বাহারি ফুলে রঙিন রাজশাহী নগরী। মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে চারপাশ। তীব্র তাপদাহে পুড়লেও দেখা মিলছে না কাঙ্খিত বৃষ্টির। এর মধ্যে যেন প্রকৃতিতে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয় নানা রঙের ফুল। কৃষ্ণচূড়ার আবির নিয়ে প্রকৃতি সেজে উঠেছে বর্ণিল রূপে। যেন প্রকৃতিতে কৃষ্ণচূড়ার রঙে আগুন জ্বলছে।
সবুজ বাগান ও প্রশস্ত বৃক্ষরাজির জন্য পরিচিত রাজশাহী নগরী এখন ফুলের রাজ্যে পরিণত হয়েছে।
নগরজুড়ে ফুটেছে উজ্জ্বল সোনালু এবং কৃষ্ণচূড়া ফুল। নগরীকে এক রঙিন পালকে মুড়ে দিয়েছে যেন। এই দৃশ্য শুধু সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে এমন নয়, বরং এটি পর্যটকদের এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে এক নতুন উদ্দীপনা সঞ্চার করেছে।
সোনালু ফুল উজ্জ্বল হলুদ রঙের জন্য পরিচিত এবং কৃষ্ণচূড়া গাঢ় লাল রঙের জন্য প্রসিদ্ধ। নগরের নানা কোনায় বিস্তৃত হয়ে আছে এই ফুলগুলো। বিশেষ করে, বড় বড় সড়কের ধারে এবং জনপথে এই ফুলগুলোর প্রাচুর্য দেখা যায়, যা একটি চিত্রমালা সৃষ্টি করে।
নগরী পথে প্রান্তরে চোখ মেললেই দেখা যাবে, আগুন ঝরা কৃষ্ণচূড়ার সমাহার। এ এক চমৎকার রূপ, যেন কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে আগুন লেগেছে। কৃষ্ণচূড়া যখন ফুটে এই প্রকৃতিতে, তখন সব বাঙালির হৃদয়ে দোলা দেয়। গ্রীষ্মের সৌন্দর্য বাড়াতে হাজির স্বর্ণাভ-হলুদ সোনাইল বা বান্দরের লাঠি ও বেগুনি রঙের মনোমুগ্ধকর জারুল! পাশাপাশি রাধাচূড়া, কুরচি, গুস্তাভিয়া, কাঠগোলাপ, ডুঁলিচাপা, উদয়পদ্ম, পাদাউক, মধুমঞ্জুরী, পেল্টোফোরাম, কমব্রেটাম, পালাম বা পালান, লাল বা গোলাপি সোনালু, নাগেশ্বর, হিজল, লাল ঝুমকো লতা, জ্যাকারান্ডা ইত্যাদি বিভিন্ন রঙিন ফুল শোভা পাচ্ছে নগর প্রকৃতিজুড়ে। গ্রীষ্মের এমন খরতাপেও প্রকৃতির এই রঙিন-রূপ আপনাকে দিয়ে যাবে এক পশলা-শান্তি।
তীব্র গরমের এই সময়ে প্রকৃতিতে ফুলের দেখা মেলে খুব কমই। তবে রাজশাহী নগরীর ইট পাথরের মধ্যেও গাছের ডাল-পাতার ফাঁকে নানা রঙের ফুল নজর কাড়ছে। নগরীর পদ্মাপাড় ঘেঁষে এখন কৃষ্ণচূড়া ফুলে যেন আগুন লেগেছে। গ্রীষ্মের এই সময়ের আগুন রাঙা ফুল হিসেবে যাকে জানা হয় তা হচ্ছে এই কৃষ্ণচূড়া।
গ্রীষ্মের সবচেয়ে রঙিন ফুলটি বোধহয় কৃষ্ণচূড়া। এর জাদুকরি রঙের ছটায় মুহূর্তেই রঙিন হয়ে ওঠে প্রকৃতি।কৃষ্ণচূড়ার বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিখ রেজিয়্যা। চমৎকার পত্রপল্লব ও আগুনরঙা ফুলের জন্য প্রসিদ্ধ এ গাছ। কৃষ্ণচূড়া গাছের আরেক নাম গুলমোহর। আমাদের দেশে সহজপ্রাপ্য এ গাছটির আদিনিবাস মাদাগাস্কারে।
কবির ভাষায়, ‘সোনালুর হলুদ ছোঁয়া আকাশে, কৃষ্ণচূড়া লালে লালে মাখামাখি। গ্রীষ্মের দুপুর আলো করে ঝলমল, প্রকৃতির কোলে রঙের উৎসব আঁকি।’ ‘মনের মাঝে বাজে উল্লাসের সুর, ফুলের সৌরভে ভরে যায় বাতাস। পথিকের পায়ে পায়ে সঙ্গী হয়ে রয়, সোনালু আর কৃষ্ণচূড়ার হাসির অবশেষ।’
