London ১১:৩৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২১ জুলাই ২০২৫, ৬ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম:
কেন্দ্রের কতিপয় নেতার অযাচিত হস্তক্ষেপে , নাটোরে বিএনপির ভগ্ন দশা! ফরিদপুর-১ আসনে নির্বাচনী সমীকরণে নয়া উত্তাপ: নতুন প্রার্থীকে ঘিরে গণআলোড়ন, মাঠে বাড়ছে প্রত্যাশা ও প্রতিযোগিতা ব্যারিস্টার কায়সার কামালের উদ্যোগে চোখের আলো ফিরে পাচ্ছেন তারা শরিতুল্যাহ মাস্টার তিস্তা সেতু’ নামকরণের দাবিতে গাইবান্ধাবাসীর মানববন্ধন দুর্গাপুরে বসতঘর থেকে স্বামী-স্ত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার,এলাকায় চাঞ্চল্য কালিয়াকৈরে সড়ক দুর্ঘটনায় ওষুধ ব্যবসায়ী নিহত নিরাপদ পারাপারের জন্য: বদলগাছী থানার মোড়ে ফুটওভার ব্রিজের দাবী শিক্ষার্থীদের আত্রাই ইউটিউবার রানার বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর প্রতারণার অভিযোগ মিরাটে আরপিএ’র ব্যতিক্রমী ফ্রি-মেডিকেল ক্যাম্প রাজশাহীতে বই পড়ে পুরস্কার পেল ছাত্র -ছাত্রীরা

৩৬৫ পুকুরের গ্রাম সোহাসা: নওগাঁর বুকে এক বিস্ময়কর ইতিহাস ও ঐতিহ্য

এস এম মোস্তাকিম, বদলগাছী (নওগাঁ) প্রতিনিধি

নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার এক অনন্য গ্রামের নাম সোহাসা। জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রামটি তার নামের কারণে নয়, বরং পরিচিতি পেয়েছে “তিন শতাধিক এর বেশি পুকুরের গ্রাম” হিসেবে। গ্রামের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য পুকুর শুধু পানির উৎস নয়, বরং শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাস, লোককথা আর গ্রামীণ অর্থনীতির এক জীবন্ত সাক্ষী।

সোহাসা গ্রামের নামকরণ বা পুকুরগুলোর সঠিক ইতিহাস নিয়ে লিখিত কোনো দলিল না থাকলেও, স্থানীয়দের মুখে মুখে নানা লোককথা ও ধারণা রয়েছে। প্রবীণদের মতে, শত শত বছর আগে এই অঞ্চলে পানীয় জলের তীব্র সংকট ছিল। সেই সংকট দূর করতে এবং চাষাবাদের সুবিধার জন্য তৎকালীন জমিদার ও প্রভাবশালী ব্যাক্তিরা প্রজাদের কল্যাণে অসংখ্য পুকুর খনন শুরু করেন।

গ্রামের সবচেয়ে বাসিন্দা দীনেশ মন্ডল বলেন, “আমার দাদার কাছে শুনেছি, এই গ্রামের হিন্দু জমিদার এক ব্যাক্তি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি ৩৬৫ দিনে ৩৬৫টি পুকুর খনন করবেন। যদিও তিনি তা সম্পন্ন করতে পারেননি, তবে তার খনন করা পুকুরগুলোই এই গ্রামের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। এরপর বংশ পরম্পরায় গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারই নিজেদের প্রয়োজনে পুকুর খনন করে।

আরেকটি প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, পাল শাসনামলে বা তার পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধবিহার ও জনবসতির প্রয়োজনে এই জলাশয়গুলো তৈরি হয়েছিল, যা পরে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়।

একসময়কার পানীয় জলের উৎস এই পুকুরগুলো এখন সোহাসা গ্রামের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। তিন শতাধিক এর বেশি পুকুরের প্রায় সবগুলোতেই এখন বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করা হয়। রুই, কাতলা, মৃগেল, পাঙাশ, তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করে গ্রামের কয়েকশ পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে।

প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে পুকুরপাড়ে মাছের খাবার দেওয়া, জাল ফেলা আর মাছ ধরার ব্যস্ততা চোখে পড়ে। এখানকার উৎপাদিত মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।

স্থানীয় মাছ চাষি তোজাম্মেল হক জানান, এই পুকুরই এখন আমাদের আয়ের প্রধান উৎস। বছরে এক একটি পুকুর থেকে কয়েক লাখ টাকার মাছ বিক্রি হয়। এই পুকুরগুলোর জন্যই সোহাসার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে অনেক সচ্ছল।”
পুকুরগুলো কেবল মাছ চাষেই সীমাবদ্ধ নেই, এর পানি গৃহস্থালির কাজে এবং শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্যও ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও, এই জলাশয়গুলো গ্রামের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

