দেশ বাঁচানোর জন্য মরতেও প্রস্তুত আছি : কৃষক বাবলু
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্তে কয়েকদিন ধরে বিএসএফের কাঁটাতারের বেড়া ও রাস্তা নির্মাণকে কেন্দ্র করে চলছিল উত্তেজনা। এ সময় বিজিবিকে সহযোগিতা করে এলাকাবাসী। তাদের মধ্যে বিজিবির সঙ্গে মাটির বাঙ্কারের পেছনে হাসুয়া হাতে অবস্থান নেন স্থানীয় কৃষক বাবলু। মুহূর্তেই নেট দুনিয়ার ছড়িয়ে পড়ে তার সেই ছবিটি। এমন অকুতোভয় দেশপ্রেমের জন্য দেশবাসীর প্রশংসায় ভাসেন কৃষক বাবুল।
বাবলু শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের কালীগঞ্জ গ্রামের বাসিন্দা। শনিবার (১১ জানুয়ারি) সকালে বাবলু বাড়িতে গেলে তার স্ত্রী বলেন, তিনি সীমান্তে গেছেন। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয়দের সঙ্গে কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া সীমান্তে উত্তেজনার বিষয়গুলো গল্পচ্ছলে তাদেরকে শুনাচ্ছেন।
বাবলু বলেন, ভারত প্রথমে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার চেষ্টা করে। এতে বিজিবি বাধা দেয়। পরে বিজিবি-বিএসএফের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ভারতের নাগরিকরা বিজিবিকে গালিগালাজ করে। পরে দ্বিতীয় দিন আরও কঠিন উত্তেজনাকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ভারত তাদের প্রান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার জন্য মর্চা (গর্ত) করতে শুরু করে। তখন বিজিবি আমাদের এলাকাবাসীর সহযোগিতা কামনা করে। আমরা তখন কোদাল দিয়ে মর্চা (গর্ত) খুড়ি এবং বিজিবির পাশে থাকি। এ ছাড়া ভারত বেড়া দিলে বাংলাদেশিদের অনেক সমস্যা হবে। কারণ তারা নিয়ম ভেঙে ৫০ গজের ভেতর বেড়া দিচ্ছিল। আর আমাদের কৃষক ভাইয়েরা যদি জমিতে কাজে যায় তাহলে তাদের রেঞ্জের ভেতরে থাকবে। তখন তারা গুলি করে সহজেই মরদেহ টেনে নিতে পারবে। এজন্য আমাদের বর্ডার এলাকার চৌকা বিজিবি বিএসএফকে বাধা দেয়।
উত্তেজনাকর দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি আরও বলেন, বিজিবি আমাদের বলেছিল, আপনারা আমাদের পেছনে থাকেন। কারণ তাদের (ভারতে) পাবলিক আছে তাই আপনারা পাশে থাকলে আমাদের সাহস বাড়বে। তারা যদি কাঁটাতারের বেড়া দিতো তাহলে আমাদের বিজিবি কঠিনভাবে বাধা দিতে প্রস্তত ছিল।
জীবন-মৃত্যুর ভয় না করে কেন গেলেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নাই। আমাদের সামনে বিজিবি স্টিলভাবে ছিল। তাতে ইন্ডিয়া যদি কাঁটাতারের বেড়া দিতো তাহলে আমরা আটকে দিতে প্রস্তত থাকবো সবসময়। এ ছাড়া তারা যদি জোড় করে বেড়া দিতো তাহলে দেশ বাঁচানোর জন্য আমরা মরতেও প্রস্তত ছিলাম এবং দেশ বাঁচিয়েই মরবো।
ভারত কাঁটাতারের বেড়া দিলে কী ক্ষতি হবে—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ভারত যদি বেড়া দিতে পারে তাহলে প্রতিদিনই আমাদের লোক মারবে। কারণ তারা এখানে আমাদের রেঞ্জের মধ্যে পাইবে। কৃষক ভাইয়েরা জমিতে কাজ করতে গেলে বর্ডারে তারা রেঞ্জের মধ্যে পেয়ে গুলি করবে। এরপর মরদেহ কাঁটাতারের বেড়ার কাছে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেবে আর বলবে, তার কাটতে আসছিল সে।
হাসুয়া নিয়ে বর্ডার এলাকায় আসার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, বর্ডারে বিজিবি আছে তারপরও যদি বিএসএফ চলে আসে…। তার জন্য আমি সেখানে হাসুয়া নিয়ে প্রস্তত ছিলাম। এ ছাড়া দেশের জন্য কাজ করতে পেরে খুব ভালো লাগছে। আমরা চাই আমাদের দেশ যেন খুব ভালো থাকে।
সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আমরা চাই বিজিবিসহ সবাই যেন দেশ ভালো রাখার বিষয়ে কাজ করে এবং আমার নিজের জন্য চাওয়া বা দাবি জানানোর কিছু নাই। বাংলাদেশের সব জনগণকে যেন সরকার ভালোবাসে সেই কামনা করছি।
