London ১২:২৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৪ মার্চ ২০২৫, ১৯ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গাজায় রোজা ধ্বংসাবশেষে অবিচল বিশ্বাসের উদযাপন

অনলাইন ডেস্ক

ইসরায়েলি আগ্রাসনে ধ্বংসপ্রাপ্ত গাজার মানুষের কাছে রোজা বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মত নয়, যেখানে উৎসবের আমেজে মানুষ রোজা ও এবাদত শুরু করেছে।

সোয়া এক বছরের যুদ্ধে বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের বিচ্ছিন্ন এই ভূ-খন্ডের মানুষ রোজা করছেন দুঃখ ও শোকের আবহে।

ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজার ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী ইসরা আবু কামার দমবন্ধ করা এ পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন।

তার ভাষায়, এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তারপর কী হবে, তা নিয়ে মানুষজন এখনও উদ্বিগ্ন। তারা ভীত, যুদ্ধ আবারও ফেরত আসতে পারে।

গত এক বছরে আমরা যা দেখেছি এবং অনুভব করেছি, তা আমাদের স্মৃতিতে প্রবলভাবে রয়েছে।

গত বছর গাজাবাসী রোজার দিনগুলো পার করেছেন ইসরায়েলি যুদ্ধ বিমানের উড়ে আসা ও বোমা ফাটার বীভৎস অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।

 

কাতারভিত্তিক টেলিভিশন সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার অনলাইন পোর্টালে ইসরা আবু কামার লিখেছেন, আমাদের জন্য যুদ্ধের মধ্যে রোজা উদ্যাপন প্রথম ছিল না।

২০২৪ সালের ৭ অক্টোবরের ইসরায়েলে গাজার সশস্ত্রগোষ্ঠি হামাসের হামলা ও জিম্মি করার জেরে ইসরায়েল আগ্রাসন শুরু করে।

এর আগে ২০১৪ সালে ইসরায়েলি হামলার ভয়াবহ সেই দিনগুলোর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি লিখেছেন, তখন আমার বয়স মাত্র নয় বছর, কিন্তু আমি খুব ভালো মনে করতে পারছি, রোজার রাতগুলো বিমান হামলা এবং ধ্বংসযজ্ঞের বিভীষিকায় ভরা ছিল, কীভাবে আমরা অন্ধকারের মধ্যে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম, কীভাবে হামলা থেকে পালিয়েছিলাম।

কিন্তু গত বছরের রোজা কঠিন ছিল। এটা অকল্পনীয়ভাবে খারাপ ছিল। সবদিকে ক্ষুধা ছিল।

ইসরা লেখেন, আমাদের পরিবারের ছয়জন সারা দিন রোজা রেখে শুধু হুমাস বা মটরশুটি দিয়ে ইফতার করতাম। বিদুৎ ছিল না, আমরা অন্ধকারে স্বাদহীন টিনজাত খাবার চিবিয়ে খেতাম। এক টেবিল বসলেও কেউ কারো চেহারা দেখতে পেতাম না।

 

আমরা আমাদের বড় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। আমার দাদি, খালা, চাচাতো ভাই-বোন, যাদের সঙ্গে আমি রোজা পালন করতাম তারা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিল। কয়েকজন তাঁবুতে ছিল এবং বাকিরা উত্তরে আটকা পড়েছিল। একসঙ্গে থাকার মাসগুলো পরিণত হয়েছিল দুঃস্বপ্নের দিনে।

গাজার এই শিক্ষার্থী লিখেছেন, “রোজা উদযাপনের চেতনাই হারিয়ে গিয়েছিল। আমরা রোজা ভাঙার জন্য মাগরিবের আগেই অথবা ফজরের আগেই আজান শুনতে চাইতাম। কিন্তু কোনো মসজিদ থেকে আজান শোনা যেত না, কারণ ইসরায়েলি হামলায় সব মসজিদই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

কিছু মানুষ আজান দিতে চাইলেও ভয়ে তা করতো না। কারণ আজানের শব্দে যদি ইসলায়েলি বিমান হামলা হয়, তাদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়- সে ভয় সব সময় তাদের মধ্যে ছিল।

পার্শ্ববর্তী মসজিদ থেকে লাউডস্পিকারে মুয়াজ্জিনের পরিচিত আজানের পরিবর্তে আমরা ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলার শব্দে রোজা ভাঙতাম।

