London ০৪:১১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বেক্সিমকোর জন্য ঋণে উদার জনতা ব্যাংক

সালমান এফ রহমানফাইল ছবি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপকে অতিরিক্ত ঋণসুবিধা দিতে সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়া হয় জনতা ব্যাংকের মতিঝিলের স্থানীয় শাখা ব্যবস্থাপককে। ফলে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান খুলে এই শাখা থেকে বেপরোয়া ঋণসুবিধা (ঋণপত্র) নেয় গ্রুপটি। তখন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অনুমোদন করলেও সব ঋণের বিষয়ে জানতে পারেনি পরিচালনা পর্ষদ।

এসব ঋণসুবিধা পরে সরাসরি ঋণে পরিণত হয়। এর অনেকগুলোই আবার খেলাপি হয়ে পড়ে। ফলে এক জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ বেড়ে দাঁড়ায়  প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৮ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। দেশে এখন সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকে।

শুরু থেকে জনতা ব্যাংক বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক গ্রুপ হিসেবে দেখত। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তথ্য জমা দিত। গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎপরতায় তা একক গ্রুপভুক্ত করা হয়। এতে সীমা ছাড়িয়ে যায় গ্রুপটির ঋণ।

বেক্সিমকো গ্রুপের সীমার ১৬ গুণ বেশি ঋণ নেওয়ার তথ্য জেনেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীরব ছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এদিকে গত বছরের আগস্টে বেক্সিমকো গ্রুপকে আর ঋণ দেওয়া যাবে না—কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন নির্দেশনার পরও গ্রুপটিকে নতুন করে ৩০১ কোটি টাকা দিয়েছে জনতা ব্যাংক। কীভাবে জনতা ব্যাংকের একটি শাখা থেকে বেক্সিমকো গ্রুপ এত টাকা নিয়ে গেল, সে বিষয়ে বিশেষ পরিদর্শন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এসব ঋণের অনুমোদন পর্ষদ থেকে দেওয়া হয়নি। আমরা ২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বিষয়টা জানতে পারি।

এস এম মাহফুজুর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান, জনতা ব্যাংক।

বেক্সিমকো গ্রুপকে ঋণ দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত জনতা ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, সালমান এফ রহমান ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। এ জন্য ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিসহ সবাই তাঁকে খুশি রাখার চেষ্টা করতেন। কেউ পদ পেতে, আবার কেউ পদ ধরে রাখতে তাঁকে নতুন নতুন কোম্পানি খোলার পরামর্শ দিয়ে অর্থায়ন করতেন। একটি কোম্পানির ঋণসীমা শেষ হলে নতুন কোম্পানি খুলে সুবিধা দেওয়া হয়। তথ্য গোপন করতে নতুন কোম্পানির মালিকানায় অন্যদের রাখা হয়। এভাবেই বেক্সিমকোর ঋণ ২৫ হাজার কোটি টাকায় ওঠে।

ব্যাংকটির নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বেক্সিমকো গ্রুপ ১৯৭৮ সালে জনতা ব্যাংকের গ্রাহক হয়। তবে তাদের ঋণ হু হু করে বাড়তে শুরু করে ২০১৯ সালের পর। বিশেষ করে করোনা শুরু হলে গ্রুপটি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ২০১৯ সালের শেষে ব্যাংকটিতে বেক্সিমকোর ৯টি প্রতিষ্ঠানের ঋণসুবিধা ও ঋণ ছিল ৫ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠান বেড়ে হয় ১৩টি, আর মোট ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠান বেড়ে ২০টিতে, আর ঋণ বেড়ে ১৫ হাজার ৪০৯ কোটি টাকায় ওঠে। ২০২২ সালে গ্রুপটির প্রতিষ্ঠান ২৮টিতে ও ঋণ ১৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠান বেড়ে ৩০টি, আর ঋণ বেড়ে ২২ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা হয়। এখন ঋণ আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা।