বাবুলের স্ত্রী মাস্তারা বেগম বলেন, গন্ডগোল দেখে আমার স্বামী বর্ডারে গিয়ে বিজিবির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যদি তারা (ভারত) হুমকি দেয় তাহলে আমরাও হুমকি দেবো। বিজিবির পাশে গিয়ে দাঁড়াবো, তাদেরকে সহযোগিতা করবো এবং দেশকে রক্ষা করবো।
তিনি আরও বলেন, আমার ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে রেখে আমার স্বামী জীবন দিতে বর্ডারে চলে গিয়েছিলেন। তার কিছু একটা হয়ে গেলে বাচ্চাদের নিয়ে আমাকে একাই থাকতে হতো। তাই সরকার যদি পুরস্কার হিসেবে কিছু একটা দেয় তাহলে আমরা খুশি হবো।
বাবলু ভাতিজা কাজল আরেফিন ওমি বলেন, আমাদের অনেক ভালো লাগছে। কারণ আমরা তাদের অবৈধ কাজে বাধা দিয়েছি। এরপর তারা যদি আবারও আমাদের মানচিত্রের দিকে চোখ তুলে তাকায় তাহলে আমরা এলাকাবাসী পালটা জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তত আছি। দেশের স্বার্থে, মানচিত্রের স্বার্থে নিজের জীবন বিলিয়ে দেবো আমরা। এ ছাড়া তার (বাবলু) এই নজিরবিহীন ঘটনা আমাদের সবার জন্য অনুপ্রেরণা। দেশের জন্য খেটে খাওয়া মানুষের যে দেশপ্রেম ফুঁটে ওঠে তার চিত্র ছিল আমাদের বাবলু চাচা। এখন তিনি এলাকাবাসীর গর্ব, এটা আমাদের জন্য অনেক গর্বের বিষয়।
এলাকার মুদি দোকানদার আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের চৌকা সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়াকে কেন্দ্র করে অনেক দিন থেকে একটি দ্বন্দ্ব চলমান আছে। গত কয়েকদিন আগে ওরা (বিএসএফ) অবৈধভাবে কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছিল। সেখানে বিজিবি বাধা দেয় এবং বিজিবিকে আমরা সাধারণ মানুষ সহযোগিতা করি। কিন্তু তার মধ্যে আমাদের বাবলু মামা ভাইরাল হয়ে যান। আপনাদের মাধ্যমে তাকে সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছে। বাবলু মামা সাহসী মানুষ। তাই আমরা চাই মামাকে যেন কিছু সহযোগিতা করা হয়। তাহলে এটা দেখে আমাদের গ্রামের মানুষ দেশপ্রেমে আরও উদ্বুদ্ধ হবে।
বাবুল আক্তারের প্রতিবেশী আহাদুল ইসলাম আহাদ বলেন, আমাদের এলাকায় বিজিবি-বিএসএফের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ সময় আমরা বিজিবিকে সহযোগিতা করি। এর মধ্যে আমার চাচা বাবলু বিএসএফকে ভয় না পেয়ে সারাক্ষণ বিজিবিকে সাহায্য করে গেছেন। আমরা চাই এলাকাবাসী আমার চাচাকে কিছু পুরস্কার দেওয়া হোক। তাহলে গ্রামবাসী আরও উৎসাহ পাবে।
একটি ফাঁকা জায়গা দেখিয়ে আল-মামুন নামে আরেকজন বলেন, আমার পেছনে যে ফাঁকা জায়গাটি দেখছেন সেই জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব লাগে। বিজিবি বাধা দেয় এবং এখানে আমাদের বাবলু কাকা একটি দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছেন। উনি আমাদের গর্ব। এদিন এলাকাবাসী সবাই এগিয়ে গেছে এবং দেশ রক্ষার্থে আমরা বিজিবিকে সার্পোট করেছি। কিন্তু বাবলু কাকা অনেক সাহসী ভূমিকা নিয়ে সামনের দিকে ছিলেন। আমরা চাই রাষ্ট্রীয় শান্তি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৫৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া বলেন, এটা দুঃসাহসিক। কিন্তু বিজিবি ফেইল না করা পর্যন্ত সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া এরকম ফ্রন্টলাইনে এগিয়ে আসা ঠিক নয়। এই দৃশ্য দেখে অন্য কেউ এমন ঝুঁকি নেওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত না হয়, দেশের জনগণের প্রতি আমার এই আহ্বান থাকবে। এ ছাড়া এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় জনগণ আমাদের পাশে থেকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছে। এজন্য বিজিবি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। স্থানীয় লোকদের আমরা ধন্যবাদ জানাই।