নেতৃত্বের ভেঙে পড়া প্রতিচ্ছবি ও এক প্রজন্মের প্রতিবাদ

আজকের তরুণ প্রজন্ম বড় হয়েছে সিনেমার কল্পনার জগতে। তারা শিখেছে ন্যায়ের পক্ষে রুখে দাঁড়াতে, দুর্বলকে রক্ষা করতে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন থাকতে। সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, আইরন ম্যান কিংবা কৃষ-এর মতো চরিত্র তাদের শিখিয়েছে নেতৃত্ব মানে সাহস, আত্মত্যাগ এবং ন্যায়ের পথে থাকা। কিন্তু আজ বাস্তব জীবনে তারা দেখতে পাচ্ছে একেবারেই বিপরীত এক চিত্র—যেখানে নেতৃত্ব মানে কৌশলী অভিনয়, জবাবদিহিহীন আচরণ এবং আত্মরক্ষায় অতিরিক্ত নাটকীয়তা।
একজন তথাকথিত রাষ্ট্রীয় মাস্টারমাইন্ড, যিনি সামান্য একটি প্লাস্টিক বোতলের ধাক্কাতেও ভেঙে পড়েন, সিটি স্ক্যান করাতে ছুটে যান, তিনি এই প্রজন্মের কাছে নেতৃত্বের প্রতীক হতে পারেন না। কারণ নেতৃত্ব মানে শারীরিক বা মানসিক দূর্বলতা নয়; নেতৃত্ব মানে প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়িয়ে সাহসিকতা ও সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়া। আজ সাধারণ জনগণ এবং শিক্ষিত তরুণরা এই নেতৃত্বকে অযোগ্য ও অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করছে।
বাংলাদেশের বর্তমান শাসনব্যবস্থা ক্রমশই ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। ওয়ার্ড পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়েছে দূর্ণীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, দলীয়করণ এবং প্রশাসনিক অকার্যকারিতা। একসময় জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে যাদের দেখা হত, আজ তারা পরিণত হয়েছেন জনগণের নিয়ন্ত্রকে। জনগণের করের টাকায় পরিচালিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষায়।
৫ আগস্টের ঘটনার পর থেকে জাতি প্রত্যক্ষ করেছে, কিভাবে জনরোষ ও প্রতিবাদকে দমন করতে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। কণ্ঠরোধ, মামলা, গ্রেফতার, নির্যাতন—এসব যেন সাধারণের ওপর নিয়ন্ত্রন বজায় রাখার নতুন পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, প্রতিবাদের অধিকার এবং ন্যায়ের দাবিই হওয়া উচিত সরকারের সংবেদনশীলতা পরিমাপের সূচক।
শিক্ষা ব্যবস্থা আজ চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। মেধা নয়, দলীয় আনুগত্যই হয়ে উঠেছে নিয়োগের মানদণ্ড। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা ও শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে দলীয় রাজনীতির আধিপত্যে। স্বাস্থ্যখাতেও দুর্নীতির বলয়, সামান্য চিকিৎসা সেবা পেতে সাধারণ মানুষকে ঘুষ দিতে হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক ক্ষেত্রে রক্ষা নয়, আতঙ্কের প্রতীক হয়ে উঠছে।
তরুণদের মধ্যে এখন একরাশ ক্ষোভ জমে উঠছে। তারা আর ধৈর্য ধরে নেই, তারা প্রশ্ন করতে শিখেছে। তারা নেতৃত্বের কাছে জবাব চাইছে—কেন আমাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের মুখে? কেন যোগ্যরা বঞ্চিত হবে আর দুর্নীতিবাজরা পুরস্কৃত হবে? কেন রাষ্ট্র হবে দুর্বলদের আশ্রয়স্থল নয়, শক্তিশালীদের আয়ুধ?
সমাধান একটাই—সত্যিকার অর্থে জনগণের প্রতিনিধি, সৎ, দক্ষ, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো নেতৃত্বকে ক্ষমতায় আনতে হবে। জনগণের ভোট, মত, ও অধিকারকে যথার্থভাবে সম্মান করতে হবে। প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচার—সবক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। তরুণদের অবজ্ঞা নয়, তাদের নেতৃত্বেই ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে হবে।
আমরা আর নিঃস্ব নেতৃত্ব চাই না। আমরা এমন এক বাংলাদেশ চাই—যেখানে নেতৃত্ব হবে সাহসের, রাষ্ট্র হবে ন্যায়ের, প্রশাসন হবে সেবার, আর রাজনীতি হবে জনগণের কল্যাণে উৎসর্গিত।