London ০৪:১২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিচারপতিদের উদ্দেশ্যে ফাঁসির আসামির আবেগঘন চিঠি

অনলাইন ডেস্ক

মাদক মামলায় ২০১৯ সালের ১৯ আগস্ট থেকে খুলনা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন বিকাশ বিশ্বাস নামে এক আসামি। শুনানি শেষে ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর খুলনার একটি আদালত তাকে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়।

তিন বছরের বেশি সময় ধরে ফাঁসির সেলে থাকা বিকাশ বিশ্বাস তার দুরবস্থার কথা জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনিরকে উদ্দেশ্যে করে সম্প্রতি একটি আবেগঘন চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিলের শুনানিতে নিজেই শুনানি করতে চেয়েছেন।

চিঠিতে বিকাশ বলেন, ‘আমি একজন অসহায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এই চিঠি আপনার বরাবর আমার স্ত্রীর মাধ্যমে পাঠানোর উদ্দেশ্যে হলো, আমার এই মামলায় আমার আইনজীবীরা সুস্পষ্টভাবে নির্দোষ প্রমাণ করা সত্ত্বেও বিজ্ঞ বিচারক মামলার সাক্ষী, জেরা, জবানবন্দি সঠিকভাবে পর্যালোচনা না করে আমার সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন।’

তিনি উল্লেখ করেন, ‘এই মামলায় আমার কোনো ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেই। আমার নামে আগে পরে কোনো মাদক সংক্রান্ত মামলা নেই। আমি অত্যন্ত গরীব বিধায় যারা এই মামলায় জড়িত তাদের আসামি না করে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে বিজ্ঞ বিচারক সম্পূর্ণ ন্যায় বিচার পাওয়া থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছেন।’

বিকাশ বিশ্বাস আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনার কাছে আমার দৃঢ় আর্তনাদ হলো, আমার ডেথ রেফারেন্স মামলাটি উচ্চ আদালতে নিজেই শুনানি করতে চাই এবং সেই বিষয় কোনো আইনগত সুযোগ আছে কিনা? আপনার কাছে জানার দৃঢ়ভাবে আর্তনাদ রইলো। আমার নথি সঠিকভাবে পর্যালোচনা করলে কোনো সচেতন বিচারক আমাকে দণ্ড দিতে পারে না।

চিঠিতে তিনি বলেন, ‘একজন ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া মানে শুধু ওই ব্যক্তিকে নয়, তার পুরো পরিবারকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া। একজন ব্যক্তির যখন মৃত্যুদণ্ড হয় তখন ওই ব্যাক্তির মা, বাবা, ভাই, বোন, স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয় স্বজন কেউ পাশে থাকে না।

উচ্চ আদালতের প্রতি আমার দৃঢ়ভাবে আকুতি থাকবে, আমাকে শুধু তিন দিন শুনানি করার সুযোগ দেয়া হলে নিম্ন আদালত যে বিচার করেছেন তা আমি চ্যালেঞ্জের সাথে নিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে দেব। আর আমি যদি নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হই তাহলে উচ্চ আদালতের কাছ থেকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার অনুমতি চেয়ে নেবো।

কারণ, বিনা দোষে জেল খাটার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।’

বিকাশ আরও লেখেন, ‘আসলে আমার মতো অসহায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির আর্তনাদ কেউ শুনতে চায় না। তারপরেও মনে হয় কেউ যদি শোনে। আমার এই আর্তনাদের কথা মাননীয় প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের অনেক বিচারপতি বরাবর আমার স্ত্রীর মাধ্যমে চিঠি পাঠিয়ে জানিয়েছি। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইড চেয়ারম্যান বরাবর এই আর্তনাদ জানিয়েছি কিন্তু কোন সাড়া পাইনি।’

চিঠিতে তিনি বলেন, ‘বাস্তবতা হলো সংবিধানে নীতি ও ন্যায়ের কথা অত্যান্ত দৃঢ়ভাবে লিখিত আছে। যা থেকে তৈরি হয়েছে আইন ও বিধান। ন্যায়ের মানদণ্ড যোগ্যকে বুঝিয়ে দিতে মধ্যরাতেও আদালতকে জেগে থাকতে হয়। সেই আদালত যদি একজন অসহায় বিচারপ্রার্থীকে সংবিধানের আইন দিয়ে প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে না পারে তাহলে সেই বিচারপ্রার্থীর আর কিছু করার থাকে না। থাকে শুধু আফসোস আর চোখের পানি।’

বিকাশের চিঠির বিষয়ে অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, ‘আবেগঘন এই চিঠিতে আমি আবেগাপ্লুত। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নিব। এই মামলায় শুনানি করতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।’

