London ০৯:০২ অপরাহ্ন, শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম:
সালাম-বরকত-রফিকের রক্তের অঙ্গীকারে ছিলো গণঅভ্যুত্থানের শক্তি ,প্রধান উপদেষ্টা সম্মেলন স্থগিত, অনির্দিষ্টকালের হরতাল ডেকেছে বিএনপি কুয়েতের মরুভূমিতে বাংলাদেশিদের মিলনমেলা গরুচুরির অভিযোগে স্বেচ্ছাসেবক দলের দুই নেতাকে গণপিটুনি গান গাইতে গাইতে মঞ্চেই লুটিয়ে পড়লেন সাবিনা ইয়াসমিন পুলিশকে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের নির্দেশ রাজনৈতিক নেতৃত্বই দিয়েছিল এইচআরডব্লিউ ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ কোন পথে’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত নেত্রকোনা সীমান্তে টংক আন্দোলনের নেত্রী রাশি মণি’র হাজংয়ের ৭৯তম প্রয়াণ দিবস পালিত ফরিদপুরে রিকশা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে চালককে হত্যা বিয়ে করলেন সারজিস আলম

পাইকারি সবজিবাজারে সুচ-দড়ি নিয়ে ব্যস্ত তাঁরা, এই আয়েই চলে সংসার

পাইকারি বাজারে বইকচুভর্তি বস্তার মুখ সেলাই করছেন সবজি শ্রমিকেরা। গত বৃহস্পতিবার দিনাজপুরের বিরামপুর পৌর শহরের নতুনবাজার এলাকায়

ডান হাতে সরু লম্বা চকচকে সূচ। বাঁ হাতে প্লাস্টিকের দড়ি। সামনেই কচুভর্তি বস্তার খোলা মুখটি বাঁধা পড়ছে ষাটোর্ধ্ব মোজাম্মেল হকের হাতে থাকা সুচ আর দড়ির নিপুণ সেলাইয়ে। কাজের পাশাপাশি তাঁর সহকর্মীদের মুখে মুখরোচক গল্পের ফুলঝুরি। মোজাম্মেলের মতো একই কাজে ব্যস্ত সবাই। এই কাজের মজুরি দিয়ে সংসার চলে তাঁদের।

এমন দৃশ্যের দেখা মিলবে দিনাজপুরের বিরামপুর পৌর শহরের পুরাতন বাজার ও নতুনবাজার এলাকায় সবজির পাইকারি বাজারে। সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার পাইকারি বাজার বসে পুরাতন বাজারে। আর বাকি দিনগুলোতে সকাল ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত সবজির পাইকারি কেনাবেচা চলে নতুনবাজারে। এসব স্থানে তখন সুচ আর দড়ি হাতে ব্যস্ততা বাড়ে এই পেশার শ্রমিকদের।

উপজেলার প্রায় ১৬টি গ্রামের ফসলি মাঠে বিভিন্ন মৌসুমি সবজি বেচতে এই দুই বাজারে আসেন স্থানীয় কৃষকেরা। সেখানে আলু, বেগুন, পটোল, শিম, লাউ, বইকচু আর কচুমুখীই বেশি কেনাবেচা হয়। বর্তমানে বাজারগুলোতে কচুর সরবরাহ ও কেনাবেচা হচ্ছে প্রচুর। স্থানীয় আড়তদারেরা এসব সবজি কিনে সেখান থেকে ট্রাকে তুলে রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠান। আর এসব সবজি বস্তায় ভরে এর মুখ সেলাই করে এরপর ট্রাকে তুলে দেন সেখানকার অর্ধশতাধিক শ্রমিক।

ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা জানান, এই দুই বাজারে প্রতিদিন ৮০০ থেকে ৯০০ বস্তা বইকচু দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। সবজির ভরা মৌসুমে এ সংখ্যা কখনো হাজারো ছাড়ায়। এ সময় ১০০ কেজি ওজনের সবজির বস্তা প্যাকিং করতে ৩৫ টাকা ও ৭৬ কেজি ওজনের বস্তা প্যাকিং করতে ২৫ টাকা মজুরি নেন শ্রমিকেরা। প্রতিদিন এ বাজারে ৬০ থেকে ৭০ জন শ্রমিক কাজ করেন। বয়স, দক্ষতা ও কায়িক শক্তি অনুযায়ী কেউ কেউ সবজির স্তূপ থেকে গামলায় করে সবজি নিয়ে বস্তায় ভরেন। কেউ সুচ ও দড়ি দিয়ে বস্তার মুখ সেলাই করেন। যাঁদের গায়ে শক্তি বেশি তাঁরা এসব মুখবাঁধা বস্তা মাথায় করে ট্রাকে তুলে দেন।

সবজির সরবরাহ বেশি হলে প্রয়োজন পড়ে অতিরিক্ত শ্রমিকের। অনেকেই বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি এ কাজটি করেন

সবজির সরবরাহ বেশি হলে প্রয়োজন পড়ে অতিরিক্ত শ্রমিকের। অনেকেই বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি এ কাজটি করেন

এই পুরো বিষয়টি দেখাশোনা করেন একজন ‘সর্দার’। এ কাজ করে দিন শেষে একেক জন শ্রমিক ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় করেন। এ আয় দিয়ে কেউ কেউ বিগত কয়েক বছরে পরিবারের জন্য করেছেন মাথা গোঁজার ঠাঁই। সংসার খরচের পাশাপাশি জুগিয়েছেন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচও। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দুই যুগের বেশি সময় এসব বাজারে এই শ্রমিকের কাজ করছেন।

সবজির পাইকারি বাজারটিতে ৩২ বছর ধরে কাজ করছেন মোজাম্মেল হক। তাঁর বাড়ি বিরামপুর পৌরসভার ভগবতীপুর গ্রামে। পরিবারে স্ত্রীসহ আছে দুই ছেলে আর দুই মেয়ে। বড় ছেলে ও দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে নতুনবাজারে বইকচুভর্তি বস্তার মুখ সেলাইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন মোজাম্মেল। সেখানেই তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ‘মুই এ বাজারোত ৩২ বছর ধরে কাজ করোচো। আগে তো সবজির বস্তা ওঠানামা করবার পারোচোনু (পারতাম)। এখন আর শরীরোত কুলায় না। এখন আড়তে যতক্ষণ কাজ থাকে, ততক্ষণ সুচ ও দড়ি দিয়ে বস্তার মুখ সেলাই করো। এ কাম করে কোনো দিন ৬০০ ট্যাকা, আবার কোনো দিন ৭০০ ট্যাকাও আয় হয়। এই ট্যাকা দিয়েই মোর সংসার চলে। এই আয় দিয়ে তিন ছেলে-মেয়ের বিয়া-শাদি দিচু। ছোট ছেলে মাস্টার্স পাস করে এখন চাকরি খোঁজোচে।’

এ কাম করে কোনো দিন ৬০০ ট্যাকা, আবার কোনো দিন ৭০০ ট্যাকাও আয় হয়। এই ট্যাকা দিয়েই মোর সংসার চলে। এই আয় দিয়ে তিন ছেলে-মেয়ের বিয়া-শাদি দিচু। ছোট ছেলে মাস্টার্স পাস করে এখন চাকরি খোঁজোচে।

মোজাম্মেল হক, শ্রমিক

পৌরসভার টাটকপুর গ্রামের বাসিন্দা হাফিজুর রহমানও বাজারটিতে সবজি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তিনিও এ আয় দিয়ে সংসার চালান। টাকা জমিয়ে এলাকায় প্রায় দুই বিঘা ধানিজমি বর্গা নিয়ে সেখানে চাষাবাদ করছেন। বাজারে শ্রমিকের কাজ আর অবসরে জমি আবাদ করে সংসার ভালোই চলছে বলে জানান হাফিজুর।

