London ০৬:৪৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম:
ট্রাম্পের গাজা দখলের পরিকল্পনা, দেশে দেশে নিন্দার ঝড় সংস্কার কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করতে দেশবাসীর প্রতি প্রধান উপদেষ্টার আহ্বান জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটিতে আওয়ামী দোষরদের অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে ও বিতর্কিত কমিটি বাতিলের দাবীতে সংবাদ সম্মেলন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আলতাব মালিথার শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত রাজমিস্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা, খুনিদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলায় ফাঁসির ৯ জনসহ সব আসামি খালাস কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের বিরুদ্ধে পকেট কমিটি গঠনের অভিযোগ নীলফামারীতে যুবককে মারধর, থানায় অভিযোগ করতে গিয়ে হামলার শিকার ১৭বছর আওয়ামী সরকার আমলে ভোট-ভাতের অধিকার হরণ করেছিলেন, জিলানী শাবান মাসে রোজা রাখার গুরুত্ব

বাংলাদেশ ব্যাংকে গোপন ৩০০ লকারের সন্ধান, যে কোনো সময় অভিযান

অনলাইন ডেস্ক

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা ভল্টে কর্মকর্তাদের অর্থ-সম্পদ জমা রাখার তিন শতাধিক লকারের সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যেখানে বর্তমান ও সাবেক ঊর্ধ্বতন ভিআইপি ব্যাংক কর্মকর্তাদের লকার রয়েছে বলে জানা গেছে।

এরই মধ্যে মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) আদালত থেকে সাবেক ও বর্তমান ব্যাংক কর্মকর্তাদের লকার খোলার অনুমতিও পেয়েছে সংস্থাটি। চলতি সপ্তাহের যে কোনো দিন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে লকার খুলতে অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র জানিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান বিভাগের প্রধান দুদক পরিচালক কাজী সায়েমুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার নামীয় বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল শাখার লকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে খোলার অনুমতি পেতে আদালতে আবেদন করা হয়েছিল। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে দাখিলকৃত কাগজপত্রসহ পর্যালোচনা করে আদালত তা মঞ্জুর করেছেন।

অন্যদিকে নাম প্রকাশ না করে দুদকের অপর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসলে দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন ডেপুটি গভর্নরের নাম আসছে। এরই মধ্যে এস কে সুর চৌধুরি গোপন লকার খুলে প্রায় ৫ কোটি টাকার দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও স্বর্ণালংকার পাওয়া গেছে। ওই অভিযানকালে দুদকের চোখে তিন শতাধিক ব্যাংক কর্মকর্তাদের নামে লকারের তথ্য মিলেছে। যার মধ্যে রিজার্ভ চুরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে আলোচিত ব্যক্তিদের নাম মিলেছিল। যে কারণেই দুদক মনে করছে তল্লাশি অভিযান চালানো দরকার। আমাদের ধারণা যথাযথ তল্লাশি করা গেলে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসবে, যা মানুষ কল্পনাও করতে পারে নাই।

দুদক ও আদালত সূত্রে জানা যায়, দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইনভেন্টরি করার জন্য ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাকে সহযোগিতা করতে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. জাকির হোসেন এমন অনুমতি দেন। কমিশনের অনুমতি নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিযান পরিচালনা করা হতে পারে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরীর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধানকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রক্ষিত লকারে তল্লাশিকালে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালংকার পাওয়া যায়। ওই তল্লাশিকালে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তাদের নামে লকার রয়েছে। অনুসন্ধানকালে দুদক টিম মনে করেছে, ওই লকারের তল্লাশি করা প্রয়োজন। সেজন্যই অনুসন্ধান টিমের পক্ষ থেকে লকার তল্লাশি করার অনুমতি চেয়েছে। আদালতের অনুমতি নিয়ে দুদক টিম আইনানুগ পদক্ষেপ নেবে।

