বরিশালের কাশিপুর এখন যেন এক মর্মান্তিক আতঙ্কের নাম। গত পাঁচ সপ্তাহে ঘটে যাওয়া ধারাবাহিক নির্মম ঘটনাগুলোতে পুরো নগরবাসীর মধ্যে এক অভাবনীয় আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে।
অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, আর পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। কাশিপুর এলাকায় মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে যেসব দৃশ্যের সম্মুখীন হচ্ছে, তা শুধু ভয়ানক নয়, বরং লোমহর্ষক। মানুষের দেহের টুকরোগুলো দীঘি, পুকুর, ড্রেন এবং ডাস্টবিনে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে, যা নগরজীবনের স্বাভাবিক ছন্দকেই বিপন্ন করেছে। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ এ অপরাধগুলো প্রতিহত করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হচ্ছে বলে নগরবাসী অভিযোগ করছে।
গত তিন দিনে বরিশাল নগরীর ইছাকাঠী এলাকায় পুকুর, ডাস্টবিন ও ঝোপঝাড় থেকে মানুষের দেহের সাতটি টুকরো উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল, মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) সকালে একটি বাসাবাড়ি এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে পুলিশের একাধিক টিম তল্লাশি চালায়। এ ঘটনায় পুরো এলাকাবাসীর মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। হতভাগ্য ওই নারীকে হত্যার পর শরীরের বিভিন্ন অংশ নিখুঁতভাবে কাটা হয়েছে বলে ধারণা করছেন পুলিশ।
প্রথম টুকরোটি উদ্ধার হয় ২৬ জানুয়ারি। ইউনুস সিকদার নামে একজন বাসিন্দা দীঘির পাশে একটি মাছ ভাসতে দেখেন। কাছে গিয়ে দেখতে পান, সেটি আসলে মানুষের পায়ের অংশ। এরপর পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই দেহের আরও চারটি টুকরো উদ্ধার করে। স্থানীয়রা জানান, টুকরোগুলো দেখে মনে হয়েছে, সেগুলো বাসার ফ্রিজে সংরক্ষণ করা ছিল। পলিথিন মোড়ানো অবস্থায় এসব অংশগুলো পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ, তবে এখনো কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি।
বরিশাল নগরীতে ধারাবাহিকভাবে ঘটে যাওয়া অপরাধ এবং পুলিশের ভূমিকাহীনতা জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক অস্বস্তি তৈরি করেছে। কাশিপুরে টুকরো টুকরো লাশ উদ্ধার থেকে শুরু করে শহরের অন্যান্য এলাকায় প্রকাশ্যে হামলা এবং চাঁদাবাজির ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, অপরাধীরা দিনের পর দিন আরও সাহসী হয়ে উঠছে।
গত ৯ জানুয়ারি, রাজিব নামে এক যুবককে হত্যা করার উদ্দেশ্যে নগরীর গোরস্থান রোডে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয়। পুলিশ ঘটনা সম্পর্কে সব জেনে নির্লিপ্ত থাকে। এর ঠিক দুই সপ্তাহ পরে, কোতোয়ালি থানার সামনে রনি নামে এক যুবককে নির্মমভাবে কোপানো হয়, অথচ থানায় আশ্রয় নিতেও তার জীবন বাঁচেনি। পুলিশ তখনও চুপ ছিল। এমনকি, অক্সফোর্ড মিশন রোড এবং নাজিরের পোল এলাকায় ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক সহিংসতায়ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা স্পষ্টভাবে নজরে এসেছে।
ইছাকাঠীর বাসিন্দারা এখন রাতে আতঙ্কে ঘুমাতে পারেন না। দেহের টুকরো উদ্ধারের ঘটনায় এলাকার একজন স্থানীয় নেতা রিয়াদ মাহমুদ বলেন, যেকোনো সময়ে ডাক-চিৎকার শুনলেই মনে হয় আবার লাশের টুকরো পাওয়া যাবে। স্থানীয়দের ধারণা, খুনি আশেপাশেই থেকে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে এবং এলাকার প্রতিক্রিয়া দেখেই আনন্দ পাচ্ছে। তল্লাশির সময় পুলিশের উপস্থিতি দেখে স্থানীয়রা যতই স্বস্তি পায় না কেন, তারা বারবার প্রশ্ন তুলছে, কেন হত্যাকারী ধরা পড়ছে না।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার রুনা লায়লা জানিয়েছেন, ৩ দিনে উদ্ধার করা সাতটি টুকরো এক নারীর দেহের অংশ এবং হত্যাকাণ্ডে প্রমাণ মেলে যে খুনি পরিকল্পিতভাবে এসব করেছে। বিভিন্ন বাড়ি, ঝোপঝাড়, রিজার্ভ ট্যাংকসহ সম্ভাব্য স্থানগুলোতে অভিযান চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে গত এক বছরে পুলিশ প্রায় ৩,০০০ জন আসামি গ্রেপ্তার করলেও দুর্বল তদন্ত এবং মামলা পরিচালনায় অদক্ষতার কারণে বেশিরভাগ অপরাধী আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে যাচ্ছে। অপরাধী শনাক্তে সিসিটিভি ফুটেজ থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
নগরবাসীর ক্রমাগত দাবি হচ্ছে, পুলিশ প্রশাসনকে এখন থেকেই জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জনগণের নিরাপত্তা প্রদানে তারা বারবার ব্যর্থ প্রমাণিত হচ্ছে। সুশীল সমাজও একমত, বরিশালে বর্তমানে অপরাধপ্রবণতার এমন অবস্থায় তৎপর ও কঠোর ভূমিকা ছাড়া সংকট দূর হবে না। পুলিশের ঢিলেঢালা কার্যক্রম এবং অপরাধীদের প্রকাশ্য দৌরাত্ম্য দেখে তারা হতাশ। তাদের প্রশ্ন, বরিশালের মানুষ কি প্রতি সকালে টুকরো লাশ দেখে দিন শুরু করবে।
বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নগরবাসী অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপের দাবি করছে। তারা চায়, বরিশালের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। সুষ্ঠু তদন্ত, কার্যকর পুলিশিং এবং অপরাধীদের।