মামলাপ্রতীকী ছবি
দিনাজপুরে গত ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সংঘর্ষের ঘটনায় রবিউল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী নিহত হয়। এ ঘটনায় পৃথকভাবে পাঁচটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় বাদী রবিউলের ভাই। বাকি মামলাগুলোর বাদীর সঙ্গে নিহত রবিউলের কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। এই বাদীদেরই কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে এজাহার থেকে আসামির নাম বাদ দেওয়ার বাণিজ্য শুরু করেছেন। আর এই কাজ করা হচ্ছে হলফনামার (অ্যাফিডেভিট) মাধ্যমে। এর সঙ্গে যোগসাজশ আছে রাজনীতিকদেরও।
রবিউল হত্যার ঘটনায় হওয়া একটি মামলার বাদী রিয়াদ হোসেন নামের এক যুবক। আন্দোলনে তিনিও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তিনি ১০৫ জনের নাম উল্লেখ করে ও ৬০০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেছেন। এই মামলায় আসামি মজিবর রহমান (৫৬) নামের এক ব্যক্তি। গত ২৯ আগস্ট মামলার বাদী রিয়াদ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে এজাহার থেকে নাম বাদ দেওয়ার হলফনামা করেন। মামলার এজাহার থেকে যেন নিজের নাম বাদ দেওয়া হয়, সে জন্য হলফনামার একটি কপি মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জমা দেন মজিবর।
আসামি মজিবর রহমান বলেন, ‘কোনো দিন কোনো রাজনৈতিক দলের মিছিল-মিটিংয়ে আমি যাইনি। এরপরও আমার নাম দিয়েছে। আমার মামলার বাদী যিনি, উনি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “বাবা, তুমি তো আমাকে চেনো না। তাহলে আমার নাম দিলে কেন?” সে বলল, “কে জানি তাঁকে দিতে বলেছে।” আমি হার্টের (হৃদ্রোগ) রোগী। এই বয়সে আমাকে হয়রানি করতেছে। বিগত সরকারের আমলেও কারণ ছাড়াই আমার নামে তিনটি নাশকতা মামলা দিয়েছিল।’
আসামিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের বিষয়ে মামলার বাদী মো. রিয়াদের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করেন এ প্রতিবেদক। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দিনাজপুরের বিভিন্ন থানায় মারধর, হত্যা, লুটপাট, চাঁদাবাজির ঘটনায় ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনায় ভাঙচুর, লুটপাট ও চাঁদাবাজিবিষয়ক মামলা আটটি, হত্যার ঘটনায় পাঁচটি এবং ছয়টি আগের ঘটনায় করা মামলা। এসব মামলার এজাহারে ৮৫১ জনকে এবং অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৪ হাজার ১৫ জনকে। গত রোববার পর্যন্ত পুলিশ এজাহারভুক্ত ১২ জন এবং সন্দেহভাজন ১৩ জনকে এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে।
থানায় ও আদালতে মামলা করার পর থেকে শুরু হয় এজাহার থেকে নাম বাদ দেওয়ার নামে ‘হলফনামা বাণিজ্য’। মজিবরের মতো অনেকেই বাদী কিংবা মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে এজাহার থেকে নাম বাদ দিতে হলফনামা তৈরি করে জমা দিচ্ছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রোববার পর্যন্ত এসব মামলার বাদীরা এজাহারে প্রায় ৪০ জন আসামিকে হলফনামা করে দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আসামির কাছে বাদীরা সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন। টাকার বিনিময়ে বাদীরা হলফনামায় লিখে দিচ্ছেন, ঘটনার সঙ্গে আসামির জড়িত না থাকার কথা কিংবা অজ্ঞতাবশত, অসুস্থতার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম এজাহারে যুক্ত করার কথা। একটি শর্তে উল্লেখ থাকছে মোকদ্দমা থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জামিন, অব্যাহতি কিংবা খালাস পেলে বাদীর কোনো আপত্তি না থাকার কথা।