তিনি আরও বলেন, দুদক টিম মনে করে লকারে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র রয়েছে। সেজন্যই দুদকের অনুসন্ধান টিম তল্লাশি অভিযান চালাবে। অনুসন্ধানের স্বার্থে বাংলাদেশের যে কোনো ব্যাংকে অভিযান চালাবে দুদক টিম।

এর আগে, গত ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা ভল্টে কর্মকর্তাদের অর্থ-সম্পদ জমা রাখার ব্যক্তিগত সব লকার সাময়িকভাবে ফ্রিজ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে গভর্নরকে চিঠি দেয় দুদক। দুদকের পরিচালক কাজী সায়েমুজ্জামান সই করা চিঠিতে বলা হয়, গত ২৬ জানুয়ারি আদালতের অনুমতি নিয়ে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে অনুসন্ধানের উদ্দেশে গঠিত দুদক টিম বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েন ভল্টে রক্ষিত অভিযোগ সংশ্লিষ্ট সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরীর সেফ ডিপোজিট তল্লাশি করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে তার জমা করা তিনটি সিলগালা কৌটা খুলে ৫৫ হাজার ইউরো, ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলার, ১০০৫.৪ গ্রাম স্বর্ণ ও ৭০ লাখ টাকার এফডিআর পাওয়া গেছে। যা তার নিয়মিত আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করা হয়নি। ওই সময় অন্যান্য কিছু কর্মকর্তার সিলগালা করে সেফ ডিপোজিট রেখেছেন। এসব সিলগালা কৌটাতেও অপ্রদর্শিত সম্পদ থাকার অবকাশ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে দুদকের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।

দুদক জানায়, গত ৩০ জানুয়ারি বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে দুদক চেয়ারম্যানের ‘দুদক ও সম্পদ পুনরুদ্ধার বিষয়ক’ আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত সম্পদ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা ওই ভল্টে রক্ষিত সম্পদ সাময়িকভাবে ফ্রিজের সম্মতি দিয়েছেন। গভর্নরকে দেওয়া দুদকের চিঠি ও অর্থ উপদেষ্টার সম্মতি থাকায় ভল্টের সব লকারের সম্পদ ফ্রিজ করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে এর মালিকরা তাদের লকার থেকে কোনো ধরনের অর্থ-সম্পদ সরিয়ে নিতে পারবেন না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই সব লকার খোলা ও লকারে থাকা অর্থ-সম্পদের তালিকা তৈরির অনুমতির জন্য আবেদন দেয় দুদক।

সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী লকারে যা পাওয়া যায়

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক আলোচিত ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরীর গোপন তিনটি লকারে সোনার চামচ, বোতাম, স্বর্ণালংকার, বান্ডিল বান্ডিল মার্কিন ডলার ও ইউরো মিলেছিল। গত ২৬ জানুয়ারি টানা সাড়ে ১০ ঘণ্টার অভিযান শেষে দেখা যায়, লকারে ১ কেজি স্বর্ণ, ১ লাখ ৬৯ হাজার মার্কিন ডলার, ৫৫ হাজার ইউরো এবং ৭০ লাখ টাকার এফডিআর পাওয়া যায়। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

লকারে যেসব স্বর্ণালংকার পাওয়া গেছে—২৩টি সোনার চেইন যার ওজন ১৭৬.৩ গ্রাম, দুটি টিকলি ২০০৭ গ্রাম, কানের দুল ১২টা ৮৯২ গ্রাম, লকেট ৩টা এক দশমিক ৩ গ্রাম, ছয়টি চুড়ি ১০৭ গ্রাম, দুটি সিতাহার ১২০.৯ গ্রাম, তিনটি আংটি ১৮.৩ গ্রাম, সোনার কয়েন তিনটি ওজন ২৩৯ গ্রাম, সোনার চামচ একটি ওজন ৬ গ্রাম, ১০০ নোলক ৮ গ্রাম, ব্রেসলেট ১৬ গ্রাম, গলার হার তিনটি যার ওজন ৫৭.৩ গ্রাম, মুকুট একটি ওজন ১৫৪ গ্রাম। আরেক লকারে চূড় ২টি ৩২.৯ গ্রাম, চুরি ২টি ২১ গ্রাম, সিতাহার একটি পিস ১১ গ্রাম,  মুকুট ২ পিস ২১.৭ গ্রাম, লকেট ২ পিস ২৬৮ গ্রাম, টিকলি একটি ৬৯ গ্রাম, গলার চেইন ৩টি ওজন ৩৯.৩ গ্রাম, গলার হার ২টি ৩২.৫ গ্রাম, কানের দুল ৮টি ৫৮.৮ গ্রাম ও শার্টের বোতাম (স্বর্ণ) ৪টি ৬২ গ্রাম।

