London ১১:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫, ২৬ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম:
ড. মোহাম্মদ ফয়েজ উদ্দিন এমবিই’র দিকনির্দেশনামূলক সুপারিশ: আগামীর উন্নত জাতি গঠনের রূপরেখা নাটোর বিএনপির প্রার্থী ও ভোটের রাজনীতি রাজশাহীতে হত্যা মামলার মুল আসামি গ্রেপ্তার অবহেলিত জনগণের সেবা করতে চাই — সাটিয়াজুরীতে আলহাজ্ব সৈয়দ মোঃ ফয়সল কালিয়াকৈরে মিথ্যা-ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচার প্রতিবাদে সাবেক মেয়রের সংবাদ সম্মেলন কসবায় অগ্রভাগীয় সাহিত্য সংগঠন (সি.টি.এল.) এর ২৪৭তম আর্থিক ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রম সম্পন্ন দুর্গাপুর সাংবাদিক সমিতির আহ্বায়ক কমিটি গঠিত দুর্গাপুরে হাজং সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী দেউলী উৎসব অনুষ্ঠিত ট্রাক চাপায় মোটরসাইকেল আরহি নিহত কালিয়াকৈরে ৭ই নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বর্ণাঢ্য র‍্যালি অনুষ্ঠিত

নাটোর বিএনপির প্রার্থী ও ভোটের রাজনীতি

ডেস্ক রিপোর্ট

নাটোর জেলা বিএনপির রাজনীতি এখন তীব্র অভ্যন্তরীণ সংকটে নিমজ্জিত। দলের দীর্ঘদিনের ত্যাগী ও মাঠের নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি, প্রভাব বিস্তার এবং এক নেতার কেন্দ্রীক ক্ষমতার রাজনীতির চাপে আজ অসহায় হয়ে পড়েছেন। বিএনপির মনোনয়ন ও সাংগঠনিক অবস্থান ঘিরে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃত্বের মধ্যে গভীর মতবিরোধ ও বিভাজন দেখা দিয়েছে। মুখে কেউ প্রকাশ্যে প্রতিবাদ না করলেও, অভ্যন্তরে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দিন দিন তীব্র হয়ে উঠছে। তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী ও ভোটারদের আশঙ্কা, এর প্রভাব পড়বে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।

লালপুর-বাগাতিপাড়া মিলে নাটোর ১ আসন। এখানে বিএনপি মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ফজলুর রহমান পটলের মেয়ে, বিএনপি চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক পরামর্শ কমিটির বিশেষ সহকারী ও দলের মিডিয়া সেলের সদস্য অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল। সদ্য তিনি নাটোর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন।

স্থানীয় রাজনীতিতে পুতুলের অবস্থান ব্যতিক্রমধর্মী। তিনি ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, দলের রাজনীতি করেন বলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে। তবে মনোনয়ন ঘিরে নতুন দ্বন্দ্বও তৈরি হয়েছে, কারণ পুতুলের আপন ভাই ডা. ইয়াসির আরশাদ রাজনও একই আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। রাজন হলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ঘনিষ্ঠ অনুসারী। জানা গেছে, দুলু নিজের বলয়কে শক্ত করতে রাজনকে সমর্থন দিয়ে পুতুলের বিরোধিতা করছেন।
জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান আসাদ মনে করেন, নাটোর জেলা বিএনপির রাজনীতিতে দুলু দীর্ঘদিন ধরে নিজের গোষ্ঠীকে প্রভাবশালী করে তুলেছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি দলের চেয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি ও নিজস্ব বলয়কে অগ্রাধিকার দেন। এই প্রভাবের কারণে অনেক ত্যাগী, মাঠের ও আদর্শিক নেতা উপেক্ষিত হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে ভোটারদের মধ্যে আতঙ্কও ছড়িয়ে পড়েছে।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, নাটোর-১ আসনে ১৯৮৬ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী মমতাজ উদ্দিন নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির নওশের আলী সরকার জয় পান। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত চারবার সংসদ সদস্য ছিলেন বিএনপির ফজলুর রহমান পটল। ২০০৮ সালে জাতীয় পার্টির আবু তালহা, ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের আবুল কালাম, ২০১৮ সালে শহিদুল ইসলাম বকুল এবং ২০২৪ সালে আবারও আবুল কালাম (স্বতন্ত্র) নির্বাচিত হন।

