London ০৪:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পদ্ধতিগত সংস্কার ছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘন থামবে না হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

অনলাইন ডেস্ক

বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হলেও ‘পদ্ধতিগত সংস্কার’ ছাড়া ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনে’র চর্চা একই থাকবে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ, সরকারি বাহিনীর ‘নির্যাতন’; জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা; ‘গুম’ এবং নির্যাতন; অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার; গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা; নারীর অধিকার; রোহিঙ্গা শরণার্থী; লিঙ্গ সমতা; শ্রম অধিকারের মত বিষয়গুলো মোটা দাগে তুলে ধরে ‘স্থায়ী’ সংস্কারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাই মাসের আন্দোলনে সহিংসতা এবং শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর ‘প্রতিশোধমূলক সহিংসতায়’ প্রায় ১ হাজার মানুষের প্রাণ গেছে, যাদের মধ্যে ১০০ জনের বেশি শিশু রয়েছে।

শেখ হাসিনার শাসন অবসান হলেও, অগাস্ট থেকে নিরাপত্তা বাহিনী ‘হাসিনার প্রশাসনের মত একই ধরনের’ নির্যাতন করছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থক এবং বিগত সরকারের পক্ষের হিসেবে পরিচিত সাংবাদিকদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং অসংখ্য ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ আসামির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের কথা তুলে ধরে উদ্বেগ জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।

গণ-অভ্যত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা ফিরিয়ে আনতে কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, সে কথাও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

স্থায়ী সংস্কারের তাগিদ দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, সেটা না হলে বাংলাদেশে এ চর্চাগুলো অব্যাহত থাকবে।

প্রতিবেদনে জুলাই আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়াদের মুক্তি এবং তদন্তের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং দল পাঠানোর বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি শেখ হাসিনার আমলে গুম, খুনের মত অভিযোগের বিষয়গুলোও এসেছে।

জুলাই অভ্যুত্থান দমাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিগত সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বিচারের উদ্যোগের বিষয়টি তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইসিটি ন্যায়বিচারের মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হয়েছে বলে অতীতে অভিযোগ উঠেছে এবং অন্তর্বর্তী সরকার আইন সংশোধন করে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করার চেষ্টা করলেও এখনও যথাযথ আইনি সুরক্ষার অভাব রয়ে গেছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ভাষ্য, এ আইনে এখনো মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়ে গেছে, যা ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন’।

প্রতিবেদনে গেল জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিরোধী দলগুলোর কয়েক হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার এবং নির্বাচন বয়কটের বিষয় তুলে ধরে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার টানা চতুর্থবারের মতো দায়িত্ব গ্রহণের নির্বাচন ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না’।

ওই নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জাতিসংঘের সমর্থন না থাকলেও চীন, রাশিয়া এবং ভারতের তরফ থেকে হাসিনাকে অভিনন্দন জানানোর বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।

সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবি শুরু হওয়া বিক্ষোভকালে দেশব্যাপী ইন্টারনেট বন্ধ, তথ্য প্রবাহ সীমিত করা এবং ‘দেখামাত্র গুলির’ আদেশ দিয়ে কারফিউ জারির সমালোচনা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এছাড়া প্রতিবেদনে সনাতনী, আহমাদিয়া মুসলিম এবং জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দোকানপাট, বাড়িঘর এবং সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়ে হামলা চালানো হয়। এসব হামলা ও সহিংসতায় ২০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।

হামলা ও সহিংসতার বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি মুসলিমদের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের রক্ষা এবং হামলার সমালোচনার বিষয়গুলোও তুলে ধরা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংসতার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষক এবং সাংবাদিকদের এই এলাকায় প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিক্ষোভে সেনাবাহিনীর গুলিতে চারজন নিহতের সমালোচনা করা হয়।

বরাবরের মতোই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘গুমের’ বিষয়টি।

মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকারে’র বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসিনা সরকারের অধীনে ৭০০ জনের বেশি মানুষকে ‘গুম’ করা হয়েছিল। কয়েকজনকে পরবর্তীতে মুক্তি দিয়ে আদালতে হাজির করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে কয়েকজন। এরপর এখনও ১০০ জনের মত ‘নিখোঁজ’ রয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে চলা ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতির’ সমালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিক্ষোভের সময় পুলিশ হেফাজতে ছাত্রদের নির্যাতনের অভিযোগ আছে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে নির্যাতনের অভিযোগে খুব কমই তদন্ত বা বিচার করা হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বার্ষিক এ প্রতিবেদনে হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে বাংলাদেশে ‘সম্পদের অসম বণ্টন’ নিয়ে।

তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সত্ত্বেও ১৫-২৪ বছর বয়সী তরুণদের বেকারত্বের হার এই অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি। নারীদের ক্ষেত্রে এ হার ৪২ শতাংশ, যা লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনে বিশ্বব্যাপী তরুণদের বেকারত্বের হারে সর্বোচ্চ।

জীবনযাত্রার ব্যয় এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকলেও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য প্রতিকারের ব্যবস্থা রয়েছে সামান্যই।

 

বাংলাদেশে গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিস্থিতি তুলে ধরে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট (পূর্বের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট) নিপীড়নের ধারাবিহকতা দিয়েছে। এটি রাজনৈতিক সমালোচকদের অপরাধী করা এবং জেলে পাঠানোর ব্যাপক ক্ষমতা দেয়।

একই সঙ্গে বাকস্বাধীনতা রক্ষা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনাকে স্বাগত জানানোর বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা এবং প্রায় ২০০ প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিলের বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে।

জুলাই অভ্যুত্থানে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে তাদের প্রতিনিধিত্ব ‘সেভাবে হয়নি’ বলে মনে করছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

তারা বলছে, বাংলাদেশে যৌন ও লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা ব্যাপক, এখানে নারী সুরক্ষা বা ন্যায়বিচারের সুযোগ খুবই কম।

গত বছরের মধ্যবর্তী সময়ে সহিংসতার কারণে মিয়ানমার থেকে আরও ১৮ হাজার রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয়ের আবেদন নাকচের সমালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কনভেনশনের বিধান অনুযায়ী, কেউ নিপীড়ন, নির্যাতন বা অন্যান্য খারাপ পরিস্থিতির ঝুঁকির মুখোমুখি থাকলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না, এমন নিয়ম বাংলাদেশের মানার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

একই সঙ্গে শরণার্থীদের নিজ দেশে পুর্নবাসনে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতিশ্রতি এবং ক্যাম্পে তাদের অনিশ্চিত জীবন ও সহিংসতার বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।

বাংলাদেশে লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে চলমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে কোনো আইনি সুরক্ষা না থাকার কথা তুলে ধরে সমকামী, উভকামী এবং ট্রান্সজেন্ডারদের (এলজিবিটি) ওপর সহিংসতার হুমকির কথাও তুলে ধরা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

 

এছাড়াও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি।

তাতে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশে কোম্পানিগুলো তাদের কর্মীদের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।”

গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকদের আন্দোলনকালে তাদের ওপর পুলিশের সহিংসতা, বিপজ্জনক জাহাজ ভাঙা শিল্প এবং এ খাতে শ্রম ও পরিবেশগত বিধি লঙ্ঘনের বিষয়েও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

পাশাপাশি তুলে ধরা হয়েছে শ্রমিক সংগঠনের স্বাধীনতার অভাব, শ্রমিকদের সুরক্ষা না থাকা এবং শ্রম আইন সংশোধন করতে না পারার বিষয়টি।

একই সঙ্গে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতাসহ সকল সহিংসতা এবং হয়রানি বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ‘ব্যর্থতার’ কথা তুলে ধরেছে প্রতিবেদনে।