এর আগে, গত ১৯ জানুয়ারি অভিযান চালিয়ে রাজধানীর ধানমন্ডিতে এস কে সুরের বাসা থেকে ১৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা জব্দের সময় তার নামে বাংলাদেশ ব্যাংকে ভল্ট থাকার তথ্য পায় দুদক। পরে সংস্থাটি জানতে পারে, সেটি ভল্ট নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল্যবান সামগ্রী রাখার লকার (সেফ ডিপোজিট)।

এরও আগে, গত ১৪ জানুয়ারি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উপপরিচালক নাজমুল হোসাইনের নেতৃত্বে একটি দল এস কে সুরকে গ্রেপ্তার করে। সম্পদের বিবরণী দাখিল না করার অভিযোগে গত ২৩ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

উল্লেখ, ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার দিকে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। ফিলিপাইনের একটি পত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বিষয়টি জানাজানি হয়। সে সময়ে তৎকালীন গভর্নরের পদত্যাগ ও দুই ডেপুটি গভর্নরকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তখন আরও দুজন ডেপুটি গভর্নর ছিলেন। তারা হলেন আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান ও এস কে সুর চৌধুরী।

২০২৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পদ বিবরণী দাখিল না করায় এস কে সুর, তার স্ত্রী সুপর্ণা সুর চৌধুরী ও কন্যা নন্দিতা সুর চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। গত বছরের আগস্টে এই পরিবারের সব ধরনের লেনদেনের তথ্য চেয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেয় দুদক।

২০২২ সালের ২৯ মার্চে তাকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল) থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ লুটপাটের ঘটনায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল বলে জানা গেছে। এসকে সুর চৌধুরী ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ডেপুটি গভর্নরের পদ থেকে অবসরে যান।

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৪:৩৪:১৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
Translate »

বাংলাদেশ ব্যাংকে গোপন ৩০০ লকারের সন্ধান, যে কোনো সময় অভিযান

আপডেট : ০৪:৩৪:১৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা ভল্টে কর্মকর্তাদের অর্থ-সম্পদ জমা রাখার তিন শতাধিক লকারের সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যেখানে বর্তমান ও সাবেক ঊর্ধ্বতন ভিআইপি ব্যাংক কর্মকর্তাদের লকার রয়েছে বলে জানা গেছে।

এরই মধ্যে মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) আদালত থেকে সাবেক ও বর্তমান ব্যাংক কর্মকর্তাদের লকার খোলার অনুমতিও পেয়েছে সংস্থাটি। চলতি সপ্তাহের যে কোনো দিন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে লকার খুলতে অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র জানিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান বিভাগের প্রধান দুদক পরিচালক কাজী সায়েমুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার নামীয় বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল শাখার লকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে খোলার অনুমতি পেতে আদালতে আবেদন করা হয়েছিল। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে দাখিলকৃত কাগজপত্রসহ পর্যালোচনা করে আদালত তা মঞ্জুর করেছেন।