প্রতিদিন বাজারে ৬০ থেকে ৭০ জন শ্রমিক কাজ করেন বলে জানান একটি আড়তের শ্রমিক সর্দার ইউসুফ আলী। তিনি বলেন, কখনো সবজির সরবরাহ বেশি হলে অতিরিক্ত শ্রমিক লাগে। এলাকার কেউ যখন কাজের অভাবে বসে থাকেন, সংসার চালাতে সমস্যায় পড়েন, তখন তাঁকে ডেকে এই কাজ দেওয়া হয়। অন্যকে কাজ দিয়ে আয়ের পথ করে দিতে পারলে ভালো লাগে।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০২:৪৮:০৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪
৪১
Translate »

পাইকারি সবজিবাজারে সুচ-দড়ি নিয়ে ব্যস্ত তাঁরা, এই আয়েই চলে সংসার

আপডেট : ০২:৪৮:০৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪

পাইকারি বাজারে বইকচুভর্তি বস্তার মুখ সেলাই করছেন সবজি শ্রমিকেরা। গত বৃহস্পতিবার দিনাজপুরের বিরামপুর পৌর শহরের নতুনবাজার এলাকায়

ডান হাতে সরু লম্বা চকচকে সূচ। বাঁ হাতে প্লাস্টিকের দড়ি। সামনেই কচুভর্তি বস্তার খোলা মুখটি বাঁধা পড়ছে ষাটোর্ধ্ব মোজাম্মেল হকের হাতে থাকা সুচ আর দড়ির নিপুণ সেলাইয়ে। কাজের পাশাপাশি তাঁর সহকর্মীদের মুখে মুখরোচক গল্পের ফুলঝুরি। মোজাম্মেলের মতো একই কাজে ব্যস্ত সবাই। এই কাজের মজুরি দিয়ে সংসার চলে তাঁদের।

এমন দৃশ্যের দেখা মিলবে দিনাজপুরের বিরামপুর পৌর শহরের পুরাতন বাজার ও নতুনবাজার এলাকায় সবজির পাইকারি বাজারে। সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার পাইকারি বাজার বসে পুরাতন বাজারে। আর বাকি দিনগুলোতে সকাল ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত সবজির পাইকারি কেনাবেচা চলে নতুনবাজারে। এসব স্থানে তখন সুচ আর দড়ি হাতে ব্যস্ততা বাড়ে এই পেশার শ্রমিকদের।

উপজেলার প্রায় ১৬টি গ্রামের ফসলি মাঠে বিভিন্ন মৌসুমি সবজি বেচতে এই দুই বাজারে আসেন স্থানীয় কৃষকেরা। সেখানে আলু, বেগুন, পটোল, শিম, লাউ, বইকচু আর কচুমুখীই বেশি কেনাবেচা হয়। বর্তমানে বাজারগুলোতে কচুর সরবরাহ ও কেনাবেচা হচ্ছে প্রচুর। স্থানীয় আড়তদারেরা এসব সবজি কিনে সেখান থেকে ট্রাকে তুলে রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠান। আর এসব সবজি বস্তায় ভরে এর মুখ সেলাই করে এরপর ট্রাকে তুলে দেন সেখানকার অর্ধশতাধিক শ্রমিক।

ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা জানান, এই দুই বাজারে প্রতিদিন ৮০০ থেকে ৯০০ বস্তা বইকচু দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। সবজির ভরা মৌসুমে এ সংখ্যা কখনো হাজারো ছাড়ায়। এ সময় ১০০ কেজি ওজনের সবজির বস্তা প্যাকিং করতে ৩৫ টাকা ও ৭৬ কেজি ওজনের বস্তা প্যাকিং করতে ২৫ টাকা মজুরি নেন শ্রমিকেরা। প্রতিদিন এ বাজারে ৬০ থেকে ৭০ জন শ্রমিক কাজ করেন। বয়স, দক্ষতা ও কায়িক শক্তি অনুযায়ী কেউ কেউ সবজির স্তূপ থেকে গামলায় করে সবজি নিয়ে বস্তায় ভরেন। কেউ সুচ ও দড়ি দিয়ে বস্তার মুখ সেলাই করেন। যাঁদের গায়ে শক্তি বেশি তাঁরা এসব মুখবাঁধা বস্তা মাথায় করে ট্রাকে তুলে দেন।

