১৫ বছরের আওয়ামী লীগের শাসনামলে গোটা খাগড়াছড়িই ছিল দলটির কাছে জিম্মি। একটি পরিবারের সিদ্ধান্তেই সব চলতো সেখানে। সেই পরিবারের নাম কুজেন পরিবার। সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ছিলেন খাগড়াছড়ির সর্বেসর্বা। তার নিয়ন্ত্রণে থাকতো বিভিন্ন নির্বাচনের দলীয় মনোনয়ন, ঠিকাদারি এবং রাজনীতি।
সাধারণ কর্মচারী থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, অনিয়মের মাধ্যমে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ। সবশেষ সংসদ নির্বাচনের আগে এক তরুণীর সাথে তার আপত্তিকর ভিডিও ফাঁস হয়। এমন কোনো অভিযোগ বাদ নেই যা তার বিরুদ্ধে উঠেনি। গত ৫ই আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পরপর তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন।
খাগড়াছড়ির একক নিয়ন্ত্রক ছিলেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। অর্থের বিনিময়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করা, দলীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ পাইয়ে দেয়া ছাড়াও সরকারের উন্নয়নমূলক কাজে কমিশন, সরকারি বরাদ্দের অর্থ নিজের সম্পদ উন্নয়নে ব্যয় করা ও ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে ১৫ বছরে খাগড়াছড়ি পার্বত্য অঞ্চলের যেকোনো নির্বাচনে মনোনয়ন কে পাবেন সেটার নির্ধারক ছিলেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ সহ সব নির্বাচনের প্রার্থী ঠিক করে দিতেন তিনি। তার মনোনীত প্রার্থীকে বিজয়ী করতে দলীয় সাপোর্ট প্রয়োগ করতেন তিনি। আর এসবই করতেন মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে। টাকা না দিলে প্রার্থিতা মিলতো না কারও, সে যতই যোগ্য হোক না কেন।
খাগড়াছড়ি জেলা, ৯টি উপজেলা, ৩টি পৌরসভা ও সকল ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের সব কমিটিতে পদ-পদবি পেতো কেবল তার অনুসারীরা। পাশাপাশি উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেয়রও হয়েছে তার পছন্দের লোকজন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে বাণিজ্য করেছেন তিনি। মনোনয়ন নিশ্চিত করতে প্রার্থীদের গুনতে হয়েছে এলাকার গুরুত্ব বিবেচনা করে ৫০ লাখ থেকে এক কোটির অধিক টাকা।
তার নিজের পছন্দের লোক ছাড়া দলের পদ ও জনপ্রতিনিধি হওয়া প্রায় অসম্ভব করে ফেলেছিলেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। তার নির্দেশ অমান্য করতে পারে, এমন কোনো নেতা বা জনপ্রতিনিধি শান্তিতে থাকতে পারতো না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একাধিক কর্মী বলেন, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা'র প্রভাবে আমরা কেউ শান্তিতে ছিলাম না। মতের অমিল হলেই তিনি আমাদের বিরোধী দলের মতো অত্যাচার করতেন।
দলীয় নেতাকর্মী ও ঠিকাদারিতে জড়িত বেশ ক’জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলা পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ড, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভাসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন প্রকল্পের কোন কাজ কে পাবেন, সেটাও ঠিক করে দিতেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। তার কিছু নিকটাত্মীয় এই ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা রাখতেন। কুজেন্দ্র ত্রিপুরা এবং তার সিন্ডিকেটের লোকদের প্রকল্পের মোট বরাদ্দের ৮ শতাংশ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিতে হতো।
বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। সরকারি খাস জমি দখল করে আলুটিলা পর্যটন এলাকায় খাস্রাং রিসোর্ট, রাঙামাটির সাজেক ভ্যালির কংলাক পাড়ায় ৪ দশমিক শূন্য ৮ একর ভূমির ওপর খাস্রাং-২ নামে রিসোর্টে ১০ কোটি টাকার বিনিয়োগ। খাগড়াছড়ি শহরের খাগড়াপুর, খবংপুরিয়া কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দুইটি বিলাসবহুল বাড়ি। নামে বে-নামে খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা, রামগড় ও পার্শ্ববর্তী রাঙামাটি জেলায় রয়েছে তার শত শত একর জমি ও কোটি কোটি টাকার সেগুন বাগান। ঢাকার উত্তরায় তার তিনটি দামি ফ্ল্যাট ও পূর্বাচলে রয়েছে কোটি টাকার জমি। খাগড়াছড়িতে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা নিজে এবং জামাতাদের দিয়ে অবৈধ ইট ভাটার ব্যবসাও পরিচালনা করতেন। বেসরকারি হাসপাতালেও মোটা অঙ্কের অংশীদারিত্ব রয়েছে তার।
