ইতিহাস ঐতিহ্যে ঘেরা কুষ্টিয়ায় নেই পর্যটকের ভিড়
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই, অমর কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন, কাঙাল হরিনাথ মজুমদারসহ অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী মনীষীর স্মৃতিধন্য জেলা কুষ্টিয়া। ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এ জেলায় রয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা
কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে কুষ্টিয়া জেলা পর্যটকদের তেমন একটা আকৃষ্ট করতে পারছে না। এমনকি ঘুরে বেড়ানোর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট এই শীত মৌসুমেও কাঙ্ক্ষিত পর্যটক আসছে না। সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ ও প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে জেলার পর্যটন খাত সমৃদ্ধ করা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক ও কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সরওয়ার মুর্শেদ বলেন, কুষ্টিয়া জেলায় পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু নানান প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। সরকারি এবং বেসরকারিভাবে যদি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া যায় তাহলে কুষ্টিয়া জেলায় পর্যটন খাত যেমন সমৃদ্ধ হবে পাশাপাশি পর্যটকরাও আকৃষ্ট হবেন। পর্যটন খাত সমৃদ্ধ করার দায়িত্ব শুধু সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে চলবে না। এক্ষেত্রে বেসরকারি পর্যায়েও উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। থাকা-খাওয়া, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা পর্যটন বিকাশের পথে বড় বাধা।
ড. সরওয়ার মুর্শেদ বলেন, অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকার বিষয়টিও রয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একসময় জমিদারি দেখাশোনা করার জন্য কলকাতা থেকে ট্রেনে চেপে কুষ্টিয়ার বড় রেলওয়ে স্টেশনে এসে নামতেন। সেই বড় রেলস্টেশনটি আজ সংস্কার ও যত্নের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। প্রয়োজনীয় সংস্কার করে রবীন্দ্র স্টেশন নামকরণ করে যদি স্টেশনটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া যায় তাহলে এটি পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া বড় রেলস্টেশনের সামনে যে টেগর লজ রয়েছে সেটিও যদি প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রবীন্দ্র জাদুঘর করা যায় তাহলে নিঃসন্দেহে এটি পর্যটকদের কাছে টানতে সক্ষম হবে। ১৯০৮ সালে স্থাপিত উপমহাদেশের এক কালের সবচেয়ে বড় বস্ত্রের মিল ঐতিহ্যবাহী মোহিনী মিল এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। মিলের অনেক জায়গাই এরই মধ্যে দখল হয়ে গেছে। যেটুকু জায়গা অবশিষ্ট রয়েছে সেটি সরকারিভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে জাদুঘরে রূপ দেওয়া যেতে পারে। ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী এরকম নানান সমৃদ্ধ স্থাপনা রয়েছে কুষ্টিয়ায়।
কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম বলেন, পর্যটন খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতারও চরম ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া পর্যাপ্ত নিরাপত্তার পাশাপাশি প্রচার-প্রচারণার ঘাটতিও এজন্য দায়ী। পর্যটকদের জন্য নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারায় অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি
কুষ্টিয়া শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে কুমারখালী উপজেলায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়ি। বাগান, পুকুর, মূল ভবনসহ এই কুঠিবাড়ির আয়তন প্রায় ৩৩ বিঘা। মূল ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে প্রায় আড়াই বিঘা জমির ওপর। অত্যন্ত মনোরমভাবে সাজানো এই কুঠিবাড়ি। কবির ব্যবহার্য অনেক জিনিসপত্রই রয়েছে এখানে। শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে প্রতি বছর ২৫ বৈশাখ জাতীয় পর্যায়ে কবিগুরুর জন্মবার্ষিকী পালিত হয়। গ্রীষ্মকালে এটি সর্বসাধারণের জন্য খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। শীতকালে খোলা হয় সকাল ৯টায় এবং বন্ধ হয় বিকেল ৫টায়। সাপ্তাহিক বন্ধ রোববার। প্রবেশমূল্য সাধারণভাবে ২০ টাকা আর বিদেশি নাগরিকদের জন্য ১০০ টাকা। এছাড়া কুঠিবাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের কাছারি বাড়ি। কুষ্টিয়া শহরের মজমপুর থেকে কুঠিবাড়ি যেতে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে জনপ্রতি ভাড়া মাত্র ৫০ টাকা। রিজার্ভ ভাড়া নিলে ৩০০ টাকা গুনতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের টেগর লজ
কুষ্টিয়ার বড় রেলস্টেশনের একেবারেই সামনে শহরের মিলপাড়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিমাখা লাল রঙের দোতলা কারুকার্যখচিত দ্বিতল ভবনটি টেগর লজ হিসেবে পরিচিত। ১৮৯৫ সালে কবিগুরু টেগর অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবসায়িক কাজে কুষ্টিয়ায় এসে এই টেগর লজ ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন। প্রায় ৯ কাঠা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত টেগর লজের প্রবেশপথে কবিগুরুর একটি আবক্ষ মূর্তি রয়েছে। নিচতলায় একটি বড় হল ঘর এবং ওপরের তলার তিনটি ঘরের একটিতে কবিগুরুর আঁকা ১২টি ছবির অনুকৃতি রাখা হয়েছে। এই টেগর লজে বসে কবি অসংখ্য কবিতা রচনা করেছেন, যা পরে ক্ষণিকা কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়। কুষ্টিয়া শহরের মজমপুর থেকে এই টেগর লজের দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার। কুষ্টিয়া পৌরসভা দীর্ঘদিন ধরে এটি দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে।
বাউল সম্রাট লালন সাঁইজির মাজার
কুষ্টিয়া জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থানগুলোর আরেকটি হচ্ছে বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইজির আখড়া বা লালন সাঁইজির মাজার। এটি কুমারখালী উপজেলার চাঁপড়া ইউনিয়নের ছেঁউড়িয়া গ্রামে অবস্থিত। এটি মূলত লালন ফকিরের সমাধিস্থল। সমাধি ঘিরে রয়েছে তার শিষ্যদের সারি সারি কবর। শিষ্য ও দেশ-বিদেশের বাউলরা এ আখড়ায় বিশেষ তিথিতে সমবেত হয়ে উৎসবে মেতে ওঠেন। বছরে দুবার এ জায়গায় লালন মেলা বসে। একবার দোল পূর্ণিমার সময়, আরেকবার কার্তিক মাসের ১ তারিখে। ওই সময় দেশের বিভিন্ন স্থান, এমনকি দেশের বাইরে থেকেও ভক্তরা দলে দলে এখানে ছুটে আসেন।
মাজারের সামনে মরা কালী নদী প্রাঙ্গণের উন্মুক্ত মাঠে রয়েছে বিশাল মঞ্চ এবং রাজঘাট। এখানে বসে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটাতে পারবেন যে কেউ। কুষ্টিয়ার মজমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে মাত্র ২০ মিনিটে ব্যাটারিচালিত রিকশা কিংবা ইজিবাইকে লালন আখড়ায় আসা যায়। ইজিবাইকে জনপ্রতি ভাড়া ২০ টাকা।
মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা
বিষাদ সিন্ধুর রচয়িতা অমর কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেনের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার লাহিনীপাড়া এলাকায়। কুষ্টিয়া শহর থেকে ইজিবাইকে জনপ্রতি ৩০ টাকা ভাড়ায় এখানে আসা যায়। তার এ বাস্তুভিটা ঘিরে বর্তমানে এখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি লাইব্রেরি, জাদুঘর ও অডিটোরিয়াম রয়েছে। সেখানে মীর মশাররফ হোসেনের ব্যবহার্য জিনিসপত্র রাখা হয়েছে।