দিনমজুর থেকে কারখানা মালিক ওলি হুজুর স্বপ্ন দেখেন কৃষিযন্ত্রে ‘স্বনির্ভর’ বাংলাদেশের

একসময় নদীভাঙনে নিঃস্ব হয়ে চুয়াডাঙ্গায় এসে দিনমজুরি করতেন। ছিল না মাথা গোঁজার ঠাঁই। সেই মানুষটিই আজ দেশীয় কৃষিযন্ত্র উৎপাদনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন রোলমডেল হিসেবে। তার প্রতিষ্ঠান থেকে বছরে বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। এরইমধ্যে জিম্বাবুয়ে, নেপাল, ভুটানসহ বেশ কয়েকটি দেশে তার কারখানায় তৈরি কৃষিযন্ত্র স্যাম্পল হিসেবে পাঠিয়েছেন। খুব শিগগির বিদেশে রপ্তানি করবেন এসব যন্ত্রপাতি। যাতে লেখা থাকবে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’।
এই গল্প চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের সরোজগঞ্জ বাজারের এক ক্ষুদ্র কারখানাকে কেন্দ্র করে—যার নাম ‘জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং’। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা মো. ওলি উল্লাহ। যাকে সবাই ‘ওলি হুজুর’ নামেই চেনেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওলি উল্লাহর জন্ম কুমিল্লার দেবীদ্বারে। সেখানে নদীভাঙনে ১৯৮৮ সালে পরিবারসহ সবকিছু হারিয়ে এলাকা ছাড়েন। তখন তার বয়স মাত্র ২৪ বছর। আশ্রয়ের খোঁজে চলে আসেন চুয়াডাঙ্গায়। জীবনের শুরু হয় নির্মম বাস্তবতা দিয়ে—খণ্ডকালীন দিনমজুরি। যে কাজ পেতেন তা-ই করতেন।
একসময় চুয়াডাঙ্গা সদরের সরোজগঞ্জ বাজারের একটি যন্ত্রপাতি মেরামতের দোকানে সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন ওলি উল্লাহ। ধীরে ধীরে যন্ত্রাংশ মেরামত ও তৈরি করার কৌশল আয়ত্তে আনেন। এর চার বছরের মাথায় সিদ্ধান্ত নেন নিজেই একটি ওয়ার্কশপ খুলবেন। কিন্তু ছিল না কোনো বড় পুঁজি। চার হাজার টাকা, অভিজ্ঞতা আর আত্মবিশ্বাস সম্বল করে শুরু করেন ‘জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং’।
জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অগ্রযাত্রা
প্রথমদিকে ‘থ্রেশার মেশিন’ উৎপাদন শুরু করেন ওলি উল্লাহ। কৃষিকাজে ব্যবহৃত এটি এমন একটি যন্ত্র যার মাধ্যমে ফসল কাটার পর ধান, গম বা অন্যান্য শস্যের শীষ থেকে দানা আলাদা করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা ও দক্ষতা দুটোই বাড়তে থাকে। এখন প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করছে ৪০ ধরনের আধুনিক কৃষিযন্ত্র। এর মধ্যে বীজ বপন যন্ত্র, কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, ঘাস ও খড় কাটার মেশিন, আলু উত্তোলন যন্ত্রসহ আরও নানা ধরনের যন্ত্র। দেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করায় এসব যন্ত্রের দাম সাধারণ কৃষকদের নাগালে। উদাহরণস্বরূপ, একটি বিদেশি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের দাম যেখানে ১২ থেকে ২৮ লাখ টাকা, বা তারও বেশি; সেখানে ওলি উল্লাহর তৈরি একই ধরনের যন্ত্র পাওয়া যায় মাত্র ৭ থেকে ৯ লাখ টাকায়।
প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে কর্মরত আছেন শতাধিক মানুষ। তাদের মধ্যে অনেকে একসময় ছিলেন দিনমজুর বা শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল সীমিত। কিন্তু এখানে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হয়ে উঠেছেন দক্ষ কারিগর। এই প্রতিষ্ঠান কর্মসংস্থান হয়েছে নারীদেরও। অনেক নারী শ্রমিক কাজ করছেন এখানে। সারাদেশে পঞ্চাশের অধিক ডিলারের মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠান বিস্তৃত হয়েছে দেশব্যাপী। যার সঙ্গে যুক্ত কয়েক হাজার মানুষ।
সহযোগিতা, গবেষণা ও স্বীকৃতি
২০১০ সালের দিকে ওলি উল্লাহর তৈরি প্যাডেল থ্রেশার আলোচনায় আসে। এরপর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিরি) কারিগরি সহায়তা এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাহায্য প্রদানকারী সংস্থা ইউএসএইড, আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্রের (সিমিট) আর্থিক সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যায়। বর্তমানে সরকারি সহায়তায় জনতা রিসোর্স-ট্রেনিং অ্যান্ড সার্ভিস নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান করে নিয়মিত দিচ্ছেন প্রশিক্ষণ।
জনতা রিসোর্স ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন শিক্ষার্থী সোহাগ হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা থেকে এখানে প্রশিক্ষণ নিতে এসেছি। জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে কৃষি মেশিনারিজ প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। এখান থেকে শিখে আমার এলাকায় কৃষিতে অবদান রাখতে চাই।’
প্রশিক্ষণরত আরেক শিক্ষার্থী মো. তামিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা শিক্ষিত বেকার যুবক, চাকরি করতে চাই না। উদ্যোক্তা হতে চাই। অর্জিত জ্ঞান দিয়ে কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।’
