London ০২:৪১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসে কোনো অর্থ দেয়নি চীন

চীনের জাতীয় পতাকাফাইল ছবি: রয়টার্স

চীন থেকে ঋণ ছাড় বন্ধ হয়ে গেছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস জুলাই-সেপ্টেম্বরে দেশটির কাছ থেকে কোনো অর্থ পায়নি বাংলাদেশ। এমনকি এই সময়ে কোনো নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতিও দেয়নি দেশটি।

অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বরের বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে চীনের ঋণ ছাড় না হওয়ার এই তথ্য পাওয়া গেছে।

নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে নেওয়া ঋণগুলো নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা শুরু হয়। চীনের কাছ থেকে তাদের মুদ্রায় ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ঋণ নেওয়ার বিষয়েও ‘ধীরে চলো’ নীতি অবলম্বন করছে ঢাকা। এই অর্থের অর্ধেক বাংলাদেশ বাজেট–সহায়তা হিসেবে চায়, অন্যদিকে চীন পুরো অর্থই ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন বা বাণিজ্য–সহায়তার আওতায় দিতে চায়।

এ নিয়ে ইআরডির একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ঋণের বিষয়ে দুই দেশ ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। নতুন সরকার এসে বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছে। ফলে ঋণের ব্যাপারে চীনের সঙ্গে একধরনের টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। যে কারণে অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে কোনো অর্থছাড় হয়নি।

— ৫০০ কোটি ডলারের চীনা ঋণের বিষয়ে ‘ধীরে চলো’ নীতিতে রয়েছে বাংলাদেশ।
— দেশটি গত চার বছরে ৩০০ কোটি ডলার দিয়েছে, যা তাদের দেওয়া মোট ঋণের ৪০%।
— তিন মাসে ঋণ ছাড়ে শীর্ষ পাঁচ দেশ ও সংস্থা হলো জাপান, এডিবি, রাশিয়া, বিশ্বব্যাংক ও ভারত।

তবে এক বছরের বেশি সময় ধরে চীনের সঙ্গে কোনো ঋণচুক্তি হয়নি। দেশটি নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতিও দেয়নি।

দেশে কয়েক বছর ধরে চীনা ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশকে ঋণ দেয়, এমন ৩২টি দেশ ও সংস্থার মধ্যে সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চীনের অবস্থান ছিল চতুর্থ। তাদের ওপরে ছিল বিশ্বব্যাংক, জাপান ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বাংলাদেশ প্রতিবছর মোট যে ঋণ পায়, তার প্রায় ১০ শতাংশ দেয় চীন। বার্ষিক ঋণ ছাড়ে অবশ্য চীন দুই বছর ধরে বিলিয়ন ডলার ক্লাবে রয়েছে। অর্থাৎ দেশটি টানা দুই বছর ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বা তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ঋণ দিয়েছে।

চীন গত চার বছরে বাংলাদেশকে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার দিয়েছে। এই অর্থ দেশটির দেওয়া মোট ঋণের ৪০ শতাংশের মতো। চীনা অর্থে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। আবার সাভারের আশুলিয়া থেকে ঢাকা বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ; রাজশাহী ওয়াসার উন্নয়ন, চারটি কার্গো জাহাজ কেনাসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

দিন দিন বিদেশি ঋণের অর্থ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। চীন ও রাশিয়ার মতো দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকা উচিত। এসব ঋণের শর্ত অনেক কঠিন থাকে। কারণ, পণ্য ক্রয় ও ঠিকাদার নিয়োগ ওই সব দেশ থেকে করতে হয়। ঋণ পরিশোধের মেয়াদও থাকে কম।

—সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম

এসব নিয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, দিন দিন বিদেশি ঋণের অর্থ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। চীন ও রাশিয়ার মতো দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকা উচিত। এসব ঋণের শর্ত অনেক কঠিন থাকে। কারণ, পণ্য ক্রয় ও ঠিকাদার নিয়োগ ওই সব দেশ থেকে করতে হয়। ঋণ পরিশোধের মেয়াদও থাকে কম।

তিন মাসে কারা বেশি ঋণ দিল

দেশে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সব মিলিয়ে ৮৪ কোটি ৬১ লাখ ডলারের বিদেশি ঋণসহায়তা এসেছে। এই সময়ে ঋণ প্রদানে শীর্ষে ছিল জাপান। দেশটি সব মিলিয়ে ২১ কোটি ডলার দিয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) দিয়েছে ১৫ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। ১৪ কোটি ৯৩ লাখ ডলার ছাড় করে তৃতীয় স্থানে রয়েছে রাশিয়া। এ ছাড়া চতুর্থ স্থানে থাকা বিশ্বব্যাংক ৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলার এবং পঞ্চম অবস্থানে ভারত সাড়ে ৪ কোটি ডলার ছাড় করেছে।

এদিকে আলোচ্য সময়ে দেশে যত বিদেশি ঋণ এসেছে, তার চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে। এ সময়ে সুদ ও আসল মিলিয়ে ১১২ কোটি ৬৫ লাখ ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে মোট ৮৪ কোটি ৬১ লাখ ডলারের ঋণ ছাড় করা সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ ছাড়ের চেয়ে প্রায় ২৮ কোটি ডলার বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে।

নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাজেট-সহায়তা বাবদ কয়েক শ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে; কিন্তু বাস্তবে অর্থছাড় কমেছে, আর ঋণ শোধ বেড়েছে। ফলে ঋণপ্রাপ্তি ও পরিশোধের ফল নেতিবাচক। অবশ্য ঋণ পরিশোধের জন্য বাজেটে আলাদা করে বরাদ্দ থাকে।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information
আপডেট : ০৩:৪৫:১৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪
৩৩
Translate »

জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসে কোনো অর্থ দেয়নি চীন

আপডেট : ০৩:৪৫:১৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪

চীনের জাতীয় পতাকাফাইল ছবি: রয়টার্স

চীন থেকে ঋণ ছাড় বন্ধ হয়ে গেছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস জুলাই-সেপ্টেম্বরে দেশটির কাছ থেকে কোনো অর্থ পায়নি বাংলাদেশ। এমনকি এই সময়ে কোনো নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতিও দেয়নি দেশটি।

অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বরের বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে চীনের ঋণ ছাড় না হওয়ার এই তথ্য পাওয়া গেছে।

নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে নেওয়া ঋণগুলো নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা শুরু হয়। চীনের কাছ থেকে তাদের মুদ্রায় ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ঋণ নেওয়ার বিষয়েও ‘ধীরে চলো’ নীতি অবলম্বন করছে ঢাকা। এই অর্থের অর্ধেক বাংলাদেশ বাজেট–সহায়তা হিসেবে চায়, অন্যদিকে চীন পুরো অর্থই ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন বা বাণিজ্য–সহায়তার আওতায় দিতে চায়।

এ নিয়ে ইআরডির একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ঋণের বিষয়ে দুই দেশ ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। নতুন সরকার এসে বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছে। ফলে ঋণের ব্যাপারে চীনের সঙ্গে একধরনের টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। যে কারণে অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে কোনো অর্থছাড় হয়নি।

— ৫০০ কোটি ডলারের চীনা ঋণের বিষয়ে ‘ধীরে চলো’ নীতিতে রয়েছে বাংলাদেশ।
— দেশটি গত চার বছরে ৩০০ কোটি ডলার দিয়েছে, যা তাদের দেওয়া মোট ঋণের ৪০%।
— তিন মাসে ঋণ ছাড়ে শীর্ষ পাঁচ দেশ ও সংস্থা হলো জাপান, এডিবি, রাশিয়া, বিশ্বব্যাংক ও ভারত।

তবে এক বছরের বেশি সময় ধরে চীনের সঙ্গে কোনো ঋণচুক্তি হয়নি। দেশটি নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতিও দেয়নি।

দেশে কয়েক বছর ধরে চীনা ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশকে ঋণ দেয়, এমন ৩২টি দেশ ও সংস্থার মধ্যে সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চীনের অবস্থান ছিল চতুর্থ। তাদের ওপরে ছিল বিশ্বব্যাংক, জাপান ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বাংলাদেশ প্রতিবছর মোট যে ঋণ পায়, তার প্রায় ১০ শতাংশ দেয় চীন। বার্ষিক ঋণ ছাড়ে অবশ্য চীন দুই বছর ধরে বিলিয়ন ডলার ক্লাবে রয়েছে। অর্থাৎ দেশটি টানা দুই বছর ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বা তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ঋণ দিয়েছে।

চীন গত চার বছরে বাংলাদেশকে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার দিয়েছে। এই অর্থ দেশটির দেওয়া মোট ঋণের ৪০ শতাংশের মতো। চীনা অর্থে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। আবার সাভারের আশুলিয়া থেকে ঢাকা বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ; রাজশাহী ওয়াসার উন্নয়ন, চারটি কার্গো জাহাজ কেনাসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

দিন দিন বিদেশি ঋণের অর্থ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। চীন ও রাশিয়ার মতো দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকা উচিত। এসব ঋণের শর্ত অনেক কঠিন থাকে। কারণ, পণ্য ক্রয় ও ঠিকাদার নিয়োগ ওই সব দেশ থেকে করতে হয়। ঋণ পরিশোধের মেয়াদও থাকে কম।

—সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম

এসব নিয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, দিন দিন বিদেশি ঋণের অর্থ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। চীন ও রাশিয়ার মতো দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকা উচিত। এসব ঋণের শর্ত অনেক কঠিন থাকে। কারণ, পণ্য ক্রয় ও ঠিকাদার নিয়োগ ওই সব দেশ থেকে করতে হয়। ঋণ পরিশোধের মেয়াদও থাকে কম।

তিন মাসে কারা বেশি ঋণ দিল

দেশে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সব মিলিয়ে ৮৪ কোটি ৬১ লাখ ডলারের বিদেশি ঋণসহায়তা এসেছে। এই সময়ে ঋণ প্রদানে শীর্ষে ছিল জাপান। দেশটি সব মিলিয়ে ২১ কোটি ডলার দিয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) দিয়েছে ১৫ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। ১৪ কোটি ৯৩ লাখ ডলার ছাড় করে তৃতীয় স্থানে রয়েছে রাশিয়া। এ ছাড়া চতুর্থ স্থানে থাকা বিশ্বব্যাংক ৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলার এবং পঞ্চম অবস্থানে ভারত সাড়ে ৪ কোটি ডলার ছাড় করেছে।

এদিকে আলোচ্য সময়ে দেশে যত বিদেশি ঋণ এসেছে, তার চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে। এ সময়ে সুদ ও আসল মিলিয়ে ১১২ কোটি ৬৫ লাখ ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে মোট ৮৪ কোটি ৬১ লাখ ডলারের ঋণ ছাড় করা সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ ছাড়ের চেয়ে প্রায় ২৮ কোটি ডলার বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে।

নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাজেট-সহায়তা বাবদ কয়েক শ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে; কিন্তু বাস্তবে অর্থছাড় কমেছে, আর ঋণ শোধ বেড়েছে। ফলে ঋণপ্রাপ্তি ও পরিশোধের ফল নেতিবাচক। অবশ্য ঋণ পরিশোধের জন্য বাজেটে আলাদা করে বরাদ্দ থাকে।