London ০১:০৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১৩ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বীরের মতো জীবন দিয়েছেন সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম

মো. আশরাফুল আলম হান্নান

পিলখানায় সেদিন হাজার হাজার জওয়ান হত্যাকাণ্ডের পক্ষেতারা খুঁজে খুঁজে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করছেন নৃশংসভাবে। ওই অবস্থায় কোনো কোনো বিডিআর সদস্য হয়তো এ হত্যাকাণ্ডের সমর্থন করেননি, কিন্তু কেউ এর প্রতিবাদও করেননি।

তার মধ্যেও একজন ছিলেন ব্যতিক্রম, তিনি হলেন বিডিআর’র তৎকালীন কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম। তিনি এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিরোধ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরের মর্যাদা দিয়েছে।

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় দরবারে যোগ দিতে দেরি হয়ে যাবে—এই আশঙ্কায় নুরুল ইসলাম সকালে নাশতা না খেয়েই বাসা থেকে বের হয়ে যান।

…বাবা খাবার খেয়ে পরীক্ষা দিতে যেতে বলেছিল, কিন্তু দেরি হয়ে যাবে বলে নিজে না খেয়ে দরবারে চলে যান, এই যাওয়ার ৭ দিন পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে বাবার মৃতদেহ গ্রহণ করি, এই ৭ দিনে এমন কোনো হাসপাতাল নেই বা যে যেখানে বলেছে সেখানেই আমরা বাবাকে খুঁজেছি, কেউই বলেনি বাবাকেও মেরে ফেলা হয়েছে।

নুরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল আলম জানান, ২০০৯ সালে বিডিআর পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত অন্যান্যের মতো তার বাবার লাশ গণকবর থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়। পরে ওই বছরের ৪ মার্চ  লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরলক্ষ্মী গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।

ছেলে আশরাফুল আলম হান্নান বলেন, বাবা ছিলেন খুবই পরহেজগার মানুষপাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন ও কোরআন তিলওয়াত করতেন নিয়মিত। প্রতি শুক্রবার দাড়ি ও চুলে মেহেদি লাগাতেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি নির্মম ঘটনায় নিহত নুরুল ইসলাম রেখে গেছেন স্ত্রী, তিন কন্যা ও এক পুত্র।

দরবার হলে জওয়ানেরা হত্যাকাণ্ড শুরু করার পর অনেকে যেখানে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছিলেন, সেখানে কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম এগিয়ে যান সশস্ত্র জওয়ানদের প্রতিরোধ করতে। হত্যাকাণ্ডে বাধা দেওয়ায় হত্যাকারীরা লোহার স্ট্যান্ড দিয়ে পিটিয়ে তার পর ব্রাশফায়ার করে নৃশংসভাবে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধা এই বিডিআরের কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজরকে।

বিডিআর সদর দপ্তরে কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর হিসেবে তিনি ছিলেন বিডিআরের প্রতিনিধি। মহাপরিচালকের সঙ্গে তার ছিল সরাসরি দাপ্তরিক সম্পর্ক।

ঘটনার আগ মুহূর্তে মহাপরিচালকের নির্দেশে তিনি মাইকযোগে জওয়ানদের শান্ত হতে বারবার বিভিন্নভাবে অনুরোধ জানান, এগিয়ে যান সশস্ত্র জওয়ানদের প্রতিরোধ করতে, হত্যাকাণ্ডে বাধা দেওয়ায় পরে ৪ জন বিডিআর সদস্য তার কাছ থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে তাকে লোহার স্ট্যান্ড দিয়ে পিটিয়ে, পেটে ক্ষতবিক্ষত করে, ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে গণকবরে রাখা হয়।

পরবর্তী সময়ে তদন্তে বেরিয়ে আসে নুরুল ইসলামের এই বীরত্বের কথা। এ হত্যাকাণ্ডের ছয় মাস পর একমাত্র বিডিআর সদস্য কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা পান এবং পরবর্তীতে বিজিবির সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ পদকে ভূষিত করে।

কর্মজীবনে নুরুল ইসলাম চারবার ডিজি পদক পেয়েছেন এবং অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য সরকার তাকে পবিত্র হজব্রত পালন করান। তার চাকরি জীবনে একজন সৎ মানুষ হিসেবে সবার শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। তিনি শ্রেষ্ঠ বিওপি কমান্ডার ও শ্রেষ্ঠ কোম্পানি কমান্ডারের স্বীকৃতি লাভ করেন।

চোরাচালান রোধে তিনি পেয়েছেন বিশেষ পুরস্কার। রাইফেলস ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ আট বছর। হয়তো তার কোনো ছাত্রের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন তিনি। ২০২১ সালে পাদুয়া যুদ্ধে সংগ্রাম ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডারও ছিলেন তিনি।

সেদিন দরবার হলসহ পিলখানায় ৯ হাজারের অধিক বিডিআর সদস্য উপস্থিত ছিল এবং সারা দেশে ৫০ হাজারের অধিক বিডিআর সদস্য উপস্থিত ছিলেন, একমাত্র আমার বাবাই হত্যাকারীদের হত্যাকাণ্ড থেকে বিরত রাখা এবং শহীদদের বাঁচাতে গিয়ে বীরের মতো জীবন দিয়েছেন।

পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড এবং নৃশংসতা একমাত্র বাধাদানকারী এবং ১২০-এর অধিক সেনা অফিসারের জীবন রক্ষার চেষ্টাকারী শহীদ হিসেবে আমার বাবার বীরত্বসূচক রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধসহ আবেদন করছি।

মো. আশরাফুল আলম হান্নান ।। শহীদ কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলামের সন্তান।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৩:৫৪:১৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
Translate »

