ইউরোপে টিকে থাকার লড়াইয়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বেশিরভাগ দেশের সরকার মুক্ত গণমাধ্যম চর্চায় বাধা সৃষ্টি করছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে দুর্বল করে তুলছে। এতে ইউরোপে গণমাধ্যমের বহুত্ববাদ ও স্বাধীনতা আশঙ্কাজনকভাবে কমতে শুরু করেছে। এমনকি কিছুক্ষেত্রে গণমাধ্যমের অস্তিত্বই সংকটে পড়েছে। সম্প্রতি ইউরোপের মানবাধিকার সংস্থা সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের (লিবার্টিজ) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
লিবার্টিজের প্রতিবেদনের বরাতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, গণমাধ্যমগুলোর মালিকানা পুঞ্জিভূত হয়ে অল্পসংখ্যক মানুষের হাতে চলে যাওয়ার কারণে এ সংকট শুরু হয়েছে। এতে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে-এমনকি যেসব দেশের গণমাধ্যম বাক-স্বাধীনতার চর্চার জন্য ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত ছিল, সেখানেও গণমাধ্যমের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসতে শুরু করেছে।
সম্প্রতি ২১টি দেশ থেকে ৪৩টি মানবাধিকার সংস্থার সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ইইউয়ের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কিত এই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, মালিকানায় স্বচ্ছতার অভাব, সরকারের সৃষ্ট চাপ ও সাংবাদিকের প্রতি নানারকম হুমকির কারণে প্রতিনিয়তই গণমাধ্যমগুলো স্বাধীনতা হারাচ্ছে। এসব কারণে ইইউয়ের দেশগুলোর গণমাধ্যমের বহুত্ববাদ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
এ বিষয়ে প্রতিবেদনটির প্রধান সম্পাদক জনাথান ডে বলেছেন, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে সরকার দেশে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করার প্রক্রিয়া শুরু করে থাকে। তাই এ পরিস্থিতি মোটেই বিস্ময়কর নয়।
ইউরোপের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সুরক্ষার জন্য প্রণীত ‘ইউরোপীয় গণমাধ্যম স্বাধীনতা আইন (ইএমএফএ)’ কার্যকর হওয়ার আগেই মুখ থুবড়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেন জনাথান। তিনি বলেন, এই আইনের সফল বাস্তবায়নের ওপর অনেক দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুরক্ষায় সফলতা বা ব্যর্থতা নির্ভর করবে।
গণমাধ্যম বহুত্ববাদ কী?
গণমাধ্যম বহুত্ববাদ বলতে মূলত এই ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য থাকা বোঝায়। ইউনেস্কোর তথ্যমতে, কোনো দেশে গণমাধ্যম বহুত্ববাদ আছে বলতে বুঝতে হবে, সেখানকার জনগণের কাছে অনেকগুলো বিকল্প মাধ্যম আছে।
সংস্থাটির ভাষ্যে, গণমাধ্যম বহুত্ববাদ বলতে এমন একটি অবস্থা বোঝায় যেখানে সরকারি, বেসরকারি কিংবা ব্যক্তিগত মালিকানার গণমাধ্যম থাকবে, পাশাপাশি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যম থাকবে, রেডিও থাকবে, ইন্টারনেটভিত্তিক মাধ্যমসহ অনেক ধরনের বিকল্প থাকবে। সেখানে ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠস্বর তৈরি হবে। সবমিলিয়ে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ গণমাধ্যম ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকবে।
এদিকে, ইউরোপের বেশ কিছু দেশের গণমাধ্যমগুলোর মালিকানা অল্পসংখ্যক ধনীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বিশেষত ক্রোয়েশিয়া, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, নেদারল্যান্ড, স্লোভেনিয়া, স্পেন ও সুইডেনের গণমাধ্যমগুলোর মালিকানা গুটিকয়েক ধনকুবেরের হাতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
দেশেগুলোর গণমাধ্যমের মালিকানা নিয়ে স্বচ্ছতা না থাকায় এই সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে বলে মনে করেন জনাথান। যে কারণে চলতি বছরের আগস্টের আগেই ইএমএফএর অধীনে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে প্রকাশযোগ্য তথ্যসমূহ প্রকাশ করতে বলা হলেও বেশিরভাগ দেশই তা করতে পারেনি।
সাংবাদিক ও সংবাদ উৎসের নিরাপত্তা, গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর স্বাধীনতা ও মালিকানার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাধ্যতামূলক ইএমএফএ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে এই আইনটির পুরোপুরি বাস্তবায়নে বেশিরভাগ দেশ অনিচ্ছুক না হলে বলতে হবে তারা অপ্রস্তুত- মন্তব্য করেন জনাথান ডে।
কোন দেশের কী অবস্থা?