আইন বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব হলফনামা খুব বেশি জোরালো ভূমিকা রাখে না। এ বিষয়ে দিনাজপুর আইনজীবী সমিতির সদস্য আইনজীবী একরামুল আমীন বলেন, ‘শুনতেছি, অনেকেই মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করে অ্যাফিডেভিট করছেন। এতে খুব একটা লাভ হবে না। কারণ, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি ঘটনার সঙ্গে ওই ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা পান, সে ক্ষেত্রে তিনি তো তাঁকে অব্যাহতি দেবেন না। আইন অনুযায়ী বাদী আদালতে উপস্থিত হয়ে জবানবন্দি দিলে আদালত পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।’ তাঁর মতে, মানুষের মধ্যে একধরনের ভীতি কাজ করছে, আর এই সুযোগটাই হয়তো কেউ কাজে লাগাচ্ছেন।
মামলার এজাহারগুলো ঘেঁটে দেখা গেছে, এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যক্তি আক্রোশ কিংবা পূর্বশত্রুতার জেরেও অনেককে আসামি করার অভিযোগ আছে। একই ব্যক্তির নাম পাঁচ-ছয়টি মামলার এজাহারে যেমন আছে, ঘটনার দিন এলাকায় ছিলেন না, এমন ব্যক্তির নামও আছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এসব মামলার নাম দিয়েছেন ‘রাজনৈতিক মামলা’। কয়েকটি মামলার বিবরণও প্রায় একই ধরনের। ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা যেমন মামলাগুলোর বাদী হয়েছেন, কেউ আবার আহত না হয়েও মামলার বাদী হয়েছেন। বাদী জানেন না তিনি মামলার বাদী হয়েছেন, এমন ঘটনা যেমন আছে, তেমনি জোর করে কাউকে বাদী করা হয়েছে এমন ঘটনাও আছে।
গত এক সপ্তাহে মামলার এজাহার থেকে আসামি হিসেবে নাম বাদ দিতে বাদীর কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে হলফনামা নিয়েছেন, এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। এর মধ্যে একজন ৫ হাজার, তিনজন ১০ হাজার করে এবং দুজন ২৫ হাজার করে মোট ৫০ হাজার টাকা দিয়ে হলফনামা নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা জানান, বাদী নিজে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছে। পরে ওই ব্যক্তিই নোটারি পাবলিকের কাছে নিয়ে হলফনামায় স্বাক্ষর নিয়েছেন।
মামলার বাদী হয়েছেন এমন পাঁচজনের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। এর মধ্যে একটি মামলার বাদী সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত রবিউলের ভাই ফরিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করি। মামলার বিষয়ে আমি কিছু বলব না।’
রবিউল হত্যার ঘটনায় প্রথম মামলাটি করেছিলেন রুহান নামের এক যুবদল নেতা। তিনি জানান, তিনি কাউকে হলফনামা করে দেননি।
হত্যার ঘটনায় আরেকটি মামলা করেন ফাহিম ফয়সাল (২২) নামের এক তরুণ। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনে গিয়ে আহত হয়েছি। আমি মামলা করেছিলাম ২০ জনের নামে। সেখানে জোর করে অন্য নামগুলো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ কে ঢুকিয়ে দিয়েছে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি সমস্যায় আছি। নাম বলতে পারব না। আপনারা খোঁজ নেন। মামলাটা তুলে নিতে চেয়েও এখন পারছি না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় বিএনপির একজন নেতা বলেন, ‘এসব মামলার বিষয়ে বাদীদের চেয়ে আমাদের দলীয় কয়েকজনের লাফালাফি বেশি। তাঁরাই মূলত মামলাগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন। আওয়ামী লীগের যাঁরা অপরাধ করেছেন, মানুষের সঙ্গে অন্যায় করেছেন, তাঁদের আসামি করা হয়েছে, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু কিছু নিরপরাধ মানুষ ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে আসামি হয়েছেন।’
এ বিষয়ে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদ বলেন, ‘ব্যক্তিগত পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত বা সংক্ষুব্ধ হয়ে যাঁরা মামলার বাদী হয়েছেন, সেটি তাঁদের বিষয়। কেউ যদি আসামিদের সঙ্গে কোনো লেনদেন করেন, তার দায়ভার বিএনপি নেবে না। এগুলো ভিত্তিহীন অভিযোগ। এ ধরনের কোনো কথা শুনিনি।’