তেজনা এমন পর্যায়ে এল কীভাবে

ভারত–কানাডা সম্পর্কে উত্তেজনা হঠাৎ বেড়ে যায় গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জাস্টিন ট্রুডোর এক ঘোষণায়। ওই সময় তিনি বলেন, কানাডীয় নাগরিক নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের সম্ভাব্য সংশ্লিষ্টতার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ তদন্ত করছে কানাডার কর্তৃপক্ষ।

ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সারের একটি শিখ মন্দিরের বাইরে ২০২৩ সালের ১৮ জুন গুলিতে নিহত হন নিজ্জর। ওই মন্দিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। খালিস্তান আন্দোলনের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিও ছিলেন তিনি। ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা এ আন্দোলনের লক্ষ্য।

তদন্তের দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে ভারতকে কলঙ্কিত করার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চেষ্টা এটি।

—ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, গতকাল এক বিবৃতিতে

অন্যদিকে ভারত সরকার শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এ আন্দোলনকে ভারতের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। সেই সঙ্গে প্রবাসে থাকা খালিস্তান আন্দোলনের নেতাদের দমনে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে সরকার।

ভারতের অভিযোগ, নিজ্জর ‘সন্ত্রাসবাদে’ জড়িত। তবে তাঁর সমর্থকেরা এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন।

কানাডার অভিযোগ প্রথম প্রকাশ্যে আসার পর দুই দেশ তাঁদের কূটনীতিকদের প্রত্যাহার করে নেয়। এ ছাড়া কানাডীয়দের জন্য কূটনৈতিক পরিষেবাও স্থগিত করে ভারত।

চলতি বছরের মে মাসে কানাডা–ভারত উত্তেজনা আবার বেড়ে যায়, যখন কানাডীয় পুলিশ ঘোষণা করে যে নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে তারা। গ্রেপ্তারকৃত তিনজনই ভারতীয়। একই সঙ্গে পুলিশ জানায়, ওই ঘটনায় ভারত সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একই ঘটনায় পরে আরেক ভারতীয়কে গ্রেপ্তার করে কানাডা পুলিশ।

কানাডার সর্বশেষ পদক্ষেপ নাকচ করে দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। তিনি বলেছেন, কানাডা ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ ভারতকে দোষ দিচ্ছে।

নয়াদিল্লিতে গত বছর অনুষ্ঠিত জি–২০ শীর্ষ সম্মেলন শুরুর আগে হাত মেলান কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

নয়াদিল্লিতে গত বছর অনুষ্ঠিত জি–২০ শীর্ষ সম্মেলন শুরুর আগে হাত মেলান কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিছবি: এএফপি

এরপর কী

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল ‘আরও পদক্ষেপ’ নেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছে, দেশটি সে অনুযায়ী কী ব্যবস্থা নেয়, তার ওপরই নির্ভর করছে ওই ঘটনার ফলাফল কত দূর গড়ায় সেই বিষয়টি।

অটোয়ায় কার্লটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক স্টেফানি কারভিন বলেন, কানাডার সর্বশেষ অভিযোগগুলো ‘খুবই গুরুতর’। এতে ভারতের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক আরও ক্ষতির মুখে পড়ার ঝুঁকিতে পড়বে। কানাডাকে এক জটিল পরিস্থিতিতে ফেলেছে এটি।

কারভিন আরও বলেন, কানাডায় দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের বসবাস। দেশটিতে বড় সংখ্যক ভারতীয় শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনা করেন। এই ভারতীয়দের কনস্যুলার সেবা প্রয়োজন। তাই তাঁদের জন্য দেশটিতে কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্বও থাকা দরকার।

এদিকে আল–জাজিরাকে শিখ বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিকেরা বলেন, কানাডায় প্রায় ৭ লাখ ৭০ হাজার শিখ নাগরিকের বসবাস। ভারতের বাইরে বিদেশে তাঁদের সংখ্যা এটিই সর্বোচ্চ। এই কানাডীয়দের ভাষ্য, ভারত সরকারের হস্তক্ষেপ নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন।

অলাভজনক সংগঠন ‘ওয়ার্ল্ড শিখ অর্গানাইজেশন অব কানাডা’ বলেছে, তারা কানাডা সরকারের গতকালের ঘোষণাকে স্বাগত জানায়। পাশাপাশি নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় কূটনীতিকসহ সব অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার চায় তারা।