ফ্রান্সের ধনকুবের ভিনসেন্ট বোলোরের হাশেত গ্রুপসহ বেশ কিছু প্রকাশনা সংস্থাকে অধিগ্রহণের ঘটনা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটিতে গণমাধ্যমের বহুত্ববাদ উল্লেখযোগ্যভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
ইতালিতেও অনেকটা একইরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে দেখা গেছে। দেশটির কট্টর ডানপন্থি লেগা পার্টির এমপি অ্যান্তোনিও আঙ্গেলুচির ‘আঙ্গেলুচি গ্রুপ’ সম্প্রতি দেশটির প্রথমসারির বার্তা সংস্থা এজিআইকে অধিগ্রহণের পরিকল্পনা করছে। যদিও এরই মধ্যে তিনটি ইতালিয়ান পত্রিকার মালিকানা রয়েছে তার।
এদিকে সুইডেনের গণমাধ্যমগুলোর ৪৩ শতাংশের মালিকানা রয়েছে বোনিয়ার ব্যবসায়ী গ্রুপের অধীনে। এছাড়া নেদারল্যান্ডের আরটিএল নেদারল্যান্ড ও টালফা নেটওয়ার্কের হাতেই দেশটির ৭৫ শতাংশের বেশি টেলিভিশন নেটওয়ার্কের মালিকানা কুক্ষিগত রয়েছে।
জার্মানিতেও গণমাধ্যমের বহুত্ববাদ হুমকির মুখে পড়েছে। দেশটিতে বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমের ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে, পত্রিকার কাটতি ব্যাপকভাবে কমে গেছে, অনেক সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে।
হাঙ্গেরিতে গণমাধ্যমের মালিকানা পুঞ্জিভূতকরণ ও রাষ্ট্রীয় মাধ্যমগুলোর আধিপত্য বিস্তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের ঘনিষ্ঠ সেন্ট্রাল ইউরোপীয়ান প্রেস অ্যান্ড মিডিয়া ফাউন্ডেশনের (কেসমা) মালিকানায় কয়েকশ গণমাধ্যম রয়েছে।
দেশটিতে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ অলিগার্করা ২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন মাধ্যমগুলো কিনে কেসমাতে দান করা শুরু করে। ফলে ২০১৮ সালের মধ্যেই দেশটির মিডিয়া ব্যবস্থা সরকার নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে।
হাঙ্গেরির ছাড়াও বুলগেরিয়া, গ্রিস, ক্রোয়েশিয়া ও ইতালির সরকারও বিভিন্নভাবে গণমাধ্যমের ওপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে থাকে। রাষ্ট্র সমর্থিত মাধ্যমগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে যাওয়া বিজ্ঞাপনের বরাদ্দের বণ্টনে বৈষম্যসহ নানাভাবে দেশগুলোর সরকার গণমাধ্যম স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা চালায় বলে লিবার্টিজের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাঙ্গেরির গণমাধ্যম পুরোপুরিভাবে সরকারের মুখপাত্র হয়ে উঠেছে। একই পথে এগোচ্ছে স্লোভাকিয়ায়ও। দেশটির নতুন আইনে সম্পাদকীয় স্বাধীনতার সুরক্ষা বাতিল করা হয়েছে।
এছাড়াও গত বছরে ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, হাঙ্গেরি এবং স্পেনে সাংবাদিকরা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, শারীরিক হামলাসহ পুলিশি সহিংসতার শিকার হয়েছেন। কিছু দেশে নারী সাংবাদিকদের অন্যায়ভাবে সমস্যায় ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।
পাশাপাশি, স্ট্র্যাটেজিক লিটিগেশন অ্যাগেইনস্ট পাবলিক পার্টিসিপেশন আইনটির অপব্যবহার করে ইউরোপের কমপক্ষে এক ডজন দেশে সাংবাদিকদের জন্য অস্তিত্বহীনতার ঝুঁকি তৈরি করেছে বলে প্রতিবেদনের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে।
বুলগেরিয়া, জার্মানি, গ্রিস, মাল্টা, নেদারল্যান্ডস এবং স্পেনসহ বেশ কয়েকটি দেশে সরকারি কর্মকর্তারা তথ্যপ্রাপ্তি অনুরোধ প্রত্যাখ্যান বা বাধা দিয়ে সাংবাদিকদের কাজে বাধা দিয়েছেন বলেও প্রতিবেদনে জানা গেছে।