London ১০:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম:
ঢাকায় বজ্রসহ বৃষ্টি নির্বাচন কমিশন কারও হুকুম মতো চলবে না: সিইসি ঝড় তুললেন বিদ্যা সিনহা মিম! সমন্বয়ককে একা পেয়ে কুপিয়ে জখম ডাকেটের ১৬৫, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ইংল্যান্ডের বিশ্বরেকর্ড সংগ্রহ অচেনা বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানকে ২৯ মিলিয়ন ডলার দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ট্রাম্পের দাবি আমরা অন্যের ওপর দোষ চাপাই, কিন্তু নিজেরা বদলাই না পরিবেশ উপদেষ্টা সাউন্ড গ্রেনেড-জলকামানে পণ্ড আউটসোর্সিং কর্মীদের অবস্থান কর্মসূচি বাসে ডাকাতি-শ্লীলতাহানি: তিন ডাকাত গ্রেপ্তার, এএসআই বরখাস্ত টেকসই ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির জন্য ইবিএফসিআই ও বাংলাদেশ হাইকমিশন লন্ডনের অংশীদারিত্ব জোরদারের আহ্বান

বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে যা করণীয়

অনলাইন ডেস্ক

বর্তমান সময়ে নগর জীবনের অন্যতম আতঙ্কের নাম অগ্নিকাণ্ড। ক্রমাগত ঘটতে থাকা বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড বিধ্বংসী রূপ ধারণ করার পরও যেন ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। পুরোটা বছর জুড়ে অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হওয়াই যেন এদেশের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতিবছর বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড কেড়ে নিচ্ছে শত শত মানুষের প্রাণ এবং নষ্ট করছে বিপুল পরিমাণ সম্পদ।

দেশে যেসব বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার অধিকাংশই হয়েছে বাণিজ্যিক ভবনগুলোয় অর্থাৎ একই ভবনের মধ্যে আছে বাণিজ্যিক ব্যবহার, রেস্টুরেন্ট ও আবাসস্থল। নগরায়ণ প্রক্রিয়া বৃদ্ধির সাথে সাথে এ ধরনের মিশ্র ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ হলো রাজউক কর্তৃক নির্ধারিত ভবন কোড না মেনে ভবন নির্মাণ, অগ্নিনিরাপত্তার শিথিল নিয়ম এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণের অভাব।

সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা:

২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তালতলায় একটি করাতকলে (স মিল) অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে প্রায় ২০টি দোকান ও দুটি স-মিল পুড়ে যায় বলেও জানায় ফায়ার সার্ভিস। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অর্থাৎ ২০১০-২০২২ সালের মধ্যে যেসব ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। একইদিনে দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে আগুন লাগে কড়াইল বস্তিতে। প্রাথমিকভাবে আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। এছাড়া আগুনে হতাহতের কোনো সংবাদও পাওয়া যায়নি।

এর মধ্যে ২০১০ সালের পুরান ঢাকার নিমতলীর নবাব কাটরায় রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদামে থাকা কেমিক্যালের প্লাস্টিক ড্রাম গলে গিয়ে বিস্ফোরণ, ২০১২ সালে ঢাকা মহানগরীর উপকণ্ঠে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় অবস্থিত তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ড, ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি ভোরবেলা গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটে এবং ১৫ মার্চ দিবাগত রাতে মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে লাগা অগ্নিকাণ্ড, ২০১৯ সালে রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনে এবং বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ২০২১ সালে মগবাজারের ওয়্যারলেস গেটের বিস্ফোরণ এবং ২০২২ সালে চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ডতে কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো আজও মানব মনে বিভীষিকার জন্ম দেয়।

অপরদিকে শুধুমাত্র ২০২৩ সালেই সারা দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া একাধিক বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও তেমন কোনো পদক্ষেপ এখনো পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোডের বিধি লঙ্ঘন এবং অগ্নিনিরাপত্তা সচেতনতার অভাবের কারণে অধিক জনসংখ্যার মেগাসিটিতে বিস্ফোরণ এবং আগুনের ঝুঁকি সর্বত্র লুকিয়ে আছে।