অন্যদিকে নাম প্রকাশ না করে দুদকের অপর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসলে দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন ডেপুটি গভর্নরের নাম আসছে। এরই মধ্যে এস কে সুর চৌধুরি গোপন লকার খুলে প্রায় ৫ কোটি টাকার দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও স্বর্ণালংকার পাওয়া গেছে। ওই অভিযানকালে দুদকের চোখে তিন শতাধিক ব্যাংক কর্মকর্তাদের নামে লকারের তথ্য মিলেছে। যার মধ্যে রিজার্ভ চুরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে আলোচিত ব্যক্তিদের নাম মিলেছিল। যে কারণেই দুদক মনে করছে তল্লাশি অভিযান চালানো দরকার। আমাদের ধারণা যথাযথ তল্লাশি করা গেলে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসবে, যা মানুষ কল্পনাও করতে পারে নাই।

দুদক ও আদালত সূত্রে জানা যায়, দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইনভেন্টরি করার জন্য ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাকে সহযোগিতা করতে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. জাকির হোসেন এমন অনুমতি দেন। কমিশনের অনুমতি নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিযান পরিচালনা করা হতে পারে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরীর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধানকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রক্ষিত লকারে তল্লাশিকালে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালংকার পাওয়া যায়। ওই তল্লাশিকালে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তাদের নামে লকার রয়েছে। অনুসন্ধানকালে দুদক টিম মনে করেছে, ওই লকারের তল্লাশি করা প্রয়োজন। সেজন্যই অনুসন্ধান টিমের পক্ষ থেকে লকার তল্লাশি করার অনুমতি চেয়েছে। আদালতের অনুমতি নিয়ে দুদক টিম আইনানুগ পদক্ষেপ নেবে।

তিনি আরও বলেন, দুদক টিম মনে করে লকারে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র রয়েছে। সেজন্যই দুদকের অনুসন্ধান টিম তল্লাশি অভিযান চালাবে। অনুসন্ধানের স্বার্থে বাংলাদেশের যে কোনো ব্যাংকে অভিযান চালাবে দুদক টিম।

এর আগে, গত ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা ভল্টে কর্মকর্তাদের অর্থ-সম্পদ জমা রাখার ব্যক্তিগত সব লকার সাময়িকভাবে ফ্রিজ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে গভর্নরকে চিঠি দেয় দুদক। দুদকের পরিচালক কাজী সায়েমুজ্জামান সই করা চিঠিতে বলা হয়, গত ২৬ জানুয়ারি আদালতের অনুমতি নিয়ে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে অনুসন্ধানের উদ্দেশে গঠিত দুদক টিম বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েন ভল্টে রক্ষিত অভিযোগ সংশ্লিষ্ট সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরীর সেফ ডিপোজিট তল্লাশি করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে তার জমা করা তিনটি সিলগালা কৌটা খুলে ৫৫ হাজার ইউরো, ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলার, ১০০৫.৪ গ্রাম স্বর্ণ ও ৭০ লাখ টাকার এফডিআর পাওয়া গেছে। যা তার নিয়মিত আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করা হয়নি। ওই সময় অন্যান্য কিছু কর্মকর্তার সিলগালা করে সেফ ডিপোজিট রেখেছেন। এসব সিলগালা কৌটাতেও অপ্রদর্শিত সম্পদ থাকার অবকাশ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে দুদকের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।

দুদক জানায়, গত ৩০ জানুয়ারি বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে দুদক চেয়ারম্যানের ‘দুদক ও সম্পদ পুনরুদ্ধার বিষয়ক’ আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত সম্পদ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা ওই ভল্টে রক্ষিত সম্পদ সাময়িকভাবে ফ্রিজের সম্মতি দিয়েছেন। গভর্নরকে দেওয়া দুদকের চিঠি ও অর্থ উপদেষ্টার সম্মতি থাকায় ভল্টের সব লকারের সম্পদ ফ্রিজ করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে এর মালিকরা তাদের লকার থেকে কোনো ধরনের অর্থ-সম্পদ সরিয়ে নিতে পারবেন না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই সব লকার খোলা ও লকারে থাকা অর্থ-সম্পদের তালিকা তৈরির অনুমতির জন্য আবেদন দেয় দুদক।

সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী লকারে যা পাওয়া যায়

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক আলোচিত ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরীর গোপন তিনটি লকারে সোনার চামচ, বোতাম, স্বর্ণালংকার, বান্ডিল বান্ডিল মার্কিন ডলার ও ইউরো মিলেছিল। গত ২৬ জানুয়ারি টানা সাড়ে ১০ ঘণ্টার অভিযান শেষে দেখা যায়, লকারে ১ কেজি স্বর্ণ, ১ লাখ ৬৯ হাজার মার্কিন ডলার, ৫৫ হাজার ইউরো এবং ৭০ লাখ টাকার এফডিআর পাওয়া যায়। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

লকারে যেসব স্বর্ণালংকার পাওয়া গেছে—২৩টি সোনার চেইন যার ওজন ১৭৬.৩ গ্রাম, দুটি টিকলি ২০০৭ গ্রাম, কানের দুল ১২টা ৮৯২ গ্রাম, লকেট ৩টা এক দশমিক ৩ গ্রাম, ছয়টি চুড়ি ১০৭ গ্রাম, দুটি সিতাহার ১২০.৯ গ্রাম, তিনটি আংটি ১৮.৩ গ্রাম, সোনার কয়েন তিনটি ওজন ২৩৯ গ্রাম, সোনার চামচ একটি ওজন ৬ গ্রাম, ১০০ নোলক ৮ গ্রাম, ব্রেসলেট ১৬ গ্রাম, গলার হার তিনটি যার ওজন ৫৭.৩ গ্রাম, মুকুট একটি ওজন ১৫৪ গ্রাম। আরেক লকারে চূড় ২টি ৩২.৯ গ্রাম, চুরি ২টি ২১ গ্রাম, সিতাহার একটি পিস ১১ গ্রাম,  মুকুট ২ পিস ২১.৭ গ্রাম, লকেট ২ পিস ২৬৮ গ্রাম, টিকলি একটি ৬৯ গ্রাম, গলার চেইন ৩টি ওজন ৩৯.৩ গ্রাম, গলার হার ২টি ৩২.৫ গ্রাম, কানের দুল ৮টি ৫৮.৮ গ্রাম ও শার্টের বোতাম (স্বর্ণ) ৪টি ৬২ গ্রাম।

এর আগে, গত ১৯ জানুয়ারি অভিযান চালিয়ে রাজধানীর ধানমন্ডিতে এস কে সুরের বাসা থেকে ১৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা জব্দের সময় তার নামে বাংলাদেশ ব্যাংকে ভল্ট থাকার তথ্য পায় দুদক। পরে সংস্থাটি জানতে পারে, সেটি ভল্ট নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল্যবান সামগ্রী রাখার লকার (সেফ ডিপোজিট)।

এরও আগে, গত ১৪ জানুয়ারি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উপপরিচালক নাজমুল হোসাইনের নেতৃত্বে একটি দল এস কে সুরকে গ্রেপ্তার করে। সম্পদের বিবরণী দাখিল না করার অভিযোগে গত ২৩ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

উল্লেখ, ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার দিকে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। ফিলিপাইনের একটি পত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বিষয়টি জানাজানি হয়। সে সময়ে তৎকালীন গভর্নরের পদত্যাগ ও দুই ডেপুটি গভর্নরকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তখন আরও দুজন ডেপুটি গভর্নর ছিলেন। তারা হলেন আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান ও এস কে সুর চৌধুরী।

২০২৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পদ বিবরণী দাখিল না করায় এস কে সুর, তার স্ত্রী সুপর্ণা সুর চৌধুরী ও কন্যা নন্দিতা সুর চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। গত বছরের আগস্টে এই পরিবারের সব ধরনের লেনদেনের তথ্য চেয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেয় দুদক।

২০২২ সালের ২৯ মার্চে তাকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল) থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ লুটপাটের ঘটনায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল বলে জানা গেছে। এসকে সুর চৌধুরী ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ডেপুটি গভর্নরের পদ থেকে অবসরে যান।