আলোচ্য সময়ের মধ্যে ২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত মতিঝিলের স্থানীয় শাখার ব্যবস্থাপক ছিলেন মোবারক হোসেন, তিনি ইতিমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন। এর পর থেকে ২০২১ সালের পুরো সময়ে ব্যবস্থাপক ছিলেন শহিদুল হক, তিনি অবসরে গেছেন। ২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ১৯ জুলাই পর্যন্ত ব্যবস্থাপক ছিলেন মিজানুর রহমান, তিনি এখন প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত। এর পর থেকে ব্যবস্থাপক মোসাম্মৎ আম্বিয়া বেগম। তাঁরা সবাই মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পদের কর্মকর্তা।

২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে গত বছরের ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত এমডি ছিলেন আব্দুছ ছালাম আজাদ, এর পর থেকে এমডি আব্দুল জব্বার। তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট থেকে ২০২০ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন জামালউদ্দিন আহমেদ। এরপর চেয়ারম্যান হন এস এম মাহফুজুর রহমান।

জানতে চাইলে সাবেক চেয়ারম্যান এস এম মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘এসব ঋণের অনুমোদন পর্ষদ থেকে দেওয়া হয়নি। আমরা ২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বিষয়টা জানতে পারি।’

সাবেক এমডি আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, ‘দেশে ডলার–সংকট চলছিল, এ জন্য শিল্পপার্কের মধ্যে আরও কারখানা করে বেক্সিমকো। রপ্তানি বাড়াতে আমরাও সেখানে অর্থায়ন করি। এসবই এখন আটকে গেছে।’

ব্যাংকটির মাধ্যমে বেক্সিমকো গ্রুপ ২০২১ সালে ১৩৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, পরের বছর তা বেড়ে ১৭১ কোটি ডলার হয়। তবে ২০২৩ সালে তা কমে হয় ৮০ কোটি ডলার। আর চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত মাত্র ১৯ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৩:৪৪:৪৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
৫৩
Translate »

বেক্সিমকোর জন্য ঋণে উদার জনতা ব্যাংক

আপডেট : ০৩:৪৪:৪৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সালমান এফ রহমানফাইল ছবি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপকে অতিরিক্ত ঋণসুবিধা দিতে সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়া হয় জনতা ব্যাংকের মতিঝিলের স্থানীয় শাখা ব্যবস্থাপককে। ফলে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান খুলে এই শাখা থেকে বেপরোয়া ঋণসুবিধা (ঋণপত্র) নেয় গ্রুপটি। তখন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অনুমোদন করলেও সব ঋণের বিষয়ে জানতে পারেনি পরিচালনা পর্ষদ।

এসব ঋণসুবিধা পরে সরাসরি ঋণে পরিণত হয়। এর অনেকগুলোই আবার খেলাপি হয়ে পড়ে। ফলে এক জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ বেড়ে দাঁড়ায়  প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৮ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। দেশে এখন সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকে।

শুরু থেকে জনতা ব্যাংক বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক গ্রুপ হিসেবে দেখত। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তথ্য জমা দিত। গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎপরতায় তা একক গ্রুপভুক্ত করা হয়। এতে সীমা ছাড়িয়ে যায় গ্রুপটির ঋণ।

বেক্সিমকো গ্রুপের সীমার ১৬ গুণ বেশি ঋণ নেওয়ার তথ্য জেনেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীরব ছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এদিকে গত বছরের আগস্টে বেক্সিমকো গ্রুপকে আর ঋণ দেওয়া যাবে না—কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন নির্দেশনার পরও গ্রুপটিকে নতুন করে ৩০১ কোটি টাকা দিয়েছে জনতা ব্যাংক। কীভাবে জনতা ব্যাংকের একটি শাখা থেকে বেক্সিমকো গ্রুপ এত টাকা নিয়ে গেল, সে বিষয়ে বিশেষ পরিদর্শন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এসব ঋণের অনুমোদন পর্ষদ থেকে দেওয়া হয়নি। আমরা ২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বিষয়টা জানতে পারি।