২০২৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার গুলশানের মোশারফ জাকের স্কাইলাইন ভবনে লাগা আগুন দুইজন নিহত হন এবং আট জন পুরুষ ১২ জন মহিলা এবং একজন শিশুসহ মোট ২১ জনকে  নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একই মাসের ২৬ তারিখে বনানীর কড়াইল বস্তিতে অগ্নি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। এই অগ্নিকাণ্ডের ফলে আনুমানিক প্রায় ২০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হলেও কোনো ধরনের নিহত বা হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

নারায়ণগঞ্জে পরিধানের জন্য তৈরি পোশাক তৈরির একটি কারখানা ৩ মার্চ বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায় যেখানে সৌভাগ্যবশত কারখানা বন্ধ থাকার কারণে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পেও অগ্নিকাণ্ড একটি স্থায়ী সমস্যা, যেটি দেশের অর্থনীতিতে একটি প্রধান অবদানকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছে।

অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ, নির্মিত ভবনগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না করা, ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ব্যবহার, শিথিল অগ্নিনিরাপত্তা বিধিমালা, অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং অগ্নিনিরাপত্তা সচেতনতার অভাবকেই অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়।

এরপর ৫ মার্চ ঢাকার সায়েন্সল্যাব এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটে। গুলিস্তান বিস্ফোরণের মাত্র দুইদিন পরে ৭ মার্চ সিদ্দিকবাজারে এবং ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। তার ঠিক ১১ দিন পরেই ১৫ এপ্রিল আগুন লাগে রাজধানীর অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক ভবন নিউমার্কেটে এবং আগুনে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার মালামাল পুড়ে যায়।

২০২৪ সালের সর্বপ্রথম অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুন লাগার মধ্য দিয়ে। এই ভবনের পুরোটাই বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হতো। বৃহস্পতিবার রাতে সংঘটিত এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। বেইলি রোডের এই অগ্নিকাণ্ডে আনুমানিক প্রায় ২০০ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।

গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটির নিচতলায় ‘চুমুক’ নামের একটি কফি শপ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়, যা পরবর্তীতে ভবনের অন্যান্য তলায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তবে বছরের শেষের দিকে অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বর প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে যেটি নজিরবিহীন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড।

অগ্নিকাণ্ডের কারণ:

প্রতিটি বিস্ফোরণের ঘটনার পরপরই পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক দপ্তর, সিআইডিসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং প্রতিবারই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বিভিন্ন উৎসের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটে থাকলেও প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়ে থাকে পানির ট্যাংকে দীর্ঘদিন জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণের ফলে, গ্যাস সরবরাহ লাইনে লিকেজ বা ছিদ্র থাকার কারণে, সিলিন্ডার বা বয়লার বিস্ফোরণ, রাসায়নিক বিক্রিয়া, উচ্চতাপে অথবা বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে থাকে।

অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ, নির্মিত ভবনগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না করা, ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ব্যবহার, শিথিল অগ্নিনিরাপত্তা বিধিমালা, অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং অগ্নিনিরাপত্তা সচেতনতার অভাবকেই অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়।

গবেষণা কী বলে?

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর সারাদেশে ঘটে যাওয়া সব অগ্নিকাণ্ড এবং এর কারণসহ একটি করে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর থেকে ১০ বছরের প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।

গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ২০১৬ এবং ২০১৯ সালের কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিবছরই পূর্ববর্তী বছর থেলে বার্ষিক অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিসংখ্যান পর্যালোচনা থেকে দেখা যায় যে, ১০ বছরে সর্বমোট ১,৮৯,০৪৫টি জায়গায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটে।

অন্যান্য বছরের তুলনায় ২০২৩ সালে সর্বাধিক জায়গায় আগুন লেগেছে। তাই বার্ষিক ক্রমানুযায়ী ২০২৩ সাল ১ম স্থানে অবস্থান করছে এবং ২০২৪ ও ২০২২ সাল যথাক্রমে ২য় ও ৩য় স্থানে অবস্থান করছে। ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে শতকরা ৪ ভাগ এবং ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে শতকরা ১১ ভাগ বেশি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল।