সরকারি প্রকল্প হাতিয়ে কৃষি খামার ও মৎস্য খামার গড়ে তুলেছিলেন তিনি। অবৈধ কাঠ ব্যবসা এবং অবৈধ বালু ব্যবসাসহ নানা খাতে শক্তিশালী সিন্ডিকেটও গড়ে তুলেছিলেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। বেশকিছু ট্রাক ও পিকআপসহ তার ছিল ল্যান্ডক্রজারসহ তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি। এছাড়াও ভারতের ত্রিপুরায় কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার বাড়ি রয়েছে এবং গত এক দশকে শত শত কোটি টাকা ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন বলেও জানিয়েছে তারই বিশ্বস্ত একটি সূত্র। বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর, মোটাদাগের সঞ্চয় এবং নিজের পাশাপাশি স্ত্রীর নামেও রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ এবং স্বর্ণালংকার। তবে পাহাড়সম সম্পদের মালিক বনে যাওয়া কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা নির্বাচনী হলফনামায় সম্পদের সিকিভাগও উল্লেখ করেননি। সবশেষ ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনের হলফনামা ঘেঁটে দেখা গেছে গত ১০ বছরে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার আয় বেড়েছে ১৩ গুণ। তবে প্রকৃত হিসাব আরও অন্তত ২০ গুণ বেশি। সম্পদের পরিমাণও ৮৫ শতাংশের বেশি আড়াল করেছিলেন হলফনামায়।
বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের দমনে তার ভূমিকা ছিল কঠোর। সবশেষ সরকারের পতনের মাত্র একদিন আগে জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদুদ ভুঁইয়া বাড়ি ভাঙচুর করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার নির্দেশে হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। ৪ঠা আগস্ট বিকেলে দলীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ওয়াদুদ ভূঁইয়ার বাড়িতে হামলার অভিযোগটি পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। বিএনপি নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি নিজ দলের ভিন্ন মতের নেতা-কর্মীদেরও উৎখাত করতে মরিয়া ছিলেন তিনি। গত একযুগে আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মী তার হামলা ও মামলার শিকার হয়েছে।
৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা খাগড়াছড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। এরপর তার অবস্থান সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তবে কিছু সূত্র জানিয়েছে যে তিনি অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছেন।
এদিকে খাগড়াছড়ির জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, 'কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা খাগড়াছড়ির একজন ত্রাস ছিলেন। তার নেতৃত্বে জেলায় ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আদর্শিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের বিভিন্ন ভাবে হয়রানি করেছেন। কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য পদক্ষেপ এবং সরকারি পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে আরও খতিয়ে দেখার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন খাগড়াছড়ির খোদ আওয়ামী নেতৃবৃন্দ।
অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার অভিযোগে গত ৪ সেপ্টেম্বর কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদক কার্যালয়ে তলব করা হলেও কোন সাড়া মেলেনি। ৫ আগস্টের পর হত্যাসহ বিভিন্ন সহিংসতা এবং হামলার অভিযোগে এ পর্যন্ত খাগড়াছড়ি সদর সহ জেলার বিভিন্ন থানায় কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার বিরুদ্ধে অন্তত ১৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলেও তিনি ভারতের মিজোরামে পালিয়ে গেছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
অভিযোগের বিষয়ে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাদের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। একটি সূত্র জানিয়েছে, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।