সবজির সরবরাহ বেশি হলে প্রয়োজন পড়ে অতিরিক্ত শ্রমিকের। অনেকেই বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি এ কাজটি করেন

সবজির সরবরাহ বেশি হলে প্রয়োজন পড়ে অতিরিক্ত শ্রমিকের। অনেকেই বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি এ কাজটি করেন

এই পুরো বিষয়টি দেখাশোনা করেন একজন ‘সর্দার’। এ কাজ করে দিন শেষে একেক জন শ্রমিক ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় করেন। এ আয় দিয়ে কেউ কেউ বিগত কয়েক বছরে পরিবারের জন্য করেছেন মাথা গোঁজার ঠাঁই। সংসার খরচের পাশাপাশি জুগিয়েছেন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচও। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দুই যুগের বেশি সময় এসব বাজারে এই শ্রমিকের কাজ করছেন।

সবজির পাইকারি বাজারটিতে ৩২ বছর ধরে কাজ করছেন মোজাম্মেল হক। তাঁর বাড়ি বিরামপুর পৌরসভার ভগবতীপুর গ্রামে। পরিবারে স্ত্রীসহ আছে দুই ছেলে আর দুই মেয়ে। বড় ছেলে ও দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে নতুনবাজারে বইকচুভর্তি বস্তার মুখ সেলাইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন মোজাম্মেল। সেখানেই তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ‘মুই এ বাজারোত ৩২ বছর ধরে কাজ করোচো। আগে তো সবজির বস্তা ওঠানামা করবার পারোচোনু (পারতাম)। এখন আর শরীরোত কুলায় না। এখন আড়তে যতক্ষণ কাজ থাকে, ততক্ষণ সুচ ও দড়ি দিয়ে বস্তার মুখ সেলাই করো। এ কাম করে কোনো দিন ৬০০ ট্যাকা, আবার কোনো দিন ৭০০ ট্যাকাও আয় হয়। এই ট্যাকা দিয়েই মোর সংসার চলে। এই আয় দিয়ে তিন ছেলে-মেয়ের বিয়া-শাদি দিচু। ছোট ছেলে মাস্টার্স পাস করে এখন চাকরি খোঁজোচে।’

এ কাম করে কোনো দিন ৬০০ ট্যাকা, আবার কোনো দিন ৭০০ ট্যাকাও আয় হয়। এই ট্যাকা দিয়েই মোর সংসার চলে। এই আয় দিয়ে তিন ছেলে-মেয়ের বিয়া-শাদি দিচু। ছোট ছেলে মাস্টার্স পাস করে এখন চাকরি খোঁজোচে।

মোজাম্মেল হক, শ্রমিক

পৌরসভার টাটকপুর গ্রামের বাসিন্দা হাফিজুর রহমানও বাজারটিতে সবজি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তিনিও এ আয় দিয়ে সংসার চালান। টাকা জমিয়ে এলাকায় প্রায় দুই বিঘা ধানিজমি বর্গা নিয়ে সেখানে চাষাবাদ করছেন। বাজারে শ্রমিকের কাজ আর অবসরে জমি আবাদ করে সংসার ভালোই চলছে বলে জানান হাফিজুর।

প্রতিদিন বাজারে ৬০ থেকে ৭০ জন শ্রমিক কাজ করেন বলে জানান একটি আড়তের শ্রমিক সর্দার ইউসুফ আলী। তিনি বলেন, কখনো সবজির সরবরাহ বেশি হলে অতিরিক্ত শ্রমিক লাগে। এলাকার কেউ যখন কাজের অভাবে বসে থাকেন, সংসার চালাতে সমস্যায় পড়েন, তখন তাঁকে ডেকে এই কাজ দেওয়া হয়। অন্যকে কাজ দিয়ে আয়ের পথ করে দিতে পারলে ভালো লাগে।