ধর্ষণের বিরুদ্ধে স্বপ্ন দেখে আগামীর ভোর

সাম্প্রতিক কালে তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে নাটকের ব্যবহার করছে। বহু দেশের মধ্যে বাংলাদেশও একটি। সাংস্কৃতিক সংগঠন, নাট্যসংগঠন, এনজিও’র নাট্যদল নানাভাবে সমাজের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নাটক উপস্থাপন করে আসছে। কিন্তু তাতে কি লাভ হচ্ছে এই সমাজের? কিছুই না।
সমাজের মানুষেরা জাদুকরের কথায় চোখে কালো রুমাল বেঁধে খেলা দেখিয়ে যাচ্ছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে নারীরা প্রতিনিয়ত মানসিক, শারীরিকভাবে ধর্ষিত হচ্ছে প্রতিক্ষণে। ধর্ষিত মানুষটি কখনো মুখ খুলছে, কখনো সমাজের ভয়ে মুখ খুলছে না।
সমাজ! সমাজ তা নিয়ে মাথা ঘামায় না, ভয় একটায়—আমার সম্ভ্রম গেছে, আমি হয়তো সমাজের কাছে মুখ দেখাতে পারবো না, কিন্তু মুখ খুললেই আমার পরিবারের হয়তো কেউই বেঁচে থাকবে না। এমন পরিস্থিতির মধ্যে কার সাধ্য আছে মুখোমুখি দাঁড়াবার?
সমাজের কর্তৃত্বপরায়ণ প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সম্প্রদায় বিভিন্নভাবে দুর্বলের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন করে যাচ্ছে। ধনিক সম্প্রদায় দরিদ্রের ওপর; শিল্প, মালিক শ্রমিকদের; শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী দেশ, অনুন্নত দেশের; পুরুষ, নারীদের ওপর প্রতিনিয়তই অত্যাচার-নিপীড়ন করে, তাদের মূল্যবোধ জোর করে দুর্বলের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।
নাটক এখন উৎসবভিত্তিক হয়ে গেছে, পথনাটক হারিয়ে গেছে। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার পতনের সময়গুলো সচেতন হয়ে নানা ধরনের নাটক হয়েছে পথে-ঘাটে।
এর প্রতিকার কী হতে পারে? কে ভাববে এই ধর্ষিত মানুষদের জন্য? এখন যেমন অবস্থা তাতে নিজের মুক্তির বিশ্বাস নিজেরই মধ্যে গড়ে তুলতে হবে, নিজের মুক্তির জন্য নিজেকেই লড়তে হবে।
অগাস্টো বোয়াল (Augusto Boal)-এর চিন্তায় অত্যাচারিতদের নাট্যের ঘটনা প্রক্রিয়াতে যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে তা হলো—
১. আমাদের বাস্তবতা (যেখানে নির্যাতন উপস্থিত)
২. নির্যাতন সংজ্ঞায়িতকরণ
৩. নির্যাতন একটি কাহিনি অথবা প্রতীকে রূপান্তরকরণ (যে কাহিনি / প্রতীক বাস্তবসম্মত)
৪. প্রশ্ন উত্থাপন: আমরা কি পরিবর্তন করতে চাই?
