দেশের বেশিরভাগ শিল্প-কারখানায় চাহিদা অনুযায়ী মিলছে না গ্যাস। বেশ কিছুদিন ধরে চলা এ সংকটে কমে গেছে শিল্প-কারখানার উৎপাদন। গ্যাস সংকটে শিল্প খাতে বিপর্যয় নেমে এসেছে বলে দাবি করেছেন শিল্পের উদ্যোক্তারা।
গ্যাসসংকটে শিল্প খাতে বিনিয়োগও প্রায় থমকে আছে। কর্মসংস্থান বাড়ছে না। শিল্প খাত না বাঁচলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি থেমে যাবে। তাই শিল্পের গ্যাস-বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে জোরালো উদ্যোগ নেয়ার তাগিদ দিচ্ছেন শিল্পোদ্যোক্তা এবং রপ্তানিকারকরা।
চলমান পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এ খাতের চার সংগঠনকে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে বাধ্য হতে হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই বিজ্ঞাপনে বলা হয়, গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের আশ্বাসে গত কয়েক বছরে ৩০০ শতাংশের বেশি গ্যাসের দাম বাড়ালেও গত দুই সপ্তাহ ধরে মারাত্মক গ্যাসসংকটে পড়েছে এ খাতের কারখানাগুলো।
গ্যাস সংকটের কারণে ভুগছে দেশের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্প। ঝুঁকিতে পড়েছে রপ্তানি আয়ের প্রধান এই খাতের ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। পাশাপাশি, মার্কিন শুল্কনীতি বিশ্ববাণিজ্যে সৃষ্টি করেছে নতুন অনিশ্চয়তা।
নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ভুলতা, মাওনা ও টঙ্গীসহ গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চলে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় অনেক বস্ত্র কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে।
বস্ত্র কারখানায় উৎপাদন চলমান রাখতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ জরুরি। এসব কারখানায় বিদ্যুৎ উৎপাদন, স্পিনিং মেশিন সচল রাখা ও কাপড় রং করতে বয়লারে বাষ্প সৃষ্টির জন্য গ্যাস দরকার হয়।
সরবরাহ বাড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সম্প্রতি গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে অনেক কারখানার মালিক বলছেন, গ্যাসের চাপ না থাকায় শিল্পাঞ্চলের কয়েকটি কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। তাই গ্যাসের দাম বাড়লেও স্বস্তি মেলেনি।
এ প্রসঙ্গে বস্ত্র খাতের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, বিভিন্ন সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে সংকট নিরসনের আহ্বান জানালেও এর কোনো সুরাহা পাননি উদ্যোক্তারা। ফলে বাধ্য হয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো নিরবিচ্ছিন্ন জ্বালানির নামে বারবার গ্যাসের দাম বাড়ালেও পর্যাপ্ত গ্যাসের অভাবে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে। একদিকে সরকার বিদেশি বিনিয়োগের কথা বলছে; অন্যদিকে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা কারখানা বন্ধ করে দেউলিয়া হওয়ার পথে। তিনি আরো বলেন, জ্বালানি সংকট নিয়ে সরকারের নানা পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি থাকলেও এর কোনো বাস্তবায়ন নেই।
বিটিএমএর হিসাব অনুসারে, একটি স্পিনিং মিলে প্রতিদিন গড়ে ২৫ লাখ টাকা লোকসান হচ্ছে। এই সংগঠনে প্রায় ৫০০ স্পিনিং মিল আছে। গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে অনেকে কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
কারখানার মালিকরা বলেছেন, গত কয়েক বছরের ধারাবাহিক সংকটগুলো মধ্যে এটি সর্বশেষ। করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা ও বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির প্রভাব থেকে এই খাতটি সবেমাত্র ফিরতে শুরু করেছিল। এখন ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে আবার অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। ডলারের বিনিময় হারে অস্থিরতা ও টাকার মান কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, শিল্প কারখানাগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় এসব এলাকার শিল্পকারখানা থেমে থেমে চলছে। গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিজস্ব ব্যবস্থা থাকলেও গ্যাসের সংকটে শিল্প কারখানাগুলো সেগুলোও চালাতে পারছে না। ফলে একদিকে সুযোগ নষ্ট এবং অন্যদিকে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) আয়োজিত 'দেশের শিল্প খাতে জ্বালানি সংকট সমাধানের পথ' শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন জানান, জ্বালানি সংকটে সিরামিক কারখানায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। পোশাক খাতে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ উৎপাদন কমেছে। স্টিল কারখানায় উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সোনালীনিউজকে বলেন, আমাদের দেশে গ্যাসের দাম বাড়ানোর আগে আমরা ভালোই গ্যাস পেতাম কিন্তু দাম বাড়ানোর পর দিন বলেন আর রাতে বলেন কোনো সময়েই ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছি না। এতে সব মেশিন চালানো যাচ্ছে না। গ্যাস-সংকটের কারণে সুতা ও কাপড় ডাইংয়ের কাজ ব্যাহত হওয়ায় কাঁচামাল সময়মতো কারখানায় আসছে না। এতে প্রতিটি ক্রয়াদেশের বিপরীতে সরবরাহ বিলম্বিত হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো গ্যাস, দ্বিতীয় এনবিআর এবং তৃতীয় হলো বাংলাদেশ ব্যাংক। এতো কিছুর মধ্যে আমাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। গ্যাস চাহিদার আলোকে তো পাচ্ছিই না, আর পাবো কিভাবে আমাদের দেশে গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে কি পর্যাপ্ত গ্যাস কূপ খনন হচ্ছে?
তিনি বলেন, সরকার দিন দিন আমাদের সুবিধাগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে কিন্তু তার বিপরীতে কোনো উপায় বের করছে না। এজন্য আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। আমরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না। কারণ বায়াররা যে রেট দেয় তার সাথে আমাদের খরচ মিলছে না। আবার আমরা যে দাম দেই তা বায়ারদের পছন্দমত হচ্ছে না। বিদেশি অনেক বায়ারের ক্রয়াদেশ দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো আছে তা শেষ হলে একদম খালি হয়ে যাবে ক্রয়াদেশ। এতে করে শুধু আমরাই না দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিটিএমএ, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিটিএলএমইএ-এর অধীনের টেক্সটাইল এবং পোশাক কারখানাগুলো দেশের রপ্তানিতে প্রায় ৮৫ শতাংশ অবদান। গ্যাস সরবরাহ পাওয়ার ক্ষেত্রে রপ্তানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত হলেও তা করা হচ্ছে না।
এতে রপ্তানি আয়ের মূল উৎসর প্রতিষ্ঠানগুলো গ্যাসের অভাবে স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। বেশিরভাগ টেক্সটাইল মিল এবং পোশাক কারখানায় গ্যাসের শূন্য চাপের প্রমাণ রয়েছে। গ্যাস সরবরাহের এই অবস্থা চলতে থাকলে বিটিএমএ, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিটিএলএমইএর অধীনের টেক্সটাইল এবং পোশাক খাতের প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ মারাত্মক হুমকিতে পড়বে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।
এআর