প্রতি বছর রোজা এলেই পণ্যের দাম বাড়তে এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে। অনেক পণ্যের দাম হয়ে যায় লাগামহীন। বিশেষ করে রমজানে যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে যেগুলোর দামে আগুন লেগে যায়। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
দিন চারেক আগেও যে সবজির বাজারে ছিল স্বস্তি, রোজা শুরুর একদিন আগে সেই বাজারে আগুন লেগে যায়। অনেকদিন ধরে সংকট দেখা দেওয়া বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট আজও কাটেনি।
রোজার প্রথম দিন রোববার (২ মার্চ) সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও হাতিরপুল বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। দুই বাজারেই এসব পণ্যের দাম আগের দুইদিনের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এ নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা গেছে।
রমজানে ইফতারের সময় শরবতের জন্য চাহিদা বাড়ে লেবুর। এই সুযোগে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বিক্রেতারা। দুই দিন আগেও বাজারে বড় আকারের যে লেবুর হালি ৫০ থেকে ৬০ টাকা দরে কেনা যেত, আজ সেই লেবু হালিপ্রতি ৭০-৮০ টাকা দরে বিক্রি করতে গেছে দেখে।
রাজধানীর কাঁঠালবাগানের বাসিন্দা মো. হাসান সকালে বাজার করতে কারওয়ানবাজারে যান। পাইকারি বাজার হওয়ায় তুলনামূলক এখানে কম দামে পণ্য পাওয়া যায় বলে তিনি বাসার পাশের বাজার ছেড়ে সকালে কারওয়ান বাজারে আসেন। কিন্তু পাইকারি বাজারে এসেও অনেকটা ক্ষোভ শোনা যায় তার কণ্ঠে।
হাসান বলেন, সারাদিন রোজা থেকে ইফতারে পরিবারের সদস্যদের গলা ভিজানোর জন্য একটু লেবুর শরবত খাব, সেখানেও ভালো খবর নেই। অস্বাভাবিক বেড়েছে লেবুর দাম। দুইদিন আগেও লেবু-সবজির দাম কম ছিল। কিন্তু আজ তা অনেক বেড়ে গেছে।
লেবুর মতো দাম বেড়েছে শসার। গত সপ্তাহে দেশি শসার কেজি ছিল ৬০ থেকে ৮০ টাকা। আজ সেই শসা প্রতি কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। আর হাইব্রিড শসার কেজি ২০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৮০ টাকা। প্রকারভেদে বেগুনের দাম কেজিতে বেড়েছে ১৫ টাকা থেকে ২০ টাকা।
তবে অপরিবর্তিত আছে টমেটো ও ধনিয়া পাতার দাম। ছোট টমেটো ২০ টাকা ও বড় আকারের টমেটো ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাজারের এই চড়া অবস্থার মধ্যে কিছুটা স্বস্তি আছে ছোলার বাজারে। মানভেদে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকায়। আগের মাসেও কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়েছিল ইফতারের অন্যতম এই উপকরণটি।
কিছু পণ্যের বাজার চড়া থাকলেও পেঁয়াজ, আলু, আটার দাম স্থিতিশীল আছে। বিশেষ করে মৌসুমের কারণে পেঁয়াজ ও আলুর দাম অনেকটাই কম। চিনির সরবরাহ ভালো, দাম বাড়েনি। বরং গত বছরের তুলনায় দাম এবার কম।
বাজারে সংকট চলছে বোতলজাত সয়াবিন তেলের। সরবরাহ বন্ধ থাকায় তেলের এমন সংকট দেখা দিয়েছে বলে বিক্রেতারা জানান। উপায় না পেয়ে খোলা তেল কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। অবশ্য এজন্য নির্ধারিত দরের চেয়ে লিটারে ২৮-৩৩ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে।
গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ৮৩০ টাকা কেজিতে আর খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১২০০ টাকা কেজিতে। ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকা, সোনালি মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৪০ টাকা ও লেয়ার মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৩০ টাকা।
বোতলের তেলের সংকট কাটেনি : প্রায় মাসখানেক ধরেই সংকটে থাকা বোতলজাত সয়াবিন তেলের চাহিদা রোজার আগে আরও বেড়েছে। যেহেতু ইফতারে ভাজাপোড়া খাওয়ার অভ্যেস অনেকেরই। কিন্তু, বাজারে বোতলের সয়াবিনের সংকট কাটেনি।
