নুরুল হক নূর, রাসেদখান, নাজমুল হাসান, বিন ইয়ামিন মোল্লা, নাহিদ ও আসিফ মাহমুদসহ: ইতিহাসের বাঁকে নতুন নেতৃত্বের উত্থান

প্রতিটি জাতির ইতিহাসে কিছু সময় আসে, যখন জনতার ভেতর থেকে কেউ উঠে এসে প্রশ্ন তোলে—”আর কত?” বাংলাদেশ ঠিক তেমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে পুরনো ধাঁচের রাজনীতির রূপ বদলাতে শুরু করেছে। ক্যানভাসে আঁকা হচ্ছে নতুন নেতৃত্বের রেখাচিত্র। এই রাজনৈতিক রূপান্তরের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছেন দুটি নাম—নুরুল হক নূর ও আসিফ মাহমুদ।
২০১৮ সাল। সারা দেশে উত্তাল ছাত্র আন্দোলন। কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা। সেই উত্তাল সময়ের মধ্যেই উঠে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ ছাত্র—নুরুল হক নূর। ভিপি পদে বিজয়ের মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতার মুখোমুখি দাঁড়ানো এক সাহসী তরুণের প্রতীক হয়ে ওঠেন। তার চোখে ছিল পরিবর্তনের স্বপ্ন, কণ্ঠে ছিল অবিচল সাহস, আর মননে ছিল এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নচিত্র।
নূরের রাজনীতি ছিল ভিন্ন। তিনি যখন মুখ খুলতেন, তাতে থাকত না রাজনৈতিক ভণিতা বা কৌশলী বাক্য। থাকত স্বচ্ছতা, স্পষ্টতা, এবং দায়িত্বশীলতার প্রত্যয়। রাজনীতি তার কাছে ছিল না শুধুই ক্ষমতার সিঁড়ি, বরং ছিল জনতার পাশে দাঁড়ানোর এক অঙ্গীকার। তিনি জনগণকে নিয়ে পথ হাঁটার কথা বলেন, শাসকের পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে থাকা মানুষদের পাশে থাকার শপথ করেন। এই নেতৃত্বের মধ্যেই জন্ম নেয় এক নবতর রাজনৈতিক স্রোত।
এ ধারারই উত্তরসূরি হিসেবে উঠে আসেন আসিফ মাহমুদ। নূরের দেখানো পথে হাঁটলেও, আসিফ নিজস্ব ধাঁচে নেতৃত্ব গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন আরও প্রাজ্ঞ, যুক্তিনির্ভর এবং সাংগঠনিকভাবে পরিপক্ব। রাজনীতিকে তিনি পরিণত করেন একটি মূল্যবোধভিত্তিক প্ল্যাটফর্মে, যেখানে মানুষের ন্যায্য অধিকারই ছিল মুখ্য। অসহিষ্ণু শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়ান স্পষ্ট কণ্ঠে, ভয়ের তোয়াক্কা না করে। এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন নতুন প্রজন্মের আশা।
তবে বিস্ময়ের বিষয়, এই দুই তরুণ যে কাজগুলো করতে পেরেছেন, তা দেশের মূলধারার বহু দল, সংগঠন ও নেতারা ১৭ বছরেও করতে পারেননি। লম্বা সময় ধরে তথাকথিত বিরোধীরা নানা কর্মসূচি, মিছিল-মিটিং, বিদেশ সফর, কিংবা মিডিয়ায় সরব থেকেও জনতার আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের রাজনীতি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মানুষ আশ্রয় খুঁজেছে বিকল্পের—যেখানে মুখোশ নয়, থাকবে বিশ্বাসযোগ্যতা।
২০২৪ সালের ২৪ জুলাই ছিল সেই বিকল্প নেতৃত্বের এক বাস্তব প্রমাণ। দিনটিকে ইতিহাস হয়তো স্মরণ রাখবে ‘গণজাগরণের দ্বিতীয় তরঙ্গ’ হিসেবে। দেশের আনাচে-কানাচে থেকে মানুষ বেরিয়ে আসে রাজপথে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শাণিত কণ্ঠে প্রতিবাদ তোলে। এই বিপুল গণজোয়ারের নেতৃত্বে ছিলেন নূর ও আসিফ। তারা ছিলেন না কোনো রাজনৈতিক বংশের উত্তরাধিকারী, না ছিল তাদের পেছনে বড় কোনো পৃষ্ঠপোষক। তাদের শক্তি ছিল—মানুষের ভালোবাসা, আস্থা, এবং এক অভিন্ন স্বপ্ন।
কিন্তু ইতিহাস বলে, যারা পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে ওঠেন, তাদের পথ সহজ হয় না। যিনি সত্য বলেন, তিনিই সবচেয়ে বেশি আক্রমণের শিকার হন। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা সম্প্রতি দেখেছি এক লজ্জাজনক ঘটনা—আসিফ মাহমুদের প্রতিকৃতি বানিয়ে তা আগুনে পোড়ানো হয়েছে। এটি শুধু এক ব্যক্তির অবমাননা নয়, বরং গণতন্ত্রের চেতনার ওপর নগ্ন আঘাত। মতের ভিন্নতা থাকতেই পারে, কিন্তু সেই ভিন্নমত দমন করার জন্য সহিংসতা কখনো সভ্যতা নয়। এটি আত্মবিশ্বাসহীন এক শাসনব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া।
আসলে নুরুল হক নূর ও আসিফ মাহমুদের ভয় নেই বলেই তারা আক্রমণের শিকার। কারণ তারা বলছেন, রাষ্ট্র জনগণের, দল বা পরিবার নয়। তারা বলছেন, ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগ নয়, বরং শ্রমিক, কৃষক, দিনমজুরদের অধিকার আগে। এই ভাষা ক্ষমতার অভ্যন্তরে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। আর সেই আতঙ্ক থেকেই আসে আগুন, গুজব, হামলা, ষড়যন্ত্র।
বাংলাদেশ এখন এক রূপান্তরের পথে। পুরনো ক্লান্ত নেতৃত্বের বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। পরিবর্তনের হাওয়া বইছে জনতার মধ্য থেকে। মানুষ এখন চায় সত্য, চায় স্বচ্ছতা, চায় সাহস। এই চাহিদার জবাব দিয়েছেন নূর ও আসিফ। তারা এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন, যেখানে রাজনীতি মানে হবে জনগণের সেবা, রাষ্ট্র মানে হবে মানুষের কল্যাণ, এবং নেতৃত্ব মানে হবে জনআস্থা অর্জনের দায়িত্ব।
সময়ের গর্ভে যাঁরা আজ ইতিহাস রচনা করছেন, আগামী প্রজন্ম তাঁদের স্মরণ করবে সম্মানের সঙ্গে। আর যারা ইতিহাসকে রুখতে প্রতিকৃতি পোড়ায়, তারা একদিন সেই ইতিহাসেই পোড়াবে নিজেদের সম্মান।