ক্যাপস কর্তৃক গবেষণাকৃত প্রাপ্ত ফলাফল পর্যালোচনা করে আরও জানা যায় যে, শুধুমাত্র বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণেই ৭৯,৪৩৯টি জায়গায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটে, যা মোট দুর্ঘটনার শতকরা প্রায় ৩৭ ভাগ। এছাড়া চুলার (ইলেকট্রিক, গ্যাস ও মাটির চুলা ইত্যাদি) মাধ্যমে ৩৭,০১১টি (১৭ শতাংশ), বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরার কারণে ৩৪,১৮৪টি (১৬ শতাংশ) এবং অন্যান্য বা অজ্ঞাত কারণে ২৭,৯২০টি (১৩ শতাংশ) জায়গায় আগুন লাগে।

অপরদিকে ২০২৩ সালে সারাদেশে সর্বমোট ২৭,৬২৩টি এবং ২০২৪ সালে সর্বমোট ২৬,৬৫৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ক্যাপসের গবেষণায় আরও পরিলক্ষিত হয় যে, সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডগুলো বেশি হয়ে থাকে। প্রতিবছর অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝরে যাচ্ছে অগণিত প্রাণ, নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ, ভেঙে যাচ্ছে হাজারো স্বপ্ন। মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের এবং নিজেদের সহায় সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে হাজারো পরিবার। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পরপরই তদন্ত কমিটি গঠিত হচ্ছে কিন্তু সঠিক কারণ নিরূপণ করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না।

করণীয়/সুপারিশ:

অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোডের বিধি লঙ্ঘন এবং অগ্নিনিরাপত্তা সচেতনতার অভাবের কারণে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি দুই কোটিরও বেশি বসবাসরত মানুষের এই মেগাসিটির সর্বত্র লুকিয়ে আছে। বাংলাদেশে অগ্নিকাণ্ডের সমস্যা মোকাবিলার জন্য সরকার অগ্নিনিরাপত্তা বিধান প্রতিষ্ঠা এবং প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সারাদেশের সব ভবনগুলোয় অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জাম নিশ্চিত করা এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নিয়মিত পরিদর্শন করা। কর্তৃপক্ষকে নিরাপত্তার বিষয়টি আরও গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে এবং আমাদের দুর্যোগ প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়াশীলতা উন্নত করতে হবে।

অপরিকল্পিতভাবে তৈরিকৃত ভবনগুলোর সেপটিক ট্যাংক এবং পানির ট্যাংকগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না করার ফলে এর ভেতরে গ্যাস জমে যায়। অত্যধিক গ্যাস জমে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটে থাকে। তাই নিয়মিত এগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

…গবেষণায় আরও পরিলক্ষিত হয় যে, সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডগুলো বেশি হয়ে থাকে। প্রতিবছর অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝরে যাচ্ছে অগণিত প্রাণ, নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ, ভেঙে যাচ্ছে হাজারো স্বপ্ন।

নির্ধারিত সময় পরপর গ্যাসের লাইনগুলোয় লিকেজ বা ছিদ্র পরীক্ষা করতে হবে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ভবনটির অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা সন্তোষজনক কিনা তা যাচাই করে ভবন নির্মাণের অনুমতি দিতে হবে। অগ্নিনিরাপত্তায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বৈদ্যুতিক সংযোগগুলো নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখতে হবে এবং ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি মেরামত করতে হবে। নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম স্থাপন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ধূমপান নিষিদ্ধ করতে হবে বা আলাদা কোনো জোন নির্ধারণ করে দিতে হবে।

কর্মস্থলের সবাইকে অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রসমূহ চালাতে জানতে হবে এবং প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষকে তাদের সব কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রসমূহ পরিচালনার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আইন অনুযায়ী অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জামসমূহ সঠিকভাবে স্থাপন ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।

জরুরি বহির্গমনের পথ সর্বদা খোলা ও বাধামুক্ত রাখতে হবে। বহুতল ভবন ও কারখানাগুলোয় প্রত্যেক রুম বা ফ্লোর থেকে নিরাপদে বের হওয়ার জন্য একটি বহির্গমন মানচিত্র এমন স্থানে ঝুলিয়ে রাখতে হবে যাতে সবাই তা দেখতে পারে।

ভবনে ফায়ার এলার্মের ব্যবস্থা রাখতে হবে। দিয়াশলাই ও গ্যাস লাইটার সর্তকতার সাথে ব্যবহার করতে হবে ও নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে। হাতের কাছে প্রচুর পানি, বালি মজুদ রাখতে হবে। প্রতিমাসে অথবা ছয় মাস অন্তর অন্তর বাধ্যতামূলকভাবে অগ্নি-মহড়া অনুশীলন করতে হবে, রাতেও অগ্নি-মহড়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

