London ০৩:৫৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অসুস্থতা যেভাবে তাঁকে ডাক্তার হতে অনুপ্রেরণা জোগাল

মাহমুদুর রহমানছবি: অপূর্ব চন্দ্র ঘোষ

এক সকালে ঘুম থেকে উঠে মাহমুদুর রহমান আবিষ্কার করলেন, চাইলেও হাত দুটো ইচ্ছেমতো নাড়তে পারছেন না। ধীরে ধীরে শরীরের অন্যান্য অঙ্গের ওপরও নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেন ঝিনাইদহ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির এই ছাত্র। প্রথমে স্থানীয় একটা ক্লিনিকে তাঁকে নেওয়া হয়। তারা রোগটা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে না পেরে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠিয়ে দেয়। সেখানেই চিকিৎসকেরা নিশ্চিত করেন—জিবিএসে আক্রান্ত তিনি।

সেই ঘটনার প্রায় ৯ বছর পর মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে আমাদের কথা হলো। তিনি নিজেই এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। রোগী হয়ে যেখানে পা রেখেছিলেন, কীভাবে সেই প্রতিষ্ঠানেরই গর্বিত ছাত্র হলেন?

জিবিএস কী

জিবিএস বা গুলেন ব্যারি সিন্ড্রোম আমাদের দেশে খুব পরিচিত অসুখ নয়। এই রোগে আক্রান্ত হলে মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে দুর্বলতা দেখা দেয়। আক্রান্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে দেহের বিভিন্ন মাংসপেশির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করে।

২৩ অক্টোবর ঢাকা মেডিকেল কলেজের সবুজ চত্বরে বসে স্মৃতিচারণা করছিলেন মাহমুদুর, ‘আইসিইউতে আমার চিকিৎসা চলল। হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও মস্তিষ্ক ছাড়া শরীরের প্রায় সবখানেই ভাইরাসটি আক্রমণ করেছিল। আমি পুরো শয্যাশায়ী হয়ে গেলাম। তখন শুধু চোখে দেখতে, কথা বলতে আর শুনতে পারতাম।’

চিকিৎসকদের পরামর্শে ঝিনাইদহে বাড়িতে থেকেই চলল চিকিৎসা। ভ্রু ও ঠোঁট ছাড়া কিছু নাড়াতে পারতেন না। তাই শুরু হয় ফিজিওথেরাপি। এভাবে চলে টানা প্রায় সাত মাস। পুরোটা সময় লেখাপড়া থেকে দূরে ছিলেন তিনি।

ষষ্ঠ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষাটা কোনো রকমে দিলেন। টানা সাত মাস পড়াশোনা না করে পরীক্ষায় বসলে যা হওয়ার তা-ই হলো—রেজাল্ট এল খুবই খারাপ। এরপর ধীরে ধীরে পড়ার টেবিলে ফিরতে শুরু করেন। আরও বছরখানেক পর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়। পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই জেএসসি পরীক্ষা দিলেন। ফলাফলও ভালো হলো; যশোর বোর্ড থেকে পেলেন জিপিএ–৫।

স্কুল পেরোনোর পরই অনেকে তাঁকে ‘ডাক্তার’ ডাকতে শুরু করে দিয়েছিল

স্কুল পেরোনোর পরই অনেকে তাঁকে ‘ডাক্তার’ ডাকতে শুরু করে দিয়েছিলছবি: অপূর্ব চন্দ্র ঘোষ

বইয়ের পড়াশোনার পাশাপাশি পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যক্রমেও মাহমুদুরের অর্জন ভালো। স্কুলজীবনে একাধিক পুরস্কারও পেয়েছেন। মাহমুদুরের সহপাঠী বাঁধন আহমেদ বলেন, ‘ও খুবই শান্ত স্বভাবের পড়ুয়া ছেলে। আড্ডায় কিংবা খেলাধুলায় ওকে সেভাবে পাওয়া যেত না।’

উচ্চমাধ্যমিকের আগেই মেডিকেলের প্রস্তুতি

ছোটবেলায় তেমন কোনো লক্ষ্য ছিল না। তবে মাহমুদুরের মা চাইতেন, ছেলে বড় হয়ে যেন সরকারি চাকরিজীবী হন। কিন্তু জিবিএসে আক্রান্ত হওয়ার পর বেশ অসহায় হয়ে পড়েন মাহমুদুর। চিকিৎসকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন—এই বুঝি ভালো কোনো খবর আসবে। তখন থেকেই চিকিৎসক হওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়। যে জিবিএস একটা সময় তাঁর জীবনকে থামিয়ে দিয়েছিল, সেই জিবিএসই ভবিষ্যতে চিকিৎসক হওয়ার অনুপ্রেরণা হয়ে আসে মাহমুদুরের কাছে।

২০২০ সালে ঝিনাইদহ সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পান তিনি। স্বপ্নটা বেগ পায় আরও।