বদলগাছী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতিয়া খাতুন বলেন, “সোহাসা গ্রামের এই পুকুরগুলো আমাদের গর্ব। আমাদের সরকারি পুকুরগুলো পুনঃখননের মাধ্যমে সেগুলোকে আরও কার্যকর করার পরিকল্পনা নিয়েছি। সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে এই গ্রামে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হবে।

সোহাসা শুধু একটি গ্রাম নয়, এটি ইতিহাস ও প্রকৃতির এক দারুণ মেলবন্ধন। এখানকার প্রতিটি পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে লুকিয়ে আছে অতীতের গল্প আর বর্তমানের কর্মচাঞ্চল্য। সঠিক পরিকল্পনা ও সংরক্ষণের মাধ্যমে এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা গেলে, ৩৬৫ টি পুকুরের এই গ্রামটি আগামী প্রজন্মের কাছে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৩:০০:৪০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫
Translate »

৩৬৫ পুকুরের গ্রাম সোহাসা: নওগাঁর বুকে এক বিস্ময়কর ইতিহাস ও ঐতিহ্য

আপডেট : ০৩:০০:৪০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫

নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার এক অনন্য গ্রামের নাম সোহাসা। জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রামটি তার নামের কারণে নয়, বরং পরিচিতি পেয়েছে “তিন শতাধিক এর বেশি পুকুরের গ্রাম” হিসেবে। গ্রামের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য পুকুর শুধু পানির উৎস নয়, বরং শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাস, লোককথা আর গ্রামীণ অর্থনীতির এক জীবন্ত সাক্ষী।

সোহাসা গ্রামের নামকরণ বা পুকুরগুলোর সঠিক ইতিহাস নিয়ে লিখিত কোনো দলিল না থাকলেও, স্থানীয়দের মুখে মুখে নানা লোককথা ও ধারণা রয়েছে। প্রবীণদের মতে, শত শত বছর আগে এই অঞ্চলে পানীয় জলের তীব্র সংকট ছিল। সেই সংকট দূর করতে এবং চাষাবাদের সুবিধার জন্য তৎকালীন জমিদার ও প্রভাবশালী ব্যাক্তিরা প্রজাদের কল্যাণে অসংখ্য পুকুর খনন শুরু করেন।

গ্রামের সবচেয়ে বাসিন্দা দীনেশ মন্ডল বলেন, “আমার দাদার কাছে শুনেছি, এই গ্রামের হিন্দু জমিদার এক ব্যাক্তি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি ৩৬৫ দিনে ৩৬৫টি পুকুর খনন করবেন। যদিও তিনি তা সম্পন্ন করতে পারেননি, তবে তার খনন করা পুকুরগুলোই এই গ্রামের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। এরপর বংশ পরম্পরায় গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারই নিজেদের প্রয়োজনে পুকুর খনন করে।

আরেকটি প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, পাল শাসনামলে বা তার পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধবিহার ও জনবসতির প্রয়োজনে এই জলাশয়গুলো তৈরি হয়েছিল, যা পরে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়।

একসময়কার পানীয় জলের উৎস এই পুকুরগুলো এখন সোহাসা গ্রামের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। তিন শতাধিক এর বেশি পুকুরের প্রায় সবগুলোতেই এখন বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করা হয়। রুই, কাতলা, মৃগেল, পাঙাশ, তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করে গ্রামের কয়েকশ পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে।

প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে পুকুরপাড়ে মাছের খাবার দেওয়া, জাল ফেলা আর মাছ ধরার ব্যস্ততা চোখে পড়ে। এখানকার উৎপাদিত মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।

স্থানীয় মাছ চাষি তোজাম্মেল হক জানান, এই পুকুরই এখন আমাদের আয়ের প্রধান উৎস। বছরে এক একটি পুকুর থেকে কয়েক লাখ টাকার মাছ বিক্রি হয়। এই পুকুরগুলোর জন্যই সোহাসার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে অনেক সচ্ছল।”
পুকুরগুলো কেবল মাছ চাষেই সীমাবদ্ধ নেই, এর পানি গৃহস্থালির কাজে এবং শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্যও ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও, এই জলাশয়গুলো গ্রামের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

বদলগাছী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতিয়া খাতুন বলেন, “সোহাসা গ্রামের এই পুকুরগুলো আমাদের গর্ব। আমাদের সরকারি পুকুরগুলো পুনঃখননের মাধ্যমে সেগুলোকে আরও কার্যকর করার পরিকল্পনা নিয়েছি। সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে এই গ্রামে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হবে।

সোহাসা শুধু একটি গ্রাম নয়, এটি ইতিহাস ও প্রকৃতির এক দারুণ মেলবন্ধন। এখানকার প্রতিটি পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে লুকিয়ে আছে অতীতের গল্প আর বর্তমানের কর্মচাঞ্চল্য। সঠিক পরিকল্পনা ও সংরক্ষণের মাধ্যমে এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা গেলে, ৩৬৫ টি পুকুরের এই গ্রামটি আগামী প্রজন্মের কাছে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।