স্থানীয় ভোটাররা মনে করেন, বর্তমান সময়ে সাহসী নেত্রী ফারজানা শারমিন পুতুল এখানে দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ, এবং তিনিই মাঠে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রার্থী।

নাটোর-২ (নাটোর সদর-নলডাঙ্গা) আসনে দলের প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। তিনি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
কিন্তু দুলুকে ঘিরে দলের ভেতরেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তার অনুসারীদের দাপট, বলয় তৈরি ও চাঁদাবাজির অভিযোগে ক্ষোভ জমছে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে। জেলা পর্যায়ের অনেক নেতা অভিযোগ করেছেন, দুলুর ক্যাডার বাহিনীর ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, তাকে মনোনয়ন দেওয়া হলে ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নেবেন।

নাটোর-২ আসনের রাজনীতি মূলত দুলুকেন্দ্রিক। ১৯৯৬ সালের দুই নির্বাচনে এবং ২০০১ সালে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের আহাদ আলী সরকার, আর পরবর্তী তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শফিকুল ইসলাম শিমুল জয়ী হন।
তবে এই আসনে এখনো বেশ কয়েকজন তরুণ ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতা রয়েছেন। তাদের মধ্যে জেলা বিএনপির সদস্য ও আমরা বিএনপি পরিবার- এর উপদেষ্টা আবুল কাশেম, এবং জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান আসাদ অন্যতম। কিন্তু স্থানীয়ভাবে অভিযোগ রয়েছে, দুলুর প্রভাবের কারণে তাদের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

এদিকে দুলুর অনুসারী জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক আহ্বায়ক ফরহাদ আলী দেওয়ান শাহীনকে স্থানীয়রা নাটোরের সবচেয়ে বড় গডফাদার হিসেবে আখ্যা দেন। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, শাহীনকে সহযোগিতা করছেন আবুল বেপারী, এ. হাই তালুকদার ডালিম, রাসেল রনি, কামরুল ও শামসুল ইসলাম রনিসহ আরও অনেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জেলার ঠিকাদারি, বাস মালিক, দলিল লেখক ও চামড়া ব্যবসাসহ নানা সংগঠনে দুলুর অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে অভিযোগ। নাটোর জেলা বিএনপির তিনজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, এই সব কার্যক্রমই পরিচালিত হয় দুলুর প্রত্যক্ষ নির্দেশে।

অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু জাতীয় সংসদে নাটোর সদরের প্রথম স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপমন্ত্রী হন। এরপর ভূমি উপমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ছিলেন। বিএনপির রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়াও বিএনপির এ নেতা দীর্ঘদিন নাটোর জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ কারণেই তার নেতাকর্মীরা বেপরোয়া বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

তবে নাটোরে বিএনপির নামে দলের কেউ অন্যায়, অত্যাচার, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজি করলে দাঁত এবং হাত ভেঙে দেওয়া হবে বলে বার বার হুঁশিয়ারি দিয়ে জনসভায় বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপির রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু।
নাটোর-৪

গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম মিলে গঠিত নাটোর-৪ আসনে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাহমুদ আব্দুল আজিজকে। কিন্তু মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকেই এলাকায় তার বিরুদ্ধে ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান আসাদও এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন।
তৃণমূল নেতারা বলছেন, মনোনয়ন পাওয়ার পরই আজিজের আশপাশে একটি গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যারা দলের পরিবর্তে ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজ করছে।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৬ সালে নাটোর-৪ আসনে জাতীয় পার্টির আবুল কাশেম সরকার নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের আবদুল কুদ্দুস, ১৯৯৬ সালে বিএনপির একরামুল আলম, পরে একই বছরের দ্বিতীয় নির্বাচনে পুনরায় কুদ্দুস, ২০০১ সালে বিএনপির মোজাম্মেল হক, এবং ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের আবদুল কুদ্দুস এই আসনে নেতৃত্ব দেন। ২০২৩ সালের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বিজয়ী হন, ২০২৪ সালেও তিনি এমপি নির্বাচিত হন।