বীরের মতো জীবন দিয়েছেন সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম

আপডেট : ০৩:৫৪:১৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

পিলখানায় সেদিন হাজার হাজার জওয়ান হত্যাকাণ্ডের পক্ষেতারা খুঁজে খুঁজে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করছেন নৃশংসভাবে। ওই অবস্থায় কোনো কোনো বিডিআর সদস্য হয়তো এ হত্যাকাণ্ডের সমর্থন করেননি, কিন্তু কেউ এর প্রতিবাদও করেননি।

তার মধ্যেও একজন ছিলেন ব্যতিক্রম, তিনি হলেন বিডিআর’র তৎকালীন কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম। তিনি এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিরোধ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরের মর্যাদা দিয়েছে।

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় দরবারে যোগ দিতে দেরি হয়ে যাবে—এই আশঙ্কায় নুরুল ইসলাম সকালে নাশতা না খেয়েই বাসা থেকে বের হয়ে যান।

…বাবা খাবার খেয়ে পরীক্ষা দিতে যেতে বলেছিল, কিন্তু দেরি হয়ে যাবে বলে নিজে না খেয়ে দরবারে চলে যান, এই যাওয়ার ৭ দিন পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে বাবার মৃতদেহ গ্রহণ করি, এই ৭ দিনে এমন কোনো হাসপাতাল নেই বা যে যেখানে বলেছে সেখানেই আমরা বাবাকে খুঁজেছি, কেউই বলেনি বাবাকেও মেরে ফেলা হয়েছে।

নুরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল আলম জানান, ২০০৯ সালে বিডিআর পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত অন্যান্যের মতো তার বাবার লাশ গণকবর থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়। পরে ওই বছরের ৪ মার্চ  লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরলক্ষ্মী গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।

ছেলে আশরাফুল আলম হান্নান বলেন, বাবা ছিলেন খুবই পরহেজগার মানুষপাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন ও কোরআন তিলওয়াত করতেন নিয়মিত। প্রতি শুক্রবার দাড়ি ও চুলে মেহেদি লাগাতেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি নির্মম ঘটনায় নিহত নুরুল ইসলাম রেখে গেছেন স্ত্রী, তিন কন্যা ও এক পুত্র।

দরবার হলে জওয়ানেরা হত্যাকাণ্ড শুরু করার পর অনেকে যেখানে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছিলেন, সেখানে কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম এগিয়ে যান সশস্ত্র জওয়ানদের প্রতিরোধ করতে। হত্যাকাণ্ডে বাধা দেওয়ায় হত্যাকারীরা লোহার স্ট্যান্ড দিয়ে পিটিয়ে তার পর ব্রাশফায়ার করে নৃশংসভাবে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধা এই বিডিআরের কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজরকে।

বিডিআর সদর দপ্তরে কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর হিসেবে তিনি ছিলেন বিডিআরের প্রতিনিধি। মহাপরিচালকের সঙ্গে তার ছিল সরাসরি দাপ্তরিক সম্পর্ক।

ঘটনার আগ মুহূর্তে মহাপরিচালকের নির্দেশে তিনি মাইকযোগে জওয়ানদের শান্ত হতে বারবার বিভিন্নভাবে অনুরোধ জানান, এগিয়ে যান সশস্ত্র জওয়ানদের প্রতিরোধ করতে, হত্যাকাণ্ডে বাধা দেওয়ায় পরে ৪ জন বিডিআর সদস্য তার কাছ থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে তাকে লোহার স্ট্যান্ড দিয়ে পিটিয়ে, পেটে ক্ষতবিক্ষত করে, ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে গণকবরে রাখা হয়।

পরবর্তী সময়ে তদন্তে বেরিয়ে আসে নুরুল ইসলামের এই বীরত্বের কথা। এ হত্যাকাণ্ডের ছয় মাস পর একমাত্র বিডিআর সদস্য কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা পান এবং পরবর্তীতে বিজিবির সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ পদকে ভূষিত করে।

কর্মজীবনে নুরুল ইসলাম চারবার ডিজি পদক পেয়েছেন এবং অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য সরকার তাকে পবিত্র হজব্রত পালন করান। তার চাকরি জীবনে একজন সৎ মানুষ হিসেবে সবার শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। তিনি শ্রেষ্ঠ বিওপি কমান্ডার ও শ্রেষ্ঠ কোম্পানি কমান্ডারের স্বীকৃতি লাভ করেন।

চোরাচালান রোধে তিনি পেয়েছেন বিশেষ পুরস্কার। রাইফেলস ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ আট বছর। হয়তো তার কোনো ছাত্রের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন তিনি। ২০২১ সালে পাদুয়া যুদ্ধে সংগ্রাম ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডারও ছিলেন তিনি।

সেদিন দরবার হলসহ পিলখানায় ৯ হাজারের অধিক বিডিআর সদস্য উপস্থিত ছিল এবং সারা দেশে ৫০ হাজারের অধিক বিডিআর সদস্য উপস্থিত ছিলেন, একমাত্র আমার বাবাই হত্যাকারীদের হত্যাকাণ্ড থেকে বিরত রাখা এবং শহীদদের বাঁচাতে গিয়ে বীরের মতো জীবন দিয়েছেন।

পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড এবং নৃশংসতা একমাত্র বাধাদানকারী এবং ১২০-এর অধিক সেনা অফিসারের জীবন রক্ষার চেষ্টাকারী শহীদ হিসেবে আমার বাবার বীরত্বসূচক রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধসহ আবেদন করছি।

মো. আশরাফুল আলম হান্নান ।। শহীদ কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলামের সন্তান।