London ১২:০৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৫, ১৬ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম:
দেশে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ সোনারগাঁও টেক্সটাইলসের দ্বিতীয় প্রান্তিক প্রকাশ পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণ হবে সব ইবতেদায়ি মাদরাসা আশ্বাস যুগ্ম সচিবের অবশেষে ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নানিয়ারচরে সিলেট-চট্টগ্রাম ফ্রেন্ডশিপ ফাউন্ডেশনের শীতবস্ত্র বিতরণ শকুনদের টার্গেট শিক্ষার্থীদের ঐক্য নষ্ট করা: আজহারী শিক্ষার্থীর মুখ চেপে ধরা সেই পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেপ্তার উড়োজাহাজ বিধ্বস্তে ১৭৯ জন নিহত, পাখায় মিলল পাখির পালক সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক ছেড়ে উঠে গেলেন নেতারা, বন্ধ থাকবে ট্রেন ভারতীয় নারীর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা বলে প্রচার রিউমার স্ক্যানার

পাঠ্যপুস্তক সমন্বয় কমিটি বাতিলের পর বিতর্ক, সমালোচনা

পাঠ্যপুস্তক সংশোধন এবং পরিমার্জন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে ১০ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ফাইল

বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ সমন্বয়ের লক্ষ্যে গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিল করার পর সিদ্ধান্তটি নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, এটা সরকারের দুর্বলতার প্রকাশ।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় গতকাল শনিবার এই কমিটি বাতিল ঘোষণা করে। এর আগে কমিটির দুজন সদস্যকে নিয়ে আপত্তি তোলে কিছু ধর্মভিত্তিক সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। সমন্বয় কমিটির যে দুই সদস্যকে নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে, তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন।

অন্যদিকে কমিটিতে কমপক্ষে দুজন আলেমকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য দাবি তুলেছে জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দল ও সংগঠন।

এরপর পুরো কমিটিই বাতিল ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই দিন বিকেলেই ‘শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকবৃন্দ’-এর ব্যানারে শাহবাগে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তাতে সরকারের সিদ্ধান্তকে নতজানু নীতির বহিঃপ্রকাশ বলে বক্তারা মন্তব্য করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সমালোচনা চলছে।

বিষয়টি নিয়ে আজ রোববার শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ সমন্বয়ের জন্য অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়েছিল। সেটাই ভুলবশত প্রজ্ঞাপন আকারে চলে যায়। এ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল, এ জন্যই কমিটি বাতিল করা হয়েছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের করা নতুন শিক্ষাক্রম অব্যাহত না রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, ২০১২ সালের পুরোনো শিক্ষাক্রম অনুযায়ী আগামী বছর পাঠ্যবই দেওয়া হবে। ২০২৬ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করে বই দেওয়ার পরিকল্পনাও আছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রমতে, আগামী বছর চতুর্থ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রমের পরিবর্তে ২০১২ সালে প্রণীত শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি পাঠ্যবই পাবে শিক্ষার্থীরা। তবে বইয়ের বিষয়বস্তুতে কিছু পরিবর্তন হবে। বিশেষ করে ইতিহাসভিত্তিক বিষয়ে বেশি পরিবর্তন হচ্ছে। দু-একটি নতুন গল্পও যুক্ত হতে পারে।

এনসিটিবি সূত্র বলছে, পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই আছে। সেই বই পরিমার্জন করে ছাপার উপযোগী করা হচ্ছে। কাজটি করছেন ৫০ জনের বেশি বিশেষজ্ঞ। তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক এবং শিক্ষা নিয়ে কাজ করা একাধিক ব্যক্তি যুক্ত হয়েছেন।

সমন্বয় কমিটিতে কারা ছিলেন

১৫ সেপ্টেম্বর এনসিটিবি প্রণীত ও মুদ্রিত সব পাঠ্যপুস্তক সংশোধন এবং পরিমার্জন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে ১০ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খ ম কবিরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে গঠিত ওই কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাসুদ আখতার খান, এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান, সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী, সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক এ এফ এম সারোয়ার জাহান, গবেষক রাখাল রাহা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. ইয়ানুর রহমান (সদস্যসচিব)।