এস এম মাহফুজুর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান, জনতা ব্যাংক।

বেক্সিমকো গ্রুপকে ঋণ দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত জনতা ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, সালমান এফ রহমান ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। এ জন্য ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিসহ সবাই তাঁকে খুশি রাখার চেষ্টা করতেন। কেউ পদ পেতে, আবার কেউ পদ ধরে রাখতে তাঁকে নতুন নতুন কোম্পানি খোলার পরামর্শ দিয়ে অর্থায়ন করতেন। একটি কোম্পানির ঋণসীমা শেষ হলে নতুন কোম্পানি খুলে সুবিধা দেওয়া হয়। তথ্য গোপন করতে নতুন কোম্পানির মালিকানায় অন্যদের রাখা হয়। এভাবেই বেক্সিমকোর ঋণ ২৫ হাজার কোটি টাকায় ওঠে।

ব্যাংকটির নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বেক্সিমকো গ্রুপ ১৯৭৮ সালে জনতা ব্যাংকের গ্রাহক হয়। তবে তাদের ঋণ হু হু করে বাড়তে শুরু করে ২০১৯ সালের পর। বিশেষ করে করোনা শুরু হলে গ্রুপটি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ২০১৯ সালের শেষে ব্যাংকটিতে বেক্সিমকোর ৯টি প্রতিষ্ঠানের ঋণসুবিধা ও ঋণ ছিল ৫ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠান বেড়ে হয় ১৩টি, আর মোট ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠান বেড়ে ২০টিতে, আর ঋণ বেড়ে ১৫ হাজার ৪০৯ কোটি টাকায় ওঠে। ২০২২ সালে গ্রুপটির প্রতিষ্ঠান ২৮টিতে ও ঋণ ১৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠান বেড়ে ৩০টি, আর ঋণ বেড়ে ২২ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা হয়। এখন ঋণ আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা।

আলোচ্য সময়ের মধ্যে ২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত মতিঝিলের স্থানীয় শাখার ব্যবস্থাপক ছিলেন মোবারক হোসেন, তিনি ইতিমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন। এর পর থেকে ২০২১ সালের পুরো সময়ে ব্যবস্থাপক ছিলেন শহিদুল হক, তিনি অবসরে গেছেন। ২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ১৯ জুলাই পর্যন্ত ব্যবস্থাপক ছিলেন মিজানুর রহমান, তিনি এখন প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত। এর পর থেকে ব্যবস্থাপক মোসাম্মৎ আম্বিয়া বেগম। তাঁরা সবাই মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পদের কর্মকর্তা।

২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে গত বছরের ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত এমডি ছিলেন আব্দুছ ছালাম আজাদ, এর পর থেকে এমডি আব্দুল জব্বার। তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট থেকে ২০২০ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন জামালউদ্দিন আহমেদ। এরপর চেয়ারম্যান হন এস এম মাহফুজুর রহমান।

জানতে চাইলে সাবেক চেয়ারম্যান এস এম মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘এসব ঋণের অনুমোদন পর্ষদ থেকে দেওয়া হয়নি। আমরা ২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বিষয়টা জানতে পারি।’

সাবেক এমডি আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, ‘দেশে ডলার–সংকট চলছিল, এ জন্য শিল্পপার্কের মধ্যে আরও কারখানা করে বেক্সিমকো। রপ্তানি বাড়াতে আমরাও সেখানে অর্থায়ন করি। এসবই এখন আটকে গেছে।’

ব্যাংকটির মাধ্যমে বেক্সিমকো গ্রুপ ২০২১ সালে ১৩৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, পরের বছর তা বেড়ে ১৭১ কোটি ডলার হয়। তবে ২০২৩ সালে তা কমে হয় ৮০ কোটি ডলার। আর চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত মাত্র ১৯ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।