পটুয়াখালীতে উচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করে ৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকার চেক বিতরণ

পটুয়াখালী জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ বিভাগ আবারও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের স্পষ্ট স্থগিতাদেশ থাকা সত্ত্বেও পায়রা বন্দর প্রকল্পের অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৯ কোটি ৬৫ লাখ ৪ হাজার ৪৫০ টাকার চেক বিতরণ করেছে জেলা প্রশাসন। আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করে এই চেক বিতরণের ঘটনায় আদালত অবমাননার অভিযোগে আইনি পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ।
জানা গেছে, মহিপুর থানার নতুন্নপাড়া গ্রামের নিবায় মগু, মায়ো মগনি, লুফরো মগু ও ফুচামা মগনির মালিকানাধীন ৪১.৫২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয় পায়রা সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের জন্য। জেলা প্রশাসন এলএ মামলা নম্বর ৬/১৮-১৯ অনুযায়ী ২২.৭১ একর জমির জন্য ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করে। অথচ ওই জমি সংক্রান্ত মামলা বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন এবং আদালত তিন দফায় আদেশ দিয়ে ক্ষতিপূরণ প্রদান স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়।
২০২৪ সালের ১ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ থেকে প্রথম আদেশ আসে, যেখানে জমির বিষয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর ২০২৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এবং ১৯ ফেব্রুয়ারির আদেশেও বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কোনো ক্ষতিপূরণ প্রদান করা যাবে না। এসব আদেশ উপেক্ষা করে জেলা প্রশাসন ২৬ জুন ২০২৫ তারিখে চেক প্রস্তুত করে এবং ১৪ জুলাই একজন ব্যক্তির হাতে তা হস্তান্তর করে।
এমন একটি স্পর্শকাতর ও বিচারাধীন বিষয়ে আদালতের স্থগিতাদেশকে পাশ কাটিয়ে চেক বিতরণ করায় প্রশ্ন উঠেছে জেলা প্রশাসনের দায় ও ভূমিকা নিয়ে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, এই চেক বিতরণ করা হয় কোনো ধরনের ওয়ারিশ যাচাই ছাড়াই। অভিযোগ রয়েছে, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এবং ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়মনীতি উপেক্ষা করে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থে এই চেক ইস্যু করেছেন।
একই অফিসে প্রকৃত মালিকেরা বছর বছর ঘুরে হয়রানির শিকার হলেও এখানে বিপুল অঙ্কের টাকা ঘুষ-কমিশন আর প্রভাব খাটিয়ে অস্বাভাবিক গতিতে চেক বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, অধিগ্রহণ অফিসে কমিশন ছাড়া কোনো কাগজ নড়াচড়া করে না। দালাল ও কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ৫% থেকে ১৫% পর্যন্ত ঘুষের বিনিময়ে চেক ছাড়ের অভিযোগও রয়েছে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃত মালিকদের নাম বাদ দিয়ে নতুন করে নাম যুক্ত করে চেক ইস্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
এই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে আইনজীবী ব্যারিস্টার মুজাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের আদেশ লঙ্ঘনের অভিযোগে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, এই চেক ইস্যু ইচ্ছাকৃতভাবে আদেশ অমান্য করে করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যক্তি পর্যায়ে দায়ী।
কলাপাড়ার ভুক্তভোগী আহসান হাবীব জানান, তার বাড়ির জমি ১১৫ নম্বর খতিয়ানে পায়রা বন্দর প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে। জমি সংক্রান্ত একটি পক্ষ ভুয়া ডিগ্রি তৈরি করে হাইকোর্টে মামলা করে এবং সেই মামলা এখনো বিচারাধীন। মামলা চলাকালেই এল এ শাখা চেক ইস্যু করে দিয়েছে, অথচ তারা প্রকৃত ওয়ারিশদের যাচাই করেনি। চেক দেওয়ার পরদিন তারা ঘটনাটি জানতে পারেন। এর মাধ্যমে এল এ শাখার কিছু কর্মকর্তা সুস্পষ্টভাবে আদালতের আদেশ অমান্য করে হাত মিলিয়ে কোটি টাকার চেক বিতরণ করেছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন এবং এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন।
আইনজীবী একেএম নুরুল আলম বলেন, এটি শুধু আদালত অবমাননা নয়, বরং প্রশাসনের ভেতরের গভীর দুর্নীতির প্রতিফলন। চলমান স্টে অর্ডার থাকা সত্ত্বেও একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে চেক হস্তান্তর করা হয়েছে, যা চূড়ান্তভাবে আদালতের আদেশ লঙ্ঘন। ৫ই আগস্ট এর পরে এধরনের কাজ হবে আমরা ভাবতেও পারিনি।
এ বিষয়ে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, তিনি যে চেক ইস্যু করেছেন তা জেলা প্রশাসক ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়ে করেছেন, তাই বেশি চিন্তার কিছু নেই।
এ বিষয় জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,আপনাদের এতো আগ্রহ কেন,তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। আদালতের কোনো নোটিশ পাননি। তিনি আরো বলেন, কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার দপ্তরে আবেদন করলে কাগজপত্র দেওয়া হবে।
এই ঘটনায় জনস্বার্থে নিরপেক্ষ তদন্ত এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন অনেকেই। অন্যথায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ ও আইনের শাসনের গুরুত্বই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।