গ্যাস সংকটে বিপর্যয়ে শিল্প খাত, ঋণ খেলাপি বাড়ার শঙ্কা

গ্যাস আর ব্যাংকিং সংকট নিয়ে উৎপাদনমুখী শিল্প চরম বিপর্যয়ে। বিদ্যুতের সমস্যাও আছে। তবে বিদ্যুৎ থেকে গ্যাসের সমস্যাই শিল্পের জন্য বড় সমস্যা। গ্যাস সংকটে উৎপাদন বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে। গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প কারখানায় মেশিনারিজ চালু করা যাচ্ছে না। আর ব্যাংক শিল্পকে সহযোগিতা করছে না। যার ফলে প্রতিদিনই লোকসান হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। লোকসান গুনতে গুনতে অনেকে হচ্ছেন ঋণ খেলাপি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকে শিল্প খাতে মোট ঋণ দেওয়া হয়েছে ৪২.৩৭ শতাংশ। যা টাকায় ৭১ কোটি ২৯ লাখ ৬ হাজার ১২৪ টাকা।
জানা যায়, এই মুহূর্তে গ্যাস সংকট চরমে। মাঝে গ্যাস ভালো ছিল। গত কয়েক দিন ধরে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, আশুলিয়া, শিল্পাঞ্চলে চরম সংকট চলছে। কোথাও গ্যাসের চাপ জিরো, কোথাও শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ আবার কোথাও এক শতাংশ। গ্যাসের এমন চাপে শিল্প চালানো যাচ্ছে না। ফলে মেশিন বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে বর্তমানে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে সব প্রতিষ্ঠানের বিক্রি কমেছে, ঋণের উচ্চ সুদহার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি সব কিছু মিলিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান তার পূর্ণ সক্ষমতায় চলতে পারছে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকাই এখন চ্যালেঞ্জ। এসব কারণে ইচ্ছাকৃত খেলাপির বাইরেও এখন বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ব্যাংকে ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছেন অনেক ভালো গ্রাহক।
এদিকে বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী কোনো গ্রাহক ছয় মাস কিস্তি দিতে না পারলে তাকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু ব্যবসায় মন্দার কারণে ঠিকমতো উৎপাদনে যেতে পারছে না বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান। আর যারা নতুন শিল্প করেও তা চালু করতে পারছেন না, তারাও অবাঞ্ছিত লোকসানের মুখে। ঋণ নেওয়ার ফলে ব্যাংকের চাপ আছে। অথচ চালু না করায়, উৎপাদন না হওয়ায় কোনো আয় নেই। এর ফলে ঋণ খেলাপি হতে হচ্ছে।
উদ্যোক্তারা জানান, তারা সরকারের প্রলোভনে পড়ে শিল্পে বিনিয়োগ করে এখন রীতিমতো মহাসংকটে আছেন। সরকারের উচিত, অবিলম্বে সব ধরনের সেবা দিয়ে কারখানা চালুর ব্যবস্থা নেওয়া। পাশাপাশি ঋণ খেলাপি থেকে রক্ষা করতে নীতিমালা জারি করা।
এদিকে চলমান পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এ খাতের চার সংগঠনকে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে বাধ্য হতে হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই বিজ্ঞাপনে বলা হয়, গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের আশ্বাসে গত কয়েক বছরে ৩০০ শতাংশের বেশি গ্যাসের দাম বাড়ালেও গত দুই সপ্তাহ ধরে মারাত্মক গ্যাসসংকটে পড়েছে এ খাতের কারখানাগুলো।
গ্যাস সংকটের কারণে ভুগছে দেশের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্প। ঝুঁকিতে পড়েছে রপ্তানি আয়ের প্রধান এই খাতের ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। পাশাপাশি, মার্কিন শুল্কনীতি বিশ্ববাণিজ্যে সৃষ্টি করেছে নতুন অনিশ্চয়তা।
নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ভুলতা, মাওনা ও টঙ্গীসহ গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চলে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় অনেক বস্ত্র কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে।