পরিবারের সবাইকে ও একটি প্রতিষ্ঠানের মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৮ শতাংশ অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। অগ্নিনিরাপত্তা বিধিমালা কঠোরভাবে সবাইকে মানতে বাধ্য করতে হবে। যেকোনো সময় অগ্নিকাণ্ড সংগঠিত হতে পারে তাই সবসময় সতর্ক থাকতে হবে।

কোথাও আগুন লাগলে সাথে সাথে বৈদ্যুতিক মূল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। অগ্নিকাণ্ডের সময় যতটা সম্ভব ধীর-স্থির ও শান্ত থাকতে হবে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের জরুরি টেলিফোন নাম্বারটি সবার মুখস্থ রাখতে হবে এবং দ্রুত তাদের জানাতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসার পূর্ব পর্যন্ত নিরাপদ দূরত্বে থেকে অবশ্যই আগুন নেভানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

অগ্নিনির্বাপক সামগ্রী ব্যবহার করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে হবে। বৈদ্যুতিক লাইনে, তেল জাতীয় আগুনে, কোনো মেশিন বা যন্ত্রে পানি দেওয়া যাবে না। সবাইকে সতর্ক করার জন্য ফায়ার এলার্ম বাজাতে হবে বা বিশেষ কোনো সিগন্যাল দিতে হবে।

কোনোভাবেই তাড়াহুড়ো করা যাবে না। এতে করে পড়ে গিয়ে বড় রকম আঘাত পাওয়া, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই মাথা ঠান্ডা রেখে কী করতে হবে তা ঠিক করতে হবে। ফ্লোর ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে গেলে হামাগুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে বের হয়ে আসতে হবে। সম্ভব হলে ভেজা কাপড়ের টুকরো, রুমাল বা তোয়ালে দিয়ে মুখ ও নাক বেঁধে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে আসতে হবে। সাথে সাথে বের হওয়া সম্ভব না হলে গ্যাস মাস্ক পরে অপেক্ষা করতে হবে।

গায়ে বা কাপড়ে আগুন লাগলে কখনই দৌড়ানো যাবে না, দ্রুত মাটিতে শুয়ে পড়তে হবে এবং দুই হাত মুখমণ্ডলের ওপর রেখে গায়ের আগুন না নেভা পর্যন্ত গড়াগড়ি দিতে হবে।

সর্বোপরি জনসাধারণকে অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন করা এবং অগ্নিকাণ্ডের সময় নিজেকে রক্ষা করা এবং প্রাথমিকভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কৌশল শেখানোর মাধ্যমে কিছুটা হলেও অযাচিত অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে।

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার ।। ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এবং যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৬:১২:১৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
Translate »

বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে যা করণীয়

আপডেট : ০৬:১২:১৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

বর্তমান সময়ে নগর জীবনের অন্যতম আতঙ্কের নাম অগ্নিকাণ্ড। ক্রমাগত ঘটতে থাকা বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড বিধ্বংসী রূপ ধারণ করার পরও যেন ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। পুরোটা বছর জুড়ে অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হওয়াই যেন এদেশের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতিবছর বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড কেড়ে নিচ্ছে শত শত মানুষের প্রাণ এবং নষ্ট করছে বিপুল পরিমাণ সম্পদ।

দেশে যেসব বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার অধিকাংশই হয়েছে বাণিজ্যিক ভবনগুলোয় অর্থাৎ একই ভবনের মধ্যে আছে বাণিজ্যিক ব্যবহার, রেস্টুরেন্ট ও আবাসস্থল। নগরায়ণ প্রক্রিয়া বৃদ্ধির সাথে সাথে এ ধরনের মিশ্র ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ হলো রাজউক কর্তৃক নির্ধারিত ভবন কোড না মেনে ভবন নির্মাণ, অগ্নিনিরাপত্তার শিথিল নিয়ম এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণের অভাব।

সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা:

২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তালতলায় একটি করাতকলে (স মিল) অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে প্রায় ২০টি দোকান ও দুটি স-মিল পুড়ে যায় বলেও জানায় ফায়ার সার্ভিস। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অর্থাৎ ২০১০-২০২২ সালের মধ্যে যেসব ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। একইদিনে দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে আগুন লাগে কড়াইল বস্তিতে। প্রাথমিকভাবে আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। এছাড়া আগুনে হতাহতের কোনো সংবাদও পাওয়া যায়নি।