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৪:৩০:১১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৫
Translate »

পদ্ধতিগত সংস্কার ছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘন থামবে না হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

আপডেট : ০৪:৩০:১১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৫

বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হলেও ‘পদ্ধতিগত সংস্কার’ ছাড়া ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনে’র চর্চা একই থাকবে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ, সরকারি বাহিনীর ‘নির্যাতন’; জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা; ‘গুম’ এবং নির্যাতন; অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার; গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা; নারীর অধিকার; রোহিঙ্গা শরণার্থী; লিঙ্গ সমতা; শ্রম অধিকারের মত বিষয়গুলো মোটা দাগে তুলে ধরে ‘স্থায়ী’ সংস্কারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাই মাসের আন্দোলনে সহিংসতা এবং শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর ‘প্রতিশোধমূলক সহিংসতায়’ প্রায় ১ হাজার মানুষের প্রাণ গেছে, যাদের মধ্যে ১০০ জনের বেশি শিশু রয়েছে।

শেখ হাসিনার শাসন অবসান হলেও, অগাস্ট থেকে নিরাপত্তা বাহিনী ‘হাসিনার প্রশাসনের মত একই ধরনের’ নির্যাতন করছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থক এবং বিগত সরকারের পক্ষের হিসেবে পরিচিত সাংবাদিকদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং অসংখ্য ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ আসামির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের কথা তুলে ধরে উদ্বেগ জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।

গণ-অভ্যত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা ফিরিয়ে আনতে কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, সে কথাও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

স্থায়ী সংস্কারের তাগিদ দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, সেটা না হলে বাংলাদেশে এ চর্চাগুলো অব্যাহত থাকবে।

প্রতিবেদনে জুলাই আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়াদের মুক্তি এবং তদন্তের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং দল পাঠানোর বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি শেখ হাসিনার আমলে গুম, খুনের মত অভিযোগের বিষয়গুলোও এসেছে।

জুলাই অভ্যুত্থান দমাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিগত সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বিচারের উদ্যোগের বিষয়টি তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইসিটি ন্যায়বিচারের মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হয়েছে বলে অতীতে অভিযোগ উঠেছে এবং অন্তর্বর্তী সরকার আইন সংশোধন করে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করার চেষ্টা করলেও এখনও যথাযথ আইনি সুরক্ষার অভাব রয়ে গেছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ভাষ্য, এ আইনে এখনো মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়ে গেছে, যা ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন’।

প্রতিবেদনে গেল জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিরোধী দলগুলোর কয়েক হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার এবং নির্বাচন বয়কটের বিষয় তুলে ধরে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার টানা চতুর্থবারের মতো দায়িত্ব গ্রহণের নির্বাচন ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না’।

ওই নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জাতিসংঘের সমর্থন না থাকলেও চীন, রাশিয়া এবং ভারতের তরফ থেকে হাসিনাকে অভিনন্দন জানানোর বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।

সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবি শুরু হওয়া বিক্ষোভকালে দেশব্যাপী ইন্টারনেট বন্ধ, তথ্য প্রবাহ সীমিত করা এবং ‘দেখামাত্র গুলির’ আদেশ দিয়ে কারফিউ জারির সমালোচনা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এছাড়া প্রতিবেদনে সনাতনী, আহমাদিয়া মুসলিম এবং জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দোকানপাট, বাড়িঘর এবং সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়ে হামলা চালানো হয়। এসব হামলা ও সহিংসতায় ২০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।

হামলা ও সহিংসতার বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি মুসলিমদের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের রক্ষা এবং হামলার সমালোচনার বিষয়গুলোও তুলে ধরা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংসতার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষক এবং সাংবাদিকদের এই এলাকায় প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিক্ষোভে সেনাবাহিনীর গুলিতে চারজন নিহতের সমালোচনা করা হয়।

বরাবরের মতোই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘গুমের’ বিষয়টি।

মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকারে’র বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসিনা সরকারের অধীনে ৭০০ জনের বেশি মানুষকে ‘গুম’ করা হয়েছিল। কয়েকজনকে পরবর্তীতে মুক্তি দিয়ে আদালতে হাজির করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে কয়েকজন। এরপর এখনও ১০০ জনের মত ‘নিখোঁজ’ রয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে চলা ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতির’ সমালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিক্ষোভের সময় পুলিশ হেফাজতে ছাত্রদের নির্যাতনের অভিযোগ আছে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে নির্যাতনের অভিযোগে খুব কমই তদন্ত বা বিচার করা হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বার্ষিক এ প্রতিবেদনে হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে বাংলাদেশে ‘সম্পদের অসম বণ্টন’ নিয়ে।

তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সত্ত্বেও ১৫-২৪ বছর বয়সী তরুণদের বেকারত্বের হার এই অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি। নারীদের ক্ষেত্রে এ হার ৪২ শতাংশ, যা লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনে বিশ্বব্যাপী তরুণদের বেকারত্বের হারে সর্বোচ্চ।

জীবনযাত্রার ব্যয় এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকলেও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য প্রতিকারের ব্যবস্থা রয়েছে সামান্যই।

 

বাংলাদেশে গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিস্থিতি তুলে ধরে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট (পূর্বের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট) নিপীড়নের ধারাবিহকতা দিয়েছে। এটি রাজনৈতিক সমালোচকদের অপরাধী করা এবং জেলে পাঠানোর ব্যাপক ক্ষমতা দেয়।

একই সঙ্গে বাকস্বাধীনতা রক্ষা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনাকে স্বাগত জানানোর বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা এবং প্রায় ২০০ প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিলের বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে।

জুলাই অভ্যুত্থানে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে তাদের প্রতিনিধিত্ব ‘সেভাবে হয়নি’ বলে মনে করছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

তারা বলছে, বাংলাদেশে যৌন ও লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা ব্যাপক, এখানে নারী সুরক্ষা বা ন্যায়বিচারের সুযোগ খুবই কম।

গত বছরের মধ্যবর্তী সময়ে সহিংসতার কারণে মিয়ানমার থেকে আরও ১৮ হাজার রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয়ের আবেদন নাকচের সমালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কনভেনশনের বিধান অনুযায়ী, কেউ নিপীড়ন, নির্যাতন বা অন্যান্য খারাপ পরিস্থিতির ঝুঁকির মুখোমুখি থাকলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না, এমন নিয়ম বাংলাদেশের মানার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

একই সঙ্গে শরণার্থীদের নিজ দেশে পুর্নবাসনে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতিশ্রতি এবং ক্যাম্পে তাদের অনিশ্চিত জীবন ও সহিংসতার বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।

বাংলাদেশে লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে চলমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে কোনো আইনি সুরক্ষা না থাকার কথা তুলে ধরে সমকামী, উভকামী এবং ট্রান্সজেন্ডারদের (এলজিবিটি) ওপর সহিংসতার হুমকির কথাও তুলে ধরা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

 

এছাড়াও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি।

তাতে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশে কোম্পানিগুলো তাদের কর্মীদের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।”

গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকদের আন্দোলনকালে তাদের ওপর পুলিশের সহিংসতা, বিপজ্জনক জাহাজ ভাঙা শিল্প এবং এ খাতে শ্রম ও পরিবেশগত বিধি লঙ্ঘনের বিষয়েও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

পাশাপাশি তুলে ধরা হয়েছে শ্রমিক সংগঠনের স্বাধীনতার অভাব, শ্রমিকদের সুরক্ষা না থাকা এবং শ্রম আইন সংশোধন করতে না পারার বিষয়টি।

একই সঙ্গে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতাসহ সকল সহিংসতা এবং হয়রানি বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ‘ব্যর্থতার’ কথা তুলে ধরেছে প্রতিবেদনে।