গেল ১২ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আশ্বাস দিয়েছিলেন, পরবর্তী ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ভোজ্যতেলের বাজার স্থিতিশীল হবে।
এরপর ১৬ ফেব্রুয়ারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে একই আশ্বাস দিয়েছিল ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।
তবে, বাজারে সেই আশ্বাসের প্রতিফলন মেলেনি। ক্রেতারা যেমন তেল না পেয়ে বিরক্ত, তেমনি বিক্রেতারাও নাকাল হচ্ছেন ক্রেতাদের কথার বাণে।
নিকেতন কাঁচাবাজারের ‘রিপা জেনারেল স্টোর'-এর বিক্রেতা ফারুক হোসেন বলেন, সয়াবিনের বোতল আমি পাইনি। পেলেও অন্য পণ্য কেনা লাগে। দুই-আড়াই মাস ধরেই এই অবস্থা। মাঝে কিছুটা সরবরাহ থাকলেও এখনও ঝামেলা। ক্রেতারা তেল না পেয়ে গালিগালাজ করে।
এই বাজারে তেল না পেয়ে সিটি গ্রুপের বোতলজাত পাম ওয়েল ‘ন্যাচারাল' কিনলেন রহিম শেখ নামে একজন।
তিনি বলেন, তেলের বাজার নিয়ে এত দীর্ঘ সংকট আগে তো দেখিনি। মাঝেমধ্যে পেলেও দাম বাড়তি। পাম ওয়েল কিনলাম হাফ লিটারের বোতল ৯০ টাকায়। গায়ের দাম ৮০ টাকা। অথচ সরকার নির্ধারিত দাম ১৫৭ টাকা লিটার।
একই রকম অভিযোগ আশিকুর রহমানে নামের এক ক্রেতার।
বেশ কয়েক দোকান ঘুরে ৫ লিটারের তেলের বোতল পেলাম। ৮৫০ টাকা গায়ের মূল্য। দোকানি চাইছেন ১ হাজার টাকা। বাধ্য হয়ে কিনলাম; তেল ছাড়া তো আর রান্না হবে না।
মাছ-মাংসের বাজারও গরম : সপ্তাহ দুয়েক আগে শবে বরাতের সময় মাংসের দাম কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে গিয়েছিল। দুদিন পরেই আবার কমে যায়। রোজা ‘উপলক্ষে’ ফের মাংসের দাম বেড়েছে।
বাজারে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২১০-২৩০ টাকা কেজিতে; আর সোনালি জাতে পড়ছে ৩৩০ থেকে ৩৫০ টাকা।
দুদিন আগেও বাজারে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয় ১৯০ থেকে ২০০ টাকা কেজিতে। আর সোনালি ছিল ৩৩০ টাকার মধ্যে।
এছাড়া লাল লেয়ার মুরগি ৩০০ টাকা, সাদা লেয়ার ২৯০ টাকা, আর দেশি মুরগি ৫৬০ টাকা করে কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
আর, বাজারে গরুর মাংসের দাম গত সপ্তাহের তুলনায় কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খাসির মাংস কেজিতে ৫০ টাকা বেড়ে ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে কিছু-কিছু মাছের দামও কেজি প্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা করে বেড়েছে।
নিকেতন কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে ৫০০ গ্রামের ইলিশ এক হাজার টাকা, ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রামের হলে দেড় হাজার টাকা, এক কেজি ওজনের হলে দুই হাজার টাকা চাওয়া হচ্ছে।
রুই মাছের দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে আকৃতিভেদে ৩৮০ থেকে ৪৫০ টাকা, গলদা চিংড়ি ৭৮০ থেকে ১২০০ টাকা, বড় কাতল ৩৫০ থেকে ৪২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
ছোলা, চিনি, পেঁয়াজ স্থিতিশীল : বাজারে স্বস্তির খবর হচ্ছে, এ বছর রোজার অন্যতম পণ্য ছোলা, খেজুর, বেসনের দাম অন্যান্যবারের মত বাড়েনি, স্থিতিশীলই বলা চলে।
বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে এসব পণ্যের সরবরাহ সংকট নেই; তাই দাম বাড়েনি।
বাজারে মানভেদে ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা, ভুট্টার বেসন ১৪০ টাকা ও অ্যাংকরের বেসন ৯০ থেকে ১০০ টাকা কেজি। আর চিনির কেজি ১২৫-১৩০ টাকা।
মহাখালী কাঁচাবাজারের ‘মাসুমা জেনারেল স্টোরের' বিক্রেতা আল আমিন বলেন, বাজারে এসব পণ্যের সংকট নেই। এজন্য অন্যান্যবারের মত দাম বাড়েনি। তেল ছাড়া অন্যান্য মুদি মালামালের সরবরাহ স্বাভাবিক।