আগামী নির্বাচনে এই আসনে ব্যারিস্টার আবু হেনা মোস্তফা কামাল রঞ্জু মনোনয়ন প্রত্যাশী। একই সালে জন গোমেজ এখানে জনপ্রিয় নেতা। তারাও এই আসনে বিএনপির হয়ে ভোট করতে আগ্রহী।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, মাহমুদ আব্দুল আজিজ দুলুর ঘনিষ্ঠ অনুসারী এবং ৫ আগস্টের পর গুরুদাসপুর–বড়াইগ্রামে এক প্রকার ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। তবে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।

বরাইগ্রামের বাসিন্দা, জেলা বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও নাটোর জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শরীফুল ইসলাম মুক্তা বলেন, নাটোর জেলার দুটি আসনে দল ত্যাগীদের বাদ দিয়ে চাঁজাবাজ নেতাদের মনোনয়নের জন্য প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে। কিন্তু দলের উচিত চিল ত্যাগীদের খুঁজে বের করা। তাদলে দলে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকত। কিন্তু নাটোরে রাজনৈতিক প্রভাবে এমন কিছু দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আছে, যাদের কারণে সত্য কথা বলাও ভয়ের। কারণ এখানে কথা বলে বাড়িতে যাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। ওরা জেলে ফেললে খুন করবে। এই কারণে ভয়ে মানুষ মুখ খোলেন না। তবে ভোটের বাক্সে কিছু মেসেজ দিবে জনগণ।

সিংড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত নাটোর-৩ আসনে বিএনপি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি। তবে জেলা বিএনপির সদস্য অধ্যক্ষ আনোয়ারুল ইসলাম আনু দাবি করেছেন, তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছ থেকে গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে মনোনয়নের জন্য নির্বাচিত করা হয়নি।

আনু সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সহধর্মিণী আরিফা জেসমিন কনিকার আপন চাচা। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে সিংড়া উপজেলা বিএনপিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। স্থানীয় নেতারা অভিযোগ করেন, আনু দলের জন্য কিছুই করেননি। বিগত ১৭ বছরে বিরোধী দলে থেকেও তার নামে কোনো মামলা হয়নি, জেলও খাটেননি।

নাটোর জেলা বিএনপির এই অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ক্ষমতার বলয় এখন দলের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ত্যাগী নেতারা বলছেন, বিএনপি যদি কেন্দ্র থেকে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দখলমুক্ত না হয়, তাহলে মাঠে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
তথ্য অনুযায়ী, নাটোর-৩ আসনে বিএনপির ঐতিহাসিকভাবে শক্ত অবস্থান ছিল। একমাত্র জুনাইদ আহমেদ পলক ছাড়া এই আসনে আওয়ামী লীগ খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ১৯৯১ সালে জামায়াতে ইসলামী থেকে আবু বকর শেরকোলী নির্বাচিত হন। তার মৃত্যু হলে ১৯৯৫ সালের উপনির্বাচনে বিএনপির প্রফেসর কাজী গোলাম মোর্শেদ এমপি নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি পুনরায় বিজয়ী হন।

চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়া উপজেলার অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ সংযোগে কাজী গোলাম মোর্শেদের ভূমিকা আজও প্রশংসিত। এবারের নির্বাচনে তিনিই দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী এবং স্থানীয়দের মতে, সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী।