ইসরা লেখেন, যুদ্ধের আগে, আমি সাধারণত আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ইফতারের পর মসজিদে যেতাম এবং আমাদের পরিচিতদের দেখতাম। এরপর আমরা গাজার রাস্তায় হাঁটতাম। বাসায় পৌঁছে তাজা কাতায়েফ (পিঠা জাতীয় খাবার) পাওয়ার আগে রোজার প্রাণবন্ত পরিবেশ উপভোগ করতাম।

কিন্তু গত বছর আমরা গণহত্যার জন্য তারাবির নামাজ পড়তেও যেতে পারিনি।

যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া গাজার সবচেয়ে সুন্দর এবং ঐতিহাসিক গ্রেট ওমারি মসজিদের স্মৃতিচারণ করে তিনি লিখেছেন, “যেখানে আমার বাবা ও ভাই রোজার শেষ ১০ দিন পার করতেন, যেখানে সুমধুর কুরআন তেলাওয়াত শোনা যেত, তা বন্ধ হয়ে গেছে।

 

বোমার আঘাতে মসজিদটি ধ্বংস হয়ে গেছে, এমনভাবে গুঁড়িয়ে যে সেটি এখন আর চেনা যাচ্ছে না। যে স্থানটিতে একসময় প্রার্থনা ও শান্তির বার্তা প্রতিধ্বনিত হয়েছে, সেটি এখন ধুলো এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

আরব দেশগুলোতে শনিবার থেকে রোজা শুরু হয়েছে। সে দিনই ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার যুদ্ধবিরতির প্রধান ধাপ শেষ হয়েছে। ইসরায়েল চায়, প্রধান ধাপের মেয়াদ আরও বাড়াতে। কিন্তু হামাস তাতে রাজি নয়। তারা বলছে, যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী দ্বিতীয় ধাপ শুরু করার পক্ষে গাজার এই স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি।

এ নিয়ে বিরোধের জেরে ইসরায়েল গাজায় মানবিক সহায়তা সরবরাহের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে আবার যুদ্ধের ঢামাঢোলের আতংকে আছেন গাজাবাসী।

ইসরা লিখেছেন, যুদ্ধবিরতির মধ্যেই এবার রোজা শুরু হয়েছে। যেখানে রোজা ভাঙার সঙ্গে গগণবিদারী কোনো বিমান হামলা নেই। ফজরের নীরবতার মধ্যে কোনো বিস্ফোরণ নেই।

আমাদের ঘর সাজাতে কোনো ভয় নেই, রঙিন বাতি ঝুলাতে কোনো ভয় নেই, এটি আমাদের লক্ষ্যবস্তু করবে না।

বেদনা ও ধ্বংসের মধ্যে যে জীবন এতদিন ধরে থেমে ছিল- তা গাজার রাস্তায় আবার ফিরে আসার চেষ্টা করছে। যেসব দোকানপাট ও বাজার অক্ষত রয়েছে, সেগুলো খুলছে, ফুটপাতে হকাররা ফেরত এসেছে। এমনকি নুসেইরাতের বড় সুপারমার্কেট তার দরজা পুনরায় খুলে দিয়েছে, লিখেছেন তিনি।

ইসরা লিখেছেন, রোজার আগে, আমার বাবা আমাকে ও আমার বোনকে নুসেইরাতের সুপারমার্কেটে নিয়ে গিয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছে, আমরা সে স্বাভাবিক দিনে ফিরে গিয়েছি। আমরা যেমন চেয়েছিলাম, হরেক রকমের চকলেট, বিস্কুট ও চিপসের প্যাকেটে দোকানের তাকগুলো সাজানো।

সেখানে ছিল রোজার সাজসজ্জা, চোখ ধাঁধানো সব লন্ঠন, খেজুরের বক্স, রঙিন শুকনো ফলমূল ও শরবত ‘কামার আল-দ্বীন’।

কিন্তু এই প্রাচুর্য প্রতারণামূলক! তাকগুলোতে যা সাজানো রয়েছে তার বেশিরভাগই অনেকের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কারণ যুদ্ধে অধিকাংশ গাজাবাসী বাড়ি ও জীবিকা হারিয়েছেন।

প্রথম ইফতারে ইসরার পরিবারের সদস্যদের পাতে ছিল ‘মুসাখান’, ফিলিস্তিনের এই খাবারটি মুরগী, পাতলা রুটি ও অনেক বেশি পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি করা হয়।