এর মধ্যে ২০১০ সালের পুরান ঢাকার নিমতলীর নবাব কাটরায় রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদামে থাকা কেমিক্যালের প্লাস্টিক ড্রাম গলে গিয়ে বিস্ফোরণ, ২০১২ সালে ঢাকা মহানগরীর উপকণ্ঠে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় অবস্থিত তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ড, ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি ভোরবেলা গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটে এবং ১৫ মার্চ দিবাগত রাতে মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে লাগা অগ্নিকাণ্ড, ২০১৯ সালে রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনে এবং বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ২০২১ সালে মগবাজারের ওয়্যারলেস গেটের বিস্ফোরণ এবং ২০২২ সালে চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ডতে কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো আজও মানব মনে বিভীষিকার জন্ম দেয়।

অপরদিকে শুধুমাত্র ২০২৩ সালেই সারা দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া একাধিক বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও তেমন কোনো পদক্ষেপ এখনো পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোডের বিধি লঙ্ঘন এবং অগ্নিনিরাপত্তা সচেতনতার অভাবের কারণে অধিক জনসংখ্যার মেগাসিটিতে বিস্ফোরণ এবং আগুনের ঝুঁকি সর্বত্র লুকিয়ে আছে।

২০২৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার গুলশানের মোশারফ জাকের স্কাইলাইন ভবনে লাগা আগুন দুইজন নিহত হন এবং আট জন পুরুষ ১২ জন মহিলা এবং একজন শিশুসহ মোট ২১ জনকে  নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একই মাসের ২৬ তারিখে বনানীর কড়াইল বস্তিতে অগ্নি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। এই অগ্নিকাণ্ডের ফলে আনুমানিক প্রায় ২০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হলেও কোনো ধরনের নিহত বা হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

নারায়ণগঞ্জে পরিধানের জন্য তৈরি পোশাক তৈরির একটি কারখানা ৩ মার্চ বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায় যেখানে সৌভাগ্যবশত কারখানা বন্ধ থাকার কারণে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পেও অগ্নিকাণ্ড একটি স্থায়ী সমস্যা, যেটি দেশের অর্থনীতিতে একটি প্রধান অবদানকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছে।

অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ, নির্মিত ভবনগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না করা, ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ব্যবহার, শিথিল অগ্নিনিরাপত্তা বিধিমালা, অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং অগ্নিনিরাপত্তা সচেতনতার অভাবকেই অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়।

এরপর ৫ মার্চ ঢাকার সায়েন্সল্যাব এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটে। গুলিস্তান বিস্ফোরণের মাত্র দুইদিন পরে ৭ মার্চ সিদ্দিকবাজারে এবং ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। তার ঠিক ১১ দিন পরেই ১৫ এপ্রিল আগুন লাগে রাজধানীর অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক ভবন নিউমার্কেটে এবং আগুনে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার মালামাল পুড়ে যায়।

২০২৪ সালের সর্বপ্রথম অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুন লাগার মধ্য দিয়ে। এই ভবনের পুরোটাই বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হতো। বৃহস্পতিবার রাতে সংঘটিত এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। বেইলি রোডের এই অগ্নিকাণ্ডে আনুমানিক প্রায় ২০০ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।

গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটির নিচতলায় ‘চুমুক’ নামের একটি কফি শপ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়, যা পরবর্তীতে ভবনের অন্যান্য তলায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তবে বছরের শেষের দিকে অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বর প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে যেটি নজিরবিহীন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড।

অগ্নিকাণ্ডের কারণ:

প্রতিটি বিস্ফোরণের ঘটনার পরপরই পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক দপ্তর, সিআইডিসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং প্রতিবারই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বিভিন্ন উৎসের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটে থাকলেও প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়ে থাকে পানির ট্যাংকে দীর্ঘদিন জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণের ফলে, গ্যাস সরবরাহ লাইনে লিকেজ বা ছিদ্র থাকার কারণে, সিলিন্ডার বা বয়লার বিস্ফোরণ, রাসায়নিক বিক্রিয়া, উচ্চতাপে অথবা বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে থাকে।

অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ, নির্মিত ভবনগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না করা, ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ব্যবহার, শিথিল অগ্নিনিরাপত্তা বিধিমালা, অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং অগ্নিনিরাপত্তা সচেতনতার অভাবকেই অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়।

গবেষণা কী বলে?