বর্ষীয়ান নেতা প্রফেসর কাজী গোলাম মোর্শেদ বলেন, আমি দীর্ঘকাল ধরে সিংড়া উপজেলায় দলের জন্য কাজ করেছি। এই আসনে বিএনপির ঐতিহ্য ও শক্ত অবস্থান বজায় রাখতে চাই। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যদি আমাকে মনোনয়ন দেয়, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে জনতার সমর্থন নিয়ে শক্তভাবে লড়াই করতে পারব। আমি বিশ্বাস করি, স্থানীয় জনগণ দলীয় প্রতিশ্রুতির সঙ্গে একজন সততা ও অভিজ্ঞ নেতা চান, আর সেই দায়িত্ব আমি নেয়ার জন্য প্রস্তুত। কারণ আমি এর আগেও এমপি হয়ে পরীক্ষায় পাস করা নেতা।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৪:২৩:০৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫
Translate »

নাটোর বিএনপির প্রার্থী ও ভোটের রাজনীতি

আপডেট : ০৪:২৩:০৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫

নাটোর জেলা বিএনপির রাজনীতি এখন তীব্র অভ্যন্তরীণ সংকটে নিমজ্জিত। দলের দীর্ঘদিনের ত্যাগী ও মাঠের নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি, প্রভাব বিস্তার এবং এক নেতার কেন্দ্রীক ক্ষমতার রাজনীতির চাপে আজ অসহায় হয়ে পড়েছেন। বিএনপির মনোনয়ন ও সাংগঠনিক অবস্থান ঘিরে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃত্বের মধ্যে গভীর মতবিরোধ ও বিভাজন দেখা দিয়েছে। মুখে কেউ প্রকাশ্যে প্রতিবাদ না করলেও, অভ্যন্তরে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দিন দিন তীব্র হয়ে উঠছে। তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী ও ভোটারদের আশঙ্কা, এর প্রভাব পড়বে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।

লালপুর-বাগাতিপাড়া মিলে নাটোর ১ আসন। এখানে বিএনপি মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ফজলুর রহমান পটলের মেয়ে, বিএনপি চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক পরামর্শ কমিটির বিশেষ সহকারী ও দলের মিডিয়া সেলের সদস্য অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল। সদ্য তিনি নাটোর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন।

স্থানীয় রাজনীতিতে পুতুলের অবস্থান ব্যতিক্রমধর্মী। তিনি ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, দলের রাজনীতি করেন বলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে। তবে মনোনয়ন ঘিরে নতুন দ্বন্দ্বও তৈরি হয়েছে, কারণ পুতুলের আপন ভাই ডা. ইয়াসির আরশাদ রাজনও একই আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। রাজন হলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ঘনিষ্ঠ অনুসারী। জানা গেছে, দুলু নিজের বলয়কে শক্ত করতে রাজনকে সমর্থন দিয়ে পুতুলের বিরোধিতা করছেন।
জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান আসাদ মনে করেন, নাটোর জেলা বিএনপির রাজনীতিতে দুলু দীর্ঘদিন ধরে নিজের গোষ্ঠীকে প্রভাবশালী করে তুলেছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি দলের চেয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি ও নিজস্ব বলয়কে অগ্রাধিকার দেন। এই প্রভাবের কারণে অনেক ত্যাগী, মাঠের ও আদর্শিক নেতা উপেক্ষিত হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে ভোটারদের মধ্যে আতঙ্কও ছড়িয়ে পড়েছে।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, নাটোর-১ আসনে ১৯৮৬ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী মমতাজ উদ্দিন নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির নওশের আলী সরকার জয় পান। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত চারবার সংসদ সদস্য ছিলেন বিএনপির ফজলুর রহমান পটল। ২০০৮ সালে জাতীয় পার্টির আবু তালহা, ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের আবুল কালাম, ২০১৮ সালে শহিদুল ইসলাম বকুল এবং ২০২৪ সালে আবারও আবুল কালাম (স্বতন্ত্র) নির্বাচিত হন।

স্থানীয় ভোটাররা মনে করেন, বর্তমান সময়ে সাহসী নেত্রী ফারজানা শারমিন পুতুল এখানে দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ, এবং তিনিই মাঠে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রার্থী।