আমরা জানি, আমরা ভাগ্যবানদের দলে আছি। গাজার অধিকাংশ মানুষই মুরগী কেনার সামর্থ্য রাখে না, যা বাজারে যুদ্ধপূর্ব সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ দামে আবার বাজারে আসছে, লিখেছেন তিনি।

ইসরা লিখেছেন, সমৃদ্ধ আর ঐতিহ্যবাহী ইফতারই কেবল গাজায় ইফতারের টেবিলে অনুপস্থিত নয়, যুদ্ধে ৪৮ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। অনেকেই, যারা সপরিবারে মারা গেছে তারা আর রোজা পালন করবেন না, ইফতারে এক টেবিলে বসবেন না।

গাজার এই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া লিখেছেন, অনেকের বাড়িতে ইফতারের টেবিলে একটি আসন ফাঁকা থাকবে, একজন বাবার কণ্ঠস্বর আর তার সন্তানদের ইফতারের জন্য ডাকবে না, রোজা ভাঙার জন্য একজন সন্তানের ছটফটানি আর দেখা যাবে না অথবা একজন মায়ের দক্ষ হাতে সুস্বাদু খাবার আর তৈরি করা হবে না।

আমিও আমার ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছি। আমার খালার স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, যিনি প্রতিবছর আমাদের ইফতারের দাওয়াত দিতেন।

আমার বন্ধু শাইমা, লিনা ও রোয়া, যাদের সঙ্গে আমি তারাবির পর দেখা করতাম, তারা সবাই শহীদ হয়েছেন।

আমাদের মসজিদ ধ্বংস করা যাবে, আমাদের বিশ্বাস ভাঙা যাবে না। আমরা আমাদের অর্ধ-ভগ্ন বাড়িতে তাঁবু টানিয়ে তারাবিহ পড়ব, ফিসফিস করে দোয়ায় সব বলব, কোরান তেলাওয়াতে আরাম খুঁজব, জেনে রাখব আমরা যেসব কষ্ট সহ্য করেছি, তার জন্য তিনি আমাদের প্রতিদান দেবেন, লিখেছেন ইসরা।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ১১:০১:২৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩ মার্চ ২০২৫
Translate »

গাজায় রোজা ধ্বংসাবশেষে অবিচল বিশ্বাসের উদযাপন

আপডেট : ১১:০১:২৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩ মার্চ ২০২৫

ইসরায়েলি আগ্রাসনে ধ্বংসপ্রাপ্ত গাজার মানুষের কাছে রোজা বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মত নয়, যেখানে উৎসবের আমেজে মানুষ রোজা ও এবাদত শুরু করেছে।

সোয়া এক বছরের যুদ্ধে বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের বিচ্ছিন্ন এই ভূ-খন্ডের মানুষ রোজা করছেন দুঃখ ও শোকের আবহে।

ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজার ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী ইসরা আবু কামার দমবন্ধ করা এ পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন।

তার ভাষায়, এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তারপর কী হবে, তা নিয়ে মানুষজন এখনও উদ্বিগ্ন। তারা ভীত, যুদ্ধ আবারও ফেরত আসতে পারে।

গত এক বছরে আমরা যা দেখেছি এবং অনুভব করেছি, তা আমাদের স্মৃতিতে প্রবলভাবে রয়েছে।

গত বছর গাজাবাসী রোজার দিনগুলো পার করেছেন ইসরায়েলি যুদ্ধ বিমানের উড়ে আসা ও বোমা ফাটার বীভৎস অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।

 

কাতারভিত্তিক টেলিভিশন সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার অনলাইন পোর্টালে ইসরা আবু কামার লিখেছেন, আমাদের জন্য যুদ্ধের মধ্যে রোজা উদ্যাপন প্রথম ছিল না।

২০২৪ সালের ৭ অক্টোবরের ইসরায়েলে গাজার সশস্ত্রগোষ্ঠি হামাসের হামলা ও জিম্মি করার জেরে ইসরায়েল আগ্রাসন শুরু করে।

এর আগে ২০১৪ সালে ইসরায়েলি হামলার ভয়াবহ সেই দিনগুলোর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি লিখেছেন, তখন আমার বয়স মাত্র নয় বছর, কিন্তু আমি খুব ভালো মনে করতে পারছি, রোজার রাতগুলো বিমান হামলা এবং ধ্বংসযজ্ঞের বিভীষিকায় ভরা ছিল, কীভাবে আমরা অন্ধকারের মধ্যে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম, কীভাবে হামলা থেকে পালিয়েছিলাম।