এর মধ্যে অধ্যাপক সামিনা লুৎফা ও অধ্যাপক কামরুল হাসানকে নিয়ে আপত্তি তোলে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি সংগঠন। তাঁদের ‘ইসলামবিদ্বেষী’ বলে দাবি করে তারা।

বিষয়টি নিয়ে অধ্যাপক কামরুল হাসানের মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি খুবই বিব্রতকর বিষয়। এ ব্যাপারে আমি কথা বলতে চাই না।’

অধ্যাপক সামিনা লুৎফা ও অধ্যাপক কামরুল হাসান আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সক্রিয় ছিলেন। তাঁদের ‘ইসলামবিদ্বেষী’ দাবি করে বক্তব্য দেওয়ার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন অনেকে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ ঘটনায় দুই শিক্ষকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। তাঁদের নিরাপদে চলাচলের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা আজ একটি প্রতিবাদ স্মারকে বলেছেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তাঁরা সবার দাবিদাওয়ার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা পোষণ করেন। কিন্তু তাঁরা অধ্যাপক সামিনা লুৎফাকে অন্যায়ভাবে ‘ইসলামবিদ্বেষী’ বলার বিরোধিতা করছেন। শিক্ষার্থীরা আরও বলেছেন, অধ্যাপক সামিনা লুৎফা সব ধর্ম ও মতের প্রতি সহনশীল এবং যথাযথ শ্রদ্ধাবোধ লালন করে থাকেন।

যা বললেন শিক্ষা উপদেষ্টা

শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন , সময় কম, তাই পুরোনো শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তকে ভাষাগত ও সংবেদনশীল বিষয়ে থাকলে তা দ্রুত সংশোধনের লক্ষ্যে প্রতিটি বিষয়ের জন্য বিশেষজ্ঞ শিক্ষকেরা কাজ করেছেন। যার মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষক যেমন আছেন, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও রয়েছেন। এই কাজের সমন্বয়ের জন্য অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়েছিল। সেটাই ভুলবশত প্রজ্ঞাপন আকারে চলে যায়। বাস্তবে এ ধরনের কমিটির কার্যকরিতা নেই।

অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। সেখানে এটি মনে করা হচ্ছে যে এই কমিটিই বোধ হয় শিক্ষাক্রম সংস্কার কমিটি, তাদের হাতেই বোধ হয় দায়িত্ব। আসলে এটি শিক্ষাক্রম সংস্কার কমিটি নয়। তিনি বলেন, দাবিদাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সমন্বয় কমিটি বাতিল করা হয়নি; বরং বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল, এ জন্য বাতিল করা হয়েছে।

কমিটির আদেশে সমন্বয় কমিটির আটটি কাজের কথা বলা হয়েছিল। যার মধ্যে ছিল পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়েছে কি না, তা যাচাই, প্রণীত পাণ্ডুলিপিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জন, বিষয়বস্তু, লেখার উদ্দেশ্য, লেখার মান, রচনার পরিমাণ, ভাষা ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে পাণ্ডুলিপিকে প্রকাশযোগ্য ও মানসম্মত করা। রাষ্ট্রীয় দর্শন, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় মতাদর্শ ও নৈতিক মূল্যবোধ যথাযথ আছে কি না, তা যাচাই করা, পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু এবং ছবি, তথ্য ইত্যাদি সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে স্পর্শকাতর বলে প্রতীয়মান হলে সেগুলো চিহ্নিত করে তার বিপরীতে মতামত দেওয়াসহ আরও কয়েকটি বিষয় দেখার কথা ছিল এই কমিটির।

‘এটি খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত হবে’

বিগত আওয়াম লীগ সরকারের আমলে ২০১৭ সালে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনের প্রস্তাব অনুযায়ী তখনকার পাঠ্যপুস্তকে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছিল সরকার। বিতর্কের মুখে চলতি বছরের সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে ‘শরীফার গল্প’ শীর্ষক বহুল আলোচিত গল্পটি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর পরিবর্তে নতুন আরেকটি গল্প সংযোজন করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই সরকার এসেছে। তাদের প্রতি জনগণের আস্থা ও প্রত্যাশা ব্যাপক। পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনে সমন্বয় কমিটি বাতিলের মাধ্যমে সরকার সেটির (আস্থা ও প্রত্যাশা) ওপর নিজেই আঘাত করল। তিনি বলেন, এই কমিটি নিশ্চয়ই সরকার বুঝেশুনে করেছিল। সেখানে বাইরের নানা কথাবার্তা বা মিথ্যাচার ও হিংসামিশ্রিত প্রচারণার পর কমিটি বাতিলের মাধ্যমে সরকারের দুর্বলতাই প্রকাশিত হলো। এটা গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও শিক্ষাসংস্কারের পথে এটি খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত হবে।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৩:৩৭:৫২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
৫০
Translate »