নাটোর-২ (নাটোর সদর-নলডাঙ্গা) আসনে দলের প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। তিনি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
কিন্তু দুলুকে ঘিরে দলের ভেতরেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তার অনুসারীদের দাপট, বলয় তৈরি ও চাঁদাবাজির অভিযোগে ক্ষোভ জমছে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে। জেলা পর্যায়ের অনেক নেতা অভিযোগ করেছেন, দুলুর ক্যাডার বাহিনীর ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, তাকে মনোনয়ন দেওয়া হলে ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নেবেন।

নাটোর-২ আসনের রাজনীতি মূলত দুলুকেন্দ্রিক। ১৯৯৬ সালের দুই নির্বাচনে এবং ২০০১ সালে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের আহাদ আলী সরকার, আর পরবর্তী তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শফিকুল ইসলাম শিমুল জয়ী হন।
তবে এই আসনে এখনো বেশ কয়েকজন তরুণ ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতা রয়েছেন। তাদের মধ্যে জেলা বিএনপির সদস্য ও আমরা বিএনপি পরিবার- এর উপদেষ্টা আবুল কাশেম, এবং জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান আসাদ অন্যতম। কিন্তু স্থানীয়ভাবে অভিযোগ রয়েছে, দুলুর প্রভাবের কারণে তাদের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

এদিকে দুলুর অনুসারী জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক আহ্বায়ক ফরহাদ আলী দেওয়ান শাহীনকে স্থানীয়রা নাটোরের সবচেয়ে বড় গডফাদার হিসেবে আখ্যা দেন। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, শাহীনকে সহযোগিতা করছেন আবুল বেপারী, এ. হাই তালুকদার ডালিম, রাসেল রনি, কামরুল ও শামসুল ইসলাম রনিসহ আরও অনেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জেলার ঠিকাদারি, বাস মালিক, দলিল লেখক ও চামড়া ব্যবসাসহ নানা সংগঠনে দুলুর অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে অভিযোগ। নাটোর জেলা বিএনপির তিনজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, এই সব কার্যক্রমই পরিচালিত হয় দুলুর প্রত্যক্ষ নির্দেশে।

অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু জাতীয় সংসদে নাটোর সদরের প্রথম স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপমন্ত্রী হন। এরপর ভূমি উপমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ছিলেন। বিএনপির রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়াও বিএনপির এ নেতা দীর্ঘদিন নাটোর জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ কারণেই তার নেতাকর্মীরা বেপরোয়া বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

তবে নাটোরে বিএনপির নামে দলের কেউ অন্যায়, অত্যাচার, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজি করলে দাঁত এবং হাত ভেঙে দেওয়া হবে বলে বার বার হুঁশিয়ারি দিয়ে জনসভায় বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপির রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু।
নাটোর-৪

গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম মিলে গঠিত নাটোর-৪ আসনে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাহমুদ আব্দুল আজিজকে। কিন্তু মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকেই এলাকায় তার বিরুদ্ধে ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান আসাদও এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন।
তৃণমূল নেতারা বলছেন, মনোনয়ন পাওয়ার পরই আজিজের আশপাশে একটি গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যারা দলের পরিবর্তে ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজ করছে।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৬ সালে নাটোর-৪ আসনে জাতীয় পার্টির আবুল কাশেম সরকার নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের আবদুল কুদ্দুস, ১৯৯৬ সালে বিএনপির একরামুল আলম, পরে একই বছরের দ্বিতীয় নির্বাচনে পুনরায় কুদ্দুস, ২০০১ সালে বিএনপির মোজাম্মেল হক, এবং ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের আবদুল কুদ্দুস এই আসনে নেতৃত্ব দেন। ২০২৩ সালের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বিজয়ী হন, ২০২৪ সালেও তিনি এমপি নির্বাচিত হন।