৫. কাহিনি / প্রতীক পরিবর্তন (যা বাস্তবসম্মত): এই অনুসন্ধানের ফলে পরিবর্তনের সম্ভাবনাসমূহ স্পষ্ট হয়।
৬. বাস্তবতায় প্রত্যাবর্তন ও পরিবর্তন।
উপরের মাত্র ৬টি প্রশ্ন নিয়ে আজকের নাট্যদল যদি একটি করেও নাটক উপস্থাপন করে তাহলে সাধারণ মানুষ কি একটুও সচেতন হবে না? নিশ্চয়ই হবে। নাটক এখন উৎসবভিত্তিক হয়ে গেছে, পথনাটক হারিয়ে গেছে। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার পতনের সময়গুলো সচেতন হয়ে নানা ধরনের নাটক হয়েছে পথে-ঘাটে।
নাট্যকার নাটক লিখেছেন সমাজের বাস্তবতা নিয়ে। নাটক দিয়ে সমাজের মানুষদের নানাভাবে সচেতন করা সম্ভব, যেমন অগাস্টো বোয়ালের এক নম্বর পদ্ধতি ‘আমাদের বাস্তবতা (যেখান নির্যাতন উপস্থিত)’ তা নিয়ে কথা বলা হয়।
তবে প্রথমেই বলতে হয়, আজকে কেন আমার বোন ধর্ষিত হচ্ছে দিনের আলোতে, রাতের অন্ধকারে! রাষ্ট্রীয়ভাবে কি একবারও ভেবে দেখেছি আজকের সমাজ ব্যবস্থায় সবার হাতে মোবাইল যন্ত্র, যার দ্বারা পৃথিবীর সবকিছুই হাতের মুঠোয়। আমাদের শিক্ষা সু-শিক্ষায় পরিণত না হওয়াতে মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেটের বদৌলতে ছবিগুলোই একমাত্র পাথেয় হয়ে উঠেছে। আর তার কারণেই একশ্রেণির মানুষের বিকৃত মনোভাব এই সমাজকে ঘিরে ধরেছে।
এখন আমাদের সামনে নির্যাতন উপস্থিত। নির্যাতনের দিক অনেক প্রকার আজকের বিষয় যদি নির্বাচন করি ‘ধর্ষণ’ তবে কি খুব একটা দোষের হয়ে যাবে? আমি ঘুম থেকে উঠে দৈনিক খবরের কাগজটা হাতে নিতেই প্রথম সংবাদ ‘আজ…. এতজন ধর্ষিত হয়েছে’ ইত্যাদি।
একদিন, দুইদিন পরে যখন বাড়ির ছোট মেয়েটি বা ছেলেটি প্রশ্ন করে, আচ্ছা ধর্ষণ কী? প্রতিদিন কাগজে এটা লেখা হয় কেন? তখন আপনি কী উত্তর দেবেন? এটিই আমাদের বাস্তবতা যে, ছোট সন্তানের কাছেও মানসিকভাবে আমরা প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হচ্ছি। আমি না হয় সন্তানের কাছে মানসিকভাবে ধর্ষিত হলাম। কিন্তু স্কুল ছাত্রীকে অচেতন করে, চলন্ত বাসে, মেঠোপথ ধরে বাড়ি ফেরার পথে, মোবাইলের ক্যামেরায় ছবি তুলে ভয় দেখিয়ে, এমনকি স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, পিতার সামনে কন্যাকে… এমন পরিস্থিতিতে এখনো কি জাদুকরের কালো কাপড় চোখে বেঁধে খেলার খেলোয়াড় হয়ে থাকবো?
নাকি সবাই মিলে একবার কণ্ঠ ছেড়ে ডাক দেবো নূরুলদীনের মতো—‘… জাগো বাহে কোনঠে সবায়।’ সৈয়দ শামসুল হক নূরুলদীনের সারাজীবন নাটকের মধ্য দিয়ে বলিষ্ঠভাবে বলে গেছেন এই বাংলায় আবার জাগতে হবে সাধারণ মানুষদের। গোল হয়ে আসতে সবাইকে, কাছে এসে একে অপরের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে সবার।
শুধু নাটক করে সমাজের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। তত্ত্বকথা বলে কাউকে পথে আনা সম্ভব নয়। মানুষ এখন বড্ড একরোখা—চাই-চাই-আর চাই! যৌনপল্লী চাই! বিনাশ্রমে অর্থ চাই! কাজ না করে অর্থের দাপটে নেতা হতে চাই! এই চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে আমি একজন ভালোমানুষ হতে চাই।
একদিন, দুইদিন পরে যখন বাড়ির ছোট মেয়েটি বা ছেলেটি প্রশ্ন করে, আচ্ছা ধর্ষণ কী? প্রতিদিন কাগজে এটা লেখা হয় কেন? তখন আপনি কী উত্তর দেবেন?