কিন্তু গত বছরের রোজা কঠিন ছিল। এটা অকল্পনীয়ভাবে খারাপ ছিল। সবদিকে ক্ষুধা ছিল।

ইসরা লেখেন, আমাদের পরিবারের ছয়জন সারা দিন রোজা রেখে শুধু হুমাস বা মটরশুটি দিয়ে ইফতার করতাম। বিদুৎ ছিল না, আমরা অন্ধকারে স্বাদহীন টিনজাত খাবার চিবিয়ে খেতাম। এক টেবিল বসলেও কেউ কারো চেহারা দেখতে পেতাম না।

 

আমরা আমাদের বড় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। আমার দাদি, খালা, চাচাতো ভাই-বোন, যাদের সঙ্গে আমি রোজা পালন করতাম তারা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিল। কয়েকজন তাঁবুতে ছিল এবং বাকিরা উত্তরে আটকা পড়েছিল। একসঙ্গে থাকার মাসগুলো পরিণত হয়েছিল দুঃস্বপ্নের দিনে।

গাজার এই শিক্ষার্থী লিখেছেন, “রোজা উদযাপনের চেতনাই হারিয়ে গিয়েছিল। আমরা রোজা ভাঙার জন্য মাগরিবের আগেই অথবা ফজরের আগেই আজান শুনতে চাইতাম। কিন্তু কোনো মসজিদ থেকে আজান শোনা যেত না, কারণ ইসরায়েলি হামলায় সব মসজিদই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

কিছু মানুষ আজান দিতে চাইলেও ভয়ে তা করতো না। কারণ আজানের শব্দে যদি ইসলায়েলি বিমান হামলা হয়, তাদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়- সে ভয় সব সময় তাদের মধ্যে ছিল।

পার্শ্ববর্তী মসজিদ থেকে লাউডস্পিকারে মুয়াজ্জিনের পরিচিত আজানের পরিবর্তে আমরা ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলার শব্দে রোজা ভাঙতাম।

ইসরা লেখেন, যুদ্ধের আগে, আমি সাধারণত আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ইফতারের পর মসজিদে যেতাম এবং আমাদের পরিচিতদের দেখতাম। এরপর আমরা গাজার রাস্তায় হাঁটতাম। বাসায় পৌঁছে তাজা কাতায়েফ (পিঠা জাতীয় খাবার) পাওয়ার আগে রোজার প্রাণবন্ত পরিবেশ উপভোগ করতাম।

কিন্তু গত বছর আমরা গণহত্যার জন্য তারাবির নামাজ পড়তেও যেতে পারিনি।

যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া গাজার সবচেয়ে সুন্দর এবং ঐতিহাসিক গ্রেট ওমারি মসজিদের স্মৃতিচারণ করে তিনি লিখেছেন, “যেখানে আমার বাবা ও ভাই রোজার শেষ ১০ দিন পার করতেন, যেখানে সুমধুর কুরআন তেলাওয়াত শোনা যেত, তা বন্ধ হয়ে গেছে।

 

বোমার আঘাতে মসজিদটি ধ্বংস হয়ে গেছে, এমনভাবে গুঁড়িয়ে যে সেটি এখন আর চেনা যাচ্ছে না। যে স্থানটিতে একসময় প্রার্থনা ও শান্তির বার্তা প্রতিধ্বনিত হয়েছে, সেটি এখন ধুলো এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

আরব দেশগুলোতে শনিবার থেকে রোজা শুরু হয়েছে। সে দিনই ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার যুদ্ধবিরতির প্রধান ধাপ শেষ হয়েছে। ইসরায়েল চায়, প্রধান ধাপের মেয়াদ আরও বাড়াতে। কিন্তু হামাস তাতে রাজি নয়। তারা বলছে, যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী দ্বিতীয় ধাপ শুরু করার পক্ষে গাজার এই স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি।

এ নিয়ে বিরোধের জেরে ইসরায়েল গাজায় মানবিক সহায়তা সরবরাহের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে আবার যুদ্ধের ঢামাঢোলের আতংকে আছেন গাজাবাসী।