আগামী নির্বাচনে এই আসনে ব্যারিস্টার আবু হেনা মোস্তফা কামাল রঞ্জু মনোনয়ন প্রত্যাশী। একই সালে জন গোমেজ এখানে জনপ্রিয় নেতা। তারাও এই আসনে বিএনপির হয়ে ভোট করতে আগ্রহী।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, মাহমুদ আব্দুল আজিজ দুলুর ঘনিষ্ঠ অনুসারী এবং ৫ আগস্টের পর গুরুদাসপুর–বড়াইগ্রামে এক প্রকার ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। তবে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।

বরাইগ্রামের বাসিন্দা, জেলা বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও নাটোর জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শরীফুল ইসলাম মুক্তা বলেন, নাটোর জেলার দুটি আসনে দল ত্যাগীদের বাদ দিয়ে চাঁজাবাজ নেতাদের মনোনয়নের জন্য প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে। কিন্তু দলের উচিত চিল ত্যাগীদের খুঁজে বের করা। তাদলে দলে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকত। কিন্তু নাটোরে রাজনৈতিক প্রভাবে এমন কিছু দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আছে, যাদের কারণে সত্য কথা বলাও ভয়ের। কারণ এখানে কথা বলে বাড়িতে যাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। ওরা জেলে ফেললে খুন করবে। এই কারণে ভয়ে মানুষ মুখ খোলেন না। তবে ভোটের বাক্সে কিছু মেসেজ দিবে জনগণ।

সিংড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত নাটোর-৩ আসনে বিএনপি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি। তবে জেলা বিএনপির সদস্য অধ্যক্ষ আনোয়ারুল ইসলাম আনু দাবি করেছেন, তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছ থেকে গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে মনোনয়নের জন্য নির্বাচিত করা হয়নি।

আনু সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সহধর্মিণী আরিফা জেসমিন কনিকার আপন চাচা। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে সিংড়া উপজেলা বিএনপিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। স্থানীয় নেতারা অভিযোগ করেন, আনু দলের জন্য কিছুই করেননি। বিগত ১৭ বছরে বিরোধী দলে থেকেও তার নামে কোনো মামলা হয়নি, জেলও খাটেননি।

নাটোর জেলা বিএনপির এই অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ক্ষমতার বলয় এখন দলের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ত্যাগী নেতারা বলছেন, বিএনপি যদি কেন্দ্র থেকে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দখলমুক্ত না হয়, তাহলে মাঠে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
তথ্য অনুযায়ী, নাটোর-৩ আসনে বিএনপির ঐতিহাসিকভাবে শক্ত অবস্থান ছিল। একমাত্র জুনাইদ আহমেদ পলক ছাড়া এই আসনে আওয়ামী লীগ খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ১৯৯১ সালে জামায়াতে ইসলামী থেকে আবু বকর শেরকোলী নির্বাচিত হন। তার মৃত্যু হলে ১৯৯৫ সালের উপনির্বাচনে বিএনপির প্রফেসর কাজী গোলাম মোর্শেদ এমপি নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি পুনরায় বিজয়ী হন।

চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়া উপজেলার অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ সংযোগে কাজী গোলাম মোর্শেদের ভূমিকা আজও প্রশংসিত। এবারের নির্বাচনে তিনিই দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী এবং স্থানীয়দের মতে, সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী।

বর্ষীয়ান নেতা প্রফেসর কাজী গোলাম মোর্শেদ বলেন, আমি দীর্ঘকাল ধরে সিংড়া উপজেলায় দলের জন্য কাজ করেছি। এই আসনে বিএনপির ঐতিহ্য ও শক্ত অবস্থান বজায় রাখতে চাই। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যদি আমাকে মনোনয়ন দেয়, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে জনতার সমর্থন নিয়ে শক্তভাবে লড়াই করতে পারব। আমি বিশ্বাস করি, স্থানীয় জনগণ দলীয় প্রতিশ্রুতির সঙ্গে একজন সততা ও অভিজ্ঞ নেতা চান, আর সেই দায়িত্ব আমি নেয়ার জন্য প্রস্তুত। কারণ আমি এর আগেও এমপি হয়ে পরীক্ষায় পাস করা নেতা।