তবুও বলবো একটা দেশের মানসিক সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে পারে সাংস্কৃতিক কর্মীরাই। এখনো অনেক মানুষ নিজের পকেটের টাকা দিয়ে, একশ্রেণির মানুষের মুখে গালমন্দ খেয়েও নাটক করে যাচ্ছে। তাই বলছি গ্রাম থেকে শহর অবধি যে সত্যিকারের সাংস্কৃতিক কর্মী নাট্যদলগুলো আছে তারা এগিয়ে আসুক, প্রতিদিনের খবরের কাগজের সংবাদ নিয়ে একটি করে ছোট নাটক করুক পথে-ঘাটে-মাঠে।
অন্তত কিছু মানুষতো জানতে পারবে, বুঝতে পারবে আমার কুলাঙ্গার সন্তানরা কী করছে। এমনকি ঘরের সন্তানকে কীভাবে মানুষ করবে তার একটা পথ হয়তো খুঁজে পাবে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ যে জাদুকর কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে খেলা দেখিয়ে যাচ্ছে তার প্রতিবাদে নিজের মনের শক্তি দিয়ে কালো কাপড় খুলে ফেলতে হাবে। সোচ্চার হতে হবে নিজেরই প্রয়োজনে।
নাটকই পারে একমাত্র মানুষকে সচেতন করতে। নাটকের মধ্যে যেমন সংলাপ অপরিহার্য তেমনি নাটকের মধ্যে গানের ব্যবহার, করে আকৃষ্ট করতে পারে মানুষকে। শুধু নাট্যদল দিয়ে মানুষকে সচেতন করা সম্ভব নয়, আমাদের ফিরে আসতে হবে
এলাকায়, সাংস্কৃতিক সংগঠন, পারিবারিক শিক্ষাসহ নিয়মিত খেলাধুলার মধ্যে। এসবের মধ্যে যখন শিশুকাল থেকে বেড়ে উঠবে একটি সন্তান তখন তার চিন্তাভাবনার মধ্যে নিজে গড়ার একটা পথ পাবে। অথচ তারই উল্টো পথে হাঁটছি আমরা।
আমরা আমাদের সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছি যন্ত্রের ডিভাইস, যেখানে আছে হাজার রকমের অনুষঙ্গ। তৃতীয় বিশ্বের মানুষ হয়েও আমাদের একটা ভূখণ্ড আছে, স্বাধীন পতাকা আছে, মায়ের ভাষা আছে—তাই একবার ভাবতেই পারি সবই যখন আমার তখন অভাব কীসের? কার বোনকে ধর্ষণ করছি! সে তো আমারই মায়ের ভাষায় কথা বলে। ও তো কারও না কারও বোন। অথবা আমারও বোন হতে পারে। বাড়ির প্রতিটি মানুষের চেহারার কথা একবার ভাবি।
কল্পনা নিয়ে যায় অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতে সেখান থেকে সৃষ্টি হয় একটা গল্প, কবিতা, নাটক, গান। চোখের সামনে দেখতে পাই চরিত্রগুলো—স্কুলের পোশাক পড়লে তাকে শিক্ষার্থী বলি। পুলিশ তার পোশাকে, প্রমাণ আচারণে, কিন্তু একজন ধর্ষককে কী দেখে চিনবে? সে সাধারণ মানুষের ভেতরে এমনভাবে মিশে আছে—ফলে তাকে চেনা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাই একসাথে রুখে দাঁড়াতে হবে ধর্ষকের বিরুদ্ধে। যারা স্বপ্ন দেখে সুন্দর একটা ভোরের। একটা ভোরে দোয়েল পাখি তার গান গাইবে বাড়ির কামিনী গাছের ডালে বসে।
ভোরের দোয়েলের সাথে সুর মিলিয়ে ডাক দিতে হবে নূরুলদীনের মতো, ‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’।
ড. আরিফ হায়দার ।। অধ্যাপক, নাট্যকলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়