‘এই রঙের খেলায় মন খুঁজে পায় শান্তি, প্রকৃতির এই মুগ্ধতায় ভরে ওঠে অন্তর। যেন বোঝাপড়া হয়ে যায় নিস্তব্ধতায়, সোনালু আর কৃষ্ণচূড়ার প্রেমে মাতোয়ারা।’
কবিতার এই পঙক্তির মতো সোনালু আর কৃষ্ণচূড়ার প্রেমে মজেছেন রাজশাহীবাসী। এসব ফুল শুধু দৃষ্টিনন্দন করে না, বরং একটি সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। সোনালু ও কৃষ্ণচূড়া নিজ নিজ সৌন্দর্য দিয়ে বাঙালির গ্রীষ্মের দিনগুলোকে আরও বেশি উপভোগ্য করে তোলে। এই মৌসুমে একটি বিশেষ সামাজিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে প্রাধান্য পায়, কারণ নাগরিক জীবনে এই রঙের ছোঁয়া সবাইকে একটু স্থিরতা এবং প্রশান্তি দেয়।
নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সোনালু ও কৃষ্ণচূড়ার ফুল প্রাণের স্পন্দন তুলেছে। নগর জীবনের যান্ত্রিকতা ও ধুলোধোঁয়া মাঝেও এই ফুলগুলো তাদের উজ্জ্বল রঙের মাধ্যমে এক অনন্য সৌন্দর্য বিস্তার করে তুলেছে। বিশেষ করে সকালের নরম রোদ এবং বিকালের মৃদু আলোয়, এই ফুলগুলোর দৃশ্য চোখ জুড়ানো।
রাজপথের পাশ দিয়ে চলা ফুটপাথগুলো এবং বাসস্থানের কাছাকাছি ছোট ছোট উদ্যানে এসব ফুলের প্রাচুর্য দেখা যায়। এছাড়া দেখা মেলে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসগুলোতে। এই সবুজ-লাল-হলুদের মিশেলে নগরবাসী প্রতিদিনের স্ট্রেস থেকে একটু হলেও মুক্তি পায় এবং নিজেদের পুনর্জীবিত মনে করে।
দৃষ্টিনন্দন বেগুনি রঙে প্রকৃতির শোভা বাড়ায় জারুল ফুল। গ্রীষ্মের শুরু থেকেই সবুজ পাতার ফাঁকে উঁঁকি দিতে থাকে এ ফুলটি। বিশাল গাছের শাখা উপশাখা জুড়ে বিচরণ জারুলের। এর বৈজ্ঞানিক নাম লেজারস্ট্রমিয়া স্পেসিওজা।
সোনালুর ঝলমলে রূপ দেখে মনে হয় কেউ যেন যত্ন করে সাজিয়েছে তাকে। দীর্ঘ থোকায় সাজানো উজ্জ্বল হলুদ ফুলের মায়াবি রূপ গ্রীষ্মেরই অবদান। সোনালুর বৈজ্ঞানিক নাম ক্যাশিয়া ফিস্টুলা। বৈশাখের শুরুতে দীর্ঘ মঞ্জরির ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে। নতুন পাতাও জেগে ওঠে একই সঙ্গে। দেখতে দেখতে ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় গাছ। দেখে মনে হয় যেন কাঁচা সোনা রঙে ভরে গেছে গাছটি। সোনালু কোথাও কোথাও বানরলাঠি নামেও পরিচিত। বানরলাঠি ঘিরে লোকসমাজে নানা গল্পও প্রচলিত রয়েছে।
অনেকটা কৃষ্ণচূড়ার মতোই দেখতে রাধাচূড়া ফুল। অনেকে কৃষ্ণচূড়া ভেবে ভুল করেন। একটু লক্ষ্য করলেই পার্থক্যটা বোঝা যায় অবশ্য। ছোট কাঁটাওয়ালা রাধাচূড়া ফুলের গাছ কৃষ্ণচূড়ার মতো বড় হয় না। ফুল হয় হলুদ এবং লাল রঙের। অনেক সময় একই গাছে লাল হলুদ দুই রঙের ফুলই দেখা যায়। রাধাচূড়ার জন্মস্থান ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
উজ্জ্বল কমলা রঙের কনকচূড়া ফুল বর্ণিলতা ছড়ায় গ্রীষ্মের প্রকৃতিতে। এই গাছটিও দেখতে কৃষ্ণচূড়া গাছের মতো। গাঢ় সবুজ পাতা ও হলুদ রঙের ফুলগুলো রোদ্র ঝলমল গ্রীষ্মকে দান করে লাবণ্য।
কনকচূড়া আমাদের দেশের নিজস্ব গাছ নয়। কনকচূড়ার আদি নিবাস আন্দামান, শ্রীলঙ্কা, মালয় ও উত্তর অস্ট্রেলিয়া।