কিন্তু এসএসসির পরপরই আসে করোনার আঘাত। কলেজের ক্লাস আটকে গেলেও ‘স্থবির’ সময়টাতে বসে থাকেননি মাহমুদুর। মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন। পরীক্ষাপদ্ধতি, প্রশ্নের ধরন সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা নিয়ে শুরু করেন প্রস্তুতি। উচ্চমাধ্যমিকের ক্লাস শুরুর আগেই মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ভালো একটা প্রস্তুতি তাঁর নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। মাহমুদুর বলেন, ‘ইন্টারমিডিয়েটের ক্লাস শুরুর আগেই আমার প্রস্তুতি দেখে শিক্ষকেরা বেশ অবাক হয়েছিলেন। অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেন—আমি মেডিকেলে চান্স পাবই। কেউ কেউ তো “ডাক্তার সিয়াম” (মাহমুদুরের ডাকনাম) বলে ডাকাও শুরু করে দিয়েছিলেন।’

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পেয়ে ঢাকার ফার্মগেটে কোচিং শুরু করেন। বেশ ভালো প্রস্তুতি আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে সেবারের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষাটা দেন মাহমুদুর। ফল প্রকাশের পর দেখা যায়, জাতীয় মেধাতালিকায় ৯২তম হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে সুযোগ পেয়েছেন তিনি।

হোয়াটসঅ্যাপে মাহমুদুরের বাবা মো. মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও কথা হলো। ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার এই সমবায় কর্মকর্তা বলেন, ‘ছেলেটা আমার মৃত্যুশয্যায় ছিল। একটা কাপড় বিছানায় ফেলে রাখলে যেমন পড়ে থাকে, সেভাবে নিথর হয়ে পড়ে থাকত। সেখান থেকে শুধু নিজের অধ্যবসায়, প্রচেষ্টা আর সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় আজ এত দূর এসেছে। আমি চাই, ও চিকিৎসক হয়ে মানুষের জন্য কিছু করুক, সমাজের জন্য কিছু করুক।’

মাহমুদুর এখন পড়াশোনা নিয়ে বেশ খুশি। তবে ফিজিওথেরাপিটা এখনো মাঝেমধ্যে নিতে হয়। পড়াশোনা আর চিকিৎসা দুটোই চলছে একই সঙ্গে। ভবিষ্যতে তাঁর ভালো একজন সার্জন হওয়ার ইচ্ছা।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৪:১৭:১৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪
২৮
Translate »

অসুস্থতা যেভাবে তাঁকে ডাক্তার হতে অনুপ্রেরণা জোগাল

আপডেট : ০৪:১৭:১৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪

মাহমুদুর রহমানছবি: অপূর্ব চন্দ্র ঘোষ

এক সকালে ঘুম থেকে উঠে মাহমুদুর রহমান আবিষ্কার করলেন, চাইলেও হাত দুটো ইচ্ছেমতো নাড়তে পারছেন না। ধীরে ধীরে শরীরের অন্যান্য অঙ্গের ওপরও নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেন ঝিনাইদহ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির এই ছাত্র। প্রথমে স্থানীয় একটা ক্লিনিকে তাঁকে নেওয়া হয়। তারা রোগটা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে না পেরে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠিয়ে দেয়। সেখানেই চিকিৎসকেরা নিশ্চিত করেন—জিবিএসে আক্রান্ত তিনি।

সেই ঘটনার প্রায় ৯ বছর পর মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে আমাদের কথা হলো। তিনি নিজেই এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। রোগী হয়ে যেখানে পা রেখেছিলেন, কীভাবে সেই প্রতিষ্ঠানেরই গর্বিত ছাত্র হলেন?

জিবিএস কী

জিবিএস বা গুলেন ব্যারি সিন্ড্রোম আমাদের দেশে খুব পরিচিত অসুখ নয়। এই রোগে আক্রান্ত হলে মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে দুর্বলতা দেখা দেয়। আক্রান্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে দেহের বিভিন্ন মাংসপেশির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করে।

২৩ অক্টোবর ঢাকা মেডিকেল কলেজের সবুজ চত্বরে বসে স্মৃতিচারণা করছিলেন মাহমুদুর, ‘আইসিইউতে আমার চিকিৎসা চলল। হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও মস্তিষ্ক ছাড়া শরীরের প্রায় সবখানেই ভাইরাসটি আক্রমণ করেছিল। আমি পুরো শয্যাশায়ী হয়ে গেলাম। তখন শুধু চোখে দেখতে, কথা বলতে আর শুনতে পারতাম।’

চিকিৎসকদের পরামর্শে ঝিনাইদহে বাড়িতে থেকেই চলল চিকিৎসা। ভ্রু ও ঠোঁট ছাড়া কিছু নাড়াতে পারতেন না। তাই শুরু হয় ফিজিওথেরাপি। এভাবে চলে টানা প্রায় সাত মাস। পুরোটা সময় লেখাপড়া থেকে দূরে ছিলেন তিনি।