পাঠ্যপুস্তক সমন্বয় কমিটি বাতিলের পর বিতর্ক, সমালোচনা

আপডেট : ০৩:৩৭:৫২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পাঠ্যপুস্তক সংশোধন এবং পরিমার্জন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে ১০ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ফাইল

বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ সমন্বয়ের লক্ষ্যে গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিল করার পর সিদ্ধান্তটি নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, এটা সরকারের দুর্বলতার প্রকাশ।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় গতকাল শনিবার এই কমিটি বাতিল ঘোষণা করে। এর আগে কমিটির দুজন সদস্যকে নিয়ে আপত্তি তোলে কিছু ধর্মভিত্তিক সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। সমন্বয় কমিটির যে দুই সদস্যকে নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে, তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন।

অন্যদিকে কমিটিতে কমপক্ষে দুজন আলেমকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য দাবি তুলেছে জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দল ও সংগঠন।

এরপর পুরো কমিটিই বাতিল ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই দিন বিকেলেই ‘শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকবৃন্দ’-এর ব্যানারে শাহবাগে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তাতে সরকারের সিদ্ধান্তকে নতজানু নীতির বহিঃপ্রকাশ বলে বক্তারা মন্তব্য করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সমালোচনা চলছে।

বিষয়টি নিয়ে আজ রোববার শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ সমন্বয়ের জন্য অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়েছিল। সেটাই ভুলবশত প্রজ্ঞাপন আকারে চলে যায়। এ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল, এ জন্যই কমিটি বাতিল করা হয়েছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের করা নতুন শিক্ষাক্রম অব্যাহত না রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, ২০১২ সালের পুরোনো শিক্ষাক্রম অনুযায়ী আগামী বছর পাঠ্যবই দেওয়া হবে। ২০২৬ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করে বই দেওয়ার পরিকল্পনাও আছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রমতে, আগামী বছর চতুর্থ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রমের পরিবর্তে ২০১২ সালে প্রণীত শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি পাঠ্যবই পাবে শিক্ষার্থীরা। তবে বইয়ের বিষয়বস্তুতে কিছু পরিবর্তন হবে। বিশেষ করে ইতিহাসভিত্তিক বিষয়ে বেশি পরিবর্তন হচ্ছে। দু-একটি নতুন গল্পও যুক্ত হতে পারে।

এনসিটিবি সূত্র বলছে, পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই আছে। সেই বই পরিমার্জন করে ছাপার উপযোগী করা হচ্ছে। কাজটি করছেন ৫০ জনের বেশি বিশেষজ্ঞ। তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক এবং শিক্ষা নিয়ে কাজ করা একাধিক ব্যক্তি যুক্ত হয়েছেন।

সমন্বয় কমিটিতে কারা ছিলেন

১৫ সেপ্টেম্বর এনসিটিবি প্রণীত ও মুদ্রিত সব পাঠ্যপুস্তক সংশোধন এবং পরিমার্জন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে ১০ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খ ম কবিরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে গঠিত ওই কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাসুদ আখতার খান, এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান, সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী, সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক এ এফ এম সারোয়ার জাহান, গবেষক রাখাল রাহা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. ইয়ানুর রহমান (সদস্যসচিব)।

এর মধ্যে অধ্যাপক সামিনা লুৎফা ও অধ্যাপক কামরুল হাসানকে নিয়ে আপত্তি তোলে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি সংগঠন। তাঁদের ‘ইসলামবিদ্বেষী’ বলে দাবি করে তারা।

বিষয়টি নিয়ে অধ্যাপক কামরুল হাসানের মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি খুবই বিব্রতকর বিষয়। এ ব্যাপারে আমি কথা বলতে চাই না।’