বস্ত্র কারখানায় উৎপাদন চলমান রাখতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ জরুরি। এসব কারখানায় বিদ্যুৎ উৎপাদন, স্পিনিং মেশিন সচল রাখা ও কাপড় রং করতে বয়লারে বাষ্প সৃষ্টির জন্য গ্যাস দরকার হয়।
সরবরাহ বাড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সম্প্রতি গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে অনেক কারখানার মালিক বলছেন, গ্যাসের চাপ না থাকায় শিল্পাঞ্চলের কয়েকটি কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। তাই গ্যাসের দাম বাড়লেও স্বস্তি মেলেনি।
দেশের ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে খেলাপি ঋণ। যার প্রসার বেড়েছে উৎপাদনমুখী শিল্পের হাত ধরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০২৩ সালে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের ৫৪ শতাংশই উৎপাদনমুখী শিল্পের। এর মধ্যে প্রায় ১৭ শতাংশ নিয়ে শীর্ষে তৈরি পোশাক খাত। এরপরই টেক্সটাইলের অবস্থান। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে এ হার সাড়ে ৫ শতাংশ।
শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, করোনার সময় বিশ্বজুড়ে উৎপাদন ব্যাহত হয়। যোগাযোগ ভেঙে পড়ে। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এ সময় বিশ্ব উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে পড়ে। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের উৎপাদন খাতেও। পাশাপাশি তীব্র গ্যাস সংকটে উৎপাদন ব্যাহত, লোকসান গুনতে হচ্ছে, যার ফলে ঋণের টাকা দিতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।
তারা বলছেন, এসব কারণে উদ্যোক্তারা ঋণ নিয়ে সময়মতো ফেরত দিতে পারেননি। এতে তারা খেলাপি হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে ওঠে। অনেক উদ্যোক্তাই ঋণ নিয়ে সময়মতো ফেরত দিতে পারেননি।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বাড়িয়ে দিলেও চাহিদামতো সরবরাহ মেলেনি।
উদ্যোক্তারা বলছেন, ব্যবসায়ীদের জন্য বিষয়টি মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো। এ পরিস্থিতিতে অনেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, দেশের শিল্প-কারখানার সক্ষমতার অনেকাংশ অব্যবহৃত থেকেছে। এ অবস্থায় শতভাগ উৎপাদন না হলেও জ্বালানি ও জনবলের ব্যয় ঠিকই মেটাতে হয়েছে। আর দিন শেষে তা মালিকের মূলধন থেকেই যাচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের সে সক্ষমতাও কম। এ অবস্থায় তারা খেলাপি হচ্ছেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ব্যাংক ব্যাক টু ব্যাক এলসিতে বিলম্ব করছে। ওভার ডিও হলে বন্ধ করে দিচ্ছে। পণ্য অর্ডার নেওয়ার পর ব্যাক টু ব্যাক এলসি দিচ্ছে না। দেখা যায়, ২০ দিন ধরে ব্যাংক ঘুরাল। এরপর যখন পণ্য রেডি করা হয় তখন বায়ার বলে এ মাল শিপমেন্টের ডেট মিস করেছে। এবার এয়ার শিপমেন্ট করো, না হয় ডিসকাউন্ট দাও। এতে আমাদের লোকসান হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমাদের করুণ পরিস্থিতিতে ব্যাংকের যথাযথ সহযোগিতা পাচ্ছি না। লোকসান গুনার পাশাপাশি অনেক কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছি। ফলে অনেক ব্যবসায়ী সময়মত ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে খেলাপি হচ্ছেন।
প্রসঙ্গ, বিগত কয়েক বছরে গ্যাস বিদ্যুৎসহ কারখানার উৎপাদন খরচ বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। ফলে পোশাক খাতের উৎপাদন কমেছে অর্ধেকের বেশি। অনেক ব্যবসায়ীই এখন ঋণ খেলাপি। ঋণ নিয়ে তৈরি হয়েছে অর্থ পাচারের অভিযোগও।