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর সারাদেশে ঘটে যাওয়া সব অগ্নিকাণ্ড এবং এর কারণসহ একটি করে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর থেকে ১০ বছরের প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।

গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ২০১৬ এবং ২০১৯ সালের কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিবছরই পূর্ববর্তী বছর থেলে বার্ষিক অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিসংখ্যান পর্যালোচনা থেকে দেখা যায় যে, ১০ বছরে সর্বমোট ১,৮৯,০৪৫টি জায়গায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটে।

অন্যান্য বছরের তুলনায় ২০২৩ সালে সর্বাধিক জায়গায় আগুন লেগেছে। তাই বার্ষিক ক্রমানুযায়ী ২০২৩ সাল ১ম স্থানে অবস্থান করছে এবং ২০২৪ ও ২০২২ সাল যথাক্রমে ২য় ও ৩য় স্থানে অবস্থান করছে। ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে শতকরা ৪ ভাগ এবং ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে শতকরা ১১ ভাগ বেশি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল।

ক্যাপস কর্তৃক গবেষণাকৃত প্রাপ্ত ফলাফল পর্যালোচনা করে আরও জানা যায় যে, শুধুমাত্র বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণেই ৭৯,৪৩৯টি জায়গায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটে, যা মোট দুর্ঘটনার শতকরা প্রায় ৩৭ ভাগ। এছাড়া চুলার (ইলেকট্রিক, গ্যাস ও মাটির চুলা ইত্যাদি) মাধ্যমে ৩৭,০১১টি (১৭ শতাংশ), বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরার কারণে ৩৪,১৮৪টি (১৬ শতাংশ) এবং অন্যান্য বা অজ্ঞাত কারণে ২৭,৯২০টি (১৩ শতাংশ) জায়গায় আগুন লাগে।

অপরদিকে ২০২৩ সালে সারাদেশে সর্বমোট ২৭,৬২৩টি এবং ২০২৪ সালে সর্বমোট ২৬,৬৫৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ক্যাপসের গবেষণায় আরও পরিলক্ষিত হয় যে, সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডগুলো বেশি হয়ে থাকে। প্রতিবছর অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝরে যাচ্ছে অগণিত প্রাণ, নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ, ভেঙে যাচ্ছে হাজারো স্বপ্ন। মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের এবং নিজেদের সহায় সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে হাজারো পরিবার। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পরপরই তদন্ত কমিটি গঠিত হচ্ছে কিন্তু সঠিক কারণ নিরূপণ করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না।

করণীয়/সুপারিশ:

অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোডের বিধি লঙ্ঘন এবং অগ্নিনিরাপত্তা সচেতনতার অভাবের কারণে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি দুই কোটিরও বেশি বসবাসরত মানুষের এই মেগাসিটির সর্বত্র লুকিয়ে আছে। বাংলাদেশে অগ্নিকাণ্ডের সমস্যা মোকাবিলার জন্য সরকার অগ্নিনিরাপত্তা বিধান প্রতিষ্ঠা এবং প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সারাদেশের সব ভবনগুলোয় অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জাম নিশ্চিত করা এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নিয়মিত পরিদর্শন করা। কর্তৃপক্ষকে নিরাপত্তার বিষয়টি আরও গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে এবং আমাদের দুর্যোগ প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়াশীলতা উন্নত করতে হবে।

অপরিকল্পিতভাবে তৈরিকৃত ভবনগুলোর সেপটিক ট্যাংক এবং পানির ট্যাংকগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না করার ফলে এর ভেতরে গ্যাস জমে যায়। অত্যধিক গ্যাস জমে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটে থাকে। তাই নিয়মিত এগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

…গবেষণায় আরও পরিলক্ষিত হয় যে, সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডগুলো বেশি হয়ে থাকে। প্রতিবছর অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝরে যাচ্ছে অগণিত প্রাণ, নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ, ভেঙে যাচ্ছে হাজারো স্বপ্ন।