অধ্যাপক সামিনা লুৎফা ও অধ্যাপক কামরুল হাসান আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সক্রিয় ছিলেন। তাঁদের ‘ইসলামবিদ্বেষী’ দাবি করে বক্তব্য দেওয়ার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন অনেকে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ ঘটনায় দুই শিক্ষকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। তাঁদের নিরাপদে চলাচলের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা আজ একটি প্রতিবাদ স্মারকে বলেছেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তাঁরা সবার দাবিদাওয়ার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা পোষণ করেন। কিন্তু তাঁরা অধ্যাপক সামিনা লুৎফাকে অন্যায়ভাবে ‘ইসলামবিদ্বেষী’ বলার বিরোধিতা করছেন। শিক্ষার্থীরা আরও বলেছেন, অধ্যাপক সামিনা লুৎফা সব ধর্ম ও মতের প্রতি সহনশীল এবং যথাযথ শ্রদ্ধাবোধ লালন করে থাকেন।

যা বললেন শিক্ষা উপদেষ্টা

শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন , সময় কম, তাই পুরোনো শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তকে ভাষাগত ও সংবেদনশীল বিষয়ে থাকলে তা দ্রুত সংশোধনের লক্ষ্যে প্রতিটি বিষয়ের জন্য বিশেষজ্ঞ শিক্ষকেরা কাজ করেছেন। যার মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষক যেমন আছেন, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও রয়েছেন। এই কাজের সমন্বয়ের জন্য অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়েছিল। সেটাই ভুলবশত প্রজ্ঞাপন আকারে চলে যায়। বাস্তবে এ ধরনের কমিটির কার্যকরিতা নেই।

অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। সেখানে এটি মনে করা হচ্ছে যে এই কমিটিই বোধ হয় শিক্ষাক্রম সংস্কার কমিটি, তাদের হাতেই বোধ হয় দায়িত্ব। আসলে এটি শিক্ষাক্রম সংস্কার কমিটি নয়। তিনি বলেন, দাবিদাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সমন্বয় কমিটি বাতিল করা হয়নি; বরং বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল, এ জন্য বাতিল করা হয়েছে।

কমিটির আদেশে সমন্বয় কমিটির আটটি কাজের কথা বলা হয়েছিল। যার মধ্যে ছিল পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়েছে কি না, তা যাচাই, প্রণীত পাণ্ডুলিপিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জন, বিষয়বস্তু, লেখার উদ্দেশ্য, লেখার মান, রচনার পরিমাণ, ভাষা ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে পাণ্ডুলিপিকে প্রকাশযোগ্য ও মানসম্মত করা। রাষ্ট্রীয় দর্শন, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় মতাদর্শ ও নৈতিক মূল্যবোধ যথাযথ আছে কি না, তা যাচাই করা, পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু এবং ছবি, তথ্য ইত্যাদি সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে স্পর্শকাতর বলে প্রতীয়মান হলে সেগুলো চিহ্নিত করে তার বিপরীতে মতামত দেওয়াসহ আরও কয়েকটি বিষয় দেখার কথা ছিল এই কমিটির।

‘এটি খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত হবে’

বিগত আওয়াম লীগ সরকারের আমলে ২০১৭ সালে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনের প্রস্তাব অনুযায়ী তখনকার পাঠ্যপুস্তকে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছিল সরকার। বিতর্কের মুখে চলতি বছরের সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে ‘শরীফার গল্প’ শীর্ষক বহুল আলোচিত গল্পটি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর পরিবর্তে নতুন আরেকটি গল্প সংযোজন করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই সরকার এসেছে। তাদের প্রতি জনগণের আস্থা ও প্রত্যাশা ব্যাপক। পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনে সমন্বয় কমিটি বাতিলের মাধ্যমে সরকার সেটির (আস্থা ও প্রত্যাশা) ওপর নিজেই আঘাত করল। তিনি বলেন, এই কমিটি নিশ্চয়ই সরকার বুঝেশুনে করেছিল। সেখানে বাইরের নানা কথাবার্তা বা মিথ্যাচার ও হিংসামিশ্রিত প্রচারণার পর কমিটি বাতিলের মাধ্যমে সরকারের দুর্বলতাই প্রকাশিত হলো। এটা গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও শিক্ষাসংস্কারের পথে এটি খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত হবে।