নিজের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন ওলি উল্লাহ। ২০২৩ সালে এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে ‘বর্ষসেরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা’ হিসেবে পুরস্কার পান তিনি। তার অফিসে ঢুকলেই চোখে পড়ে শতাধিক ক্রেস্ট ও সম্মাননা। সবশেষ কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ২০২৪ সালে তাকে ‘কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (এআইপি)’ সম্মাননা দেয় সরকার।
শুধু উৎপাদন নয়, প্রশিক্ষণও
শুধু কৃষি যন্ত্র উৎপাদনেই থেমে থাকেননি ওলি উল্লাহ। পাশাপাশি দুইশোর বেশি কর্মশালার মাধ্যমে কয়েক হাজার জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন নিজ উদ্যোগে। বর্তমানে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, যশোরসহ সারাদেশে তার কারিগরি শিষ্যদের মধ্যে অন্তত দেড়শো জন কৃষিযন্ত্র উৎপাদন ও বিক্রয়ে নিয়োজিত, যাদের অনেকেই একসময় জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কর্মচারী ছিলেন।
কৃষকের কাছে ‘ওলি হুজুর’
প্রতিষ্ঠানটির আশপাশের এলাকায় ‘ওলি হুজুর’ নামেই বেশি পরিচিত ওলি উল্লাহ। কুতুবপুর ইউনিয়নের কৃষক মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি তার কাছ থেকে সিডার, রিপার আর ড্রাম থ্রেশার কিনেছি। দাম কম, মান ভালো। যন্ত্র নষ্ট হলে নিজেই এসে সারিয়ে দেন।’
সরোজগঞ্জ বাজারের মীম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক মিলন মিয়া বলেন, ‘আমি উনার কারখানায় কাজ শিখেছি। এখন নিজেই একটা ছোট কারখানা চালাই।’
ভবিষ্যতের ভাবনা
জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের রয়েছে তিনটি কারখানা। এরমধ্যে দুটি চলমান। তবে স্বয়ংক্রিয় তৃতীয় কারখানার নির্মাণ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। কাজ চলছে। ওলি উল্লাহর স্বপ্ন, একদিন পুরোপুরি দেশীয় উপকরণ দিয়ে শতভাগ যন্ত্রাংশ তৈরি করবেন, যাতে কৃষকেরা আরও সস্তায় উন্নত প্রযুক্তি পেতে পারেন।
জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা এআইপি ওলি উল্লাহ ওরফে ওলি হুজুরের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তিনি বলেন, ‘নদীভাঙনে সব হারিয়ে একসময় দিনমজুরের কাজ করতাম। তখন বুঝিনি কোনো একদিন মানুষ আমাকে উদ্যোক্তা বলবে। যন্ত্রপাতির প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। মেকানিকের কাজ শিখতে শিখতে একটা স্বপ্ন গেঁথে যায় মনে—নিজের একটা কারখানা গড়বো, যেখানে শুধু যন্ত্র নয়, মানুষও (প্রশিক্ষিত মানুষ) তৈরি হবে। মাত্র ৪ হাজার টাকা পুঁজি আর অনেক কষ্টের অভিজ্ঞতা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম। এখন আলহামদুলিল্লাহ! জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং দেশের অন্যতম কৃষিযন্ত্র প্রতিষ্ঠান।’
ওলি উল্লাহ বলেন, ‘আমার ইচ্ছা, বাংলাদেশ একদিন কৃষিযন্ত্রের জন্য বিদেশের দিকে না তাকিয়ে নিজের ঘরেই সমাধান খুঁজবে। আমরা চেষ্টা করছি শতভাগ দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে যন্ত্র তৈরি করতে। একটা স্বয়ংক্রিয় কারখানা করছি, যাতে উৎপাদন খরচ কমে আসে, কৃষকের কাছে সাশ্রয়ী দামে উন্নত যন্ত্র পৌঁছায়।’
নিজের কারখানায় উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রপাতি বিদেশেও রপ্তানির চেষ্টা চলছে বলে জানান ওলি উল্লাহ। তিনি বলেন, ওলি উল্লাহ এরইমধ্যে জিম্বাবুয়ে, নেপাল, ভুটানসহ বেশ কয়েকটি দেশে তার কারখানায় তৈরি কৃষিযন্ত্র স্যাম্পল হিসেবে পাঠিয়েছেন। খুব শিগগির বিদেশে রপ্তানি করবেন এসব যন্ত্রপাতি। যাতে লেখা থাকবে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। এজন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহকারী প্রকৌশলী সজীব হোসেন জানান, এখানে প্রায় ৪০ ধরনের কৃষিযন্ত্র এবং যন্ত্রাংশ তৈরি হয়। এসব যন্ত্রাংশ কৃষকরা কিনে কৃষিকাজে ব্যবহার করেন। সারাদেশে জনতার কৃষিযন্ত্র ও যন্ত্রাংশের ব্যাপক চাহিদা। ডিলারের মাধ্যমে সারাদেশে এই যন্ত্র বিক্রি করা হয়।
খুলনা বিভাগের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উপপরিচালক উপসচিব মোছা. শাহনাজ বেগম জাগো নিউজকে বলেন, একজন সাধারণ মানুষ কীভাবে কঠোর পরিশ্রমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, সেটা চুয়াডাঙ্গার ওলি উল্লাহকে দেখলে বোঝা যায়। দেশীয় কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরিতে তার অবদান আমরা স্বীকার করি।
তিনি বলেন, আশা করি, ভবিষ্যতে আরও উদ্যোক্তা এই খাতে আসবেন এবং কৃষি প্রযুক্তির বিকাশ ঘটবে, যা দেশের কৃষিখাতের জন্য উন্নতির নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।