ষষ্ঠ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষাটা কোনো রকমে দিলেন। টানা সাত মাস পড়াশোনা না করে পরীক্ষায় বসলে যা হওয়ার তা-ই হলো—রেজাল্ট এল খুবই খারাপ। এরপর ধীরে ধীরে পড়ার টেবিলে ফিরতে শুরু করেন। আরও বছরখানেক পর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়। পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই জেএসসি পরীক্ষা দিলেন। ফলাফলও ভালো হলো; যশোর বোর্ড থেকে পেলেন জিপিএ–৫।

স্কুল পেরোনোর পরই অনেকে তাঁকে ‘ডাক্তার’ ডাকতে শুরু করে দিয়েছিল

স্কুল পেরোনোর পরই অনেকে তাঁকে ‘ডাক্তার’ ডাকতে শুরু করে দিয়েছিলছবি: অপূর্ব চন্দ্র ঘোষ

বইয়ের পড়াশোনার পাশাপাশি পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যক্রমেও মাহমুদুরের অর্জন ভালো। স্কুলজীবনে একাধিক পুরস্কারও পেয়েছেন। মাহমুদুরের সহপাঠী বাঁধন আহমেদ বলেন, ‘ও খুবই শান্ত স্বভাবের পড়ুয়া ছেলে। আড্ডায় কিংবা খেলাধুলায় ওকে সেভাবে পাওয়া যেত না।’

উচ্চমাধ্যমিকের আগেই মেডিকেলের প্রস্তুতি

ছোটবেলায় তেমন কোনো লক্ষ্য ছিল না। তবে মাহমুদুরের মা চাইতেন, ছেলে বড় হয়ে যেন সরকারি চাকরিজীবী হন। কিন্তু জিবিএসে আক্রান্ত হওয়ার পর বেশ অসহায় হয়ে পড়েন মাহমুদুর। চিকিৎসকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন—এই বুঝি ভালো কোনো খবর আসবে। তখন থেকেই চিকিৎসক হওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়। যে জিবিএস একটা সময় তাঁর জীবনকে থামিয়ে দিয়েছিল, সেই জিবিএসই ভবিষ্যতে চিকিৎসক হওয়ার অনুপ্রেরণা হয়ে আসে মাহমুদুরের কাছে।

২০২০ সালে ঝিনাইদহ সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পান তিনি। স্বপ্নটা বেগ পায় আরও।

কিন্তু এসএসসির পরপরই আসে করোনার আঘাত। কলেজের ক্লাস আটকে গেলেও ‘স্থবির’ সময়টাতে বসে থাকেননি মাহমুদুর। মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন। পরীক্ষাপদ্ধতি, প্রশ্নের ধরন সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা নিয়ে শুরু করেন প্রস্তুতি। উচ্চমাধ্যমিকের ক্লাস শুরুর আগেই মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ভালো একটা প্রস্তুতি তাঁর নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। মাহমুদুর বলেন, ‘ইন্টারমিডিয়েটের ক্লাস শুরুর আগেই আমার প্রস্তুতি দেখে শিক্ষকেরা বেশ অবাক হয়েছিলেন। অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেন—আমি মেডিকেলে চান্স পাবই। কেউ কেউ তো “ডাক্তার সিয়াম” (মাহমুদুরের ডাকনাম) বলে ডাকাও শুরু করে দিয়েছিলেন।’

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পেয়ে ঢাকার ফার্মগেটে কোচিং শুরু করেন। বেশ ভালো প্রস্তুতি আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে সেবারের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষাটা দেন মাহমুদুর। ফল প্রকাশের পর দেখা যায়, জাতীয় মেধাতালিকায় ৯২তম হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে সুযোগ পেয়েছেন তিনি।

হোয়াটসঅ্যাপে মাহমুদুরের বাবা মো. মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও কথা হলো। ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার এই সমবায় কর্মকর্তা বলেন, ‘ছেলেটা আমার মৃত্যুশয্যায় ছিল। একটা কাপড় বিছানায় ফেলে রাখলে যেমন পড়ে থাকে, সেভাবে নিথর হয়ে পড়ে থাকত। সেখান থেকে শুধু নিজের অধ্যবসায়, প্রচেষ্টা আর সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় আজ এত দূর এসেছে। আমি চাই, ও চিকিৎসক হয়ে মানুষের জন্য কিছু করুক, সমাজের জন্য কিছু করুক।’

মাহমুদুর এখন পড়াশোনা নিয়ে বেশ খুশি। তবে ফিজিওথেরাপিটা এখনো মাঝেমধ্যে নিতে হয়। পড়াশোনা আর চিকিৎসা দুটোই চলছে একই সঙ্গে। ভবিষ্যতে তাঁর ভালো একজন সার্জন হওয়ার ইচ্ছা।