নির্ধারিত সময় পরপর গ্যাসের লাইনগুলোয় লিকেজ বা ছিদ্র পরীক্ষা করতে হবে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ভবনটির অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা সন্তোষজনক কিনা তা যাচাই করে ভবন নির্মাণের অনুমতি দিতে হবে। অগ্নিনিরাপত্তায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বৈদ্যুতিক সংযোগগুলো নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখতে হবে এবং ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি মেরামত করতে হবে। নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম স্থাপন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ধূমপান নিষিদ্ধ করতে হবে বা আলাদা কোনো জোন নির্ধারণ করে দিতে হবে।

কর্মস্থলের সবাইকে অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রসমূহ চালাতে জানতে হবে এবং প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষকে তাদের সব কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রসমূহ পরিচালনার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আইন অনুযায়ী অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জামসমূহ সঠিকভাবে স্থাপন ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।

জরুরি বহির্গমনের পথ সর্বদা খোলা ও বাধামুক্ত রাখতে হবে। বহুতল ভবন ও কারখানাগুলোয় প্রত্যেক রুম বা ফ্লোর থেকে নিরাপদে বের হওয়ার জন্য একটি বহির্গমন মানচিত্র এমন স্থানে ঝুলিয়ে রাখতে হবে যাতে সবাই তা দেখতে পারে।

ভবনে ফায়ার এলার্মের ব্যবস্থা রাখতে হবে। দিয়াশলাই ও গ্যাস লাইটার সর্তকতার সাথে ব্যবহার করতে হবে ও নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে। হাতের কাছে প্রচুর পানি, বালি মজুদ রাখতে হবে। প্রতিমাসে অথবা ছয় মাস অন্তর অন্তর বাধ্যতামূলকভাবে অগ্নি-মহড়া অনুশীলন করতে হবে, রাতেও অগ্নি-মহড়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

পরিবারের সবাইকে ও একটি প্রতিষ্ঠানের মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৮ শতাংশ অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। অগ্নিনিরাপত্তা বিধিমালা কঠোরভাবে সবাইকে মানতে বাধ্য করতে হবে। যেকোনো সময় অগ্নিকাণ্ড সংগঠিত হতে পারে তাই সবসময় সতর্ক থাকতে হবে।

কোথাও আগুন লাগলে সাথে সাথে বৈদ্যুতিক মূল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। অগ্নিকাণ্ডের সময় যতটা সম্ভব ধীর-স্থির ও শান্ত থাকতে হবে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের জরুরি টেলিফোন নাম্বারটি সবার মুখস্থ রাখতে হবে এবং দ্রুত তাদের জানাতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসার পূর্ব পর্যন্ত নিরাপদ দূরত্বে থেকে অবশ্যই আগুন নেভানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

অগ্নিনির্বাপক সামগ্রী ব্যবহার করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে হবে। বৈদ্যুতিক লাইনে, তেল জাতীয় আগুনে, কোনো মেশিন বা যন্ত্রে পানি দেওয়া যাবে না। সবাইকে সতর্ক করার জন্য ফায়ার এলার্ম বাজাতে হবে বা বিশেষ কোনো সিগন্যাল দিতে হবে।

কোনোভাবেই তাড়াহুড়ো করা যাবে না। এতে করে পড়ে গিয়ে বড় রকম আঘাত পাওয়া, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই মাথা ঠান্ডা রেখে কী করতে হবে তা ঠিক করতে হবে। ফ্লোর ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে গেলে হামাগুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে বের হয়ে আসতে হবে। সম্ভব হলে ভেজা কাপড়ের টুকরো, রুমাল বা তোয়ালে দিয়ে মুখ ও নাক বেঁধে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে আসতে হবে। সাথে সাথে বের হওয়া সম্ভব না হলে গ্যাস মাস্ক পরে অপেক্ষা করতে হবে।

গায়ে বা কাপড়ে আগুন লাগলে কখনই দৌড়ানো যাবে না, দ্রুত মাটিতে শুয়ে পড়তে হবে এবং দুই হাত মুখমণ্ডলের ওপর রেখে গায়ের আগুন না নেভা পর্যন্ত গড়াগড়ি দিতে হবে।

সর্বোপরি জনসাধারণকে অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন করা এবং অগ্নিকাণ্ডের সময় নিজেকে রক্ষা করা এবং প্রাথমিকভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কৌশল শেখানোর মাধ্যমে কিছুটা হলেও অযাচিত অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে।

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার ।। ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এবং যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)