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৫:০৮:৩৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫
১২
Translate »

বিচারপতিদের উদ্দেশ্যে ফাঁসির আসামির আবেগঘন চিঠি

আপডেট : ০৫:০৮:৩৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫

মাদক মামলায় ২০১৯ সালের ১৯ আগস্ট থেকে খুলনা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন বিকাশ বিশ্বাস নামে এক আসামি। শুনানি শেষে ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর খুলনার একটি আদালত তাকে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়।

তিন বছরের বেশি সময় ধরে ফাঁসির সেলে থাকা বিকাশ বিশ্বাস তার দুরবস্থার কথা জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনিরকে উদ্দেশ্যে করে সম্প্রতি একটি আবেগঘন চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিলের শুনানিতে নিজেই শুনানি করতে চেয়েছেন।

চিঠিতে বিকাশ বলেন, ‘আমি একজন অসহায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এই চিঠি আপনার বরাবর আমার স্ত্রীর মাধ্যমে পাঠানোর উদ্দেশ্যে হলো, আমার এই মামলায় আমার আইনজীবীরা সুস্পষ্টভাবে নির্দোষ প্রমাণ করা সত্ত্বেও বিজ্ঞ বিচারক মামলার সাক্ষী, জেরা, জবানবন্দি সঠিকভাবে পর্যালোচনা না করে আমার সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন।’

তিনি উল্লেখ করেন, ‘এই মামলায় আমার কোনো ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেই। আমার নামে আগে পরে কোনো মাদক সংক্রান্ত মামলা নেই। আমি অত্যন্ত গরীব বিধায় যারা এই মামলায় জড়িত তাদের আসামি না করে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে বিজ্ঞ বিচারক সম্পূর্ণ ন্যায় বিচার পাওয়া থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছেন।’

বিকাশ বিশ্বাস আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনার কাছে আমার দৃঢ় আর্তনাদ হলো, আমার ডেথ রেফারেন্স মামলাটি উচ্চ আদালতে নিজেই শুনানি করতে চাই এবং সেই বিষয় কোনো আইনগত সুযোগ আছে কিনা? আপনার কাছে জানার দৃঢ়ভাবে আর্তনাদ রইলো। আমার নথি সঠিকভাবে পর্যালোচনা করলে কোনো সচেতন বিচারক আমাকে দণ্ড দিতে পারে না।

চিঠিতে তিনি বলেন, ‘একজন ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া মানে শুধু ওই ব্যক্তিকে নয়, তার পুরো পরিবারকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া। একজন ব্যক্তির যখন মৃত্যুদণ্ড হয় তখন ওই ব্যাক্তির মা, বাবা, ভাই, বোন, স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয় স্বজন কেউ পাশে থাকে না।

উচ্চ আদালতের প্রতি আমার দৃঢ়ভাবে আকুতি থাকবে, আমাকে শুধু তিন দিন শুনানি করার সুযোগ দেয়া হলে নিম্ন আদালত যে বিচার করেছেন তা আমি চ্যালেঞ্জের সাথে নিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে দেব। আর আমি যদি নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হই তাহলে উচ্চ আদালতের কাছ থেকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার অনুমতি চেয়ে নেবো।

কারণ, বিনা দোষে জেল খাটার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।’

বিকাশ আরও লেখেন, ‘আসলে আমার মতো অসহায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির আর্তনাদ কেউ শুনতে চায় না। তারপরেও মনে হয় কেউ যদি শোনে। আমার এই আর্তনাদের কথা মাননীয় প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের অনেক বিচারপতি বরাবর আমার স্ত্রীর মাধ্যমে চিঠি পাঠিয়ে জানিয়েছি। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইড চেয়ারম্যান বরাবর এই আর্তনাদ জানিয়েছি কিন্তু কোন সাড়া পাইনি।’

চিঠিতে তিনি বলেন, ‘বাস্তবতা হলো সংবিধানে নীতি ও ন্যায়ের কথা অত্যান্ত দৃঢ়ভাবে লিখিত আছে। যা থেকে তৈরি হয়েছে আইন ও বিধান। ন্যায়ের মানদণ্ড যোগ্যকে বুঝিয়ে দিতে মধ্যরাতেও আদালতকে জেগে থাকতে হয়। সেই আদালত যদি একজন অসহায় বিচারপ্রার্থীকে সংবিধানের আইন দিয়ে প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে না পারে তাহলে সেই বিচারপ্রার্থীর আর কিছু করার থাকে না। থাকে শুধু আফসোস আর চোখের পানি।’

বিকাশের চিঠির বিষয়ে অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, ‘আবেগঘন এই চিঠিতে আমি আবেগাপ্লুত। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নিব। এই মামলায় শুনানি করতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।’