ইসরা লিখেছেন, যুদ্ধবিরতির মধ্যেই এবার রোজা শুরু হয়েছে। যেখানে রোজা ভাঙার সঙ্গে গগণবিদারী কোনো বিমান হামলা নেই। ফজরের নীরবতার মধ্যে কোনো বিস্ফোরণ নেই।

আমাদের ঘর সাজাতে কোনো ভয় নেই, রঙিন বাতি ঝুলাতে কোনো ভয় নেই, এটি আমাদের লক্ষ্যবস্তু করবে না।

বেদনা ও ধ্বংসের মধ্যে যে জীবন এতদিন ধরে থেমে ছিল- তা গাজার রাস্তায় আবার ফিরে আসার চেষ্টা করছে। যেসব দোকানপাট ও বাজার অক্ষত রয়েছে, সেগুলো খুলছে, ফুটপাতে হকাররা ফেরত এসেছে। এমনকি নুসেইরাতের বড় সুপারমার্কেট তার দরজা পুনরায় খুলে দিয়েছে, লিখেছেন তিনি।

ইসরা লিখেছেন, রোজার আগে, আমার বাবা আমাকে ও আমার বোনকে নুসেইরাতের সুপারমার্কেটে নিয়ে গিয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছে, আমরা সে স্বাভাবিক দিনে ফিরে গিয়েছি। আমরা যেমন চেয়েছিলাম, হরেক রকমের চকলেট, বিস্কুট ও চিপসের প্যাকেটে দোকানের তাকগুলো সাজানো।

সেখানে ছিল রোজার সাজসজ্জা, চোখ ধাঁধানো সব লন্ঠন, খেজুরের বক্স, রঙিন শুকনো ফলমূল ও শরবত ‘কামার আল-দ্বীন’।

কিন্তু এই প্রাচুর্য প্রতারণামূলক! তাকগুলোতে যা সাজানো রয়েছে তার বেশিরভাগই অনেকের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কারণ যুদ্ধে অধিকাংশ গাজাবাসী বাড়ি ও জীবিকা হারিয়েছেন।

প্রথম ইফতারে ইসরার পরিবারের সদস্যদের পাতে ছিল ‘মুসাখান’, ফিলিস্তিনের এই খাবারটি মুরগী, পাতলা রুটি ও অনেক বেশি পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি করা হয়।

আমরা জানি, আমরা ভাগ্যবানদের দলে আছি। গাজার অধিকাংশ মানুষই মুরগী কেনার সামর্থ্য রাখে না, যা বাজারে যুদ্ধপূর্ব সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ দামে আবার বাজারে আসছে, লিখেছেন তিনি।

ইসরা লিখেছেন, সমৃদ্ধ আর ঐতিহ্যবাহী ইফতারই কেবল গাজায় ইফতারের টেবিলে অনুপস্থিত নয়, যুদ্ধে ৪৮ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। অনেকেই, যারা সপরিবারে মারা গেছে তারা আর রোজা পালন করবেন না, ইফতারে এক টেবিলে বসবেন না।

গাজার এই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া লিখেছেন, অনেকের বাড়িতে ইফতারের টেবিলে একটি আসন ফাঁকা থাকবে, একজন বাবার কণ্ঠস্বর আর তার সন্তানদের ইফতারের জন্য ডাকবে না, রোজা ভাঙার জন্য একজন সন্তানের ছটফটানি আর দেখা যাবে না অথবা একজন মায়ের দক্ষ হাতে সুস্বাদু খাবার আর তৈরি করা হবে না।

আমিও আমার ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছি। আমার খালার স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, যিনি প্রতিবছর আমাদের ইফতারের দাওয়াত দিতেন।

আমার বন্ধু শাইমা, লিনা ও রোয়া, যাদের সঙ্গে আমি তারাবির পর দেখা করতাম, তারা সবাই শহীদ হয়েছেন।

আমাদের মসজিদ ধ্বংস করা যাবে, আমাদের বিশ্বাস ভাঙা যাবে না। আমরা আমাদের অর্ধ-ভগ্ন বাড়িতে তাঁবু টানিয়ে তারাবিহ পড়ব, ফিসফিস করে দোয়ায় সব বলব, কোরান তেলাওয়াতে আরাম খুঁজব, জেনে রাখব আমরা যেসব কষ্ট সহ্য করেছি, তার জন্য তিনি আমাদের প্রতিদান দেবেন, লিখেছেন ইসরা।