পাতার ফাঁকে ফুটে থাকা সাদা, লাল, গোলাপি আর হলুদাভ রঙের কাঠগোলাপ আরেকটি চমৎকার ফুল গ্রীষ্মের। এর বৈজ্ঞানিক নাম প্লুমেরিয়া অবটুসা। এটি মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা, ভেনেজুয়েলা ও দক্ষিণ ভারতের স্থানীয় ফুল। কাঠগোলাপের গাছ ঝোপ আকৃতির এবং পরিস্থিতিভেদে কয়েক মিটার লম্বা হতে পারে। পাতা কিছুটা বড় ও লম্বা। পাঁচটি ছড়ানো পাপড়ির ফুলগুলো পাঁচ থেকে আট ইঞ্চি চওড়া। পাপড়ির কেন্দ্রে কিছুটা হলদে বা কমলা রঙের ছোঁয়া থাকে। ফুলের পাশাপাশি এর পাতার বিন্যাসের সৌন্দর্যও দৃষ্টি কাড়ে। অনেক সময় গাছে পাতা গজানোর আগেই ফুল ফোটে। এর পাতাগুলো ডালের শেষ প্রান্তে গুচ্ছবদ্ধ হয়ে থাকে। পাতা ঝরার পর ডালে চিহ্ন থেকে যায়। কাঠগোলাপ ছাড়াও গুলাচ, কাঠচাঁপা, গোলকচাঁপা, গৌরচাঁপা, চালতাগোলাপ ইত্যাদি নামে একে ডাকা হয়।
গ্রীষ্ম ও বর্ষায় ফুল আসে মধুমঞ্জরী লতায়। ফুলটিকে মাধবীলতা বলে অনেকেই ভুল করেন। এর বৈজ্ঞানিক নাম কুইসকুয়ালিস ইন্ডিকা। স্নিগ্ধ সবুজ পাতার ফাঁকে ডালের আগাতে থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা হালকা গোলাপি ও সাদার মিশ্রণে ফুলগুলো স্নিগ্ধতা নিয়ে আসে প্রকৃতিতে। মালয়েশিয়ার প্রজাতি এটি। কখনও কখনও শীত পর্যন্ত থেকে যায় মধুমঞ্জরী লতার ফুল। সন্ধ্যায় নতুন ফোটা ফুলের সুগন্ধ মন মাতিয়ে তোলে।
স্থানীয় বাসিন্দা ফারহানা বেগম বলেন, রাজশাহীর এই রূপ দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ। প্রতি বছর এই সময়ে আমি এবং আমার পরিবার এই ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে বাইরে বের হই। শহরের পার্কগুলো এবং চারদিকের উদ্যানগুলো এই সময়ে বিশেষ করে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
নগরীর শিরোইল এলাকার বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম রুনু জানান, এই ফুলের মৌসুম আমাদের জন্য একটি বড় সুযোগ। আমরা এই সময়ে অনেক বেশি পর্যটক আকর্ষণ করতে পারি। এছাড়া, স্থানীয় শিল্পীরা এই ফুলগুলোকে তাদের শিল্পকর্মের অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যবহার করেন।
রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী আকলিমা হোসেন বলেন, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জারুল, বকুল ও গ্রীষ্মকালীন ফুলগুলোর সৌন্দর্য মন কেড়ে নেয়। বিশেষ করে সিমলা পার্কে ফুলগুলোর ঘ্রাণ ও সৌন্দর্যে মন ও নয়ন জুড়িয়ে যায়। প্রায় প্রতিটি ঋতুতেই কিছু না কিছু ফুল আমাদের মুগ্ধ করে, নিয়ে যায় প্রকৃতির কাছে। এ রকম মনোমুগ্ধকর ফুলের রঙে মনে পড়ছে ছেলেবেলার কথা, গ্রামের কথা, মায়ের কথা।
রাজশাহী কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান নুরুননেসা বলেন, সোনালু এবং কৃষ্ণচূড়া ফুল শুধু সৌন্দর্যই বাড়ায় না, এরা বায়োডাইভার্সিটির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এই ফুলগুলো বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এবং প্রজাপতি আকর্ষণ করে, যা একটি সুস্থ পারিস্থিতিক তন্ত্র গড়ে তোলে। রাজশাহী নগরীর চেহারা দেখে সবাই মুগ্ধ।